বারো পর্ব
অলোক যখন ফিরে এসেছে তার দু একদিন আগে থেকেই গ্রামের পুরনো ডাকাতদের অত্যাচার আবার বেড়েছে। রাত তখন নটা হবে প্রীতিশ বাড়ি আসার জন্য তার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখছে। আর অলোকের সঙ্গে এ মাসে কি চাষ করা যাবে তার কথাগুলো সেরে নিচ্ছিল। কারণ এ মাসে কুসুমপুর আর আসতে পারবে না সে। মাসের মাঝামাঝি সময়ে তাকে যেতে হবে পুরস্কার গ্রহণ করার জন্য এবং তারপরই হয়তো নানা কাজে ব্যস্ত থাকতে হবে। খবরের কাগজের লোক আসবে তাদেরকে সময় দিতে হবে। গোছানো প্রায় শেষ, দশটার সময় পারমিতা খাওয়ার জন্য ডাকলো। খেতে খেতে পারমিতা বলল - ভাই এবার বিয়েটা করে ফেল। আমি একটা ভালো মেয়ে দেখে রেখেছি, দেখতে বেশ ভালো।
অলোক - তোমার দিদি ঠিক বলেছে। এবার তোমার বিয়ে ছাড়বো।
প্রীতিশ - আমাকে কে মেয়ে দেবে? চাকরি বাকরি করলে না হয় তাও বলা যেত।
পারমিতা - তোর কথা সবাই জানে। তুই বসে থাকার ছেলে নয়। যাক এবার বাড়ি গিয়ে মাকে বলবো।
প্রীতিশ - তোদের অত লাফালাফি করতে হবে না। আমায় নিয়ে চিন্তা নেই আমি…
পারমিতা - কি হল বল?
অলোক - আহা বলেই ফেলো না। আমরা তো আর পর নই।
পারমিতা - বুঝেছি কাউকে ভালবাসিস তাই তো? তা কি নাম মেয়েটার?
প্রীতিশ একটু লজ্জা পেল। বলল - তুই চিনবি না। আমরা একসঙ্গে পড়েছি ওর নাম ঊর্মি।
পারমিতা - তা কেমন দেখতে? আর স্বভাব টবাব?
প্রীতিশ - এখন আর কিছু বলবো না।
কথা বলতে বলতে খাওয়া শেষ হয়ে গেল। সবাই উপরে শুতে গেল। প্রীতিশ নিচে একা রইল। রাতে শুয়ে কিছুতেই ঘুম আসছে না। শুধুই ঊরমির কথা মনে পড়ছে। খানিকক্ষণ নিজের ঘরে পায়চারি করে আবার শুয়ে পড়ল। রাতের গভীর নিস্তব্ধতা। মাঝে মাঝে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আসছে কিছুক্ষণ পর পর। একটু তন্দ্রা এল। হঠাৎ দরজায় গুড়ম গুড়ম শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। এতদিন প আবার ডাকাতির উপদ্রপ বেড়েছে। যখন ডাকাতের খুব উপদ্রব ছিল তখন এ বাড়িতে ডাকাতি হয়নি। বিছানায় উঠে বসল প্রীতিশ। সঙ্গে সঙ্গে বিকট শব্দে ঘরের দরজাটাও খুলে গেল। ছিটকানি টা ভেঙ্গে গেছে। অলোক উপর থেকে নামতে গিয়ে কয়েকজনের হাতে আটকা পড়ে গেল। প্রীতিশের ঘরে ঢুকে গেল কয়েকজন। কয়েকজন উপরে গিয়ে পারমিতার মুখের সামনে একটা পিস্তল ধরে আছে। চিৎকার করলেই গুলি করার ভয় দেখিয়েছে। পারমিতা চুপ করে বসে আছে। এদিকে ডাকাত দলের পান্ডা প্রীতিশের ঘরে ঢুকলো। কিন্তু এক নজরে চেয়ে রইল প্রীতিশের দিকে।
একজন বলল - জনাব হুকুম দিন শুরু করি।
সর্দার বলল - চুপ।
সঙ্গে সঙ্গে তারা চুপ করে গেল। সর্দার প্রীতিশের দিকে এগিয়ে গেল। ওদিকে তিনজন মিলে অলোককে ধরে নিয়ে এলো সর্দারের কাছে। সর্দার আবার ধমক দিয়ে বলল - ছাড়ো ওকে।
সঙ্গে সঙ্গে ছাড়া পেল অলোক। প্রীতিশ একটু অবাক হলো। গলার স্বরটা যেন চেনা চেনা লাগছে। সর্দার মুখোশটা খুলে ফেলল। তারপর বলল দেখ চিনতে পারিস কিনা
প্রীতিশ একরাশ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকলো তার দিকে। তারপর বলল - সন্তোষ না?
সন্তোষ- যাক চিনতে পেরেছিস। একজনকে আদেশ দিল যারা উপরে আছে তাদেরকে ডাক। আর এ বাড়িতে যেন কারোর কোনো ক্ষতি না করে। সঙ্গে সঙ্গে একজন ছুটে গেল উপরে।
প্রীতিশ - কিন্তু তুই সন্তোষ না অন্য কেউ।
সন্তোষ গায়ের জামাটা খুলে ডান কাঁধে পোড়া দাগটা দেখালো। বলল- দেখ এবার চিনতে পারিস কিনা?
প্রীতিশ - হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে। তোর মা …………
সন্তোষ - আমার মা আমাকে গরম হাতা দিয়ে ছ্যাকা দিয়েছিল। সেই থেকে এটাই রয়ে গেছে।
প্রীতিশ - তুই এই কাজ করিস?
সন্তোষ - সব বলবো।
সন্তোষ সব ডাকাতদের ডেরায় ফিরে যেতে আদেশ দিল। সেই মতো সকলে ফিরে গেল।
পারমিতা অভিষেককে নিয়ে নিচে এল। পাড়ার যারা জানতে পারল তারা নিজেদের ঘরের দরজাটা আরো শক্ত করে এটে দিল।
প্রীতিশ - দিদি চিনতে পারছিস এ সন্তোষ আমার বন্ধু।
সন্তোষ - ক্ষমা করো দিদি।
পায়ের ধুলো নিল। আসলে তোমাদের বাড়ি আমি জানতামই না।
প্রীতিশ - তুই এখন এসব শুরু করলি কি করে?
সন্তোষ - তোমরা তো জানো পরীক্ষার ফেল করে আমি থেকে বেরিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলাম কলকাতায়। পালিয়ে গিয়ে কলকাতার একটা চায়ের দোকানে ঢুকি। দিনে চায়ের দোকান আর রাতে হয়ে উঠতো ডাকাতদের ডেরা। প্রাণের ভয় দেখিয়ে আমাকে পাঠাত গোপন গোপন সংবাদ আনতে। তার জন্য আমায় কিছু টাকাও দিত। আমার সাহস দেখে ওরা আমায় ওদের দলে টেনে নেয় কারণ ওরা জানত আমি থাকলে ওদের অনেক উপকার হবে। এরপর আমি জড়িয়ে পড়ি ওদের সঙ্গে। তারপর অনেক উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে আমি ডাকাতদের সর্দার হলাম। আমরা এক সপ্তাহ বা দুই সপ্তাহ একটা অঞ্চলে দাবিয়ে বেড়াই।
প্রীতিশ - খুব দুঃখের কথা ভাই। কিন্তু তুই কি আর আগের জীবনে ফিরতে পারবি না।
সন্তোষ - ইচ্ছে হয় রে, কিন্তু ভরসা পাই না।
প্রীতিশ - কেন চল আমি তোকে নিয়ে যাব।
সন্তোষ - কিন্তু যখন আমার এই দুষ্করের কথা সবাই জানতে পারবে তখন সবাই আমাকে ঘৃণা করবে।
প্রীতিশ - কেউ জানতে পারবে না ভাই। দিদিরা তো সব শুনল ওরা কাউকে বলবে না।
পারমিতা - নানা আমরা কাউকে বলবো না। তুই ভালো হয়ে যা।
সন্তোষ - তুই বাড়ি ফিরবি কবে?
প্রীতিশ - কাল।
সন্তোষ - কাল?
প্রীতিশ - হ্যা রে কালই ফিরব। আমার অনেক কাজ পড়ে আছে ।
সন্তোষ - আমি তোর কথা সব জানি। কাগজে পড়েছি ভাই। আনন্দ হয়। যাক তুই সকালে অপেক্ষা করিস। আমি কালই তোর সঙ্গে বাড়ি ফিরব। কতদিন দেখিনি মা বাবা ভাইদের। সেই কবে চলে গিয়েছি , আর আজ তোর সাথে দেখা। আমি এখন যাই ওদের মুক্ত করে দিই। ওরাও আর এভাবে থাকতে চায় না। শুধু আমার জন্য জোর করে আছে। যাই ভাই কাল তবে……………
প্রীতিশ - আমি অপেক্ষায় থাকবো
সকালে বাড়ির সামনে অনেক লোক। গতকাল রাতে ডাকাত পড়েছিল সারা পাড়া খবর হয়ে গেছে। সত্যিই তো সদর দরজা টা ভাঙ্গা। কিন্তু বাড়ির সবাই চুপচাপ কেন? বুঝতে পারছে না অনেকে। তবে কি কি বড় বিপদ হল?
পারমিতা সকলের সামনে এসে বলল - কাল ডাকাত দল এসেছিল কিন্তু কিছু নিতে পারিনি। কারণ আমার ভাই তাদের একমাত্র বন্ধুটি কেড়ে তাদের দিকে বাগিয়ে ধরেছিল। তারপর তারা পালিয়ে যায়।
পাড়ার ছেলেরা বলল বন্দুকটা দেখাও না বৌদি।
পারমিতা মনে মনে ভাবলো, এটাতো সাজানো মিথ্যা। বন্দুক পাবে কোথায়। তারপর বলল - ভোররাতে পুলিশকে খবর দিতে গিয়ে থানায় জমা করেছে। কারণ বাড়িতে বন্দুক রাখলে উল্টো কেস হতে পারে।
মোটামুটি সন্তোষজনক উত্তর। ধীরে ধীরে ধীর ভীড় পাতলা হল। এবং যে যার কাজে চলে গেল। পারমিতা হাফ ছেড়ে বাঁচল। সকাল আটটা নাগাদ সন্তোষ এল। কাঁধে দুটি বড় বড় সাইজের ব্যাগ।
প্রীতিশ - তোর চেলারা সব কি বলল?
সন্তোষ - আনন্দে মুক্ত জীবনে ফিরে গেল। আর আমি চলে এলাম আমার মুক্ত জীবনে।
প্রীতিশ একবার ভাবছি ভাবছিল ওর ব্যাগে কি আছে জিজ্ঞাসা করে। কিন্তু সন্তোষ কিছু মনে করতে পারে ভেবে আর জিজ্ঞাসা করল না। দুজনে জল খাবার খেয়ে বাড়ির পথে বেরিয়ে পড়ল।
প্রীতিশ - কেউ যদি জিজ্ঞাসা করে এতদিন তুই কোথায় ছিলি? কি বলবি?
সন্তোষ - আমিও তাই ভাবছি। কি বল বলা যাই বলতো?
প্রীতিশ একটু ভাবলো। তারপর বলে শোন - বলবি আমি একজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। তিনি একজন বড় ব্যবসাদার প্রথমে তার বাড়ির কাজ করতাম তারপর তার ব্যবসার কাজে সাহায্য করতাম। তোমাদের কথা মনে পড়লে দুঃখ হত তাই চলে এলাম।।
সন্তোষ - সুন্দর বলেছিস। একেবারে খাসা জবাব ভাই।
প্রীতিশ - এখন বাড়ি ফিরে কি করবি?
সন্তোষ - ব্যবসা। ইচ্ছা আছে কিছু একটা করতেই হবে।
প্রীতিশ - টাকা পাবি কোথায়?
সন্তোষ - এতদিনের জমানো টাকাটা তো এবার কাজে লাগাবো।
প্রীতিশ - যাক ভালই হবে।
এদিকে বাসের কডাক্টর হাকচ্ছে - আমতলা আমতলা।
প্রীতিশ - ওঠ সন্তোষ এসে গেছি।
কথা বলার মাঝে মাঝে সময়টা বেশ ভালোই কেটে গেল। বাস থেকে নেমে দুজন গ্রামের সরু পথ ধরল।
0 মন্তব্যসমূহ