চতুর্থ অধ্যায়
সকালে ইভা একটু দেরি করেই ঘুম থেকে উঠে। বাড়ির সবাই জানে সে কথা। কিন্তু আজ ওর ঠাম্মা খবরের কাগজটা নিয়ে জোর করে ডেকে তোলে। ইভা ঘুম কাতুর চোখে বলে - কি হলো ঠাম্মা? কাগজটা কি পরে পড়তে পারতাম না?
ঠাম্মা - পারতিস কিন্তু প্রথম পাতায় কি আছে দেখ।
ঠাম্মার হাত থেকে কাগজটা নিয়ে চোখ রাখে কাগজে। তারপর কয়েকটা হেডলাইন পড়ে এক জায়গায় চোখ আটকে যায় তার।
“প্রায় পাঁচশো মানুষের মৃত্যু, মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে আরও ৬-৭০০ মানুষ। বেলাইন এবং বোমা দুন এক্সপ্রেসে”।
লাফ দিয়ে অঠে ইভা। জানালার কাছে সরে যায় কাগজটা নিয়ে। আবার পড়ে, আবার।
ঠাম্মা - কালকে আমাদের অহিন ওই দুন এক্সপ্রেসেই তো গেল তাই না?
ইভা একটা ছোট্ট জবাব দেয় - হ্যাঁ।
ঠাম্মা - ছেলেটা কেমন আছে কি জানি। বড্ড ভালো রে ছেলেটা।
ইভা - তুমি যাও দেখি। আমাকে ঠিক করে পড়তে দাও।
ইভা চোখ দুটো ভালো করে পরিষ্কার করে পড়তে থাকে কাগজটা আবার। তারপর একসময় হাত থেকে খসে পড়ে খবরের কাগজ। জানালা দিয়ে শূন্যে চোখ দৃষ্টি ছুটে যায় দূরে বহু দূরে । তারপর হঠাৎ এক সময় চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসে। কয়েক ফোটা জল দুগাল দিয়ে আস্তে আস্তে নেমে আসে। পরের দিন টিভিতে সেই ট্রেন দুর্ঘটনার খবর দেখে ইহা আর তৃষা। দুজনেই নিশ্চল চুপচাপ টিভির সামনে। খবরেই জানতে পারে নিহত ও আহত ব্যক্তির নামের তালিকা টানানো হবে হাওড়া স্টেশনে।
তৃষা বলে - চল দুজনে গিয়ে দেখে আসি।
ইভা - ভীড় হবে খুব। তোর আমার পক্ষে হয়তো বোর্ড পর্যন্ত পৌঁছানো সম্ভব হবে না। শুধু পরিশ্রম।
তৃষা- কথাটা ঠিক কিন্তু …
ইভা - ঠাকুরকে ডাকা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। কি যে এত ঘোরার দরকার কি জানি। না ঘুরলে কি মানুষ মরে যায়?
তৃষা - ঘোরাটা একটা নেশা। আমার মেজো মামারও ছিল ওই ঘুরে বেড়ানোর নেশা।
- এখন আর নেই?
- এখন আর সময় পায়না।
ইভা বলে - আর দেখ অহিন দার কথা ভাব। কোন চিন্তা নেই, ভাবনা নেই, একা মানুষ। যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়ায়। ওভাবে ওকে নিয়ে কেউ ভাবে না। ওকে কেউ ……ইভা কথা বলতে পারে না, কেঁদে ফেলে।
তৃষা নিজের ওড়না দিয়ে ইভার চোখের জল মিছিয়ে দিয়ে বলে - ভাবিস না। আয় আমরা আজই হংসেশ্বরী মন্দির পূজা দিয়ে আসি।
ইভা চকিত হরিণীর মতন নড়েচড়ে উঠে, বলে - যাবি? চল এখনি যাবো।
হংসেশ্বরী মন্দিরে পূজো দিয়ে কিছুক্ষণ মন্দিরে বসে প্রার্থনা করে ইভা ও তৃষা। প্রার্থনা করে তাদের অহিন দার জন্য। অনেকক্ষণ পর ওরা ফিরে আসে যে যার বাড়িতে। ইভা যেন কিছুতেই নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনা। কোনরকমে দুটো ভাত খেয়ে নিজের ঘরে শুয়ে ভাবতে থাকে অহিনের কথা। কত কথাই মনে পড়ে তার। শৈশব কেটে যৌবন এসেছে। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে ঢুকেছে। কিন্তু অহিনকে সে কিছুতেই কোনদিন ভুলে যেতে পারেনি। আর ভুলে যাওয়া হয়নি। কিন্তু আর যদি অহিন দা না আসে ………।
চোখের কোনা দিয়ে জল গড়িয়ে মাথার বালিশ ভিজে যায়। আর বারবার ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে থাকে। একটা একটা করে দিন কেটে যায়। খাওয়া-দাওয়া প্রায় ছেড়ে দিয়েছে। চোখের তলায় কালি পড়েছে। বাবা-মা ঠাম্মা কেউ বুঝে উঠতে পারছে না কি হয়েছে ইভার। ওর বাবা-মা কয়েকবার ডাক্তার দেখানোর কথা বলেছে কিন্তু ইভা রাজি হয়নি। ও বারবার বলেছে ওর কিছু হয়নি। মাঝে মাঝে তৃষা আসে। তারপর দুই বন্ধু মিলে গল্প করে ছাদে বসে।
ইভা - তৃষা কি হবে বলতো?
তৃষা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে উত্তর দেয় - ফিরবে, সময় হলেই ফিরবে।
ইভা - দেখ না ফেরার তারিখ তো চলে গেল।
কথাটা বলেই তৃষাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। তৃষা স্নেহে যত্নে তার ওড়না দিয়ে ইভার চোখের জল মিছিয়ে দেয়।
তারপর বলে - ধৈর্য ধর ফিরবে।
ইভা বলে - বলতো কি পাপ করেছি আমি? যার জন্য অহিন দা আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে যাবে? বল কেন আসবে না আমার কাছে?
তৃষা - আহা তুই পাপ করেছিস কে বলল? হয়তো যেখানে বেড়াতে গেছে সেই জায়গা পছন্দ হয়ে গেছে। তাই দু-তিনদিন বেশি করে থেকে আসবে।
ইভা - ঠিক বলছিস তো ? তাই হবে? সত্যিই কি তাই?
তৃষা দেখ না কি হয়।
দুই বন্ধু আরো কিছুক্ষণ বসে সময় কাটায়। সন্ধ্যা হলে তৃষা বাড়ি ফিরে যায়। ইভা ঘরে গিয়ে ধীরে ধীরে বইয়ের পাতা উল্টে যায়। কিন্তু মন পড়ে থাকে দূরে, বহু দূরে কোন এক অজানা ঠিকানায়।
এমনি করে আরো কয়েকদিন পেরিয়ে যায়। কিন্তু ইভা, অহিনের কোন সংবাদ পায় না। তবুও তৃষা ইভাকে মনের শক্তি জুগিয়ে চলে। একসময় তৃষা কেমন যেন ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তারপর দুজনাই ঈশ্বরের উপর ছেড়ে দেয় সব। তৃষা কলেজে গেলেও ইভাকে কিছুতেই কলেজে নিয়ে যেতে পারে না।
একদিন ওর ঠাম্মা ওকে ডেকে নিয়ে বসায় নিজের ঘরে। ছাদের উপর নির্জন ঘরে ঠাম্মা ইভার মাথায টেনে নেয় তার কোলে। তারপর ধীরে ধীরে চুলের মধ্যে দিয়ে হাত বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞাসা করে - বলতো দিদিভাই কেন তুই দিন দিন এমন হয়ে যাচ্ছিস?
ইভা চুপ করে থাকে। কিছুক্ষণ তারপর একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে।
ঠাম্মা- বল দিদিভাই । আমাকে বল। তুই কি কাউকে ভালোবাসিস?
ইভা তার হাত দুটি প্রসারিত করে ঠাম্মার হাত দুটি ধরে ফেলে। তারপর ঠাম্মার চোখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকে।
ঠাম্মা বলে - ইভা দিদিভাই কি হয়েছে তোর? কে সে? যার জন্য এত দুঃখ ?
ইভা কেঁদে ফেলে। কোন কথাই সে বলতে পারল না।
ঠাম্মা আঁচল দিয়ে চোখ মুছে দিয়ে বলে - এতে আবার কান্নার কি আছে? কি হয়েছে বলবি তো? কে সেই ভাগ্যবান ছেলে? যার জন্য তোর এই অবস্থা ? সে কি কিছু বলেছে তোকে?
ইভা, এবার কথা বলে - না কিছু বলেনি। আমি যাকে ভালোবাসি সে মোটেই আমাকে ভালবাসে না।
ঠাম্মা এক গাল হেসে বলে - কেন সে কি রাজপুত্র নাকি?
ইভা- না রাজপুত্র নয়।
ঠাম্মা - সে কে? জানতে পারি কি?
ইভা কিছু বলে না। অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে। ঠাম্মা ওর কপালে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে।
এবার ইভা সাহস সঞ্চয় করে বলে - তুমি তাকে খুব ভালো করেই চেনো।
ঠাম্মা - চিনি। তার নামটা বলবি তো।
ঠাম্মা - নামটা বললে তুমি অমত করবেনা তো?
ঠাম্মা - তোর পছন্দ হলে আমি কেন অমত করব। বল। আমি তো জানি আমার দিদিভাই কখনো অমত করার মত পাত্র পছন্দ করবে না।
ইভা - কিন্তু ঠাকুমা যদি তাই হয়?
ঠাম্মা - আমি কখনোই অমত করব না।
ইভা অত্যন্ত স্নেহে ঠাম্মাকে জড়িয়ে ধরে। তারপর বলে - অহীন দা কে তোমার পছন্দ হয় ঠাম্মা?
ঠাম্মা অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে আবার ইভার মাথাটা কোলে তুলে নেয়। তারপর বলে - তোর পছন্দ কি খারাপ হয় রে। ও তো খুব ভালো ছেলে।
ইভা আবার বলে - তুমি তো জানো সে বেড়াতে গেছে যে গাড়িতে, সেই গাড়িতে বোমা বিস্ফোরণ হয়ে প্রচুর লোক মারা গেছে। তিন দিন আগে ফেরার কথা ছিল অহিন দার। এখনো ফিরল না কেন জানি না।
ঠাম্মা - ও তাই মেয়ের এমন অবস্থা। সেই চিন্তায় চিন্তায় তুই এমন হয়ে গেছিস?
ঠাম্মা আরো নিবিড়ভাবেই ইভাকে জড়িয়ে ধরে। তারপর অনেক কষ্টে অনেক কিছু বুঝিয়ে তাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে। অবশেষে ঠাম্মার আশা ব্যঞ্জন কথায় ইভার প্রাণে কিছুটা আশা জেগে ওঠে। ঠাম্মার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে সে।
0 মন্তব্যসমূহ