মিলি রহস্য

 মিলি রহস্য

অতনু সরকার










 

সিরুমালাই শহরেরএকটা একটা ছোট্ট হোটেলে রয়েছি আমি। বাংলা থেকে প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার দূরে। আজ মহা ষষ্ঠী। গত কয়েক বছর ধরে দুর্গা পুজোতে তেমন কোনো আনন্দ আর আমার মনের মধ্যে জাগে না। কেন যাবেনা? কেন আনন্দ হয় না বুঝতে পারিনা। তাই এ বছর পুজোর আগে চলে এসেছি। সিরুমালাই শহরটা একেবারে পাহাড়ের উপরে অবস্থিত। এখানে রয়েছে বিরাট একটা ফরেস্ট। প্রকৃতি যেহেতু আমার বরাবরের একটা প্রেম, তাই এই ফরেস্ট দেখতে এসেছি। শহরের একেবারে নিবৃত একটা প্রান্তে কয়েকটি হোটেল রয়েছে। সেই হোটেলের একটিতে রয়েছে আমি। জীবনের উদভ্রান্ত দিকগুলি যখন কাটিয়েছি তখন মনে হতো শান্ত নিরিবিলি একটা জায়গায় কয়েকটা দিন কাটিয়ে আসবো। আজ সময় এসেছি বহু দূরে পাহাড়ের উপরে একটা ছোট্ট হোটেলে কয়েকটা দিন কাটানোর জন্য। পাহাড়ের উপর থেকে নিচের দিকটা বেশ সুন্দর দেখায়। এখানে রয়েছে কয়েকশো কিলোমিটার দূরে বিস্তৃত একটা ফরেস্ট। খুব একটা গভীরে যাওয়া যায় না কিন্তু কিছুটা ভিতরে ঢুকে দেখা যায়। কত চেনা আর অচেনা গাছের সম্ভার এই পাহাড়ের মাথায়। সেই সঙ্গে পাখিদের আনাগোনা। সারাক্ষণ পাখির ডাকে মুখরিত এবং কলকল্যাণিত হয়ে থাকে চারিধার। ও আমার পরিচয়টাই তো দেওয়া হয়নি আমি সায়ন। ভ্রমণ পিপাসু এবং অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় একজন মানুষ। মধ্যজীবনে এসে সারা ভারত বর্ষকে দেখার তীব্র ইচ্ছা আমার মনের মধ্যে সারাক্ষণ তোলপাড় করতে থাকে। সেই অ্যাডভেঞ্চার নিয়ে পুজোর কটা দিন চলে এসেছি সুদূর এই পাহাড়ি শহর টায়। এখানে কয়েকদিন থেকে চলে যাব আর ও নানা প্রান্তে। শেষে যাবো কন্যাকুমারী। কন্যাকুমারী থেকে রামেশ্বরম। তারপর ফিরব নিজের কর্মস্থলে। খবরের কাগজের অফিসে কাজ করি আমি।এখন খবরের কাগজের অফিসে কাজের পাশাপাশি একটা অনলাইন মিডিয়া চ্যানেল রয়েছে আমার। জানেনই তো মানুষের সময় বড় কম। সমগ্র পৃথিবী যখন মানুষের হাতের মুঠোয় তখন অনলাইনের ব্যাপারটা বেশ মজাদার এবং চমৎকার। যদিও সে অনলাইন মিডিয়াম এখনো সেই ভাবে জমে ওঠেনি। তবে চেষ্টা করছি যাতে জনপ্রিয় করা যায়। এই অনলাইন ম্যাগাজিনের একটি বিভাগ আছে ভ্রমণ বৃত্তান্ত নামে। সেখানে অনেকেই লেখালেখি করেন আমিও আমার অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। বলতে পারি সেইসব অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য এবং কর্মক্লান্ত জীবন থেকে ছুটি নিয়ে একাকী নিরিবিলিতে কটা দিন কাটানোর জন্য বেরিয়ে পড়েছি। হোটেলের বারান্দায় বসে তাকিয়ে ছিলাম শুধু সবুজ ঘন জঙ্গলের দিকে। ধীরে ধীরে প্রকৃতির বুকে সন্ধ্যায় নেমে আসছে। সুদূর দক্ষিণ প্রান্তে হঠাৎ যেন মনের মধ্যে ঢাকির বাদ্য বেজে উঠলো। দুর্গাপূজায় যতই ভালো লাগুক আর না লাগুক ছোটবেলা থেকে শুনে আসা ঢাকির বাদ্য মনকে উতালা করে দিত। আজও যেন উতলা হতে থাকলো মনের ভিতর কানের মধ্যে ভেসে আসতে লাগলো সুদূর বাংলা থেকে হাজার হাজার ঢাকের বাদ্য। কিছু সময়ের জন্য মনটা কেমন নিস্তেজ হয়ে গেল। সন্ধ্যার পর বাইরে থাকা এখানে নিরাপদ নয়। তাই ঘরে ঢুকে যেতে হল। ঘরে ঢুকে ল্যাপটপটা নিয়ে বসলাম কিছু লেখার জন্য। কিন্তু বারবার মন যেন ছুটে যেতে চাইছিল পূজা মন্ডপের দিকে। কানের মধ্যে  আসছিল হাজার হাজার ঢাকের বাদ্য। হোটেলের কাচের জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকলাম বাইরে ঘনায়মান অন্ধকারের দিকে। 

সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে এখানে খাওয়া-দাওয়ার সম্পূর্ণ করে নিতে হয়। তারপর এই হোটেলের কর্মচারীরা চলে যায় যে যার নিজের ঘরে। পর্যটক খুব কম আসে এখানে। তাই এই কাজের পাশাপাশি তাদের অন্য কাজও করতে হয়। আমি সন্ধ্যে সাতটার মধ্যে খেয়ে আবার ঘরে ঢুকে পড়লাম। কাচের জানালাটা খুলে দিতে হু হু করে বাতাস আসছে ঘরে। সবগুলো জানালা খুলে দিলাম। ঠান্ডা বাতাস ঘরটাকে শীতল করে দিল। একটা চেয়ারে বসে সামনে টেবিলে ল্যাপটপটা রেখে লেখার চেষ্টা করছিলাম। এমন সময় দূরের পাহাড়ে অথবা জঙ্গলের কাছাকাছি কোথাও হয়তো একদল পাখি হঠাৎ ডেকে উঠলো। জানালার পাশে মনে হলো কে জানে দৌড়ে চলে গেল। হোটেলের ম্যানেজার বলেছিল জানালা না খুলতে। কথাটা মনে করে একটা যান জানালা বন্ধ করে দিলাম। আরেকটা বন্ধ করতে যাব ঠিক সেই সময় একটা থাবা এসে পরল জানালার লোহার রডের উপর। দ্রুত জানালাটা বন্ধ করে দিলাম। বাপরে বাপ এত বড় একটা থাবা। কাছে পিঠ কোন চিতা বাঘ বা বন বিড়াল জাতীয় কিছু একটা হবে মনে হল, দৌড়ে ঢুকে গেল জঙ্গলের দিকে। মনে মনে ভাবলাম পাখিগুলি বাঁচিয়ে দিল আমায়। এখানে রাতের বেলা নিরাপদ নয়। কারণ ঘন জঙ্গল থেকে মাঝেমধ্যে বেরিয়ে আসে চিতাবাঘ আরো ঘন জঙ্গলে রয়েছে বাঘ। লোকালয়ে যদিও বাঘ আসেনা তবে চিতা বাঘ শুনেছি মাঝেমধ্যে আসে। আর রয়েছে বড় বড় জাগুয়ার এছাড়া বড় বড় বন বিড়াল। অনেকে এদেরকে ভাম বলে থাকে। এছাড়াও রয়েছে সাপের উৎপাত। সেই জন্য জানালা দরজার খুলে রেখে এখানে ঘরে থাকার খুব একটা নিরাপদ একদমই নয়। হাওয়াটা আসছিল বলে ভুল করে জানালাটা খুলে রেখেছিলাম। বুঝলাম যে কোন সময় বিপদ হতে পারে। বাইরের শব্দ আর কানে আসছে না। মন দিয়ে লিখ ছিলাম।

হঠাৎ জল পিপাসা পেল। উঠে জলের বোতল টা হাতে নিয়ে দেখলাম সেটা একেবারেই ফাকা। গলাটা শুকিয়ে আসছিল অনেকক্ষণ ধরে। জলের বোতলটা ফাঁকা দেখে হতাশ হলাম। এখন তো হোটেলের রান্নাঘরটাও বন্ধ। রান্নাঘর আর খাবার ঘর একসঙ্গে। সেখানেই রয়েছে জলের ব্যবস্থা। ভাবলাম জলের বোতল টা নিয়ে একবার দেখে আসি। বাইরে বেরোবো কিনা ভাবছিলাম সেই সময় দরজায় কলিং বেলটা বেজে উঠল। কিছুটা অবাক হলাম তারপর ভাবলাম যাক যদি হোটেলের কেউ আসে অন্তত এক বোতল জল পাব গলাটা শুকিয়ে গেছে অনেকক্ষণ। ঘড়ির কাটাই তখন দশটা। দরজাটা খুললাম। দরজা খুলে যাকে দেখলাম তাকে দেখে আমার হৃদপিণ্ড স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার মতন। একটা জলের বোতল নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে দিয়ে মিলি। মিলি জলের বোতলটা আমার দিকে এগিয়ে দিল। বলল - এটা রাখো। তোমার খুব জল পিপাসা পেয়েছে তাই না।

মুহূর্তে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ। একই মিলিকে দেখে অবাক। তার উপর তার হাতে জলের বোতল। এবং সে বলছে আমার জল পিপাসা পেয়েছে। মিলি তো শুনেছি এক বছর আগে মারা গেছে। কোথায় যেন বেড়াতে গিয়ে সে মারা গিয়েছিল। 

আমাকে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মিলি বলল - কি হলো? জলের বোতলটা নাও। নতুন বোতল। জল পিপাশা পেয়েছে তোমার। খাও। আর কি হলো ঘরে আসতে বলবেনা? আমাকে কি চিনতে পারছ না সায়ন দা?

আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে মিলির কাছ থেকে জলের বোতলটা নিলাম। কারণ আমার গলা শুকিয়ে গেছে, কথা বলার শক্তি টুকু পর্যন্ত নেই। বোতলটা হাতে নিয়ে ঢক ঢক করে অর্ধেক জল পান করলাম। তারপর মিলিকে বললাম - এসো ঘরে এসে বস। তুমি কি পাশের ঘরেই আছো?

মিলি বলল-  আমি এখানেই থাকি। 

আমি বললাম - তাহলে তুমি কি এখানে বেড়াতে এসেছো? আমি তো শুনেছিলাম তুমি মারা গেছো। 

মিলি ঘরের দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিল। তারপর হো হো করে হেসে উঠে বলল - কারা বলেছে আমি মারা গেছি। 

আমি বললাম - তোমার শ্বশুর বাড়ির লোকই তো…

মিলি আমার মুখ থেকে কথাটা কেড়ে নিয়ে বলল  - শ্বশুর বাড়ির লোক ছাড়া কারা এমন বলতে পারে।

আমি বললাম - তাহলে তুমি….

মিলি -আমি তো বেঁচে আছি। এইতো আমাকে তুমি দেখছো না?  বলো। 

আমি কি বলবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। যার শ্রাদ্ধতে নিমন্ত্রণ খেলাম। সে দাঁড়িয়েছে আমার সামনে। আর বলছে সে মরেনি।

মিলি একটা চেয়ার টেনে বসলো। আমি বসলাম বিছানার উপর।

মিলি বলল -কেমন লাগছে জায়গাটা? খুব সুন্দর তাই না? 

আমি বললাম -অসাধারণ লাগছে দিনের বেলায় ভালো লেগেছে। 

মিলি - কাল ভোরে উঠে, যখনপূর্ব দিকে তাকাবে তখন দেখবে পাহাড়ের উপর দিয়ে গাছপালার ভিতর থেকে লাল একটা সূর্য উঠে আসছে। অপূর্ব লাগবে জানো সেই দৃশ্যটা।

আমি - তাই নাকি তাহলে সেই দৃশ্য দেখার লোক তো সামলাতে পারবো না যদি ঘুম ভাঙ্গে তাহলে নিশ্চয়ই দেখব মোবাইলে অ্যালার্ম দিয়ে রাখব বুঝলে। 

মিলি -মোবাইলে এলার্ম দিতে হবে না আমি তোমায় ডেকে দেবো। 

আমি - মানে? তুমি কি করে ডাকবে?

মিলি নির্লিপ্তভাবে উত্তর দিল - আমি এখানেই থাকবো। 

আমি অবাক হয়ে বললাম - এখানে মানে এই হোটেলে? 

মিলি বলল - প্রয়োজনে এই ঘরেও থাকতে পারি। আরে ভয় নেই আমার সঙ্গে কেউ নেই। আমি একাই আছি। 

আমি তাড়াতাড়ি বললাম -তোমাকে আমার এখানে থাকতে হবে না। তুমি  তোমার ঘরে থাকো। আমি এলার্ম দিয়ে রাখবো। আর তুমি ডাকবে বলছে যখন সমস্যা নেই ডেকে দিও।

মিলি হাসতে হাসতে বলল -ভয় পেয়ে গেলে নাকি। আমি থাকবো বললাম বলে। আমি একা তো আছি, আর তো কেউ নেই। একটা সময় তুমি আমাকে ভালবাসতে তাই না? 

আমি বললাম -অতীত নিয়ে ভেবে আর কি লাভ? যাও তুমি তোমার ঘরে ফিরে যাও। 

মিলি বলল -তুমি খুব ভয় পেয়ে গেছো। তখনো তুমি খুব ভীতু ছিলে জানো তো। ভীতু ছিলে বলে আমাকে ভালোবাসো কথাটা বলতে পারেনি তুমি। আমি কিন্তু তোমায় মনে মনে ভালোবাসতাম। আমি অপেক্ষা করেছিলাম তুমি কবে বলবে। যাইহোক তুমি যখন অতীত নিয়ে নাড়াচাড়া করতে চাইছ না। আমি চললাম।

কথা টা বলে মিলি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মিলি ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই দেখলাম চেয়ারের উপর রয়েছে একটা গল্পের বই। ভাবলাম মিলি হয়তো ভুলে গেছে নিয়ে যেতে।  বইটা নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এলাম। কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মিলি যে কোথায় মিলিয়ে গেল আর দেখতে পেলাম না। পাশের ঘরে আছে কিনা জানার ইচ্ছা ছিল কিন্তু যদি না থাকে। তাহলে অযথা অন্য কাউকে বিরক্ত করে কি লাভ। যাক ভোরবেলায় ডেকে দেবে তো বলেছে। যখন সকালে আসবে তখন না হয় গল্পের বইটা দিয়ে দেবো। বইটা নাড়াচাড়া করে দেখলাম শরৎচন্দ্রের উপন্যাস সমগ্র। তামিলনাড়ুতে শরৎচন্দ্রের বাংলা উপন্যাস খুঁজে পাবো এ তো কল্পনারও অতীত। বইটা খুলে পড়তে লাগলাম। পড়তে পড়তে হঠাৎ কারেন্ট চলে গেল। ঘুম ঘুম আসছিল বইটা পাশে রেখে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। 

তারপর কখন কারেন্ট এসেছে জানিনা। হঠাৎ বাইরে একদল শিয়ালের তীব্র চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল। দেখলাম ঘরে আলো জ্বলছে। তারপর যা দেখলাম তাতে আমার বুকের হৃদপিণ্ড স্তব্ধ হয়ে যাবার জোগাড়। টেবিলের পাশে চেয়ারটায় বসে আছে মিলি। যে গল্পের বইটা আমি পড়তে পড়তে শুয়েছিলাম সেই গল্পের বইটা মিলি পড়ছে। চুপচাপ শুয়ে ভাবছিলাম মিলি কি করে ঢুকলো ঘরে। আমি তো দরজা ভালো করে বন্ধ করে শুয়েছিলাম। ভালো করে সমস্ত জানালা দরজা বন্ধ আছে কিনা দেখে শুয়েছিলাম। তার পরেও কি করে এলো ঘরে। কৌতুহল সংবরণ করতে পারলাম না। হঠাৎ মিলিকে আমার ঘরে দেখে প্রথমে একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম নিজেকে সামলে নিয়ে গলাটা কেশে বললাম - আরে মিলি তুমি কখন এলে? কিভাবে ঢুকলে ঘরে?

মিলি অত্যন্ত নরম গলায় বলল - তুমি মনে হয় শোবার সময় দরজাটা বন্ধ করতে ভুলে গেছিলে। আমি বেরিয়েছিলাম বাইরে। দেখলাম দরজাটা খোলা তাই ঢুকে পড়লাম। 


আমি মনে মনে ভাবলাম আমার স্পষ্ট মনে আছে দরজাটা বন্ধ করেছি তারপর আমি আর একবার জল খেয়ে শুয়েছি। গল্পের বইটা হাতে নিয়ে পড়ছিলাম। 

আমাকে চুপ থাকতে দেখে মিলি বলল - আরে চুপচাপ শুয়ে পড়ো। ভেবে লাভ নেই। কাল সকালে উঠতে হবে।

আমি কোন কথা না বলে চোখ বুঝে শুয়ে থাকলাম। কিন্তু ঘুম এলো না কিছুতে। কারন আমার স্পষ্ট মনে রয়েছে দরজা আমি বন্ধ করেছিলাম। কোন মায়া মরিচিকার কবলে পড়লাম কিনা কি জানি! নিজেকে একটু সাবধানে রাখতে হবে। বলা তো যায় না ভূত প্রেতাত্মা অথবা অন্য কিছুর হতে পারে। না কিছুতেই ঘুম আসছে না। একবার এপাশ একবার ওপাস করছি। 

হঠাৎ মিলি বলল - ঘুমানোর চেষ্টা করো। তোমার মনে হয় মাথাটা যন্ত্রণা করছে। আমি আসছি মাথাটা একটু টিপে দিই। যাতে ঘুম আসে।

আমি বললাম-  তার দরকার হবে না। তুমি বরং বইটা পড়ো। বইটা মনে হয় তুমি ভুল করে রেখে গিয়েছিলে।

মিলি উত্তর দিল - তুমি গল্পের বই পড়তে ভালোবাসো আমি জানি, তাই বইটা রেখে গিয়েছিলাম যাতে তুমি সময় পেলে পড়ো। 

আমি বিস্ময়ের পর বিস্ময়ে পড়েছি। মিলি এত কিছু জানলো কি করে আমার সম্পর্কে। কলেজে যখন পড়তাম তখন মিলিকে ভালো লাগতো। আমি তখন থার্ড ইয়ার। মিলি ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী। আমাদের পাশের পাড়াতেই থাকে। ভালো লাগতো কিন্তু কখনো বলতে পারিনি তাকে আমার ভালোবাসার কথা। আমার কোন বন্ধুরাও জানে না। কিন্তু মিলি কি করে জানল ঠিক বুঝতে পারছি না। আমার কোন বন্ধুকে বলেছিলাম কিনা মিলির ব্যাপারে তাও তো মনে নেই। আমি যে গল্পের বই পড়তে ভালোবাসি সেটাও মিলি জানলো কি করে কি জানি। ধুর এমন এক জায়গায় এসে পড়লাম। সারাটা দিন আনন্দ করে কাটালো, আর এই রাতে এসে পড়লাম বিপদে।

হঠাৎ মিলি বলল - বিপদে পড়নি। কোন ভয় নেই আমি তোমার মিলি।

আমি বললাম -আমার মিলি মানে? তুমি আমার মিলি কবে হলে? তুমি তো আমার মিলি ছিলে না। 

মিলি হাসতে হাসতে বলল -আমি তোমারি ছিলাম কিন্তু তুমি বুঝতে পারো নি। আচ্ছা থাক তুমি শুয়ে পড়ো। জানি তোমার ঘুম আসছে না। দাঁড়াও আমি ব্যবস্থা করছি। 

মিলি চেয়ারটা নিয়ে এসে বসলো আমার মাথার কাছে। তারপর বলল - সায়নদা, চোখ বন্ধ কর। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি ঘুম এসে যাবে।

মিলি কোন কথা শুনল না।  আমার মাথায় ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। আঙ্গুলগুলো অত্যন্ত ঠান্ডা মনে হচ্ছিল। মিলি সুন্দরী লাস্যময়ী রমণী। এমন যৌবনে ভরপুর এক যুবতী যখন মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় তখন অন্য জগতে বিচরণ করতে ইচ্ছা করে।

আমি কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতে পারিনি। অনেক রাতে একটু শীত শীত করছিল। হাতটা নড়ে যেতে ই মনে হল তো কিছুর সঙ্গে ছোঁয়া লাগলো। শক্ত কিছু পড়ে রয়েছে  বুকের উপর। অন্ধকারের মধ্যে উঠে বসলাম। কতগুলো হাড়ের মতো কিছু জিনিস গা থেকে পড়ে গেল মনে হল।  খুবই ভয় পেয়ে গেলাম। চিৎকার করতে গিয়েও গলাটা শুকিয়ে এলো। গলা দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছিল না আমার। সঙ্গে সঙ্গে ঘরের লাইটটা জ্বলে উঠলো। দেখলাম মিলি জলের বোতলটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার পাশে। 

মিলি বলল -সায়ন দা স্বপ্ন দেখছিলে মনে হয়। 

আমি -তুমি এত রাতে কি করছো আমার ঘরে। তুমি যাওনি ফিরে? 

মিলি -তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই তোমার যেমন ঘুম এসে গেল তেমনি আমারও ঘুম এসে গিয়েছিল। তাই তোমার পাশেই শুয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ তুমি নড়েচড়ে উঠলে তাই আমি সরে এলাম। 

আমি -কিন্তু আমার বুকের উপর মনে হলো শক্ত কিছু ছিল।

মিলি -আসলে এসব তোমার ভয়ের কারণ। যাও চোখ মুখে একটু জল দিয়ে শুয়ে পড়ো। 

আমি বললাম -না আর ঘুম আসবে না। বরণ গল্পের বইটা পড়তে পড়তে ভোর হয়ে যাবে। তারপর উঠে না হয় ভোরের সূর্য দেখব। 

মিলি বলল -বেশতো তুমি চেয়ারে গিয়ে বসে বই পড়ো। আমি একটু তোমার বিছানায় শুয়ে পড়ি। আর হয়তো ঘন্টাখানেক পরেই ভোরের আলো ফুটবে। 

মিলি আমার বিছানায় শুয়ে পড়ল। আমি গল্পের বইটা নিয়ে হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করলাম। মাথাটা বেশ ঝিমঝিম করছে। হঠাৎ কাঁচা ঘুমটা ভেঙে গেলে যা হয়। ওয়াশরুমে গিয়ে চোখে মুখে ভালো করে জল দিয়ে এলাম। ঠান্ডা জলে শরীরটা একটু চাঙ্গা হল। আমি চেয়ারে বসে গল্পের বই পড়ছিলাম। কিন্তু শরৎচন্দ্র তখন মাথায় ঢুকছিল না। মনের মধ্যে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল। একবার পিছনে তাকিয়ে দেখলাম। খাটের উপর টান টান হয়ে শুয়ে আছে মিলি। আবার একবার গল্পের বইটা পড়ার চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু মাথাটা এত যন্ত্রণা করছে। যে পড়তেই পাচ্ছি না। বোতলের জলটা শেষ করে ফেললাম। তারপর পাতা উল্টাতে লাগলাম। পড়ছিলাম পন্ডিত মশাই। ধীরে ধীরে একটু স্বাভাবিক লাগছিল। গল্পে মোজে গেছি তখন। আধঘন্টা পর। হঠাৎ পিছনে তাকালাম। এবার আমার আত্মা উড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হল। কয়েক মুহূর্তের জন্য দেখেছিলাম আমার বিছানায় শুয়ে রয়েছে একটা কঙ্কাল। তারপর অজ্ঞান হয়ে গেছি। আমার আর কিছু মনে নেই। ভোর পাঁচটার সময় দেখলাম আমি বারান্দার একটা চেয়ারে বসে আছি। একা আশেপাশে কেউ নেই। ঘরের দিকে তাকাতে সাহস হলো। বারান্দায় কি করে এলাম তাও জানিনা। এখনো এখানে চারিদিকটা বেশ অন্ধকার। সবুজ গাছপালা গুলো কালো কালো হয়ে রয়েছে। তবে পুবের আকাশে একটা হালকা আলোর ছটা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। অনেকটা হালকা আবির রঙের মতন। মনে হচ্ছিল চোখে একটু ঠান্ডা জল দিতে পারলে ভালো হতো। ঠিক তখনই একটা ঠান্ডা হাত আমার পিঠের উপর এসে পড়ল। আমি আর পিছন ফিরে তাকাতে সাহস পেলাম না। গলার আওয়াজ শুনে বুঝতে পারলাম মিলি।

মিলি বলল - এই নাও ঠান্ডা জল। চোখে মুখে ছিটিয়ে দাও একটু। আরাম পাবে। 

মিলির দিকে তাকানোর মতন কোন শক্তি আমার ছিল না। কাঁপা কাঁপা হাতে জলের বোতলটা নিলাম। তারপর ওখানে বসেই চোখে মুখে একটু জল দিলাম। 

মিলি বলল - ভয় নেই আমি কোনো ক্ষতি করব না।

আমি মিলির দিকে তাকাতে পারলাম না ভয়ে। 

বললাম - সত্যিই তুমি মৃত? কিন্তু তুমি কেন এসেছ আমার কাছে? আমি তো তোমার কোন ক্ষতি করিনি। 

মিলি একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল -আমি কি তোমার কোন ক্ষতি করেছি? আমি চাইলেই তো তোমার ক্ষতি করতে পারতাম। তুমি যে ঘরটায় আছো সেটাই আমার ঘর ছিল।মৃত্যুর আগে পর্যন্ত। না না ভয় পেয়ো না, ভয় পাওয়ার কিছু নেই আমি তোমাকে কিছু করবোনা। তুমি ঠিকই শুনেছিলে আমি মারা গেছি। তুমি যাকে দেখছো সে জীবিত মিলি নয়। 

কথাটা শুনে চেয়ার থেকে প্রায় পড়েই যাচ্ছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে মিলি আমাকে ধরে নিল। ঘরে নিয়ে গিয়ে খাটের উপর বসালো। 

তারপর মিলি বলল - সায়নদা আমি মরিনি, আমাকে মেরে ফেলা হয়েছে।  আমাকে মেরে ফেলে দিয়ে গেছে পাহাড়ের উপর থেকে নিচে। এই ঘরটাই আমি থাকতাম। ক্ষতি করবো না। কারণ কারো ক্ষতি করিনি আমি। কাউকে দেখাও দেইনি। কিন্তু যখন তুমি এলে তখন না দেখা দিয়ে থাকতে পারলাম না। তুমি কাগজের অফিসে চাকরি করো নিজেও লেখ। তুমি আমার জীবনের সত্যি কাহিনীটা তুলে ধরো। আমি যে মরিনি মেরে ফেলা হয়েছে এটা তুলে ধরো তুমি। তোমার কলমের মধ্যে দিয়ে অন্তত সত্যিটা প্রকাশ পাক। 

আমি বললাম -সত্য ঘটনা কি? 

মিলি বলতে লাগলো বিয়ের পর থেকে ঘটে যাওয়া সব কিছু ঘটনা। অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে তার স্বামী এবং স্বামীর প্রেমিকা তাকে হত্যা করেছিল। শেষ রাতের সেই আবছা অন্ধকারে মিলি বলতে লাগলো তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা। আমি কথা দিলাম নিশ্চয়ই খবরের কাগজের অফিসে গিয়ে লিখব কিন্তু মিলি - এই ঘটনা যে সত্যি, তোমাকে যে আমি দেখলাম, তা কি করে প্রমাণ করবো বলো তো। আমি লিখবো অবশ্যই, কিন্তু লোকে বলবে গাজাখুরি গল্প।

মিলি কিছুক্ষণ ভাবলো তারপর তার হাত থেকে একটা সোনার আংটি দিল। বলল - এই সোনার আংটিতে আমার আর অবিনাশের নাম লেখা আছে। এই আংটিটা আমার হাতে ছিল তাই ওরা ভুলে গেছে নিতে। প্রমাণ স্বরূপ এটা তোমাকে দিলাম।

আংটিটা আমি হাতে নিলাম। কি অদ্ভুত রকমের ঠান্ডা একটা  স্পর্শ পেলাম মিলির হাত থেকে। আমি বললাম - এই আংটিটা আমি কি করবো ?

মিলি -তুমি প্রমাণ চাইছিলে তাই দিলাম। যদি সত্যিই কখনো প্রমাণ হিসেবে দরকার হয় এটা কাজে লাগিও। আরেকটা উপকার করবে সায়ন দা?

আমি - বল কি উপকার করতে পারি? 

মিলি -আমরা হিন্দু তাই হিন্দু শাস্ত্র মতে আমার অস্থি যদি গঙ্গায় বিসর্জন না দিই তাহলে আমার আত্মার সদগতি হবে না। আমিও মুক্তি পাচ্ছিনা। তোমার টেবিলে ছোট্ট একটা লাল মাটির দলার মধ্যে রাখা আছে অস্থি। প্লাস্টিকে মোড়ানো আছে তুমি যখন ফিরে যাবে ওটা নিয়ে গঙ্গায় ভাসিয়ে দিতে পারবে? আর অবশ্যই আমার মা-বাবার সঙ্গে দেখা করে সত্যি ঘটনাটা বলো। সোনার আংটিটার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে তাদেরকে দিয়ে দিও।

আমি মিলির দিকে এক পলক তাকিয়ে দেখলাম -মিলির শরীরটা ক্রমে কঙ্কালে পরিণত হচ্ছে। তারপর একসময় মিলিয়ে গেল। একটা সাদা ওড়নার মতন কিছু একটা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আমি পিছু পিছু বেরিয়ে এলাম। দেখলাম সেই সাদা ওড়নাটা ধীরে ধীরে জঙ্গলের মধ্যে মিলিয়ে যাচ্ছে।

দেখতে দেখতে ভোরের আকাশ ক্রমে পরিস্কার হতে শুরু করেছে। দূরে পাহাড় আর জঙ্গলের ভেতর দিয়ে লাল থানার মতন একটা সূর্য উঁকি দিচ্ছে। সারি সারি গাছের ভেতর দিয়ে পাহাড়ের মাথার উপরে একটু একটু করে উঠবে সূর্য। এ দৃশ্য জীবনে যারা দেখেনি তাদেরকে বলে বোঝানো খুব কঠিন। কারণ সৌন্দর্য কখনো বলে বোঝানো যায় না। সৌন্দর্যকে উপভোগ করতে হয়। তবে সেদিন ভোরে সূর্যোদয়ের আগে এবং সূর্যোদয়ের পরে যে দৃশ্য আমি দেখেছি তা সারা জীবন মনে থাকবে। জীবনে অলৌকিক কিছু বিশ্বাস করিনি। কিন্তু আজ হয়তো বিশ্বাস করতে বাধ্য হলাম। টেবিলের উপরে দেখলাম একটা সাদা প্লাস্টিকের মোড়ানো কিছু একটা রয়েছে। বুঝতে পারলাম মিলির রেখে যাওয়া অস্থি। কথা দিয়েছিলাম তাই নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে দিলাম। ফিরে নিশ্চয়ই গঙ্গায় ভাসিয়ে দেবো। কিন্তু আর একটা রাত এখানেই থাকার মতন সাহস আমি দেখাতে পারলাম না। যে বিছানায় মিলি শুয়ে ছিল সেই বিছানায় আমি শোবো এই সাহসও আমার ছিল না। অথচ আমি কখনো ভূততে ভয় পাইনি। আজ আমার সর্ব অঙ্গ শিথিল হয়ে গেছে। হাঁটু দুটো এখনো কাঁপছে। সকাল দশটার মধ্যেই আমি বেরিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম এখান থেকে। কারণ মিলির ঘটনাটা আমি কিছুতেই ভুলতে পারছিলাম না। আমার সমস্ত অবিশ্বাস ভেঙে দিয়েছে মিলি রহস্য। কি করে একটা আত্মা মানুষের মতন সামনে এসে দাঁড়াতে পারে এই চিন্তা সারাদিন ঘুরপাক খেতে থাকল।

 









একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ