তৃতীয় পর্ব
শীতের বিকেল দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হয়ে এলো। চারিদিকে একটা অন্ধকার যেন ঘনিয়ে আসতে লাগলো। অলোক অফিস থেকে বাড়ি ফিরেছে। বাড়ি ফাঁকা দেখে প্রথমে অবাক হল। তারপর উপরে গিয়ে দেখলে অভিষেক আপন মনে বই পড়ছে। ওকে জিজ্ঞাসা করল - হা রে তোর মা কোথায় ?
অভিষেক - জানিনা। খেলতে গিয়েছিলাম, বাড়ি এসে পড়তে বসেছি।
অলক নেমে এলো নিচে। তারপর হাত মুখ ধুয়ে জামা কাপড় ছেড়ে সোফায় গিয়ে বসে পড়ল। পারমিতা থাকলে চা আসতো। কোথায় যে গেল কে জানে? ভাবতে ভাবতে বাইরের বারান্দায় বেরিয়ে রাগে পায়চারি করতে লাগলো। রুপার মা বাড়ি ফিরছিল তখন। অলোক ডাক দিয়ে জিজ্ঞাসা করলে - ও মাসিমা, পারু কোথায় বলতে পারো।
রুপার মা - অলোক কে দেখে আছে এলো। তারপর সব কথা বলে একটা লম্বা বিবরণ দিল। অলকের এসব কাজ পছন্দ হয় না।
অলক রুপার মাকে দিয়ে খবর পাঠালো। পারমিতা যেন তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসে। তারপর আবার ঘরে ঢুকে ইজি চেয়ারে থাকা বই, যেটা পারমিতা পড়ছিল সেটা তুলে নিয়ে দেখতে লাগলো।
সুজাতার ছেলের তখন জ্ঞান ফিরেছে। কিন্তু ঘাড়ে আঘাত পাওয়ায় ঘাড় নাড়াতে পারছে না। ওকে ডাক্তার দেখাতে বললে সুজাতার হাতে লুকিয়ে একশ টাকার একটা নোট গুজে দিল। সন্ধ্যা হয়েছে। ঠান্ডা পড়েছে। গায়ে গরম জামা নেই, শুধু একটা চাদর। কাঁপতে কাঁপতে বাড়ি ফিরে এলো পারমিতা। ঘরে ঢোকার মুখে একবার দেখে নিল অলোক কে। পায়ের শব্দ শুনে অলোক ও চোখ তুলে দেখলো পারু ঘরে ঢুকেছে। পারমিতা সোজা রান্নাঘরে গিয়ে চা চাপিয়ে ঘর থেকে একটা গরম জামা চাপিয়ে দুই কাপ চা নিয়ে প্রবেশ করল ঘরে। একটা অলোকের দিকে এগিয়ে দিল। রোজকার মতো কাপটা তুলে নিয়ে অলোক বলল - আমি আগেও বলেছি, এসব আমার ভালো লাগেনা। তবু তুমি যাচ্ছ।
পারু - কোন সবের কথা বলছো?
অলোক চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল - এই যে, যার তার বাড়ি যাওয়া।
পারু - আমারি ছেলের বয়সী একটা ছেলে চোখের সামনে অসুস্থ হলে তাকে দেখতে যাব না ?
অলোক - বলেছি তো ওসব আমার ভালো লাগেনা।
পারমিতা - তোমার না লাগলেও আমার ভালো লাগে।
অলোক - তোমার ভালো লাগাটাই কি সব।
পারমিতা - অন্যায় তো করছি না।
অলোক - অন্যায়ের কথা তো আমি বলছি না। আমি বলছি এইভাবে যার তার বাড়ি যাওয়া, যার তার সঙ্গে কথা বলা ……………
কথা শেষ করার আগে পারমিতার রেগে বলে উঠল - তুমি কথা বলোনা বুঝি কারও সঙ্গে। আমি তো আর অন্যের সঙ্গে সিনেমা দেখতে যাচ্ছি না। যাচ্ছি প্রতিবেশীর সাহায্য করার জন্য। চেষ্টা করছি অসুস্থ কে সুস্থ করার।
কথাগুলো বলতে বলতে পারমিতার মুখ লাল হয়ে গেল।
অলোক - থাম পারু
পারমিতা- চোখ রাঙিয়ে ভয় দেখিয়ে লাভ হবে না। উপরে অভিষেক আছে ওকে খেতে দিয়ে আসি তারপর বাকি কথা শেষ করা যাবে।
বলেই হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল।
অলোক মুখে বই চাপা দিয়ে শুয়ে পড়লো। সময় এগিয়েছে। তারপর রাগ বেড়েছে কিন্তু কারো সাথে কোন কথা হয়নি। যেটুকু হয়েছে তা ইঙ্গিতের নামান্তর।
দিন যায় দূরত্ব বাড়তে থাকে দুজনের মধ্যে। কিন্তু প্রকাশ পায় না। কারণ অভিষেক ও বড় হচ্ছে। ওর মধ্যে একটা প্রভাব পড়তে পারে, এই ভেবে রাগ প্রকাশ করে না কেউ। কিন্তু পারমিতা আজও খুঁজে পায় না তার দোষটা কোথায়? পারমিতা তার সেবার মনোভাব ত্যাগ করতে পারে না, কারণ পাড়া প্রতিবেশীর স্নেহ ভালোবাসা যে তাকে অন্য এক জগতে নিয়ে যায়। পারমতা ভাবে তাহলে কি অন্য কারণে হয়তো হতে পারে? এই যে মেয়েটা কি…………?
আর ভেবে লাভ নেই। আর ভাবতেও পারছে না। কিছুদিন ধরে মনটা খুব খারাপ। সংসার জীবনের এক দুঃসহ জ্বালা তার বুকের মাঝে ঝড় তুলেছে। কি আর করা ভাগ্যে যা আছে তা তো ফলবেই। কোন কোন দিন বিকেলে পারমিতা তাই অভিষেককে নিয়ে বেড়িয়ে আসে কোন নদীর ধার থেকে। কখনো বিশাল আম বাগানে শেষ প্রান্তে অবস্থিত মাঠে যায়। নিরালায় তার ভালো লাগে। স্নেহ পাওয়ার আশায় ছলেটাও মায়ের সঙ্গে বেড়াতে যায়। বিকেল হলেই জামা কাপড় পরে তৈরি হয়। পারমিতা ওকে সঙ্গে করে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। বিকেলটা ভালো কাটে। কিন্তু সন্ধ্যায় নেমে আশে বিষন্নতা। আগের মত অলকের সঙ্গে বসে গল্প করতে করতে চা খাওয়া হয়না আর। অনেক মনোরম কথাও হয় না আগের দিনের মতো। কত কথা মনে পড়ে তার। তখন দুচোখ দিয়ে শ্রাবনের ধারা নেমে আসে। অলোক যৌবনের অনুকূল স্রোতে গা ভাসিয়ে চলার পথে ভুলে যেতে বসেছে নিজের বউ ছেলের কথা। হায়রে পুরুষের মন। কখন যে কি হয় তা সেই জানে। এই সব কথা চিন্তা করতে করতে কখন যে একটু হালকা ঘুমিয়ে পড়েছে বিছানায়, তা সে জানে না। বারবার দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল তার। তারপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত নটা বাজে। অবাক হয়ে গেল পারমিতা। কোনদিন তো অলোক এত রাতে বাড়ি ফেরেনা। সন্ধ্যে সাতটার মধ্যে বাড়ি ঢুকে পড়ে। যাক দরজাটা খুলে দিল পারমিতা।
দরজা টা খুলে পারমিতা জিজ্ঞাসা করল - এত রাত হল যে?
অলোক - কাজ ছিলো তাই।
পারু - রাতে তো আগে কাজ হতোনা।
অলোক - এখন হয়।
কথাটা বলে অলোক সোজা নিজের ঘরে ঢুকে পড়লো। পারমিতা দরজা বন্ধ করে অলোকের পিছু পিছু এলো ঘরে।
অলোক ব্যাগটা রেখে ঘুরতেই পারমিতাকে দেখে বলল - একি তুমি?
পারমিতা - অন্য কাউকে আশা করছিলে নাকি? হ্যাঁ আমি। অনেকদিন সহ্য করেছি। এখন প্রায়ই তুমি দেরি করে ফের। কিন্তু কেন? আগে তো দেরি হতো না।
অলোক উত্তর দেয় - আগে হতো না, এখন হচ্ছে। ভবিষ্যতেও হবে।
পারমিতা - জানতে পাইকি কি এর কারণ?
অলোক- কারণ তোমার না জানাই ভালো।
পারমিতা - না জানাই ভালো মানে? আমি তোমার স্ত্রী। আমি জানতে চাইবো না?
অলোক একটু বিরক্তি হয়ে বলল - বললাম তো, না না।
পারমিতা - একদিন নয়। দুই দিন নয়, দিনের পর দিন তোমার কথাবার্তা চালচলন যেন ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে। কিন্তু কেন আমি বুঝতে পারছি না। আর যেটুকু বুঝেছি তা তোমার মত লোকের পক্ষে শোভা পায় না।
অলোক - জানি না তুমি কি বলতে চাইছো।
পারমিতা - জানবে কি করে? তুমি যে বুঝতে চেষ্টা করবে, সেটা আমি ভাবি না। আগুন নিয়ে খেলা করছে কর কিন্তু সাবধান এই আগুনে একদিন তোমাকে পড়তে হবে। তখন আফসোস করতে হবে।
কথাগুলো শেষ করে দ্রুত বেরিয়ে এলো পারমিতা। এমনি কথা কাটাকাটির খেলা চলছে। পারমিতা ধৈর্যশীললা তাই সবকিছুকে মুখ বুজে সহ্য করতে পারে এবং সহ্য করছে।
অফিসের দোতলার বারান্দায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে অলোক অপেক্ষা করছে ছন্দার জন্য। একটু পরেই ছন্দা বেরিয়ে এলো। বেলা তখন দুটো হবে। শনিবার অফিস ছুটি হয়ে গেছে। দুজনে দুজনার হাত ধরে নেমে এলো নিচে। তারপর পার্কের রাস্তা ধরে তারা। পার্কে এসে নিরিবিলি জায়গায় একটা বেঞ্চে বসলো দুজন। বাদাম ভাজা খেতে খেতে নানান গল্পে বয়ে যেতে থাকে বেলা। এই অবেলায় এক বিবাহিত পুরুষের সঙ্গে অবিবাহিতা ছন্দারকে বেমানান লাগছিল না। পারিপার্শ্বিক পরিবেশ তাদের পৌঁছে দিয়েছে এক অভূতপূর্ব প্রেমের জগতে। যৌবনের চূড়ান্ত সীমায় দাঁড়িয়ে নির্ভয়ে নিজের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ছন্দা অলোকের দিকে।
আর অলোক তার যৌবনকে গ্রহণ করার জন্য আবেগে ধরেছে তার হাত। শুরু হয়েছে এক অবৈধ প্রেম। যার শুরু আছে কিন্তু শেষ আছে কিনা তা কেউ জানে না। গল্প করতে করতে বেলা পড়ে এসেছে। পড়ন্ত বেলার বাঁকা রোদ এসে পড়েছে ছন্দার মুখে। আর চকচক করছে তার আবেগ মথিত হাসিময় মুখখানি। ছন্দা সুন্দরী। হয়তো সেই কারণে প্রেমের আবেগে ভেসে যেতে অলোকের সময় লাগেনি। অফিসে তাদের নিয়ে নানান কানাঘুস হয়। সেটা জানে দুজনেই। পাত্তা দেয়না। নব প্রেমের জোয়ারে ভাস্তে থাকে তারা।
অলোক বলল - চলো বাড়ি ফিরে যাই। বেলা পড়ে গেছে।
ছন্দা - কেন কোথায় যাবে বাড়ি গিয়ে? আরে একটু বোসো না।
অলোক উত্তর দেয় - বেশ বসলাম।
ছন্দা অলোকের কোলে মাথা রেখে বলে - কালকে ছুটির দিন, চল না দূরে কোথায় ঘুরে আসি?
অলোক - দূরে বলতে কোথায় যাবে?
ছন্দা - এই ধরো তারাপীঠ বা অন্য কোথাও
অলক - মন্দ হয় না কিন্তু।
ছন্দা - তাহলে কখন বেরোবে?
অলোক - তুমি ঠিক করো। কোথায় যাবে?
ছন্দা - তারাপীঠ?
অলোক - তোমার সমস্যা নেই তো?
ছন্দা - না।
অলোক - বেশ। সকালের ট্রেন ধরতে হবে।
ছন্দা - খুব সকালে যেতে হবে।
অলোক - ঠিক আছে তাহলে আমি সকাল ছটায় ষ্টেশনে দাঁড়াচ্ছি।
ছন্দা - আমার জন্য কোন চিন্তা করতে হবে না। চলো এবার উঠি।
দুজনে আবার হাত ধরা ধরি করে ফেরার পথ ধরলো ।
0 মন্তব্যসমূহ