ছায়ার মতো তুমি, অধ্যায় ৩: বৈদ্যপুর

 

ছায়ার মতো তুমি

✍️ অতনু সরকার

অধ্যায় ৩: বৈদ্যপুর




ট্রেন যখন বৈদ্যপুর স্টেশনে থামল, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেলের ছায়া। হালকা কুয়াশা যেন চারপাশে আবছা একটা পর্দা টেনে রেখেছে। সৌরভ জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখল ছোট্ট একখানা প্ল্যাটফর্ম—না কোনও দোকান, না তেমন যাত্রী। শুধু দু-একজন চুপচাপ লোক, যাদের চোখে কৌতূহলের আলো।

সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে সৌরভ অনুভব করল—সে যেন কোনও অন্য সময়ের ভেতর ঢুকে পড়েছে। মোবাইলে নেটওয়ার্ক নেই। কানে শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ।

স্টেশন থেকে বেরিয়ে একটা রিকশা পেল সে। বৃদ্ধ রিকশাওয়ালাকে বলল,
— “ঘোষপাড়া যাব। কেউ বলেছিল ওদিকেই মেঘলা বৌদি থাকেন।”
রিকশাওয়ালা তাকিয়ে বলল,
— “মেঘলা বৌদি… মানে ওই পুরনো স্কুলপাড়ার মেঘলাদি? থাকেন তো… কিন্তু আপনি কে বাবু?”

সৌরভ হালকা হেসে বলল,
— “আমি শহর থেকে এসেছি। একটা কাজ আছে। দেখা করব।”
আর কিছু না বলে সে চুপ করে রইল।

রিকশা চলতে লাগল কাঁচা রাস্তা ধরে। দু’পাশে ধানখেত, মাঝেমধ্যে তালগাছ। দূরে ভাঙাচোরা একটা পুরনো স্কুলবাড়ি দেখা গেল। তারপর একটা বাড়ির সামনে এসে রিকশা থামল।

মাটির উঠোন, একটা আমগাছ, আর একটা একতলা পোড়া ইটের ঘর।
দরজার পাশেই বসে আছে এক মাঝবয়সী নারী—চুলে সাদা রেখা, মুখে ম্লান ভাব কিন্তু মায়াবী, চোখে এক আশ্চর্য স্থিরতা।

-মেঘলা।

সৌরভ কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে থাকল।
এই সেই মানুষ? ঠাকুরদার ডায়েরিতে যার নাম লেখা ছিল “আমার ছায়া”?

মেঘলা উঠে দাঁড়ালেন, বলেলন — “আপনি ?

আমি সৌরভ।

- কি শহর থেকে এসেছেন?”
সৌরভ মাথা নাড়ল বলল— আমি … অরবিন্দ ঘোষের নাতি।”

এক মুহূর্তের জন্য মেঘলার চোখ দুটো কেঁপে উঠল। তারপর সে চোখ নামিয়ে বলল,
— “ভেতরে আসুন।”

ঘরের ভেতর অদ্ভুত শান্ত। কাঠের আলমারি, এক কোণে পুরোনো হারমোনিয়াম, আর ছোট্ট একটা কাঠের বাক্স।

মেঘলা জল এনে দিলেন। সৌরভ ছবি আর ডায়েরি বের করল।
— “আমি আপনার কথা জানতাম না। কিন্তু ওঁর ডায়েরিতে... আপনার ছবি ছিল, চিঠি ছিল, নাম ছিল। তিনি চাইতেন আপনি চিঠিগুলো রেখে দিন।”

মেঘলা ধীরে মাথা নোয়ালেন।
— “রেখেছি। সব রেখেছি। কেউ জানে না। ওর চিঠিগুলো আমার কাছে এখনও জীবিত।”

একটু চুপ করে থেকে বললেন,
— “আপনার ঠাকুরদা আমার শিক্ষক ছিলেন। আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। আর তখনই বুঝেছিলাম, ভালোবাসা সবসময় একসঙ্গে থাকার নাম নয়। কারো কারো ভালোবাসা শুধু ছায়া হয়ে পাশে থাকে।”

সৌরভ তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে বুঝতে পারে, এই সম্পর্ক আর পাঁচটা প্রেমের গল্প নয়। এর ভেতরে ছিল শ্রদ্ধা, আবেগ, ত্যাগ আর এক গভীর অনুচ্চার স্বীকারোক্তি।

মেঘলা আবার বলে উঠলেন,
— “তুমি ওর সব কিছু পড়েছো?”
— “সব না। কিন্তু পড়ব।”
— “তবে থাকো ক’দিন। যা বলার আছে, আমি ধীরে ধীরে বলব।”

সৌরভ কিছু বলল না। শুধু মেঘলার চোখে গভীর কোনো অপেক্ষার ছায়া দেখতে পেল।
হয়তো এই অপেক্ষার নামই ছিল ভালোবাসা


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ