অধ্যায় ৫: সময়ের দূরত্ব
✍️ অতনু সরকার
বৈদ্যপুরের সন্ধ্যা যেন নিঃশব্দে মেঘলা হয়ে ওঠে। রাঙা আকাশের নিচে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, কুয়োর ধারে বসে থাকা বিগত দিনের ছায়া, আর মাঝেমাঝে দূর থেকে ভেসে আসা লাউডস্পিকারের পুরনো বাংলা গানের সুর—সব মিলিয়ে যেন এক সোনালি বিষাদ।
সৌরভ দাঁড়িয়ে ছিল মেঘলাদের পুরনো বাড়ির বারান্দায়। কাঠের দরজায় পুরনো পিতলের কড়া। দুলছিল হালকা বাতাসে। আর মনে হচ্ছিল যেন সময় নিজেই নিঃশব্দে কড়া নাড়ছে।
আজ দুপুরে মেঘলার সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ কথা হয়েছে। সে হাসে, কথা বলে, কিন্তু তার চোখে একটা দীর্ঘশ্বাস লুকানো থাকে। সে যেন চায় কিছু বলতে, আবার থেমে যায়।
"আপনি কলকাতা থেকে এসেছেন... কেবল একটা নামের টানে?" মেঘলা জিজ্ঞেস করেছিল।
সৌরভ মাথা নেড়েছিল, "একটা নাম... আর কিছু চিঠির অর্ধেক বাক্য।"
মেঘলা কেমন যেন চুপ করে গিয়েছিল। তারপর বলেছিল, "আপনার ঠাকুরদা অনেক কিছু রেখে গেছেন… অনেক চিঠি, অনেক না বলা গল্প। আপনি কি জানেন, তিনি জীবনে একবারও আমার দিকে ফিরে তাকাননি, অথচ প্রতি বছর লিখেছেন?"
সৌরভ বিস্মিত হয়েছিল। "কেন?"
"হয়তো সময় ভয় পায় ভালোবাসাকে।" – মেঘলা বলেছিল।
সেই রাতে সৌরভ মেঘলার দেওয়া একটি পুরনো কাঠের বাক্স খুলে দেখে একগুচ্ছ চিঠি। প্রতিটা চিঠি এক একটা ঋতুর মতো—আলাদা গন্ধ, আলাদা ব্যথা, আলাদা একরাশ ভালোবাসা।
চিঠিগুলোতে শুধু মেঘলার নাম নয়, কোথাও কোথাও এমন কিছু লাইন ছিল যা সৌরভের নিজের হৃদয়ের তারে ঝংকার তোলে।
"মেঘলা, তুমি এখনো আমার ছায়া হয়ে আছো… আমি জানি, সময় আমাদের দূরে রেখেছে। কিন্তু ছায়া কি কখনো আলো ছাড়া থাকে?"
চিঠি পড়তে পড়তে সৌরভ বুঝে ফেলে—তার নিজের মনেও কোথাও এক অতল টান জন্ম নিচ্ছে মেঘলার জন্য। কিন্তু এই টান—এটা কি শুধুই ঠাকুরদার অতীতের ছায়া? নাকি সৌরভের নিজস্ব ভবিষ্যতের কোনো নতুন আলোর ইঙ্গিত?
বাইরে মেঘ জমেছে। বাতাসে পত্রপুটির মৃদু শব্দ। আর সেই অন্ধকার বারান্দায় দাঁড়িয়ে সৌরভ ভাবছে—সময়ের দূরত্ব কি কখনো মুছে যায়?
0 মন্তব্যসমূহ