দশম অধ্যায়
অহিন আর বসে থাকতে পারলো না সেখানে। উঠে দাঁড়ালো তারপর ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে নদীর তীরে জলের কাছে এসে দাঁড়ায়। নদীতে তখন ভাটার টান লেগেছে। বালির চর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আকাশ-পাতাল কত কল্পনা কত স্বপ্ন যেন দুমড়ে-মুচড়েএকাকার হয়ে যেতে থাকে। কিন্তু তার মধ্যেও এই শূন্য নদীর তীরেও যেন বারবার ভেসে আসে ইভার হাসির একটা শব্দ। যেটা অহিনের কানে যন্ত্রণার ঝংকার তুলে দিচ্ছে বারবার। না অহিন আর পিছনে তাকাইনি কখনো। তাকানোর প্রয়োজন মনে করেনি। মনে মনে ভাবতে থাকে এটা কিভাবে সম্ভব। মেয়েদের চরিত্র যে বোঝা দায়, যে মেয়ে একদিন অহিনের জন্য কেঁদেছিল সেই মেয়ে কি অবলীলায় আর একটা ছেলের গায়ে গায়ে বসে গল্প করতে পারে।
অহিন ভাবতেই পারে না। কোথা থেকে কি হয়ে গেল সব। মনে মনে ভাবে, সত্যিই যদি এইভাবে না বলতো তাহলে হয়তো ইভার যথার্থ রূপ ফুটে বের হতো না। এতক্ষণ যে কারণে অহিন দুঃখ করেছিল কড়া কথা শোনানোর জন্য সেই দুঃখ আর রইল না। নদীর ধারের মুক্ত বাতাসে উদাসীন হয়ে চলতে থাকে তার উদাস হেটে যাওয়া। নদীর ওপর পারে তখন নৌকায় ফিরে চলেছে কোন এক মাঝি আপন মনে গান গাইতে গাইতে। সে গানের মৃদু সুর কানে এসে বাজতে থাকে
"তুমি বন্ধু ভরা নদীর জোয়ার না ভাটা…….."
অহিন চলতে থাকে, দূরে আরো দূরে, সূর্য পশ্চিমে তখন অস্ত গেছে সন্ধ্যার আবেশ মাখানো পরশ প্রকৃতিকে আবিষ্ট করে ফেলেছে। পশ্চিম আকাশে মেঘের রং তখন লাল আর আবির মাখানো। অহিন চলতে থাকে আপন মনে, আপন খেয়ালে। বাড়ি ফেরার কোন খেয়াল তার ছিল না। এমনি করেই নেমে আসে সন্ধ্যা নদীর ধারেই তখন ঝিঝির পোকার ডাক। রাস্তা অন্ধকার হতে থাকে।
পরদিন অফিসের বদলির জন্য আবেদন করে অহিন। না এখানে আর নয়, এই পরিবেশ ওর কাছে কেমন যেন বিষের মত হয়ে গেছে। অনেক কষ্টে বদলি হলো। অফিসের সবাই অবাক হয়েছিল ওর বদলির আবেদন দেখে।
সবাই যে যার নিজের এলাকায় থাকতে চায় আর অহীন কিনা চলে যেতে চায় দূরে। ওর মতন একটা সচেতন কাজের ছেলে চলে যাবে বলে ওর সহকর্মীদের একটু আফসোস হলো বটে। তারপর একদিন ব্যাগ বাক্স গুছিয়ে বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়াল কিছুক্ষণ। তাকিয়ে রইল বাড়িটার দিকে। একদিন এখানে তার জন্ম তারপর সবাইকে হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে আর আজ সেই সুখ দুঃখের বাড়ি ছেড়ে চলেছে অজানা অচেনা এক জগতে। পাড়ার কেউ কেউ জানতে চাইল অহীন আবার কোথাও ঘুরতে যাচ্ছে কিনা। কিন্তু তারা যখন শুনলো অহিন দীর্ঘদিনের জন্য বাইরে যাচ্ছে তখন কেউ দুঃখ প্রকাশ করল কেউবা বড় রাস্তায় ছুটে গেল রিক্সা ডাকার জন্য। পাড়ার ছোট বড় অনেকেই জড়ো হল। সেখানে ছিল তার দূর সম্পর্কের এক পিসি এবং পিসেমশাই। তাদেরকে ডেকে অহিন বলে - পিসি বাড়িটা রইল দেখ, আমি মাঝেমধ্যে এসে দেখে যাব।
পিসি একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলে - তুইও আমাদের ভুলে চলে যাবি, যা আমরা যতটুকু দেখার দেখব।
একটু পরে রিক্সা এসে উপস্থিত হলো রিক্সায় মালপত্র তুলে সকলকে বিদায়ের জানাল। রিক্সা চলতে থাকে। এক সময় চির পরিচিত পাড়া ছেড়ে অহিনের রিক্সা বড় রাস্তা ধরে জোরে চলতে শুরু করে রেল স্টেশনের দিকে। পিছনে পড়ে থাকে তার শৈশব, কৈশোর আর যৌবনের সুখ-দুঃখের কাছের মানুষগুলো । আর তার সাধের বাড়িটা ।
ইভা আর তৃষা ছাদের উপর থেকে দেখলে অহিনের চলে যাওয়া। পাড়ার লোক জানতেই পারল না ইভা নামের মেয়েটার জন্য হয়তো চলে যেতে হল তাকে। তবে কি সত্যিই সে ইভাকে ভীষণ ভালই বেসেছিল? ইভা শুধু প্রসুনের সঙ্গে পার্কে গিয়েছিল অহিনকে আঘাত দেওয়ার জন্য ইচ্ছা করে। কিন্তু সেটা যে এত বড় করে দেখা দেবে তা ভাবতেও পারিনি ইভা।
হয়তো ইভার পিসি কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছিল। ছাদের উপর দাঁড়িয়ে ইভা দেখল তার ভালোবাসাকে কিভাবে অহিন হেলায় পেছনে ফেলে চলে যাচ্ছে। রাগে অভিমানে অহিন একটিবারের জন্য ইভাদের বাড়ির দিকে তাকালো না। ইভা ভেবে ছিল একবার হয়তো তাকাবে তার দিকে কিন্তু না তাকালো না। ইভা আস্তে আস্তে বসে পড়ে ছাদের উপর। উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকি নীল আকাশের দিকে। আর ভাবে তার বোকামির কথা।
পাশে দাঁড়িয়ে তৃষা বলল - ইভা প্রসূনদা আসছে।
ইভা কোন কথা বলে না।
প্রসুন এই পাড়ার ছেলে। বড়লোক বাবার একমাত্র ছেলে। বাবার ব্যবসা দেখাশোনা করে। বেশ কয়েকদিন ধরেই প্রসুনের বাবা ইভার বাবার কাছে তাদের মধ্যে আত্মীয়তার বন্ধন হিসেবে বিবাহের একটা প্রস্তাব করেছিল।
ইভা ধীরে ধীরে উঠে বসে। চোয়াল শক্ত করে। তারপর তৃষাকে বলে - দেখব কতদিন, কত বছর বাড়ির বাইরে থাকে। আমিও ওই পাড়া ছেড়ে যাচ্ছি না। তুই আমার মাকে বলিস যে ইভা প্রসূনকে বিয়ে করতে রাজি আছে।
তৃষা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ইভার দিকে। তারপর বলে - কি বলছিস তুই।
ইভা - ঠিকই বলছি।
তৃষা - তাহলে তুই অহিন দা কখনো ভালবাসিস নি।
ইভা - ওর নাম আমার সামনে করিস না। কাপুরুষ কোথাকার একটা মেয়ে কতবার একটা ছেলেকে বলতে পারে ভালোবাসার কথা। একটা মেয়েকে ভালোবাসার ভয়ে পালিয়ে যায় অন্য জায়গায়।
তৃষা - এমন তো হতে পারে আমরা কেউ ওকে বুঝতে পারিনি।
ইভা - বোঝার শক্তি ……
কথাটা শেষ করার আগেই প্রসুন উঠে আসে ছাদে।
প্রসুন - আরে ইভা তুমি এখানে। আর আমি তোমার জন্য নিচে বসে আছি কতক্ষণ।
- এসো বস
তৃষা - তোরা বোস, কথা বল। আমার কাজ আছে।
তৃষা ছুটে নেমে যায়। তৃষা ইভার এই দ্বিচারিতা মেনে নিতে পারেনা। প্রসুন খুব কাছে এসে বসে। তারপর বলে - যাক তোমার বন্ধু তো বেশ ভালো , আমাদের কথা বলার সুযোগ দিয়ে চলে গেল।
ইভা - হ্যাঁ আমার বন্ধু যখন ভালো তো হবেই।
প্রসুন - তারপর তোমার নায়ক তো চলে গেল।
ইভা একটু স্মিত হেসে উত্তর করে - হুম।
প্রসুন - নায়কের চলে যাওয়াতে তোমার চোখে জল থাকার কথা কিন্তু…
ইভা - কিন্তু চোখের জলের বদলে মুখে হাসি এইতো?
প্রসুন - একদম ঠিক।
ইভা - তুমি অতনু সরকারের সেই কবিতাটা পড়নি? যেখানে অতনু বাবু লিখেছেন
“যে প্রেম অংকুরে বিনষ্ট হয়
তার জন্য বেশি দুঃখ হয় না
যে প্রেম অন্তরের সাথে অন্তরের হয়
মৃত্যুর পরও সে প্রেম ভোলা যায় না”।
প্রসুন একটু হেসে বলে - তা তোমার কোনটা?
ইভা উত্তর দেয় - তোমার কোনটা বলে মনে হয়?
তুমি যখন অতনু বাবুর কবিতার কথা বললে, তাই তোমার উত্তর আমি তারই লেখা আরেকটা কবিতা দিয়ে দিচ্ছি।
“সবকিছু চেনা যায়
চেনা যায় না শুধু নারী
সবকিছু বোঝা যায় কিন্তু
নারীর মন বোঝা বড় ভারী
সে কখন কি করে নিজেই শুধু জানে
কি জানি কি আছে ওই নারীর মনে”।
ইভা - অতনু বাবু সত্যিই একজন প্রেমের কবি তাই না?
প্রসূন - কবিতার কতটুকুই বা বুঝি যে কবি কে নিয়ে সমালোচনা করব।
ইভা - তবু যতটুকু বোঝা যায়।
প্রসুন - কবিকে না হয় বুঝলাম। কিন্তু তোমাকে বুঝবো কি করে।
ইভা - যেমন করে নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে বোঝা যায় ধ্রুবতারা।
প্রসুন - দেখি তোমার চোখ আমার দিকে তাকাও।
ইভা তার মোহিনী চোখ আস্তে আস্তে মেলে ধরে প্রসুনের দিকে। আর মনের মধ্যে জ্বলতে থাকে অহিনের জন্য প্রতিহিংসার জ্বালা।
প্রসুন হাতের উপর হাত রাখে। ইভা কিছুই বলে না। সন্ধ্যার আবেশ আর আঁধার ঘনিয়ে দ্রুত।
ইভা সেই আবেশ জড়ান সন্ধ্যায় আবৃত্তি করতে থাকে
"আকাশের তারা যত দূরে রয়
তার প্রতি মোহ তত বেড়ে যায়।
তবুও তাকে যায়নি ছোঁয়া
অধরা থেকে যায় সারা জীবন,
কাছে যারে পাই কাছে টেনে নিয়ে
তাকেই করি জীবনে-মরনে আপন।"
প্রসুন উত্তর দেয় - নিশ্চয়ই অতনু বাবুর লেখা
ইভা - এছাড়া আর এমন কথা কার হতে পারে?
এবার প্রসুন উঠে দাঁড়ায়। আকাশের দিকে দুহাতে প্রসারিত করে বলে
"সন্ধ্যা ঘনিয়েছে তাই
এসেছি তোমার দ্বারে,
সন্ধ্যার চাঁদের তুমি উপমা
তোমার দিকে বাড়াই
হাত ওগো প্রিয়তমা।।
এসো প্রিয়তমা সন্ধ্যার
আধারে একসাথে হাটি পথ
দীর্ঘ পথ চলার করি শপথ।"
ইভা উঠে দাঁড়ায়। তারপর বলে - কবির মরমি মনের কথা সত্যিই আমাদের প্রাণ মন ছুঁয়ে যায়। কোন সন্দেহ নেই আমাদের মতন হাজারো তরুণ তরুণীর মনের ভিতর দাগ কেটে যায় তার কথাগুলো। জান প্রসুন মনে হয় কবির সঙ্গে একবার দেখা করি। সামনাসামনি একবার দেখা করে জানতে চাইবো এই শব্দ তিনি কোথায় পান।
প্রসুন উত্তর দেয় - বেশতো চলো দুজনেই যাওয়া যাবে একদিন।
ইভা খুশি হয়ে বলে - তুমিও যাবে আমার সাথে? এত খুব ভালো কথা । তবে চলো এখন আর ছাদে থাকাটা ঠিক হবে না।
0 মন্তব্যসমূহ