অপেক্ষার পরে , বাংলা গল্প

 অপেক্ষার পরে

অতনু সারকার





মধ্যবয়সী অরুণ, আজও বিয়ে টা করা হল না। মানে জীবনে প্রতিষ্ঠা  আর অর্থ রোজকগার করতে গিয়ে এতোটাই দেরি হয়ে গেল যে বিয়ে টা করা হল না। লেখালেখি বই গান বাজনা নিয়ে বেশ কেটে যাচ্ছে জীবন টা। কলেজ জীবনে একজন বন্ধু ছিল। মাঝে মধ্যে কথা হত। তার পর জীবন নদির স্রোতে সব হারিয়ে গেছে। বহু বছর হল তার সঙ্গে আর দেখা হয় না। ব্যস্ত কর্মজীবন, পুরনো স্মৃতি, আর কিছুটা একাকীত্বের সাথে সে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ভাগ্য কি সত্যি থেমে থাকে?

এক সন্ধ্যায় কলকাতার এক বইমেলায়, পুরনো বইয়ের স্টলে সে হঠাৎ মেঘনার মুখোমুখি হয় । অরুণের হাতে ছিল রবীন্দ্রনাথের "শেষের কবিতা" আর মেঘনার চোখ আটকে গিয়েছিল ঠিক সেই বইতেই। হঠাৎ কিছুটা অবাক হয় দুজনেই। তারপর অরুণ বলে - আরে মেঘনা না? 

মেঘনা হেসে বলে বলে - চিনতে পেরেছ তাহলে। 

এরপর  একটু হাসি বিনিময় হল।

মেঘনা বলে - বই নিয়ে এখনো তোমার ভালোবাসা আগের মতোই আছে দেখছি।

অরুণ - এটাই তো আমার এক মাত্র বন্ধু। তাই ভালোবাসা কমে গেলে কি করে বাঁচবো। চল না কফি খেতে খেতে কথা বলা যাক। 

মেঘনা - আমার কোন তাড়া নেই। চল। 

সেখান থেকে শুরু—কফিশপের আড্ডা, ভোরবেলা গঙ্গার ধারে হাঁটা, মেঘলা দিনের গান শোনা। তারা আবিষ্কার করলেন, প্রেম শুধু তরুণদের জন্য নয়, বরং সময়ের সাথে জীবনের পরিবর্তনে তা আরো গভীর হয়ে ওঠে। কবে কার ফেলে আসা সামান্য একটা বন্ধুত্ব কখন যেন প্রেমের দুয়ারে নিয়ে দাড় করায় তাদের। সময়ের সাথে সাথে তা এমন হয় যে কেউ কাউকে না দেখে থাকতে পারে না। 

একদিন মেঘনা জিজ্ঞেস করল - তুমি কি কখনো ভেবেছিলে, আমরা প্রেমে পড়্রব?

অরুণ হাসল, বলল - হয়তো ভাবিনি, কিন্তু জীবন তো চমকে দেওয়ারই জন্য তাই না? 

সত্যিই  বলতে কি কখনো কখনো প্রেম আমাদের ঠিক তখনই খুঁজে নেয়, যখন আমরা ভাবি, সে আর আসবে না। আসলে জীবনের প্রয়োজনে প্রেম এসে কড়া নাড়ে। 

অরুণ ও মেঘনা দু’জনই কর্মব্যস্ত জীবনের ব্যস্ততায় একাকীত্বের সঙ্গী হয়ে উঠেছিলেন। বই, গান, অফিসের কাজ—এসবই ছিল তাদের দৈনন্দিন জীবন। এই সব নিয়েই তাদের প্রেমের জগত তৈরি হয়। 

কলকাতার বইমেলার পুরনো বইয়ের স্টলে তাদের চোখাচোখি হওয়ার পর থেকেই যেন সব কিছু  বদলাতে শুরু করল। অরুণের বাড়ির ঝুলন্ত বারান্দায় বসে দুজনে। সামনে খোলা রবীন্দ্রনাথের "শেষের কবিতা"।  বইয়ের পাতায় মেঘনার আঙুল থেমে থাকল, অরুণের  চোখে ছিল একরকম বিস্ময়।

মেঘনা বলে চোখ তুলে বলে - তুমি কি কখনো ভেবেছিলে, ভালোবাসা আবার ফিরে আসবে?

মেঘনার প্রশ্ন শুনে অরুণ একটু থেমে গিয়ে বলল - ভেবেছিলাম হারিয়ে গেছে, কিন্তু এখন ভাবছি  হয়তো সে শুধু লুকিয়ে ছিল!

মেঘনা বলল -  তুমি এতো দিন বিয়ে করলে না কেন? 

অরুণ - নিজে কে খুঁজে পেতে খুব দেরি হয়ে গেল তাই আর সময় করে উঠতে পারলাম না। তা ছাড়া বাবা-মা মারা গেলো। এক দিদি সে তাকে কানাডাতে। আমার জন্য আর কে পাত্রী খুঁজে দেবে বল? কিন্তু তুমি? 

 মেঘনা তার অতীতের কিছু দুঃখের কথা শেয়ার করল—ভালোবাসার ব্যর্থতা, ভরসার ভাঙন সব। অরুণ তাকিয়ে রইল, তার নিজের অতীতও কম কষ্টের ছিল না।

ভয় হয় যদি আবার হারিয়ে ফেলি?  মেঘনা ফিসফিস করে বলল।

অরুণ মৃদু হেসে বলল- তাহলে আবার খুঁজে নেব। 

মেঘনা - সত্যিই তো? আসলে কখনো কখনো জীবন আমাদের দ্বিতীয় সুযোগ দেয়, যদি আমরা তা গ্রহণ করতে প্রস্তুত থাকি।

অরুণ হেসে বলে- যদি তুমি চাও তাহলে বন্ধুত্বের পরিণতি হতে পারে। 

আকাশে তখন পূর্ণিমার গোল চাঁদ উঠেছে। সেই দিকে তাকিয়ে মেঘনা বলল - সত্যি কি তুমি চাও? 

অরুণ উঠে দাঁড়ায় তারপর রেলিঙের উপর হাত রেখে বলে - এক বার হাত টা শক্ত করে ধরে দেখ। 

মেঘনা উঠে অরুণের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। দক্ষিণের বাতাসে মেঘনার আঁচল উড়ে চলে আসে মাথার উপর। সে দিকে তাকিয়ে অরুণ বলে - বধু বেশে বেশ মানিয়েছে কিন্তু।

মেঘনা লজ্জা পেয়ে বলে - ধ্যাৎ। 



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ