রহস্যময় গুপ্তধন

 রহস্যময় গুপ্তধন

অতনু সরকার



সন্ধ্যা তখন ঘনিয়ে এসেছে। আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা, দূরে কোথাও বজ্রপাতের আলো ছায়ার মতো ছুটে আসছে। নদীর ধারে ছোট্ট গ্রাম নাম দেবগ্রাম।  এখানে রাত নামলেই কেমন একটা  অদ্ভুত  নীরবতা নেমে আসে।


সেই নীরবতা ভেঙে নদীর ঘাটে দাঁড়িয়ে ছিল অভিজিৎ। বছর চব্বিশের যুবক, শহর থেকে এসেছে তার পৈতৃক ভিটেতে। এই গ্রামেই তার দাদু থাকতেন, কিন্তু বছর দশেক আগে এক অদ্ভুত ঘটনার পর তিনি নিখোঁজ হয়ে যান। সেই ঘটনার রহস্য আজও কেউ উদঘাটন করতে পারেনি।


দাদুর পুরোনো কাঠের বাড়িটা অনেক দিন ধরে ফাঁকা পড়ে আছে। গ্রামের মানুষ বলে, "ওখানে রাত হলে কেমন একটা অদ্ভুত আওয়াজ শোনা যায়, যেন কেউ চাপা গলায় কাঁদছে।"


অভিজিৎ এসব গল্প বিশ্বাস করে না। সে স্থির করেছে, এবার সে দাদুর নিখোঁজ হওয়ার রহস্য উদঘাটন করবেই।



রাত বাড়তেই অভিজিৎ পুরোনো বাড়ির ভেতরে ঢুকল। চারদিকে ধুলো জমেছে, বাতাসে একটা স্যাঁতসেঁতে গন্ধ। হঠাৎ ওর চোখ পড়ল এক পুরোনো কাঠের টেবিলের ওপর রাখা একটা ডায়েরিতে।


ডায়েরির প্রথম পাতায় লেখা—


"আমি সত্যেন রায়, যদি কোনোদিন এই লেখাগুলো কেউ পড়ে, তবে জেনে রেখো, আমি দেবগ্রামের এক ভয়ংকর সত্যের সাক্ষী ছিলাম।"


এই বাক্য পড়েই যেন অভিজিতের শিরদাঁড়া দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। সে দ্রুত পৃষ্ঠা উল্টে পড়তে লাগল।



ডায়েরির মধ্যে দাদু লিখেছিলেন, বহু বছর আগে দেবগ্রামের ঘাটে প্রতিদিন রাত বারোটার সময় এক রহস্যময় ছায়ামূর্তি দেখা যেত। কেউ বলত, ওটা এক আত্মা, আবার কেউ বলত, ওটা গ্রামেরই এক নিখোঁজ মানুষ, যে অভিশপ্ত হয়ে গেছে।  আমি ঘটনাটা কি সেটা জানার জন্য খুব উদ্গ্রীব ছিলাম। তাই একদিন কাউকে কিছু না জানিয়ে নিজেই সেই ছায়ামূর্তির রহস্য উদঘাটন করতে বেরিয়ে পড়লাম। মনে একটু ভয় ছিল। কিন্তু সেই রহস্য জানার আগ্রহ এতোটাই ছিল যে সেই সামান্য ভয় কে উপেক্ষা করে অন্ধকারের বুক চিরে এগিয়ে চললাম।  রাত তখন ঠিক বারোটা। পূর্ণিমার  আলোয় নদীর ঘাট স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। একটা গাছের নীচে গিয়ে বসলাম। অনেক্ষন পর হঠাৎ একটা দীর্ঘ কালো ছায়া ঘাটের ধারে উদয় হলো। বুকের ভেতরটা কেমন যেন চিন চিন করে উঠলো। তবুও এগিয়ে গেলাম। একটা  কালো চাদর ঢাকা লম্বা  অবয়ব, মুখটা ঢাকা, শুধু দুটো উজ্জ্বল চোখ দেখা যাচ্ছে। সে ধীরে ধীরে নদীর দিকে হাঁটতে শুরু করল। আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়েছিলাম। তারপর কেমন যেন একটা আচ্ছন্ন ভাব আমাকে গ্রাস করল। এরপর সেই অবয়ব আমার দিকে এগিয়ে আস্তে লাগল। আর ঠিক তখনই আমার শরীর অসাড় হয়ে গেল। ও আমার দিকে এগিয়ে এলো...।


 তারপর কিছু লেখা নেই। এক জায়গায় গোল করে লেখা, ‘যদি আমি হারিয়ে যাই, কেউ এই রহস্য সমাধান করো..."


এরপর পৃষ্ঠা ফাঁকা।



অভিজিৎ আর দেরি করে না। সেই রাতেই সে নদীর ঘাটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। সাথে শুধু একটা টর্চলাইট আর সেই ডায়েরিটা নিল। 


অন্ধকার ঘুটঘুটে একটা রাত। এই বাড়ির পিছন দিয়ে নদীর ঘাটে জাওয়া যায়। সেই পথ ধরে সে এগিয়ে গেল। সে যে কেন যাচ্ছে টা সে নিজেও জানে না। ঘাটের কাছে পৌঁছে সে লক্ষ্য করল, চারপাশটা নীরব। নদীর জলে চাঁদের আলো পড়ে মৃদু ঝিকিমিকি করছে। হঠাৎ কোথা থেকে একটা ঠাণ্ডা বাতাস বইতে শুরু করল। কেমন যেন শীত শীত একটা ভাব। ও ভাবলো হয়তো ফাকা জায়গা বলে এমন শীতল বাতাস বইছে। কিন্তু গা টা কেন যেন ছম ছম করছে। একটা পেঁচা দেকে উঠলো কর্কশ স্বরে।  


ঠিক তখনই… একটা দীর্ঘ ছায়া ঘাটের পাথরের উপর ফুটে উঠল।


অভিজিৎ চমকে উঠল। সেই ছায়া ধীরে ধীরে ওর দিকে এগিয়ে আসছে। বুক ধড়ফড় করতে লাগল, কিন্তু পিছু হটল না।


"কে তুমি?"— অভিজিৎ চিৎকার করল।


কোনো উত্তর নেই।


ছায়াটা আরও কাছে এল। এবার অভিজিৎ স্পষ্ট দেখতে পেল— সেটা কোনো অলৌকিক সত্তা নয়, বরং একটা মানুষ!



টর্চের আলো ফেলতেই দেখা গেল, এক বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে আছে, পরনে পুরোনো ছেঁড়া চাদর। চোখজোড়া দগদগে, যেন বহুদিন ধরে দুঃস্বপ্ন দেখে এসেছে।


অভিজিৎ বলল - কে তুমি... তুমি কে?


বৃদ্ধ একটু হাসল, তারপর বলল, - সত্যেন রায়...


অভিজিৎ হতবাক হয়ে বলল - তাহলে তুমি... আমার দাদু?


সে বৃদ্ধ উত্তর দিল - হ্যাঁ, কিন্তু আমি এখন আর আগের সেই মানুষটি নেই। আমি একটা সত্যের পাহারাদার।"


অভিজিৎ - কিসের সত্য? 


বৃদ্ধ ধীরে ধীরে বলতে লাগল — এই নদীর নিচে একটা গোপন সিন্দুক আছে। বহু বছর আগে এখানে গুপ্তধন ছিল, যেটার পাহারায় ছিল এক রহস্যময় ব্যক্তি। আমি সেটার সন্ধান করতে গিয়ে ওদের হাতে ধরা পড়ি। 


অভিজিৎ - তারপর?


বৃদ্ধ - সে আমাকে মেরে ফেলার বদলে য়ামাকে বন্ধি করে রাখে। আর বলেছিল এই সম্পদ তুই ভোগ করতে পারবিনা। তোর বংশের কোন পুরুষ বুকে একটা লাল তিল থাকবে সেই হবে এই সম্মত্তির মালিক। আমি জানতাম, একদিন কেউ না কেউ এই সত্য জানবে আর আমার  প্রকৃত উত্তরাধিকারী এই সম্পদ পাবে। তুমি আমার ছোট ছেলে সমরজিত রায়ের ছেলে। তমার বুকে আক্টা লাল তিলও আছে জেটা আর কারর মধ্যে নেই। তুমি চাইলে সেই সম্পদ উদ্ধার করতে পার।  


অভিজিৎ স্তব্ধ হয়ে গেল। শান্ত কন্ঠে বলল - তাহলে এখন কী হবে?"


বৃদ্ধ বলল- গুপ্তধন পেতে চাইলে নদীর নিচে নামতে হবে, কিন্তু সাবধান, সে এখনো পাহারায় আছে। ওই যে পদ্ম ফুলটা ফুটে আছে অর নীচে আছে সেই সিন্ধুক। 

কথা টা বলেই সে মিলিয়ে গেল।


অভিজিৎ দেখলো একটা পদ্ম ফুটে আছে মরা নদীর জলে। এই নদী এখন আর আগের মতো নেই। এখানে স্রোত নেই। বহু বছর আগে থেকেই নদী প্রায় দিক হারা। 


অভিজিৎ ভাবল সত্যিই কি নদীর নিচে নামবে সে? গুপ্তধন কি শুধু এক গল্প, নাকি এর পেছনে আরও ভয়ংকর কিছু আছে? এই জমিদার বংশের অনেক কথা সে শুনেছে। জমিদারি হারিয়েছে বহু বছর আগে। অর বাবাও দেখেনি কিছু। অবে এই বিরাট কাথের বাড়িটা ছিল ওদের খুব প্রিয়। অভিজিৎ বিদেশে পড়া শুনা করেছে। ভয় একটু কম। সে ভাবল। এই রাতেই তাকে রহস্যের সমাধান করতে হবে। কিছু একটা ভেবে একটু দাড়ালো। তারপর সে ধীরে ধীরে নদীর দিকে এগোতে লাগল...। একটু একটু করে জলে নামতে লাগলো সে। রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে নদীর উপর দিয়ে মৃদু একটা শো শো শব্দ আসছিল, যেন কেউ কোনো গোপন বার্তা দিচ্ছে।


"আমি কি সত্যিই পারবো?"— নিজের মনে প্রশ্ন করল সে।

 

কিন্তু সত্য খোঁজার তীব্র ইচ্ছা ওকে এক মুহূর্তের জন্যও পিছু হটতে দিল না।


অভিজিৎ ফিস ফিস করে বলল - দাদু, আপনি কি আমাকে সাহায্য করতে পারবেন?


সে শুনতে পেল ফিস ফিস করে সত্যেন রায় বললেন- আমি তোমার সাথে নামতে পারব না। মনে রেখো, যদি কিছু ভুল করো, তাহলে ফিরে আসার পথ পাবে না। তবে আমি বাঁচানোর চেস্টা করবো। 


অভিজিৎ গভীর শ্বাস নিল। নদীর একবুক জলে দাঁড়িয়ে সে পকেট থেকে একটা ছোট ছুরি বের করল, যদি কোনো বিপদ আসে। ঠান্ডা জলে শরীরে কাঁপুনি ধরিয়ে দিল। চাঁদের আলোয় নদীর নিচের কালো অন্ধকার রহস্যের মতো দেখাচ্ছিল। তারপর ডুব দিল। জলের নিচে আরো অন্ধকার। কিছুই দেখা যাচ্ছে না, শুধু পদ্ম ডাঁটা আর পাথর। দাদু কি মিথ্যা বলেছিলেন?   হঠাৎ পায়ের নিচে কিছু শক্ত জিনিস লাগল। সে পা দিয়ে স্পর্শ করল— একটা শক্ত পাত্র। ডুব দিল। পদ্মের গোঁড়া থেকে একটু নীচে একটা কলশি তুলে নিল। খুব ভারী। মনে মনে ভাবল - "গুপ্তধন!"


অভিজিৎ দ্রুত কলশিটাকে টেনে তুলতে লাগল। কিন্তু ঠিক তখনই পেছন থেকে কারও হাত ওর পায়ের গোড়ায় শক্ত করে চেপে ধরল!


অভিজিৎ চমকে গেল! এক ঝলক আলোয় দেখতে পেল— নদীর গভীর থেকে একটা ছায়ামূর্তি ওর দিকে এগিয়ে আসছে। তার মুখ দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু চোখদুটো কোটরের গভীরে জ্বলছে!


হঠাৎ একটা মৃদু ফিসফিসানি শোনা গেল— তুমি এখানে কী চাও?


অভিজিৎ কোনো মতে কলশিটা নিয়ে উপরে ওঠার চেস্টা করতে লাগলো।



পেছনের ছায়া টা  ধীরে ধীরে এগিয়ে এল। অভিজিৎ বুঝল, এখনই পালানোর সময়!



সে দ্রুত কলশিটা তুলে নিয়ে পা চালাল উপরের দিকে। কিন্তু ছায়াটা তাকে টানতে লাগল, যেন জলেই ডুবিয়ে মারবে!


এমন সময় নদীর ওপার থেকে একটা আলো চমকাল। অভিজিৎ তাকিয়ে দেখল— দাদু এক হাতে একটা পুরোনো লণ্ঠন ধরে দাঁড়িয়ে আছেন, আর হাত তুলে কিছু একটা বলছেন - ছাড় অকে ওই আমার সেই বংশের প্রদীপ জার বুকে আক্টা লাল তিল আছে। ছাড় ওকে। 


অবাক ব্যাপার, সেই কথা শুনে ছায়ামূর্তি অভিজিৎ এর সামনে এসে পথ আটকালো। তারপর কি যেন একটা দেখলো। আর ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে লাগল!


অভিজিৎ প্রাণপণে ওপরে উঠল। সে নদীর তীরে উঠে আসতেই দেখল দাদু হাঁপাচ্ছেন, যেন অনেক বড় যুদ্ধ করেছেন।


অভিজিৎ - দাদু, কে ছিল ও ? 


সত্যেন রায় বললেন- ও সেই পুরোনো ধনের রক্ষক, যে এই গুপ্তধনের পাহারা দিত। কিন্তু এখন আর ওর অস্তিত্ব নেই, শুধু ছায়া রয়ে গেছে।


অভিজিৎ কলশিটা খুললো। দেখলো সোনার মহর আর একটা বই। 

সে বলল - এতা কি বই দাদু?


দাদু - এই বইতে লেখা আছে দেবগ্রামের হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস। অনেক কাল আগে এখানে আমাদের জমিদারি ছিল, আমাদের পূর্ব পুরুষ যারা এই ধনসম্পদশরজন করেছিল তারা বিদেশি আক্রমনের সময় এই সম্পদ লুকিয়ে রেখেছিল এখানে। আর পাহারা দিত আমাদেরই এক পূর্ব পুরুষের আত্মা। 

অভিজিৎ চুপ করে শুনছিল। বলল - এখন কী করব, দাদু?


সত্যেন রায় মৃদু হেসে বললেন - এটা তোমার হাতে। চাইলে ধন নিতে পারো, না চাইলে ইতিহাসকে আগের মতোই রেখে দিতে পারো। না হলে এই গ্রামে একটা বড় মন্দির করে দিয়। ভোগ করতে পারবে বলে মনে হয় না। 


অভিজিৎ কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করল, তারপর কলশিটা  আবার নদীর জলে সেই স্থানে রেখে  দিল।


মনে মনে ভাবল - আমি অতীতের রহস্য জানলাম, কিন্তু ইতিহাসকে বদলাবো না।


সত্যেন রায় সন্তুষ্ট দৃষ্টিতে তাকালেন। রাতের আকাশ তখন ধীরে ধীরে ফর্সা হয়ে আসছে।



সেদিন রাতের পর থেকে দেবগ্রামের নদীতে আর কোনো ছায়ামূর্তি দেখা যায়নি।


কিন্তু অভিজিৎ জানে— কিছু সত্য চিরকাল গোপন থাকাই ভালো।




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ