রাতের অতিথি
অতনু সরকার
ভ্রমণপিপাসু মন যখন প্রকৃতির টানে ছুটে বেড়ায় তখন শরীরটা বাড়িতে থাকতে চায় না। শরীর ও মনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটতে চায়।শরীর যদিও কখনো কখনো ক্লান্ত হয়ে পড়ে কিন্তু মন ক্লান্ত হয় না। মন ছুটে চলে নতুন নতুন জায়গা আর নতুন সৌন্দর্যের খোঁজে। আবার বেরিয়ে পড়লাম ভ্রমণের উদ্দেশ্যে। দক্ষিণ ভারত সম্পর্কে শুনেছিলাম আমার এক বন্ধুর কাছে। সেই বন্ধুকে ফোন করলাম। দক্ষিণ ভারতের কোন কোন জায়গায় ঘোরা যায় সেই বিষয়ে কথা বলার জন্য। অনেকক্ষণ কথা বললাম ওর সঙ্গে। তারপর ও নিজেই জানালো ওর বাড়িতে যাওয়ার জন্য। আমি গেলে আমার সঙ্গে ওরও ঘোরা হয়ে যাবে। তাছাড়া হোটেল খরচ লাগবে না। যদিও হোটেল বা খাওয়া খরচ নিয়ে চিন্তা করলে ভ্রমণ করা যায় না। আর আমি কখনো সেসব চিন্তা করিও না। হয়তো ওর বাড়িতে একদিন বা দুদিন থাকতে পারি, তারপর কোন একটা হোটেল দেখে নেব। কর্মসূত্রে ও রয়েছে চেন্নাইতে। কিন্তু ওর বাড়ি তামিলনাড়ুর প্রান্তিক একটা গ্রাম মালাই পুরমে। চেন্নাই থেকে ও আমার সঙ্গে যাবে, এমনই একটা পরিকল্পনা তৈরি হল। হাওড়া থেকে কন্যাকুমারী এক্সপ্রেস ধরলাম। যথারীতি চেন্নাই থেকে ট্রেনে উঠলো আমার বন্ধু এন্টনি রমেশ। তামিলনাড়ুর বহু জায়গা রয়েছে ভ্রমণ করার। কোথাও পাহাড়-পর্বত সমতল আবার কোথাও রয়েছে বিরাট বিস্তৃত সমুদ্র সৈকত। বৈচিত্র্যময় একটা রাজ্য। বৈচিত্র্যময় ভাষা আর এখানকার সংস্কৃতি । প্রাচীন ভাষা গোষ্ঠীর মধ্যে তামিল ভাষা একটা স্বতন্ত্রতা নিয়ে আজও অবস্থান করছে। ফলে খুব সহজে এই ভাষাকে আয়ত্ত করা যায় না। তাই আমার একমাত্র মাধ্যম হলো ইংরাজি। রমেশের সঙ্গে আমি এসে পৌঁছালাম মালাইপুরাম গ্রামে। গ্রাম বলতে যা বোঝায় আসলে সেটা নয়। শহরের একটা প্রান্তিক জায়গা। মূল শহর থেকে একটু দূরে। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে শ্রীনগর কন্যাকুমারী হাইওয়ে। ভারতের দীর্ঘতম হাইওয়ের মধ্যে অন্যতম। ঠিক তার পাশে দিয়ে একটা রাস্তা ডানদিকে নেমে গেছে। কিছুটা নেমে গিয়ে আবার একটা পাহাড়ের উপর উঠতে হবে। এই পাহাড়ের উপরে রয়েছে একটা ছোট্ট জনবসতি। পাহাড়ের উপর থেকে দূরে শহরটা স্পষ্ট দেখা যায়। রয়েছে হসপিটাল, বড় স্কুল আর সবুজ প্রকৃতি। পাহাড়টা কিন্তু বিরাট বড় নয়। একটা টেবিলের মতন বিস্তৃত ভূখণ্ড। তার উপরে রয়েছে একটা চার্চ। পাহাড়ে নিচের দিকে রয়েছে একটা মসজিদ আর পাহাড়ের অপর প্রান্তে রয়েছে দু-চারটে মন্দির। এখানে পাহাড় মানে তার উপরে থাকবে শিব মন্দির। এটি তার ব্যতিক্রম নয়। সর্ব ধর্মের সমন্বয় রয়েছে এখানে। পাহাড়ের গায়ে খুব সুন্দর ভাবে তৈরি হয়েছে বেশ কতগুলো বাড়ি তার মধ্যে কিছু রয়েছে দোতালা। কোথাও বা নীল রঙের বাড়ি কোনটা হলুদ কোনটা আবার টালি দিয়ে ছাওয়া। অপূর্ব সমন্বয় রয়েছে এখানে। পাহাড়ের উপর থেকে দেখলে বাড়িগুলোকে মনে হবে নিচের দিকে রয়েছে। পাহাড়ের উপর থেকে বাড়ির ছাদে সহজে পৌঁছানো যায়। আবার নিচের দিক থেকে দোতলা বা তিন তলা মনে হয়। এই মালাইপুরমের প্রায় মাঝামাঝি চারিদিকে গাছপালা দিয়ে ঘেরা প্রায় তিন বিঘা জমির উপর রয়েছে অ্যান্টোনিদের বাড়ি। বাড়িটা বিরাট নয় তবে সুন্দরভাবে সাজানো গোছানো। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন একটা বাড়ি। দোতলাটা টালি দিয়ে ছাওয়া। গরমের সময় এখানে বেশ গরম পড়ে তাই টালির নিচে সিলিং বসিয়ে এসির ব্যবস্থা আছে। আমার জন্য একটা ঘর বরাদ্দ করে দিল সে। পরিচিত হলাম ওর বাড়ির সকলের সঙ্গে কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় রমেশ এবং তার বোন ছাড়া কেউই ইংরেজি জানে না। তাই তাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য আমার মাধ্যম প্রয়োজন হবে। যদিও এই বাড়িতে থাকার জন্য আমি আসিনি। দুদিন পর আমি হয়তো চলে যাব অন্য কোথাও। এখান থেকে কাছাকাছি পালানি বলে একটা জায়গা রয়েছে সেখানে রয়েছে মুরুগান মন্দির। রমেশের সঙ্গে যখন ওদের বাড়ির চারপাশটা ঘুরে দেখছিলাম তখন দেখলাম পাহাড়ের একেবারে শেষ প্রান্তে যেখান থেকে পাহাড়টা সরাসরি খাড়া নেমে এসেছে টেবিলের মতন। ঠিক সেইখানে দুটো ঘর। চারিদিকে বড় বড় গাছপালা। সুন্দর ফুলের বাগান। বড় একটা গাছের নিচে ঘর দুটো। আশা করি সূর্যের আলো এই ঘরে খুব একটা প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। আমি রমেশকে জিজ্ঞাসা করলাম - এই ঘরটি কাদের?
রমেশ বলল– আমাদের ঘর। আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধু-বান্ধবদের সমাগম হলে এই ঘরেই তারা আসে আনন্দ করার জন্য। অনেক সময় গরমের থেকে বাঁচার জন্য এখানে এসে থাকে সে।
আমি বললাম –ভাই রমেশ এই ঘরটি কি আমার জন্য ব্যবস্থা করা যায় না?
সে বললো –একা একা এখানে থাকতে কি তোর ভালো লাগবে।
আমি বললাম –খুব ভালো লাগবে। এই ঘরের জানালা থেকে পাহাড়ে নিচের গ্রামটা যেমন সুন্দর দেখা যাবে, তেমনি এই গাছ তলায় বসে রাতের আকাশটাও উপভোগ করা যাবে।
রমেশ বললো – আমার কোন আপত্তি নেই। এখানে শোবার ব্যবস্থা আছে। মাঝেমধ্যে আমি এখানে এসে থাকি। তুই যদি এখানে থাকতে চাস তাহলে আমাদের কোন সমস্যা হবে না।
আমি বললাম –বাড়িতে থাকার থেকে এখানে দুদিন রাত কাটানো বেশ উপযোগী হবে বলে মনে হয়।
রমেশ বলল – বেশ তাহলে আমি এখানে সমস্ত ব্যবস্থা করে দেব কিন্তু খেতে যেতে হবে বাড়িতে।
আমি বললাম – যেতে অসুবিধা নেই। খেয়ে দেয়ে আবার চলে আসবে এখানে।
মনে মনে ভাবলাম বাড়িতে ওর অনেক লোকজন। সেইসঙ্গে রয়েছে ওর যুবতী বোন? কে কি ভাববে তার থেকে বরং এই শেষ প্রান্তে নিঝুম নিরালায় এই ঘরটা বেশ উপযোগী হবে আমার কাছে। দেয়ালটা সাদা রং করা। জানলা গুলো সবুজ। অদ্ভুত একটা রঙের মিশ্রণ। সে যাই হোক ভেতরটা কিন্তু বেশ বড়? অনেকগুলো জানালা রয়েছে।
রমেশ বলল – রাতের বেলা জানালা খোলা যাবে না কারণ এখানে পাহাড়ি পশু বা সাপের উৎপাত আছে। সেই জন্য রাতের বেলা জানালা না খুলে রাখাই ভালো।
সন্ধ্যেবেলায় খাওয়া-দাওয়া শেষ করে চলে এলাম এই ঘরটায়। আমার বরাবরই একটু তাড়াতাড়ি খাওয়ার অভ্যাস। তাই সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে রাতের খাওয়া শেষ করে চলে এসেছি এখানে। সঙ্গে নিয়ে এসেছি আমার লাগেজ ব্যাগ। দুদিন এখানে সংসার পেতে থাকতে হবে আমাকে। সত্যি বলতে কি আজ আকাশটা পরিষ্কার। সাঁঝ তারা উঠেছে পূর্ণিমার চাঁদের ঠিক নিচে। বড় গাছটার ফাঁক দিয়ে পূর্ণিমার চাঁদের আলো এসে পড়েছে এই ঘরের উপর। চারিদিকে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর এক অদ্ভুত নীরবতা। একটা মায়াবী পরিবেশ তৈরি করেছে।
রমেশ বলল – তাড়াতাড়ি শুয়ে পরিস। কাল সকালে আমরা পালানি যাব।
কিছুক্ষণ গল্প পর রমেশ বিদায় নিল। আমি আমার মত করে গুছিয়ে নিলাম ঘরটা? বিছানাটা গুছিয়ে নিয়ে জানালা টা খুলে দিলাম। সাপের ভয় ছিল বটে কিন্তু জানালা খুলে দিতেই দক্ষিণ দিক থেকে হু হু করে বাতাস এসে ঢুকলো ঘরে। সেই বাতাসে ঘরের ভিতরে থাকা গন্ধগুলো উড়িয়ে নিয়ে গেল উত্তরের একটা জানালা দিয়ে। উত্তর দিকে জানলা দিয়ে তাকালে পাহাড়ের ঠিক নিচে জনবসতি টাকে দেখা যায়? অন্ধকারে খুব ভালো দেখা না গেলেও বাড়িতে যে আলো জ্বলছে মনে হচ্ছে যেন জোৎস্নার মতন ফুটে রয়েছে ঘরের আলোগুলো। বাইরে এসে দাঁড়ালাম। গাছের তলায় অনেকগুলো বসার জায়গা পাথর কেটে বানানো। অর্থাৎ প্রাকৃতিক বসার জায়গা। বসলাম সেখানে। এক অদ্ভুত শান্তি বিরাজ করছিল মন জুড়ে। বসে বসে যখন এই রাতটা উপভোগ করছিলাম তখনই একটা নারী কন্ঠে বুকটা কেঁপে উঠল। বুকের ভেতরটা তখনো ধুপ ধুপ করছিল। দেখলাম একটা যুবতী মেয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে আমার দিকে আর বলছে – আপনি বাইরে একা বসে আছেন কেন?
আমি বললাম –কে আপনি? এত রাতে এখানে?
সে বলল –রাত কোথায়? এখন তো সবে নটা বাজে।
আমি বললাম –তবুও এই রাতে একা আপনি এখানে কি ব্যাপার?
তাকে এখানে আসতে দেখে যতনা চমকেছি তার থেকেও বেশি চমকেছি তার উত্তর শুনে।
সে বলল –’আপনার সঙ্গে গল্প করতে এসেছি।
আপনাদের মনে হতে পারে সে কি বাংলায় কথা বলছিল? না ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে কথা বলছিলাম দুজনেই। কারণ আমি যে খুব ভালো ইংরেজি বলতে পারি তেমনটা নয়। সুবিধার্থে বাংলায় লিখলাম যাতে আপনাদের আমার এই খারাপ ইংরেজি শুনতে না হয়।
ঘনায়মান অন্ধকারে প্রথমে তাকে খুব একটা বুঝতে পারিনি যখন কাছে এলো তখন দেখে বুঝলাম সে রমেশের বোন।
আমি বললাম –আপনি এখানে এত রাতে বাড়ির লোক জানতে পারলে খারাপ ভাববে আপনি ফিরে যান।
সে বলল – ভয় নেই। আমি যে এসেছি কেউ জানে না। আপনি না বললে কেউ জানতেও পারবেনা। আশা করি আপনি আমার দাদাকে আমার আসার কথা বলবেন না।
আমি বললাম – সে না হয় বলবো না কিন্তু এই রাতেই আপনি এখানে থাকাটা কি ঠিক হবে?
সে উত্তর দিল– দিনের বেলায় আমি সময় পাইনা। তাই রাতেই এলাম। আমার গল্প করার কেউ নেই। আমার কথা শোনার কেউ নেই। তাই ভাবলাম আপনি একা আছেন, আপনার সঙ্গে না হয় একটু কথা বলাই যাক।
আমি বললাম –এই রাতে যদি হঠাৎ আপনার দাদা এসে পড়ে তাহলে খুব বাজে ব্যাপার হবে।
সে বলল – দাদা ঘুমিয়ে পড়েছে, বাড়ির সকলেই ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই এখানে আর কেউ আসবে না। আমি কি বসতে পারি আপনার এখানে?
আমি কি বলবো ঠিক ভেবে উঠতে পারলাম না। বললাম – বসো।
সে বসলো আমার সামনের একটা পাথরের উপর। দেখলাম তাকে। চাঁদের আলো এসে পড়েছে তার গায়ের উপর। শ্যামলা বরন শরীর, গোলগাল খুব মিষ্টি একটা চেহারা, খুব মোটা বলা চলে না আবার রোগাও বলা চলে না। শ্যামলা বরণ হলেও মুখের মধ্যে একটা সৌন্দর্য রয়েছে। প্রাচীন তামিল মন্দিরগুলি যেমন কারুকার্য শোভিত তেমনি এই মেয়েটির মুখটাও মনে হয় কারুকার্য করা। লম্বা নাক, টানা টানা দুটি চোখ। কালো চুল পিঠ ছাপিয়ে এসে পড়েছে কোমরের উপর। সুন্দরী বলা চলে। আমাদের কাছে সুন্দরী বলতে ফর্সা গায়ের রং কেই বোঝায়। কিন্তু সুন্দরের ব্যাখ্যা অন্যরকম। আপনার চোখে বা আপনার কাছে কেমন লাগছে সেটা নির্ভর করবে আপনার আপেক্ষিক ব্যক্তিগত মতামতের উপর। সৌন্দর্য বিষয়টাই একটা আপেক্ষিক। কখন কার চোখে কোনটা ভালো লাগে তা আগে থেকে বলা শক্ত। আর মানুষের রূপ হল এমন একটা বিষয় যে আমার ভালো না লাগলেও আপনার হয়তো ভালো লাগতে পারে বা আপনার যেটা ভালো লাগছে না সেটা হয়তো আমার ভালো লাগছে। মনে মনে ভাবছিলাম এসব কথা।
মেয়েটি বলল –কি ভাবছেন এত?
আমি বললাম –আপনাকে দেখছি আর ভাবছি …
মেয়েটি বলল – কি ভাবছেন?
আমি বললাম –ভাবছি সুন্দর কত রকমের হতে পারে ।
মেয়েটি বলল –আমাকে দেখে কি সুন্দরী মনে হয় আপনার?
আমি বললাম –সৌন্দর্য যেখানে থাকে তাকে সুন্দরী বলতে আপত্তি কোথায় !
মেয়েটি হেসে উঠলো । সেই হাসি গাছপালা আর রাতের অন্ধকারে নীরবতা ভেদ করে ঠিক কতদূর পৌঁছালো আন্দাজ করতে পারি না।
আমি বললাম – আপনার নাম তো মেরি তাইনা।
সে বলল– না।
আমি –কিন্তু আপনি যে তখন বলেছিলেন আপনার নাম মেরি!
সে বলল –আমার নাম স্টেলা। মেরি আমার যমজ বোন।
আমি একটু অবাক হলাম। তাহলে রমেশ যে বলেছিল ওর একটাই বোন।
স্টেলা বলল –আমাকে আপনি দেখেননি। আগে যাকে দেখেছেন সে আমার বোন। আমরা দুজন একই রকম দেখতে জমজ। আমি খুব একটা বাইরে আসিনা। তাছাড়া আপনি যখন এসেছিলেন তখন আমি ছিলাম না। তাই আপনার সঙ্গে পরিচয় হয়ে ওঠেনি। আপনি ভাবছেন আমি মেরি, তাই না। না মশাই আমার নাম স্টেলা।
আমি আবারো অবাক হলাম। দিনের বেলায় যাকে দেখেছি তার সঙ্গে এর খুব একটা অমিল্ নেই। তবে দিনের বেলায় লজ্জায় হয়তো খুব একটা মুখের দিকে তাকানোর সুযোগ ঘটেনি।
কাছাকাছি একদল শিয়াল হঠাৎ ডেকে উঠল। এত কাছ থেকে ডাকছিল যে বুকটা আবার কেঁপে উঠল।
স্টেলা বলল – আসুন ঘরে গিয়ে বসি। এখানে থাকাটা ঠিক হবে না। রাতের বেলা বাইরে না থাকাই ভালো। মাঝে মাঝে বন্য পশুরা এসে পড়ে। তার থেকে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়াই ভালো। আসুন ঘরে গিয়ে বসি।
দুইজন ঘরে ঢুকলাম। ঘরে ঢুকে সে সঙ্গে সঙ্গে জানালা আর দরজা গুলো বন্ধ করে দিল
আমি বললাম –কি হলো? সব বন্ধ করে দিচ্ছেন কেন?
সে বলল– জানালা দরজা বন্ধ না করে দিলে বাইরের সাপ ঘরে ঢুকতে পারে। এখানে সাপের বড় উৎপাত। পাহাড়ি এলাকা বুঝলেন না। মাঝেমধ্যেই ঢুকে পড়ে ঘরে। কেন দাদা বলেনি আপনাকে জানারা বন্ধ করে রাখতে।
আমি বললাম –সে তো বলেছে, কিন্তু বাইরের হাওয়াটা বেশ ভালো লাগছিল। তাছাড়া ঘরের মধ্যে একটা গুমোট গন্ধ হয়েছিল গন্ধটা কেটে গেছে এখন।
সে এসে বসলো বিছানার উপর। আমাকে বলল শুয়ে পড়ুন। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি ঘুমিয়ে পরলে আমি চলে যাব।
আমি- কি দরকার এসবের। আপনি বরং ফিরে যান শুয়ে পড়ুন।
সে বলল– আপনার ঘুম আসবে না। এখানে একা থাকতে আপনার নিশ্চয়ই ভয় করবে। আপনি শুয়ে পড়ুন। আপনি ঘুমিয়ে পড়লে আমি ঠিক চলে যাব।
সারাদিনের ক্লান্তিতে সত্যি সত্যি চোখটা বুঝে আসছিল। শুয়ে পড়লাম। আমার মাথার কাছে এসে বসলো সে। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল –আমাকে আপনার ভালো লাগে?
আমি কোন উত্তর দিতে পারলাম না। কারণ একদিনের একটুখানি কথাতে ভালো লাগে কি লাগে না সে কথার উত্তর দেওয়া কঠিন। তাছাড়া এই ভালো লাগালাগির বিষয়ে মতামত দিতে আমার খুব একটা ভালো লাগে না। আমি একজন যাযাবর মানুষ। কোথায় কখন থাকি কি করি আমি নিজেও জানিনা। তাই কাউকে ভালোলাগার কথা মাথাতেও খুব একটা আনার চেষ্টা করি না।
সে আবার বলল –কি ভাবছেন?
আমি বললাম –আপনিতো সুন্দরী ভালো লাগবে না কেন। কিন্তু সেই ভালোলাগা দিয়ে আপনি কি করবেন ?
সে বলল –মানুষকে ভালবাসতে আমার খুব ইচ্ছা করে জানেন। আমার খুব ইচ্ছা ছিল আমার একজন মনের মানুষ থাকবে। তাকে বিয়ে করবো, ঘর সংসার করবো।
আমি বললাম –করলেন না কেন? আপত্তি কোথায়?
সে উত্তর দিল –সুযোগ হলো না।
আমি বললাম– কেন? সুযোগ হলো না কেন? এখনো তো সুযোগ আছে।
সে হাসতে হাসতে বলল –সুযোগ আর নেই তাই আপনার কাছে এসেছি। আপনাকে দেখে আমার খুব ভালো লেগেছে জানেন। একটা রাতের জন্য আপনার সঙ্গে থাকতে চাই।
আমি আকাশ থেকে পড়লাম। এ আবার কেমন কথা। একটা রাতের জন্য আমার সাথে থাকতে চাই মানেটা কি? বিষয়টা অন্যদিকে নিয়ে যাচ্ছে। তাই আমি বললাম– দয়া করে আপনি ফিরে যান। আপনি এখানে থাকলে আমার ঘুম হবে না।
সে বলল– তাড়িয়ে দিচ্ছেন আমাকে? আমি যদি না যাই আপনি কি জোর করবেন?
কি যে বিপদে পড়লাম কে জানে? ঘরের মধ্যে একটা যুবতী। সে থাকতে চায় আমার সঙ্গে। বন্ধুর বোন। তার সঙ্গে রাত কাটানো কত বড় অন্যায়। সে আমি জানি। আর রাত কাটাবোই বা কেন? সে তো আমার প্রেমিকা বা নয় বন্ধু নয়।
স্টেলা বলল – কি ভাবছেন? কেমন মেয়ে রে বাবা একটা পুরুষের সঙ্গে রাত কাটাতে চায় তাই না? আমি সত্যি সত্যি চাই। দাদা ছাড়া আপনি প্রথম পুরুষ যে প্রথম এখানে এলেন। তাই আপনার সঙ্গে থাকতে চাই একটা রাত।
মেয়েটির এই ব্যবহারে আমি যথেষ্টই ক্ষুন্ন হয়েছি। কারণ বন্ধুর বোনের কাছ থেকে এমন আচরণ আমি কখনোই আশা করিনি। আমি এমন প্রকৃতির নয় যে যুবতী দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়বো। নিজের মান-সম্মান কিভাবে বজায় রাখতে হয় সে আমি জানি।
সে বলল – কি ভাবছেন এত? চুপচাপ শুয়ে চোখ বুজুন।
কথাটা ধমকের মতো লাগলো আমার কাছে। কিন্তু উপায় না দেখে চোখ বুঝলাম। ঘুমের ভান করে পড়ে থাকি। দেখি কি হয়।
চোখ বুজে পড়ে আছি। মাথায় অনুভব করছি একটা শীতল হাত চুলের ভিতর অনবরত বিলি কেটে চলেছে। প্রচন্ড ক্লান্ত ছিলাম। দীর্ঘ ট্রেন যাত্রা প্রায় চল্লিশ ঘন্টা ট্রেন যাত্রা। তারপর বিছানায় এই মনস্তাত্ত্বিক লড়াই।সব কিছু মিলিয়ে এতটাই ক্লান্ত ছিলাম যে ঘুম আসতে খুব একটা সময় লাগলো না। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি বলতে পারবো না। বরাবরই আমার অভ্যাস রাতের দিকে একবার টয়লেটে যাওয়া। টয়লেটে যাওয়ার জন্য যখন উঠতে যাব ঠিক সেই সময় অনুভব করলাম আমার বুকের উপরে কে যেন শুয়ে রয়েছে। চোখ খুলে দেখলাম স্টেলা তার শরীরটা এলিয়ে দিয়েছে আমার গায়ের উপর। পুরোপুরি আমার শরীরের উপর মেলে দিয়েছে তার যৌবন। কোনরকমে তাকে সরাতে যাব এমন সময় উঠে বসলো সে।
বলল –একি ঘুম ভেঙে গেল নাকি। কিছু মনে করবেন না আমিও ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
আমি বললাম –আপনি এখনো যাননি।
ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলাম রাত তখন তিনটে বাজে।
বললাম –ফিরে যান, রাত তিনটে বাজে।
সে বলল– সময় মত ফিরে যাব চিন্তা করতে হবে না।
আমি রেস্টরুম থেকে ফিরে এলাম। আবার শুয়ে পড়লাম। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল। কিছুক্ষণ পর অনুভব করলাম সে আবার আমার বুকে মাথা রেখে শুয়ে পড়েছে। আমি আবার কখন ঘুমিয়ে পড়েছি বলতে পারবোনা। ভোরবেলা যখন ঘুম ভাঙলো তখন দেখলাম কেউ নেই ঘরে। হ্যাপ ছেড়ে বাঁচলাম।
কিন্তু একটু সকাল হতেই যখন ঘরের দরজা খুলে বাইরে বেরোতে যাব তখন দেখলাম দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। তাহলে স্টেলা গেল কোথায়। সেকি রেস্ট রুমের মধ্যে রয়েছে? কয়েকবার ডাকলাম তার নাম ধরে। কিন্তু রেস্ট রুমের দরজা তো আলগা। আস্তে করে টোকা দিলাম দরজাটা খুলে গেল। ভিতরে কেউ নেই। সে যদি চলে যায় তাহলে দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ করল কে? আমি কি বন্ধ করেছিলাম ঘুম চোখে? কিছু মনে করতে পারছিনা।
ভাবতে ভাবতে দরজাটা খুলে বাইরে এসে দাঁড়ালাম পূব দিকের আকাশ তখন আবির রঙে রাঙা। পুরো আকাশ জুড়ে আবির রং ছড়িয়ে দিয়েছে যেন কে।
সেই সুন্দর দৃশ্য যখন মোবাইল বন্দী করছিলাম তখন রমেশ এল।
সে বলল– বন্ধু ঘুম কেমন হলো?
আমি বললাম –ঘুম তো ভালোই হয়েছে।
সে বলল –চল তাড়াতাড়ি গুছিয়ে নে। আমরা পালানি যাব মরুগান মন্দিরে।
আমি তাড়াতাড়ি গুছিয়ে নেবার চেষ্টা করছি। গুছাতে গুছাতে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম– স্টেলা কে?
হঠাৎ রমেশ গম্ভীর হয়ে গেল। সে বলল– কেন?
আমি বললাম – বলনা।
সে বলল– তুই কিভাবে জানলি তার নাম। মেরি বলেছে।
আমি মিথ্যে করে বললাম –হ্যাঁ মেরির কাছে শুনছিলাম।
রমেশ বলল– এক বছর হলো মারা গেছে। খুব ভালো মেয়ে ছিল রে। ওর জন্য বিয়ে ঠিক হয়েছিল। বিয়ের এক মাস আগে মারা গেল।
আমি রমেশের মুখের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার মুখে কোন শব্দই আর আসছিল না।
রমেশ– কি হলো? অমন করে তাকিয়ে আছিস যে।
আমি বললাম –গতকাল রাতে এসেছিল।
রমেশ বলল –কে এসেছিল স্টেলা? কিন্তু সে তো মারা গেছে এক বছর হল। তুই কি পাগল হয়ে গেলি নাকি? কেমন দেখতে ছিল রে।
আমি কিছু বলতে পারলাম না। হঠাৎ মাথাটা ঘুরে পড়ে গেলাম। তারপর যখন জ্ঞান ফিরলো তখন দেখলাম শুয়ে আছি রমেশদের বাড়িতে।
সেদিনই ওদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। এমন অদ্ভুত ঘটনা জীবনে যে ঘটবে আশা করিনি কখনো। রাতের এমন অতিথি আর কখনো আমি চাইনা।
0 মন্তব্যসমূহ