ছায়ার মতো তুমি
✍️ অতনু সরকার
অধ্যায় ২: ছবির মানুষ
ঘড়ির কাঁটা তখন রাত দশটার ঘরে। বাড়ির ভেতর নেমে এসেছে এক গভীর নিরবতা। ঘরের এক কোণে একটা ছোট্ট টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে, হলুদ আলোয় মাখানো সৌরভের মুখ—চোখদুটো স্থির, কিন্তু ভিতরে এক অদ্ভুত সাড়া। প্রাণের নব স্পন্দনে আন্দলিত হচ্ছে সৌরভের মন।
সে এখনো তাকিয়ে আছে ছবিটার দিকে।
মেঘলা।
কিন্তু সে কে? ঠাকুরদার সঙ্গে কী সম্পর্ক ছিল তার?
আর বৈদ্যপুর? কোথায় সে জায়গা?
সৌরভ অনেকবার ভেবেছে সে তার ঠাকুরদাকে চেনে। কিন্তু এই বাক্সটা খুলে মনে হচ্ছে, তিনি যেন এক ভিন্ন মানুষ ছিলেন—এক প্রেমিক, যাঁর হৃদয়ের কোনে কোনে জমে ছিল অনুচ্চারিত ভালোবাসা।
ডায়েরির পাতাগুলো আবার উল্টে পড়ে সে।
১৯৬৮ সালের ১৪চি জুলাই -
“আজ প্রথম চিঠি দিলাম মেঘলাকে। জানি না কী ভাবে নেবে। তবু সাহস করলাম। ওর চোখ দুটো অনেক কথা বলে... হয়তো কখনো আমার হবে না, তবু আমি লিখে যাব।”
আরেকটি পাতায় লেখা:
“বৈদ্যপুরে এবারের পুজোটা যেন অন্যরকম। মেঘলা আর আমি নদীর ধারে বসে অনেকক্ষণ চুপ করে ছিলাম। কথা হয়নি, তবু মনে হল, ও বুঝেছে...”
সৌরভের গলায় কেমন যেন কাঁটা লেগে থাকে।
এই মানুষটাই কি সেই ঠাকুরদা, যিনি কোনোদিন নরম করে কথা বলেননি?
এমন সময় মাসি দরজার বাইরে এসে বলে,
— “সৌরভ, খাবে না? অনেক রাত হয়ে গেছে।”
সে চমকে ওঠে।
— “না মাসি, আজ খিদে নেই।”
মাসি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর একটুও না বলে চলে যায়।
সৌরভ উঠে জানালার কাছে যায়। বাইরে রাস্তার আলো, দূরে ট্যাক্সির হর্ণ, হালকা হাওয়া।
সে হঠাৎ সিদ্ধান্ত নেয়—
সে যাবে বৈদ্যপুরে।
পরদিনই সে গুগল ম্যাপে দেখে নেয় জায়গাটা—বর্ধমানের কাছে এক পুরনো গ্রাম, এখনো তেমন আধুনিকতার ছোঁয়া পায়নি।
একটা ট্রেন যায়—বর্ধমান লোকাল।
সকালের আলো ফুটতেই সে ব্যাগ গুছিয়ে নেয়। একটু টাকা, ঠাকুরদার ডায়েরি, ছবিটা আর ক'টা জামা।
জানালার ধারে বসে থাকে ট্রেনের কামরায়।
ট্রেন ছাড়ে। শহর আস্তে আস্তে ফিকে হতে থাকে কলকাতা। এক অজানা অচেনা গ্রাম। সেখান কার কাউকে সে চেনে না। তবু চলেছে এক অমোঘ টানে।
নতুন গন্ধ, নতুন মানুষ, নতুন রাস্তা…
আর সৌরভের চোখে ঘুরে বেড়ায় একটাই মুখ—
মেঘলা।
0 মন্তব্যসমূহ