তান্ত্রিক দাদুর সত্যি ভূত
অতনু সরকার
দাদু বাড়িতে আসা মানে আমাদের মজার আর শেষ থাকে না। সন্ধ্যে বেলায় যখন দাদু কে ঘিরে বসলাম তখন আকাশে ঘন কালো মেঘ করেছে। জানালার পাল্লা দুটো দমকা বাতাসে দুলতে লাগলো। হঠাৎ করে ঝম ঝম করে বৃষ্টি নেমে এলো। আমাদের আর তর সইছিলো না। আমি বললাম দাদু শুরু করো। আজ কিন্তু একটা যবরদস্ত গল্প হওয়া চাই। দাদু মুখে একটা পান ঢুকিয়ে গল্প বলা শুরু করল। আর আমরা চুপ করে শুনতে থাকলাম। বৃষ্টির শব্দের মাঝে দাদুর গম্ভীর কণ্ঠ যেন আরও রহস্যময় হয়ে উঠল।
দাদু ভারি গলায় বলতে লাগলো - সেই সময় আমি ছিলাম অল্পবয়সী, হঠাৎ তন্ত্রবিদ্যা শেখার প্রবল আগ্রহ জেগে ওঠে আমার মধ্যে। অনেক খোঁজখবর করে জানতে পারলাম, সুন্দরবনের এক নির্জন গ্রামে থাকে এক শক্তিশালী গুনিন – নাম তার ‘ভবেশ সাধু’।
লোকমুখে শুনেছিলাম, ভবেশ সাধু নাকি প্রকৃতির সাথে কথা বলতে পারে, বাঘকে নিজের অনুচর বানিয়ে রাখতে পারে, এমনকি মৃতদের আত্মার সাথেও যোগাযোগ করতে পারে। আমার প্রবল ইচ্ছা হলো তার সঙ্গে দেখা করে তার শিষ্য হওয়ার। বুঝলে দাদু ভাইরা তখনকার দিনে পথঘাট এত ভালো ছিল না, তাই অনেক কষ্ট করে নৌকা আর পায়ে হেঁটে সেই গ্রামে পৌঁছালাম। গ্রামের লোকেরা ভবেশ সাধুর নাম শুনেই আতঙ্কিত হয়ে উঠল। তারা বলল, 'ওখানে যেয়ো না বাবা, অনেকেই গেছে, কিন্তু আরা ফেরেনি!' কিন্তু আমি আছিলাম বেপরোয়া। আমার মনে তখন এক্তা নতুন কিছু শেখার প্রবল ইচ্ছা। যাই হোক তিন দিন অপেক্ষার পর অবশেষে ভবেশ সাধুর দেখা পেলাম। তিনি ছিলেন দীর্ঘকায়, লম্বা জটা, গায়ে গেরুয়া বসন। একজোড়া তীক্ষ্ণ লাল চোখ যেন আমার অন্তরাত্মা পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে! আমি প্রণাম করতেই তিনি হেসে বললেন, ‘তন্ত্রবিদ্যা শিখতে চাস? ঠিক আছে, কিন্তু তার জন্য তোকে অনেক পরীক্ষা দিতে হবে।’
আমি রাজি হলাম।
এরপর দাদু একটু থামলেন। এক গ্লাস জল খেলেন, তারপর আবার শুরু করলেন—
বুঝলে প্রথম কয়েকদিন সাধুর কাছ থেকে সাধারণ তন্ত্রবিদ্যা শিখছিলাম। কিন্তু এমাস ছয়েক পর একদিন তিনি বললেন, 'তুই যদি সত্যি শক্তিশালী হতে চাস, তাহলে তোকে কালো রাতের পরীক্ষা দিতে হবে!'
আমি বললাম- পরীক্ষা? কিসের পরীক্ষা?
তিনি বললেন, 'এই গভীর জঙ্গলে এক নির্দিষ্ট জায়গা আছে, যেখানে তান্ত্রিক শক্তির প্রভাব সবচেয়ে বেশি। সেখানে তোর সাহসের পরীক্ষা হবে। যদি টিকতে পারিস, তবে প্রকৃত তান্ত্রিক হতে পারবি।'
আমি রাজি হলাম।
তারপর নির্দিষ্ট দিনে রাতের বেলা তিনি আমাকে একটা পুরোনো ভাঙাচোরা মন্দিরে নিয়ে গেলেন। চারপাশে কুয়াশা, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর দূর থেকে ভেসে আসা বাঘের গর্জন। সেই পরিবেশে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। আমার গা তখন ছম ছম করেছে। দূরে বাঘের গর্জন আর রাতের অন্ধকারে সেই পরিবেশ চোখ বুজলে আমি আজো দেখতে পাই।
সাধু বললেন, ‘এখানে এক পুরোনো আত্মা বাস করে। যদি সাহস থাকে, তবে এখানে একা বসে গভীর রাত পর্যন্ত ধ্যান করবি। ভয় পেলেই সব শেষ! আমি তোর জন্য অপেক্ষা করব।’
বৃষ্টি তখন খুব জোরে পড়ছে। মাঝে মাঝে মেঘের গর্জন শোনা যাচ্ছে। আমারা বললাম তুমি কি করলে দাদু?
দাদু তখন একেবারে নিচু স্বরে বললে, সেই রাতের স্মৃতি এখনো আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। আমি একা সেই মন্দিরের ভিতরে বসে ধ্যান করতে লাগলাম। ধীরে ধীরে চারপাশ আরও নিস্তব্ধ হয়ে গেল। হঠাৎ অনুভব করলাম, কেউ যেন আমাকে দেখছে। আমার চারপাশটা হিমশীতল হয়ে গেল।শরীরটা যেন প্রচণ্ড ভারি হয়ে গেল।সেই সময় মন্দিরের ভেতরের একটা কোণ থেকে আস্তে আস্তে একটা ছায়া স্পষ্ট হতে লাগল। প্রথমে মনে হলো, চোখের ভুল। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই ছায়ার আকৃতি স্পষ্ট হলো— অন্ধকারে মোড়া একটা লম্বা অবয়ব, চোখদুটো আগুনের মতো জ্বলছে! আমি স্থির হয়ে রইলাম। গুরুর কথা মনে পড়ল— যদি ভয় পাই, তবে শেষ! সাহস করে আমি মন্ত্র জপতে লাগলাম। কিন্তু হঠাৎ সেই ছায়া আমার দিকে এগিয়ে এলো! আমি অনুভব করলাম, যেন আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, শরীর জমে যাচ্ছে! মনে হলো, হাত-পা নাড়াতে পারছি না! ঠিক তখনই ভবেশ সাধু আমে আমার গুরুর গম্ভীর কণ্ঠ শোনা গেল— ‘ওর দিকে তাকাস না! মন্ত্র জপতে থাক!’
আমি প্রাণপণে মন্ত্র জপতে লাগলাম। একটা সাদা মূর্তি যেন নানান রুপে আমার চারিপাশে পাক খেতে লাগলো। সে এক বীভৎস রূপ। আমি অই আসনে না থাকলে হয়তো ভয়ে মারা যেতাম। কাছেই মনে হল একটা বাঘ চিৎকার করে উঠলো। তার কয়েক মুহূর্ত পর আর একটা বিকট চিৎকার শুনলাম, আমার সামনে একটা ধোঁয়ার কুন্ডলি পাকিয়ে উঠলো।আমি আর কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। তারপর হঠাৎ সেই ছায়া মিলিয়ে গেল।
আমি বললাম - তারপর কি হল দাদু?
দাদু বললে - সাধু গুরু এসে আমায় বললেন, ‘তুই পাশ করেছিস। এটা ছিল একটা আত্মার পরীক্ষা, যা একজন প্রকৃত তান্ত্রিকের ক্ষমতা যাচাই করে। তুই সফল হয়েছিস, তাই সে তোকে ছেড়ে দিয়েছে।"
সেই রাতের পর থেকে আমি বুঝতে পারলাম, তন্ত্রবিদ্যা শুধু শক্তি নয়, এটা এক বিশাল দায়িত্ব। যারা এই পথে চলে, তাদের সাহস, ধৈর্য আর আত্মনিয়ন্ত্রণ থাকা দরকার।এরপর আমি অনেক কিছু শিখেছিলাম, কিন্তু আজও সেই রাতের কথা ভুলতে পারিনি।
দাদু থেমে গেলেন। বাইরে তখনো মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে, মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।
আমরা সবাই শিউরে উঠলাম।
অপু আস্তে করে বলল - দাদু, ওই ছায়াটা কি আসলেই ছিল?
দাদু একটু হেসে বললেন - তা তো জানি না। কিন্তু ঐ রাতের পর থেকে আমি আর কখনো ভয় পাইনি।
সেদিন রাতে আমাদের আর ঘুম এলো না। একদিকে বৃষ্টি, অন্যদিকে দাদুর গল্প।যত বার জানালার দিকে চোখ পড়ছে মনে হচ্ছে, জানলার বাইরে কে যেন দাঁড়িয়ে আমাদের কথা শুনছে।
0 মন্তব্যসমূহ