বাংলা গল্প
গায়ে হলুদ
অতনু সরকার
আবার একটা দীর্ঘ ছুটি। আবার চলেছি আমার অত্যন্ত প্রিয় একটা গ্রাম তালসারি। গ্রামে একটা পুকুর রয়েছে, সেই পুকুরের চারিধারে সারি সারি তাল আর নারকেল গাছ। হয়তো সেই পুকুরটার নাম তালসারি থেকে গ্রামের নামও তালসারি হয়েছে। তবে এ বিষয়ে আমি অতটা জানার চেষ্টা করিনি কখনো। আমার স্কুল জীবনের বন্ধু সৌম্যর বিয়ে উপলক্ষে চলেছি সেই গ্রামে। বলতে পারেন কিছুটা টান অন্য আরেকটা কারণেও আছে। তবে সে কথা ক্রমশ প্রকাশ্য। কি অদ্ভুত মায়াময় একটা গ্রাম। বাস থেকে নেমে এখন হাঁটতে শুরু করলাম। হেঁটে যেতে বেশ খানিকটা সময় লাগবে। ফোন করলে হয়তো ওরা গাড়ি নিয়ে চলে আসতে পারতো কিন্তু গ্রামের সৌন্দর্য দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না।
কাঁধে ভারী ব্যাগ। দশ পনেরো দিন তো থাকতেই হবে, কারণ বিয়ের এক সপ্তা আগে আমি পৌঁচাচ্ছি। অবশ্যই এটা সৌম্যর আবদার বলা যেতে পারে। আর একজনের আবদার ও আছে। যাই হোক আমি যে আজ আসব সেটা ওরা জানে না। জানলে হয়তো বাসস্ট্যান্ডে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। আমি ইচ্ছা করেই বলিনি। একটা সারপ্রাইজ দেবো বলে। রাস্তার দু'ধারে বড় বড় সবুজ গাছ। কিছু গাছ আমি চিনি আবার কিছু গাছের নাম জানিনা। দুধার দিয়ে গাছগুলো রাস্তাটাকে এমন সুন্দরভাবে ঘিরে রেখেছে যে গরমকালেও এই পথে হাঁটতে অসুবিধা হয় না। আর এখন তো শীতের শেষ। মাঘ মাস। এখনো গ্রামে সেই ভাবে গরম পড়েনি। যথেষ্ট শীত রয়েছে। তাই হেঁটে চলতে খুব একটা অসুবিধা হচ্ছে না আমার। দুপুর গড়িয়ে এখন আমার ঘড়িতে প্রায় তিনটে বাজে। ঠান্ডা হাওয়া বইছে। রাস্তার দু ধারে ধরে যেমন গাছপালা রয়েছে তেমনি সেই গাছপালার অপরপ্রান্তে রয়েছে সবুজ ধান খেত। কত রকমের সবজি চাষ হচ্ছে এখানে। রাস্তাটাও অদ্ভুত একটা মায়াবী আবরণ ছড়িয়ে রেখেছে চারিধারে। সামনে একটা বড় বাঁশ ঝাড়। বাঁশগুলো রাস্তার উপরে ছাউনির মতো তৈরি করেছে। আমি গুনগুন করে গাইতে গাইতে মনের আনন্দে চলছিলাম। হঠাৎ পিছন দিক থেকে বারবার সাইকেলের বেলের শব্দ শুনে বেশ কিছুটা সরে দাঁড়ালাম রাস্তার ধারে। বুঝতে পারলাম না এত বেল বাজানোর কি হল। আমি তো একেবারে ধার দিয়েই হেঁটে চলেছি। আমার প্রায় গায়ের কাছে এসে সাইকেল থেকে নেমে দাঁড়ালো এক যুবতী। দেখে খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছিল চিনতে পারলাম না।
সেই যুবতী বলল - আরে আপনি অর্পণ দা না?
আমি বললাম - হ্যাঁ।
সেই যুবতী বলল - হেঁটে হেঁটে কোথায় চলেছেন? সৌম্য দা কে বললে গাড়ি নিয়ে এসে আপনাকে নিয়ে যেত। অথবা সৌমি যদি জানত তাহলে কি আপনাকে হেঁটে যেতে দিত। চলুন আমার সঙ্গে।
আমি হেসে বললাম – আপনি যান,আমি একটু হাঁটি। কাউকে কিছু খবর দেওয়ার দরকার নেই। আসলে আমি একটা সারপ্রাইজ দেবো বলে যাচ্ছি। আর এই গ্রামের পথটা বেশ ভালো লাগে। আপনাদের মতন সহজ সরল এই গ্রাম আমি খুব কম দেখেছি। তাই হাঁটতে দিন না একটু গ্রামের পথে।
সে সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল – তাহলে আমিও কি আপনার সঙ্গে হাঁটবো।
আমি বললাম – কি দরকার আপনি চলে যান। আমি ঠিক পৌঁছে যাব।
সেই যুবতী আবার সাইকেলে চেপে চলতে লাগলো। কিন্তু সাইকেলের গতিটা যেন ক্রমশ বাড়তে থাকলো। আমি বুঝলাম আমার আর সারপ্রাইজ দেওয়া হলো না। তো সে যাই হোক গ্রামের এই সুন্দর পথ ধরে হেঁটে চলেছি।
সূর্য তখন পশ্চিম দিকে অনেকটা ঢলে পড়েছে। গাছে গাছে কত রকম পাখির কলতানের শব্দ। গাছে গাছে কত রকমের ফুল। তারপর মাঠ জোড়া আলুর চাষ। সবুজ আর সবুজ হয়ে রয়েছে। কোথাও কুমড়ো চাষ করা হয়েছে কোথাও বা উচ্ছে চাষ করা হয়েছে। একটু এগিয়ে দেখলাম বিরাট একটা জলাশয়। সেখানে মাছ চাষ করেছে। দুজন লোককেও দেখলাম মাছের খাবার দিচ্ছে তারা। গ্রামের এইসব প্রকৃতি দেখতে দেখতে আনমনে হেঁটে চলেছি। হঠাৎ দেখি দূর থেকে একটা বাইক এগিয়ে আসছে আমার দিকে। বুঝতে অসুবিধা হলো না। সৌম্য এবং সৌমি। দুজনেই এসে দাঁড়ালো আমার পাশে তারপর শুরু হল বকাঝকা।
সৌম্য বললো– তুই যে আসবি তা একটা খবর দিবি না? এতটা পথ হেঁটে আসছিস লোকে দেখলে কি বলবে বলতো।
আমি বললাম– লোকে কিছুই বলবে না। আর বললেও তাতে আমার কি যায় আসে। তোদের এই মায়াভরা গ্রামটা আমার দেখতে খুব ভালো লাগে। এমন রাস্তার পাশ দিয়ে সবুজ মাঠ কতদিন দেখিনা। অন্তত চোখের আরামের জন্য হাঁটতে দোষ কি বল।
এবার অভিমানী গলায় সুমি বলল– এসব মিছে কথা। তুমি সারপ্রাইজ দেবে বলে ঠিক করেছিলে।
আমি বুঝলাম সেই যুবতী সুমির বন্ধু, সে বাড়িতে গিয়ে সঙ্গে সঙ্গে খবর দিয়েছে।
সুমির কথায় আমি হাসতে হাসতে বললাম – ভেবেছিলাম অনেক কিছু। কিন্তু হলো আর কই।
সৌম্য বললো– চাপ গাড়িতে।
আমি বললাম – আমি যদি গাড়িতে চাপি তাহলে আর একজনকে যে হেঁটে যেতে হবে।
সুমি বলল– সে আমি হেঁটে যাব, কিন্তু অতিথিকে তোমার হাটাতে পারি না।
সৌম্য বলল– চাপ তিনজনেই যাওয়া যাবে।
যাই হোক আর কথা বাড়ালাম না। কারণ জানি এখানে কথা বাড়িয়ে কোন লাভ হবে না। তিনজনে ঠাসাঠাসি করে চেপে পড়লাম গাড়িতে। ও বাবা বাড়ির দরজার কাছে গাড়ি দাঁড়াতেই দেখি আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে মাসীমা নিজে। আমাকে দেখে একগাল হেসে বলল– এইভাবে আসতে হয়। একটা খবর দিতে হয় না? এতটা রাস্তা হেঁটে হেঁটে কি কষ্ট হলো বলতো বাবা।
আমি গাড়ি থেকে নেমে তাকে প্রণাম
করলাম একটু দূরে দেখলাম মেসোমশাই গরুকে খাবার দেওয়ার জন্য ঘাস কাটছিল। আমাকে দেখে তিনিও আমার দিকেই আসছিলেন। আমি কয়েক পা এগিয়ে তার দিকে গিয়ে একটা প্রণাম করলাম। তিনিও আমার সঙ্গে কুশল বিনিময় করলেন।
সৌম্য বলল – চল ঘরে গিয়ে বস। একটু বিশ্রাম নে, তারপর কথা হবে।
ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে গটগট করে হেঁটে চললাম। হঠাৎ সুমি বলল – এই যে মশাই হেঁটে চললে কোন দিকে।
আমি বললাম – কেন দোতালায়।
সে বল –দোতারার কোন ঘরে যাবে?
আমি উত্তর দিলাম –কেন সৌমের ঘরে।
সুমি বলল– আজ্ঞে না মশাই ও ঘরে আর তোমার থাকা হবে না। তুমি বোধহয় ভুলে গেছো তোমার বন্ধুর বিয়েতে তুমি এসেছ। ও ঘর বন্ধুর জন্যই সংরক্ষিত আছে। তোমাকে থাকতে হবে পাশের ঘরে।
আমি বললাম – পাশের ঘরে মানে তোমার ঘরে? তাহলে তুমি থাকবে কোথায়?
পাশ থেকে মাসিমা বললেন– আমরা জানি তুমি এক সপ্তাহ আগে আসবে। তাই তোমার জন্য পাশের ঘরটাই ব্যবস্থা করেছি। সুমি আমার সঙ্গে নিচে থাকবে।
আমি বললাম – আচ্ছা তাই হোক।
উপরের দিকে চললাম। মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল সৌম্যর ঘরে থাকলে সুমি থাকত পাশের ঘরে। মাঝে মাঝে একটু দেখাও পাওয়া যেত কথা হতো।তা সে যাই হোক বিয়ে বাড়ি বলে কথা, সব সুবিধা তো আর পাওয়া যায় না। আমার পিছন পিছন উঠে এলো দুই ভাই বোন।
সৌম্য বলল – একা থাকতে ভয় করবে নাকি রে?
কথাটা বলে হাসতে লাগলো।
আমি বললাম – তুই তো এতদিন একা ছিলি তোর ঘরে। তোর যখন ভয় করেনি তখন আমারও ভয় করবে বলে মনে হয় না। তাছাড়া পাশে যখন তুই আছিস তখন আর ভয়ের কি আছে।
সুমি বলল, পাশে দাদা আছে। নিচে আমি আছি সুতরাং ভয় করবে না মশাই। যদিও তোমার যে কোন ভয় নেই সে তো আমরা সবাই জানি।
আমি বললাম – ভয় তো জ্যান্ত পেত্নীকে নিয়ে।
সুমি একটু অভিমান করে বলল – ভালো হবে না বলছি।
কথাটা বলে সঙ্গে সঙ্গে নিচে নেমে গেল।
সৌম্য বলল – দিলি তো রাগিয়ে।
আমি বললাম – দেখ না এক্ষুনি ছুটে আসবে। হয়তো চা করতে গেছে।
ঘন্টাখানেক বিশ্রাম নিয়ে আমি আর সৌম্য বেরিয়ে পড়লাম। ঘরে যে মন টেকে না সেটা সৌম্য বেশ ভালই জানে।
সে বললো – চল আমাদের আলু ক্ষেতটা ঘুরিয়ে নিয়ে আসি তোকে। এবার প্রচুর আলু চাষ হয়েছে। আলু তোলার সময় হয়ে গেছে ভাবছি পরের সপ্তায় তুলে ফেলতে হবে।।
আমি বললাম – সাত দিন পরে তোর বিয়ে আর তুই এখন আলু তোলার কথা ভাবছিস।
সৌম্য – না ভেবে তো উপায় নেই। এত বড় মাঠের আলু। বিয়ের পরপরই তুলে নেব ভাবছি। যদিও রাতে পাহারায় রেখেছি। এবার আমাদের এখানে আলু ফলন খুব বেশি হয়েছে। কিন্তু আমি যেহেতু জৈবিক পদ্ধতি ব্যবহার করি তাই আশা করছি আমার আলুর ফলন দ্বিগুণ হবে।
দুজনে হাঁটতে লাগলাম আলপথ ধরে। কোথাও বিঘার পর বিঘা আলু চাষ হয়েছে আবার কোথাও বা ধান ঝাড়ার পর ধানের আঁটি গুলি জড়ো করে রাখা হয়েছে মাঠে। কিছুদিন পর তারা সেগুলো পুড়িয়ে দেবে সেই ছাই জমিতে পড়ে তৈরি হবে সার। যেহেতু মাঠে আলু রয়েছে তাই এখন বিচুলি পোড়ানো যাবে না।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম সৌম্যদের আলুর ক্ষেতে। যতদূর চোখ যায় ততদূর ওদের জমি। পুরোটাই আলু আবার ঠিক উল্টোদিকে রয়েছে শশা খেত, উচ্ছে খেত, সে এক অপূর্ব দৃশ্য। উচ্ছে ক্ষেতের পাশ দিয়ে সারি সারি বেগুন গাছ। সেখানে ধরে রয়েছে বেগুন। আমার মতন প্রকৃতি প্রেমিকদের কাছে এইসব জায়গা অত্যন্ত প্রিয়।
দেখলাম আলুর গাছগুলি বেশ সবল এবং সতেজ এবং গোড়া মোটা। ফলে আলু যে প্রচুর হবে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কোথাও কোথাও আলু বেরিয়ে পড়েছে মাটি ভেদ করে। এবার আমরা আল পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে দুই চারটি কচি শশা তুলে নিলাম। যখন খেতে যাব তখনই পিছন থেকে একটা নরম হাত খপ করে ধরে নিল।
বলল – এই যে মশাই শসা খাচ্ছেন দাম দেবেন না।
কথাটা বলে খিল খিল করে হাসতে লাগলো। হাসিটা যদিও একজনের নয় বেশ কয়েকজনের বলেই মনে হল। কিছুটা অপ্রস্তু থেকে পিছন দিকে তাকিয়ে দেখি আমার হাতটা ধরে রয়েছে সুমি।
আমার সামনে দিয়ে হেটে চলেছে সৌম্য সেও এই আকস্মিকতায় থমকে দাঁড়ালো। তারপর এই দৃশ্য দেখে আবার সোজা তাকিয়ে হাঁটতে লাগলো।
আমি বললাম – দাম তো অবশ্যই দেব, কিন্তু কি দাম দেবো বলো তো।
সঙ্গে সঙ্গে পিছন থেকে একটি মেয়ে বলে উঠলো – আমাদের এখানে খুব ভালো ফুচকা তৈরি হয়। চন্ডীমণ্ডপের পাশে বটগাছের তলায় ফুচকা ওয়ালা বসে। আমাদের ফুচকা খাওয়ালেই হবে।
আমি বললাম – বেশতো তাহলে চন্ডীমণ্ডপের বটগাছের তলাতেই চল।
সুমি বলল – আরে না না আমরা ইয়ার্কি করছিলাম।
সৌম্য বললো – তুই কি আসবি না ওদের সঙ্গে যাবি।
আমি বললাম – তুইও আয় কারণ আমি একা সামলাতে পারবো না।
যে পথ ধরে আমরা হেঁটে চলছিলাম সেই পথ ধরে না গিয়ে বাঁ দিকের একটা আল পথ ধরে আমরা গ্রামের দিকে ফিরলাম। এই পথটাতে আমার কখনো আসা হয়নি। এখানে রয়েছে একটা মন্দির। সেখানে দুর্গাপূজো, কালীপুজো, শীতলা পুজো সব রকমই পুজোয় হয়। মন্দিরের পাশে রয়েছে একটা বুড়ো বটগাছ। শোনা যায় বহুদিনের পুরনো। গাছটা সম্পর্কে আমি শুনেছিলাম আগেরবার কিন্তু দেখা হয়নি। এবার দেখলাম।অনেক গুলো ছোট ছোট দোকান। গ্রামের চায়ের দোকান, চপের দোকান আর সবজি পাতির দোকানও রয়েছে দু-একটা। একটা মুদিখানার দোকান আছে। এই জায়গাটা একটু জমজমাট। গ্রামের ছেলে বুড়ো সকলেই এখানে এসে জড়ো হয়। আমরা একটা ফুচকা ওয়ালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। তখন গ্রামের মধ্যে বেশ সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। ফুরফুর করে শীতল বাতাস বইছে। সেই বাতাসের সঙ্গে ভেসে আসছে সবুজ মাঠের নানান গন্ধ। গ্রাম্য মানুষের কাছে এসব নতুন নয় কিন্তু আমার কাছে এক অদ্ভুত অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ। সকলে মিলে ফুচকা খেলাম তারপর আবার ফিরে এলাম সৌম্যদের বাড়িতে।
পরের দিন সকালে আমাকে জলখাবার দিয়ে সুমি বলল – আমি একটু বেরোচ্ছি ঘন্টা দুয়েক পরে আসবো।
আমি বললাম – হঠাৎ কোথায় বেড়াচ্ছো?
সুমি বলল – আমি এখানে একটা স্কুলে কাজ করি। বিনা বেতনে মশাই। বেতন নেই না।
আমি বেশ অবাক হয়ে বললাম – তুমি স্কুলে কাজ কর। আমাকে তো কখনো বলোনি। দিনে তো দুবার ফোন করো অথচ এ কথাটা বলনি কেন।
সুমি বলল –”আসলে এটা বলার কথাই নয় কারণ আমি তো চাকরি করি না। আমি যখন সময় পাই তখন স্কুলে যাই বাচ্চারা আসে তাদেরকে পড়াই তবে হ্যাঁ এটা সত্যি আমার ভুল হয়ে গেছে বলাটা উচিত ছিল।
কথাটা বলে মনে হল যেন একটু নিজেকে গুটিয়ে নেবার চেষ্টা করছে সে। কোন একটা অপরাধবোধ থেকে।
আমি বললাম – আরে ঠিক আছে। সবকিছুই যে আমাকে শেয়ার করতে হবে এমন কিছু তো নয়। আচ্ছা তুমি যাও তোমার না হয় দেরি হয়ে যাবে।
হঠাৎ সুমি বলল – তুমি যাবে আমার সঙ্গে।
আমি বললাম – আমি যাব? আমি গিয়ে কি করবো? আমি তো আর পড়াতে পারবো না।
সুমি বলল – জানো স্কুলটার একটা বিরাট ইতিহাস রয়েছে। যদি তুমি জানতে।
আমি বললাম – ইতিহাস? কিসের ইতিহাস?
সে বলল – প্রস্তুত হয়ে নাও চলো আমার সঙ্গে যেতে যেতে বলব। তবে দেরি করলে চলবে না মশাই।
আমি বললাম – তুমি যাও।
সুমি অভিমান করে বলল – ও আমি তোমাকে বলিনি বলে রাগ করেছ। যাবে না আমার সঙ্গে।
আমি দেখলাম ব্যাপারটা অন্যদিকে মোর নিতে পারেl বললাম – আচ্ছা তুমি যাও আমি আসছি।
মিনিট দুয়েকের মধ্যে আমি নেমে এলাম নিচে। ইতিমধ্যে মাসি মা জেনে গেছে যে আমি যাব সুমির সঙ্গে । সে বলে রেখেছে সুতরাং বেরোনোর সময় কেউ কোনো প্রশ্ন করেনি। রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম। আমি বলেছিলাম হেঁটে যাবো। হাঁটতে হাঁটতে শুনছিলাম সেই স্কুলের কথা।
সুমি বলতে শুরু করলো, জানো আমাদের এই পাশের পাড়ায় প্রভাতী নামে একটি মেয়ে ছিল। আসলে আমাদের এই গ্রামে মেয়েদের খুব অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যায় বিশেষ করে যারা খেটে খাওয়া চাষী তাদের ঘরের মেয়েদের খুব অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দেয় বাবা মা। কিন্তু প্রভাতী বলে ওই মেয়েটি যাকে আমরা প্রভাতী দি বলি সে কিন্তু ছিল সমাজের উল্টো স্রোতে হেঁটে চলা একজন মহিলা। ছোটবেলা থেকেই সে পণ করেছিল স্কুলে ভর্তি হবে পড়াশোনা করবে। জোর করে স্কুলে ভর্তি হয়েছিল মাধ্যমিক পাশ করলো। আমাদের স্কুল থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করলো কিন্তু তারপরেই ওর বাবা নিজের জমি জায়গা বিক্রি করে ওকে বিয়ে দিল। আমাদের এখান থেকে দশ মাইল দূরে সোনামুখী গ্রামে। বিয়ের পর সে যখন শ্বশুরবাড়ি গেল তখন জানতে পারলো তার শ্বশুরবাড়ি প্রত্যেককে দুটি করে বিয়ে। তার ননদদের যেমন দুটি করে বিয়ে তেমনি অন্য ভাসুরদেরও দুটি করে বিয়ে। প্রথম কয়েক মাস ঠিকঠাক চলছিল তারপর শুরু হল অত্যাচার। বাবার বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে এসো, গয়না নিয়ে এসো। খাবার টাকা নিয়ে এসো। মারধর চলত। প্রভাতী দি প্রায়ই বাপের বাড়ি এসে বাবা মার কাছ থেকে টাকা নিয়ে যেত। শ্বশুরবাড়িতে পান থেকে চুন খসলেই চলত অত্যাচার। কোনদিন রান্না করতে দেরি হলে বা কোনদিন খেতে দিতে দেরি হলে কোন কারনে শশুর শাশুড়ি ননদ ভাসুর বর সবাই মিলে মারত। এ যেন এক মধ্যযুগীয় প্রথা। গ্রামের সবাই খারাপ কিনা জানিনা সেই পরিবারটির কথা বলছি তারা ছিল খুব খারাপ। ওর বাবা মা ভেবে ছিল তার বাচ্চা হলে হয়তো ঠিক হয়ে যাবে। আচ্ছা বাকি কথাটা প্রভাতীদের কাছ থেকে শুনবে?
আমি বললাম – তোমার প্রভাতী দি আমাকে বলবে কেন? তার জীবনের কথা। সে না আমাকে চেনে না আমাকে জানে।
সুমি বলল – প্রভাতী দি তোমাকে চেনে।
আমি বললাম – আমাকে চেনে মানে? আমাকে তো দেখেনি কখনো।
সে বলল – এই আধুনিক যুগে ফোন থাকতে অচেনার কি আছে। আগে গ্রামে ফোন ছিল না। কিন্তু এখন একজন দুজন করে তো ফোন কিনছে। একটা টাওয়ারও বসেছে জানো আমাদের গ্রামে।
গ্রামে ঘোরার সময় টাওয়ারটা দেখেছিলাম বটে, কিন্তু অতটা ভাবি নি সে যাই হোক।
আমি বললাম – তোমার কাছ থেকেই শুনি। একজন অপরিচিতা মহিলার কাছ থেকে তার জীবনের দুঃখের কথা শোনার থেকে তোমার কাছ থেকেই শুনি।
সুমি বলল – আচ্ছা বেশ, তারপর তার স্বামী একদিন বলল এক লাখ টাকা লাগবে। বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে আসতে হবে। যতদিন না সে বাপের বাড়ি গেল ততদিন তো অত্যাচার চলল তার উপর। বাপের বাড়িতে গিয়ে সে শুনল ওর মেজ বোনের বিয়ে ঠিক হয়েছে। ওর বাবা টাকা দিতে পারবে না। মেজ বোনের বিয়ে ঠিক হয়েছে শুনে সেও আর জোর করল না। ফিরে এলো বাড়িতে কিন্তু আবার তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হল বাপের বাড়ি। ততদিনে সে নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা। প্রভাতী দির একটা মেয়ে হল। তিন মাস পর যখন সে মেয়েকে নিয়ে বাড়িতে গেল তখন তার ওপর চলল অত্যাচার। স্বামী, শাশুড়ি, শ্বশুর, ননদ, ভাসুর সকলে মিলে তাকে পিটাতে শুরু করলো। কারণ একটাই সে কেন ফিরে এসেছে। গাছের সঙ্গে বেঁধে মারতে লাগলো সবাই। অদ্ভুত, গ্রামের মানুষ কেউ দেখলো না। তারপর তার হাত ভাঙল। মুখ দিয়ে রক্ত পরতে লাগলো। এবং ছোট্ট বাচ্চাটাকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হলো মাঠের বিলের জমিতে। ধান ক্ষেতে তখনও জল চিকচিক করছে। সেই সময় কোন এক গ্রামের বউ জল নিতে আসছিল পুকুরে সে এই দৃশ্য দেখে দৌড় দিল বাড়িতে। তারপর বাড়িতে গিয়ে সব বলাতে দুই তিন জন ছুটে এলো বাচ্চাটাকে কোনরকম উদ্ধার করল। প্রভাতী দি কে গাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে গেল লোকাল থানায়। সে কেস এখনো চলছে। ও ফিরে এলো গ্রামের বাড়িতে।। কিন্তু প্রভাতীদির মতন এমন মানুষ আমি জীবনে দেখিনি। এত কিছু প্রতিকূলতা, এত অত্যাচার সহ্য করার পরেও সে দমে যায়নি। জানো যখন এইসব কথাগুলো আমি শুনছিলাম প্রভাতীদির মুখ থেকে তখন আমার দুচোখ বেয়ে জল নেমে আসছিল। ভাবছিলাম এই আধুনিক যুগে এ গ্রামীন জীবনে এমন অত্যাচার হয়। ভাবতে কষ্ট লাগছিল। যাই হোক সেই প্রভাতী দি কিন্তু তার মেয়েকে মানুষ করতে যেমন বদ্ধপরিকর তেমনি সে বদ্ধপরিকর তার মতন পরিস্থিতির শিকার মহিলাদের জন্য কিছু করার। যারা তার মতন নির্যাতিতা তাদের সন্তানদের জন্য কিছু করার কথা হঠাৎ তার মাথায় চাপল। ঠিক করলো ওদের জমিতে একটা স্কুল তৈরি করবে সে। স্কুল তৈরি করবে যাতে গ্রামের মানুষেরা বিশেষ করে গ্রামের মেয়েরা ছোটবেলায় সেখানে পড়াশোনা করতে পারে। নিজেদেরকে স্বনির্ভর করতে পারে। কিন্তু স্কুল যে করবে চালাবে কি করে। জানো স্কুল বাড়ি তৈরি করতে সে পথে পথে ভিক্ষা করতে লাগলো।
আমি বললাম –তাহলে তার সংসার চলতে কি করে।
সুমি বলল – সংসার চালাতো ওর বাবা-মা। এখনো চালায়। আর স্কুল চালানোর জন্য ও এখনও রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করে। বলে আমার স্কুলের জন্য কিছু দাও। আমার স্কুলের জন্য কিছু দাও। আমরা সব সময় ওর পাশে থাকি। যে মেয়েটা এত নির্যাতনের পরেও নির্যাতিতাদের পাশে এসে দাঁড়ায় তাদের সন্তানদের পাশে এসে দাঁড়ায় তার জন্য সত্যিই মনটা কেমন করে। একদিন কি হল সে পাড়ায় পাড়ায় ভিক্ষা করছিল। স্কুলের জন্য। আমাদের বাড়িতে এসে ভিক্ষা চাইছিল। আমার স্কুলটা তৈরি করব গরিব ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করবে বিশেষ করে মেয়েরা। তখন আমি ওর সব কথা শুনেছিলাম। বলেছিলাম তোমার স্কুলে পড়াবে কারা। তখনো বলেছিল তার মতন অনেক নির্যাতিতা সে জড়ো করেছে। চার পাঁচ জন এমন আছে যারা বিনা পয়সায় পড়াবে। আমি তখন বলেছিলাম আমি যদি পড়াই বিনা পয়সায় নেবে আমাকে। সে আমার দিকে তাকিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিল। বলেছিল তোমার মতন শিক্ষিতা যদি আমার স্কুলে আসে তাহলে স্কুলটা চলতে অসুবিধা হবে না। আমার জমানো টাকা আমি ওকে দিয়ে দিয়েছিলাম সেদিন। আর তারপর দিন থেকেই আমি ওর সঙ্গে কাজ করছি। কি অদ্ভুত মনের জোর জানো। আজ ওর মেয়ের বয়স আট বছর। এরকম আট থেকে বারো বছরের মধ্যে দেড়শ জন ছেলেমেয়ে সেখানে পড়াশোনা করে। দরমার বেড়া আর মাটির বেড়া দেওয়া স্কুলটা এখন পাকা বাড়ি হয়েছে। একজন সহৃদয় ব্যক্তি কিছু টাকা দিয়েছিল। আমার বাবাও অনেক টাকা দিয়েছে। আমিও যখন যা লাগে দেওয়ার চেষ্টা করি। এইভাবে এগিয়ে চলছে প্রভাতীদের স্কুল।
আমি বললাম তোমার এই কথাগুলো শোনার পর না তোমার প্রতি আমার একটা শ্রদ্ধা এবং সম্মান বেড়ে গেল সুমি। আর সেই প্রভাতী দিকে দেখার জন্য আমার মনটাও ছটফট করছে। কে সেই মহীয়সী যে এত অত্যাচার সহ্য করে রাস্তায় ভিক্ষা করে স্কুল চালায়। যাতে তার মতন কাউকে কষ্ট পেতে না হয়।
সুমি বলল– সামনের যে বাড়িটা দেখছো ওটাই আমাদের স্কুল।
দেখলাম অনেক ছেলেমেয়ে সেখানে খেলছে। সুমিকে দেখেই তারা দৌড়ে এলো। কেউবা দিদিমণি দিদিমণি বলে জড়িয়ে ধরল তাকে। সুমিও তাদের সঙ্গে কেমন যেন শিশুর মতো হয়ে গেল। সেই সঙ্গে আরেকজন মহিলাকে দেখলাম। শ্যামলা বরণ ছিপছিপে শরীর। সাদা কাপড় নীল পাড়। শ্যামলা হলেও তার মুখের মধ্যে যেন এক অদ্ভুত প্রশান্তি বিরাজ করছে। মুখটা করুন হলেও একটা মায়াবী আস্তরণ রয়েছে সেখানে।
তিনি এগিয়ে আসতেই সুমি তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল– প্রভাতীদি ইনি আমার দাদার বন্ধু। তোমাকে এর কথাই বলেছিলাম।
প্রভাতী দি আমার দিকে এগিয়ে এসে নমস্কার জানালো। আমিও নমস্কার জানিয়ে মাথাটা নত করে দিলাম সেই অসাধারণ কর্মযজ্ঞের প্রতিষ্ঠাতার কাছে।
প্রভাতী দি বললেন – ঘরে এসে বসবেন আসুন।
সুমি বলল – এসো আরো দিদিমণিদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই।
আমি একটু লজ্জায় পাচ্ছিলাম কারণ একেবারে অচেনা অজানা একটা পরিবেশ এতগুলো বাচ্চা ছেলে মেয়ে তারাও সব অদ্ভুত একটা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। হঠাৎ একটা ছেলে দৌড়ে এলো আমার কাছে। এসে বলল, “আপনি ফুটবল খেলেন না”?
আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম –খেলতাম, এখন তো খেলিনা, তুমি আমার খেলা দেখেছো নাকি?
সে সঙ্গে সঙ্গে বলল – আমার দাদার ফোনে আপনার খেলা দেখেছি।।
বুঝলাম এখানে ফোনের প্রচলন বাড়ছে আর না বাড়ার তো কোনো কারণ নেই। আধুনিক ভারতে যেখানে ঘরে ঘরে ফোন সেখানে এখানে কেনই বা থাকবে না।
ঘরে গিয়ে বসলাম আরো চার-পাঁচ জনের সঙ্গে পরিচিত হলাম।। ভালো লাগলো বিশাল কর্ম যজ্ঞটাকে দেখে। এখানে যারা দিদিমণি আছেন তারা সবাই বিনা পয়সায় পড়ান। আমি প্রভাতী দি কে বললাম – এখানে যে কটা দিন আমি থাকবো সেই কটা দিন দুপুরের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করুন সকলের জন্য। আমি আগাম টাকা দিয়ে দেবো। করা যাবে কি ব্যবস্থা। আপনাকে কালকে এসে অথবা সুমিকে দিয়ে পাঠিয়ে দেবো।
প্রভাতী দি আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তার চোখে জল বেরিয়ে এলো আনন্দে। বলল দাদাভাই কি বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ দেব জানিনা। খার ব্যবস্থা আমি করে দেবো। কিন্তু যদি দুটো ব্ল্যাক বোর্ড এর ব্যবস্থা করে দেন ভালো হয়।
আমি বললাম – আমি এতটাই খুশি হয়েছি যে বলে বোঝাতে পারবো না। আপনার মত একজন মানুষ এইভাবে একটা মহৎ কাজে নেমেছেন আর শুধু তাই নয় আপনাকে ভিক্ষা করতে হয় এই স্কুল চালানোর জন্য। এটা শুনে মনে হল ফেরিওয়ালারা এখনো বেঁচে আছে। আচ্ছা ব্ল্যাক বোর্ড এর ব্যবস্থা করে দেব। কলকাতা থেকে অনিয়ে দেবো। এখানেবকিনপাওয়া যাবে।
সে বলল - না, এখানে পাওয়া যাবে না।
আমি ওখানে বসে অনলাইনে অর্ডার করে দিলাম।
স্কুল টা দেখে তার কর্মকাণ্ডের কথা শুনে প্রভাতীদির জীবন সংগ্রামের কথা শুনে আমার এতটাই ভালো লেগেছিল যে বলে বোঝাতে পারবো না। আমি সুমিকে দিয়ে বেশ কিছু টাকা পাঠিয়ে দিয়েছিলাম যাতে এক মাসের খাওয়া দাওয়া চলে গিয়েও আরো কিছু থাকবে। এমন একজন মানুষের পাশে কিছুটা সময়ের জন্য দাঁড়াতে পেরে আমার ভালই লাগছিল। আমি শহরে গিয়ে এই কথা জানাবো সকলকে হয়তো তারাও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে স্কুলটা হয়তো আরো ভালোভাবে চলবে। যারা বিনা পয়সায় পড়াচ্ছে তারা হয়তো খুশি হবে।
সত্যি বলতে কি সুমি কেও যেন আজকে খুব ভালো লাগছিল এমন একটা মহৎ কাজের সঙ্গে ও জড়িত এটা দেখে। বুঝলাম ওর মনটাও কত বড় হতে পারে।
রাতে খাওয়া দাওয়া করে শুয়েছি। সৌম্য এসে বসেছে আমার ঘরে। আমার ঘর বললে ভুল হবে সুমির ঘর। আমি কিছুদিনের জন্য আছি। আছি যখন আমার ঘর বলতে আর আপত্তি কোথায়। একটা চেয়ার নিয়ে বসল আমার পাশে।
বলল– বিয়ের ব্যাপারটা এত ঝামেলা না বুঝলি। চল তো দেখি হিসাব নিকাশ একটু করে ফেলি। কোথায় কি লাগবে কোথায় কি দিতে হবে বুঝে উঠতে পারছি না। নে উঠে বস খাতা কলমটা ধর।
অগতা উঠে বসতে হলো। বিয়ের আয়োজন। কি কি হবে কোথায় প্যান্ডেল হবে। কত টাকা কিসের জন্য ধরতে হবে কি কি খাওয়া হবে, কি জামা কাপড় কিনতে হবে সমস্ত একটা লম্বা তালিকা তৈরি করা হলো। হঠাৎ দরজার উপর দুটো টোকা পড়ল। সৌম্য গিয়ে দরজা খুলতেই দেখলাম দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সুমি।
সৌম্য বলল –কিরে এত রাতে তুই।
সুমি কিছুটা ভেবাচাকা খেয়ে গেল। তবু দেখলাম নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, তোরা দুই বন্ধু কি করছিস তাই দেখতে এলাম।
উপস্থিত বুদ্ধি আছে বলতে হবে।
সৌম্য বলল– বিয়ের হিসাব করছি।
সুমি উত্তর দিল– বারে তোর বিয়ে বলে কি আমাকে ডাকবি না? বোনটাকে একেবারেই ভুলে গেলি বন্ধুকে পেয়ে।
সৌম্য এবার চুপ করে গেল। সত্যিই তো, সুমি তার সব সময়ের সঙ্গী অথচ সেই সুমিকেই ডাকা হয়নি। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল– আরে ওর সঙ্গে একটা প্ল্যান করছিলাম। প্ল্যানটা করা হয়ে গেলে তোকে নিশ্চয়ই দেখাতাম।
সুমি বলল – প্লান করা হয়ে গেলে দেখি কি লাভ।
আমি বললাম– আমিও তো এই কথাটাই বলার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু ও তো শুনলে না। আচ্ছা তুমি যখন এসেই পড়েছ তখন তোমার কি কি প্লান আছে বল।
রাত বারোটা পর্যন্ত চলল প্লান। তারপর সাড়ে বারোটার সময় যে যার ঘরে ফিরে গেল। আমার ঘুম আসছিল না। আমি জানি তুমি আমার কাছে আসতে চেয়েছিল একাকী। কিন্তু ঘরের মধ্যে যে দাদাকে দেখতে পাবে এটা ভাবতে পারেনি।
দুদিন পর সুমি তার স্কুল থেকে আমাকে ফোন করলো। ফোন করে বলল প্রভাতী দি আমাকে নাকি ডাকছে। এক্ষুনি যেতে হবে। কি আর করা কিছুটা সময় নিয়ে উপস্থিত হলাম সেখানে। গিয়ে দেখলাম ছেলে মেয়েরা মহানন্দে খেতে বসেছে। আমাকে দেখে প্রভাতী দি ডেকে নিয়ে গেলেন ঘরে। অর্ডার করে বোর্ড এসে গেছে। এবার আমাকেও খেতে হবে তাদের সঙ্গে। এটা তাদের আবদার। আবদার মেটাতে হল। সত্যি কথা বলতে কি ওদের সঙ্গে খেতে খুব একটা খারাপ লাগেনি। মনে হচ্ছিল একটা নতুন অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। আর প্রভাতীদি কে যত দেখছি ততই যেন অবাক হচ্ছি।
বিকেল বেলায় প্রতিদিনের মতো আজও বেরোলাম সৌম্যর সঙ্গে। আজ পাড়ার মাঠে গিয়ে বসলাম। ছেলেরা ফুটবল খেলছিল। সৌম্য আর আমি একটা গাছের তলায় গিয়ে বসলাম। দেখছিলাম তাদের খেলা। আসলে গ্রামের মধ্যে এভাবেই মজা করে দিন কাটায় ছেলেরা। তবে খেলা দেখতে ভালই লাগছিল। দেখতে দেখতে ফিরে যাচ্ছিলাম আমার শৈশবে।
শৈশবে যখন খুব ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি আসতো তখন পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে মাঠে ফুটবল খেলতে কি মজাই না লাগতো। একদিন তো মনে আছে দুপুরবেলায় ঝমঝম করে বৃষ্টি নেমে এলো। সঙ্গে সঙ্গে ছেলেরা বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে। আমিও যোগ দিলাম। ঘন্টা দুয়েক ফুটবল খেলার পরেও যেন আশ মিটছিল না। তখনও বৃষ্টি পড়ছিল অঝোর ধারায়।
আসলে এই মজার কোন ভাগ হবে না। দু একজন আমাদের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলবার চেষ্টা করছিল। সৌম্য আর আমি উঠে মাঠের অন্যপ্রান্তে হেঁটে যাচ্ছিলাম কারণ সেই দিকটাতে রয়েছে মস্ত একটা ধানক্ষেত আর সেই ধান ক্ষেতের ভিতর দিয়ে একটা সরু রাস্তা চলে গিয়েছে। এই রাস্তা ধরে যাওয়া যায় পাশে একটি গ্রামে। রাস্তাটা সরু হলেও চারিদিকে এত সুন্দর গাছপালা মনে হচ্ছে যেন প্রকৃতি তার আপন মহিমায় সাজিয়ে রেখেছে এই রাস্তাটিকে। সবুজ গাছ পালার ভিতর দিয়ে একটা সুরঙ্গের মতো রাস্তা। কি অদ্ভুত। প্রকৃতির যে কি খেয়াল বুঝিনা। এত সুন্দর প্রকৃতি না দেখলে বিশ্বাস করতে পারতাম না। আর তখনই মনে পড়ল প্রভাতীর কথা। এই সুন্দর পরিবেশে প্রভাতীর মত মেয়েরা থাকে। আবার তারা অত্যাচারিত হয় ঘর ছাড়ে। ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়। বাধ্য করা হয় তাদের। তারপর এক অদম্য ইচ্ছা শক্তিকে কাজে লাগিয়ে লড়াই করতে থাকে। তার অদ্ভুত লড়াই বার বার মনে করছিলাম। এই সুন্দর প্রকৃতি যেন তাদেরকে লড়াই করতে শেখায়। মেয়েটার জন্য খুব কষ্ট হয়েছিল। এমন অনেক প্রভাতী গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কিন্তু এই প্রভাতীর মতন অদম্য ইচ্ছা শক্তিকে কাজে লাগিয়ে স্কুল তৈরি করে রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করে শত শত বাচ্চাকে মানুষ করার মানসিকতা আমি কোথাও দেখিনি। হয়তো এই পরিবেশ এই প্রকৃতি তাকে শিখিয়েছে। এখানে না আসলে সবকিছু অধরা হয়ে থাকত। হাঁটতে হাঁটতে বুঝলাম এক অদ্ভুত সৌন্দর্য আমার চারিদিকে যেন ঘিরে রেখেছিল।
দেখতে দেখতে বিয়ের দিনও এসে গেল। হাসি মাজায় কটা দিন যে কাটিয়ে ফেললাম মনেই হলো না। বিয়ের দিন সকাল থেকে বাড়িতে আত্মীয় পরিজন সকলের ভিড়। অনেক আত্মীয় আমাকে চেনেন না। অনেকে জানবার চেষ্টা করছিল ছেলেটি কে। কারণ সৌম্যদের বাড়িতে তারা আমাকে এই প্রথম দেখছে। অনেকে আবার সরাসরি আমাকে জিজ্ঞাসা করেছে। কানাঘুষ অনেক কথা ও শুনতে পাচ্ছি তবে গায়ে মাখছি না। মজাই পাচ্ছি। গায়ে হলুদ শুরু হলো সকাল সকাল। সৌম্যর গায়ে হলুদ হলে সেই হলুদ যাবে মেয়ের বাড়িতে। এখন আবার একটা চলতি রীতি উঠেছে সবাই গায়ে হলুদের সময় হলুদ শাড়ি পরবে। বেশ মজা করছিল সবাই। বর কে বসানো হয়েছে উঠনের ঠিক মাঝখানে। সৌম্যর এক বৌদি সৌম্যকে নিয়ে খুব মজা করছিল। ব্যাপারটা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছিলাম আমিও। পাড়া গায়ের বিয়ে। তারপর আবার পাড়ার প্রায় বেশিরভাগ পরিবারই আমন্ত্রিত। পাড়ার বয়স্ক মহিলারা জড়ো হয়েছেন। তারাও বেশ মজা করছিল। এটা কিন্তু একটা গ্রাম্য রীতির মধ্যে পড়ে অনেক সময় এমন অনেক কথা বলা হয় যা হয়তো খারাপ লাগতে পারে কিন্তু সেগুলোকে খারাপ ভাবে নিলে আপনি কষ্ট পাবেন। আর সোজাসাপ্টা ধরে নিলে মজাই পাবেন। আমিও বেশ উপভোগ করছিলাম মজা। উঠোনের এক কোনায় দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা পুরো দেখছিলাম আর আমার ফোনে ক্যামেরাবন্দি করছিলাম। হঠাৎ সেই বৌদি কোথা থেকে এসে আমার গায়ে হলুদ মাখিয়ে দিল।
কানে কানে বলল– সৌম্যর সঙ্গে তোমারটাও সেরে নিলাম। এবার সুমির পালা।
কথা শেষ হতে না হতেই দেখি সুমিও এসে হাজির। সেও হলুদ মাখিয়ে দিলে মুখে।
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বৌদি তার হাত থেকে কাঁচা হলুদ আমার হাতে দিয়ে বলল– ঠাকুর জামাই দেরি কেন তুমিও মাখিয়ে দাও একেবারেই গায়ে হলুদটা হয়েই যাক।
হঠাৎ সকলের দৃষ্টি সৌম্য থেকে সরে আমাদের দুজনের দিকে এসে পড়ল। এই প্রথম আমি লজ্জায় মুখ নামিয়ে নিলাম। আত্মীয়-স্বজনরা বিষয়টা জানতো না। তারা ঘটনার বিপরীত স্রোতে কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেল। আমি কেন সুমির মুখে হলুদ মাখিয়ে দিলাম। আর সুমি বা কেন আমার মুখে হলুদ মাখাল। বিষয়টা মজার মধ্যে ধরে নিলে মিতে যেতে পারতো কিন্তু এটা যে গ্রাম। দু একজন বলে উঠলো একসঙ্গে কি সুমির বিয়েটাও হয়ে যাবে। সুমির মাসি বিষয়টা জানতো তিনি আবার হঠাৎ উলুধ্বনি দিয়ে উঠলেন।
ব্যস শুরু হয়ে গেল সকলের উলুধ্বনিধনী হাসাহাসি।
সত্যি কথা বলতে তখন আমার একটু লজ্জা লাগছিল আমি এইসবের জন্য খুব একটা প্রস্তুত ছিলাম না। যাইহোক পরিস্থিতিটা সামাল দেবার জন্য আমি কথা বলতে বাধ্য হলাম। বললাম, আরে এটা কি রং খেলা নাকি যে যাকে তাকে রং লাগিয়ে দিলেই হল। সৌম্য ব্যাপারটা তাড়াতাড়ি শেষ কর তোর গায়ের হলুদ দিয়ে যেতে হবে কনের বাড়িতে মনে আছে তো।
মাসিমা বললেন – আরে তাড়াতাড়ি কর দেরি হয়ে যাচ্ছে যে।
যাইহোক সকাল বেলাটা কোনরকমেই সামাল দিলাম। জানি এই সময়টা সমাল দিতে পারলে আর কোন সমস্যা নেই। এরপর থেকে সবাই নতুন বরকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। আমি তখন নিশ্চিন্তে একটা ঘুম দেবো আমার ঘরে।
সন্ধ্যেবেলায় বরযাত্রী নিয়ে বেরোলাম। গ্রামের বিয়েতে এই প্রথম অংশগ্রহণ করছি। বেশ মজাই পাচ্ছিলাম। বন্ধুর বিয়ে বলে কথা। সেজেগুজে সবাই প্রস্তুত। সত্যি কথা বলতে সৌমিকে আজ ভীষণ সুন্দর লাগছিল। হালকা সবুজ রঙের একটা শাড়ি তার সঙ্গে ম্যাচিং করে পড়া ব্লাউজ। লম্বা চুল সুন্দর করে খোপা বাধা। তাতে জুঁই ফুলের মালা। আমি চোখ সরাতে পারছিলাম না। মাঝেমধ্যে দুজনের চোখাচোখি হয়ে যাচ্ছিল। আর আমাকে দেখে সে বারবার মুচকি হেসে চলে যাচ্ছে অন্যদিকে। যাইহোক বরের সঙ্গে সুমি এবং ওর আরো দুজন মাসতুতো আর খুড়তুতো বোন বসল গাড়িতে। আমি বসলাম সৌম্যর পাশে। আমি বাসে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু সৌম্য রাজী হয়নি। যাইহোক রওনা দিলাম।
বিয়েটাও বেশি ধুম ধাম করে কেটে গেল। পরের দিন নতুন বউ নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। দু তিনটে দিন বিয়ে বৌভাত এইসব নিয়ে কোথা থেকে যে কেটে গেল বুঝতে পারলাম না। বৌভাতের পরের দিন আমি সৌম্যকে বললাম - এবার আমায় ফিরতে হবে।
সৌম্য বলল- তোকে যেতে দিলে তো তুই যাবি। চুপচাপ ঘরে যা রেস্ট নে।
পিছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন মাসিমা আমি দেখতে পাইনি। আমার চলে যাবার কথা শুনে তিনি বললেন - এখানে কি খুব অসুবিধা হচ্ছে বাবা? তোমার তো পনেরো দিনের ছুটি নিয়ে আসার কথা। নাকি আমরা তোমাকে ঠিকমতো….
আমি ঘুরে দাঁড়ালাম। মাসিমার কথাগুলো কেমন যেন লাগলো আমার কাছে। আমি বললাম– এ কি কথা বলছেন? আমি কি সে কথা বলেছি একবারও। আসলে আমাকেও তো বাড়ি ফিরতে হবে। অনেকদিন হয়ে গেল।
মাসিমা বললেন– কোথায় অনেকদিন হয়ে গেল এই তো সবে সাত দিন হল।
আমি আর কথা বাড়ালাম না। বললাম –আচ্ছা, আর দুদিন না হয় থাকবো।
মাসিমা বললেন – সে দেখা যাবে। যাও নিচে যাও দেখো সুমি তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। নতুন বউকে নিয়ে যেও।
আমি সৌম্য এবং নতুন বৌদি নিচে গেলাম। সুমি আমাদের জন্য জলখাবার রেডি করে রেখেছে টেবিলে। নতুন বৌদি গিয়ে বসল সুমির কাছে। বলল– দিদিভাই তুমিও বসে পড়ো না, আমি না হয় পরিবেশন করি।
সুমি বলল – তা কি করে হয় বৌদি, তুমি নতুন। তোমাকে দিয়ে কাজ করালে আমার রক্ষা থাকবে। বস তোমরা তিনজন। আমি পরিবেশন করছি তারপর আমিও বসে পড়বো।
আত্মীয়-স্বজন প্রায় সকলেই বিদায় নিয়েছে দু-একজন যারা ছিল তারা আগেই খেয়ে নিয়েছে। এখন টেবিলে আমরা চারজন। খেতে খেতে গল্প করতে করতে অনেকটা সময় কাটালাম সেখানে। নতুন বৌদি বললে – আপনাদের বিয়েতে কবে আনন্দ করবো?
সুমি চট করে উত্তর দিল– বৌদি ভাই আমাকে তাড়িয়ে দিতে চাইছো।
নতুন বৌদি বিষয়টা সেভাবে বলতে চাইনি কিন্তু হঠাৎ এমন একটা কথা শুনে ঘাবড়ে গেল। তারপর আমতা আমতা করে বলল– তোমাকে তাড়িয়ে দেবো কেন ভাই। তোমাদের দুজনকে একসঙ্গে দেখলে আমার ভালো লাগবে তাই কথাটা বলেছিলাম। অন্যভাবে নিও না দিদিভাই। অন্যভাবে নিলে আমি কিন্তু দুঃখ পাবো।
বিষয়টা অন্যদিকে যেতে পারে ভেবে আমি বললাম– এইতো সবে বিয়ে খাওয়া-দাওয়া সারলাম হজমটা হোক। তারপর না হয় আরেকটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যাবে কি বলেন বৌদি ভাই।
সুমি বলল– আরে বৌদি ভাই অত মুখ গোমড়া করে বসে থাকার কিছু নেই। আমি কিছু মনে করিনি। আমি ইয়ার্কি করে তোমাকে কথাটা বললাম। আমি দাদাকে কথা দিয়েছিলাম দাদার বিয়ে দিয়ে আমি বিয়ে করবো। দাদার বিয়ে হয়ে গেছে। এবার বাবা-মা , দাদা যদি বলে আজকে বিদায় নিতে আমি আজকেই বিদায় নেব, আর যদি বলে থাকতে থাকবো আমার কর্তব্য শেষ।
সৌম্য বললো– এসব কথা বন্ধ করবি। তোকে কবে বিদায় দেবো সে আমি বুঝবো।
সুমি বলল –দেখা যাক কি হয়।
খাওয়া শেষ করে আমি আর সৌম্য বেরিয়ে পড়লাম বাইরে। কারণ তখনো কিছু কাজ বাকি ছিল। তারপর আবার অষ্টমঙ্গোলায় যেতে হবে সৌম্যকে। সেই সব বিষয়ে কিছু কেনাকাটার জন্য বেরিয়েছিলাম।
আজ বারো দিন হল এখানে আছি। এবার ফেরার পালা। মাঘ মাস শীত এখনও রয়েছে। রাতে নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিলাম ব্যাগে। তারপর যখন শুতে যাব ঠিক সেই সময় দরজার টোকা পড়লো। দুবার । বুঝলাম সৌমি।
দরজাটা খুলে দিলাম। আমার অনুমান একেবারেই ঠিক। দরজা খুলে দিতেই চট করে ঘরে ঢুকে গেল। তারপর আস্তে করে দরজাটা বন্ধ করে দিল। আমি বললাম, কি হলো হঠাৎ দরজা বন্ধ করলে যে।
সৌমি বলল, বারো দিন হলো একদিনও কি তোমার সাথে কথা বলতে পেরেছি। বিয়ে বাড়ির চাপে আসতে পারিনি। হয়তো তুমি অনেক মান অভিমান করে চলে যাচ্ছ। তাই ভাবলাম কিছুক্ষণের জন্য তোমার সঙ্গে কথা বলে আসি।
আমি বললাম– কে বলল যে আমি মান অভিমান করে চলে যাচ্ছি। বিয়ে বাড়ি সবাই ব্যস্ত। সেটুকু বুদ্ধি কি আমার নেই।
সৌমি বলল – জানি তবু এলাম। চলে যাব, নাকি বসতে বলবে।
আমি বললাম– তোমার বাড়িতে আমি বসতে বলবো।আচ্ছা এস।
আমি ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে এসে বসলাম আমার বিছানায়। তারপর তাকে টেনে নিলাম আমার খুব কাছে আর দুই গালে দুটি চুম্বন করে বললাম –খুশি তো।
সুমি লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে বলল –দুষ্টু !:আমি কি এই জন্য এসেছি।
আমি বললাম –যে জন্য এসে থাকো না কেন এটা তোমার প্রাপ্য।
সে বলল –’মনে রেখো মশাই, গায়ে হলুদ হয়ে গেছে। অন্য কোথাও যেন সরে পোড়ো না।
কথাটা বলেই নিজেই হাসতে লাগলো।
আমি বললাম– গায়ে হলুদ হয়ে গেছে বলেই অন্য কোথাও সরে পড়তে পারব না এ কথা কে বলল। ইচ্ছা থাকলেই সরে পড়া যায় কিন্তু ইচ্ছা থাকলেই তো তোমার মতন সুন্দরী কে ছেড়ে চলে যাওয়া যায় না। যাবে আমার সঙ্গে। তোমাকে ছাড়া আমি আর থাকতে পারবো বলে মনে হয় না।
সুমি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল– নিয়ে যাবে নিয়ে যাবে আমাকে? আমার আর একা থাকতে ভালো লাগছে না।
আমি বললাম –চলো আমরা ঘর বাঁধি।
সুমি বলল – তোমার সঙ্গে যেতে আমার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু বাবা মায়ের খুব ইচ্ছা জানো মেয়েকে ধুম ধাম করে বিয়ে দেবে তুমি আসবে। আমি সেজে বসে থাকবো। বিয়ে করে নিয়ে যাবে আমায়।
আমি বললাম বেশ তুমি তোমার বাবা মাকে বলো আমি আসবো।
আমার বুকে মাথা রেখে সে আবার বলল – দেরি করো না। তুমি যেদিন বলবে বাবা মা সেদিন রাজি হবে। কালকে বলো না একবার। আমি মেয়ে হয়ে কি বলতে পারি বল। তুমি না হয় দাদাকে বলতে পারো কথাটা।
আমি বললাম – বেশ কাল সকালেই না হয় আলোচনা করব।
সুমি – ছাড়ো এবার। যেতে হবে। না হলে মা খুঁজতে বেরোবে। তোমাকে আমাকে একসঙ্গে দেখলে হয়তো কিছু বলবেনা। কিন্তু তবু বাজে ভাবতে পারে।
বুকের মধ্যে আগুন জ্বেলে সৌমি অর্থাৎ সুমি বিদায় নিল। সারারাত ঘুম এলো না। না আসাতেই স্বাভাবিক। এক উন্মুক্ত যৌবনকে যেন জাগিয়ে দিয়ে গেল সৌমি।
পরের দিন সকাল বেলা খাবার টেবিলে বসেছি খেতে। আত্মীয়-স্বজনরা সকলেই চলে গেছে। সৌম্যকে বললাম তোর তো বিয়ে হয়ে গেল এবার তোর বোনেরটা ভাব।
সৌম্য হাসতে হাসতে বলল– সুমিতে এক পায়ে খাড়া, ডেটটা কে দেবে।
আমি বললাম– মেসোমশাই মাসিমাকে একবার জানা। তাদের সময় মতোই না হয়। তারপরে এই একটা বিয়ে এত খরচ আবার নতুন করে।
মেসোমশাই খেতে আসছিলেন। তিনি কথাটা বোধহয় শুনেছেন। বললেন – তা বাবা তুমি যেদিন চাইবে সেই দিনই আমি মেয়েকে তুলে দেবো তোমার হাতে। তুমি আজ চাইলে আজও দিতে পারি।
সুমি বলল –বাবা তুমি আমাকে এভাবে বিদায় করবে।
মেসোমশাই বললেন – এটাতো কথার কথা তুই কি ভাবলি আমি তোকে এই ভাবেই বিদায় করব। অর্পণ যেদিন চাইবে সেদিনই তোর বিয়ে হবে। আমার আর কিছু বলার নেই। ও যদি আজ চায় আজি অনুষ্ঠান করে আমি বিয়ে দেব।
সৌম্য বললো এখনো তো মাঘ মাস শেষ হয়নি মাসের শেষ দিকে না হয় একটা তারিখ খুঁজি।
আমি বললাম –বেশ আমাকে ফোনই জানিয়ে দিস।
নতুন বৌদি বলল– গায়ে হলুদ তো হয়েই গেছে শুনেছি। বাকি শুধু ছাতনা তলায় যাওয়া। সেটা যে কোনদিনই হতে পারে। অনুষ্ঠান হলে আমিও আবার একটু সেজেগুজে বসতে পারি দিদি ভাইয়ের পাশে।
আমি বললাম –’শুভস্য শীঘ্রম।
সকালে জল খাবার খাওয়া শেষে আর থাকা চলে না। কারণ আমার ট্রেনের সময় মত আমাকে বেরোতে হবে। সকলের থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সৌম্য তার বাইক নিয়ে আমাকে পৌঁছে দেবে স্টেশন।
যথারীতি বাইকে উঠতে যাব ঠিক সেই সময় দেখি সুমি এসে দাঁড়িয়েছে সেজেগুজে। সেও যাবে। তো যাই হোক বারন আর করা গেল না। তিনজন একটা বাইকে কোনো রকমের ঠাসাঠাসি করে বসে পড়লাম। গ্রামের সেই মেঠো পথ দিয়ে ছুটে চলল বাইক।
স্টেশনে বিদায় জানালাম দুজনকে। সুমি এসে আমার হাত ধরে আমার কানে কানে বলল – এই যে মশাই মনে রেখো গায়ে হলুদ হয়ে গেছে কিন্তু। এখন তুমি শুধু আমার।
আমি বললাম – আমি আবার অন্যের হলাম কবে।
সুমি হাসতে হাসতে বলল – ছেলেদের মন তো বোঝা ভারি মুশকিল। তুমি যদি অন্যের হয়েছ আমি ভূত হয়ে তোমার গলা টিপে দেবো। নীহারিকার কথা মনে আছে তো?
আমি বললাম – নীহারিকার কথা মনে থাকবে না আবার। সারা জীবন মনে থাকবে। এমন সত্যি ভূতের কাহিনী আমি জীবনে দেখিনি।
যখন আমি বিদায় নিচ্ছি সৌমি আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে আছে। চোখ থেকে দু ফোঁটা জল যেন ওর গাল বেয়ে পড়ল শাড়ির উপর।
আমি বললাম – সৌমি গায়ে হলুদ হয়ে গেছে আমি তোমারি।
সে একটু হাসলো। তারপর দুজন দুদিকে হাঁটা শুরু করলাম।
0 মন্তব্যসমূহ