জোছনার আলোয় ছায়ার মিতালি


জোছনার আলোয় ছায়ার মিতালি

জোছনার আলোয় ছায়ার মিতালি

অতনু সরকার 



পাহাড় ঘেরা ছোট্ট গ্রাম কুসুমপুর। এখানে রাতের আকাশ যেন মণিমুক্তায় ভরা, আর পূর্ণিমার রাতে পুরো গ্রামটাই জোছনায় স্নান করে। এখানে নানান রঙের ফুলে ভরা থাকে প্রতিটা বসন্ত।  রিয়া, শহর থেকে একখানে আসে নিজের ছবির  জন্য নতুন অনুপ্রেরণা খুঁজতে। কারণ সে এলজন চিত্রকর। কোন এক বন্ধুর মারফৎ সে খবর পায় এই পাহাড়ে ঘেরা গ্রামটার। তার পর সে আর দেরি করে না। মাত্র দুদিনের মধ্যেই সে চলে আসে একখানে। 

রিয়া প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় গ্রাম ঘুরে বেড়াত, পাহাড়ের পায়ের কাছে বসে ছবি আঁকত। কিন্তু একদিন, পূর্ণিমার রাতে, সে দেখতে পেল একটি অদ্ভুত ছায়ামূর্তি। একজন যুবক, রাতে জোছনার আলোয় বাঁশি বাজাচ্ছিলেন। তার বাঁশির সুরে এমন মাধুর্য ছিল যা রিয়ার মন ছুঁয়ে গেল। 

রিয়া ধীরে ধীরে ছেলেটার  কাছে গিয়ে বলল,- কে আপনি? কোথায় থাকেন? আপনার বাঁশির সুর যেন পাহাড়ের বাতাসে  এক সুন্দর আলোড়ন  সৃষ্টি করছে। আপনি কি পেশাদার সুরকার?”
 

অয়ন মৃদু হেসে বলল- আমি অয়ন, আমি সুরকার নই। কিন্তু সুর আমার কাছে ঠিক ততটাই আপন, যতটা এই পাহাড়ের নির্জনতা। কিন্তু আপনি কে, যে এত রাতে এখানে এসেছন?
রিয়া একটু লাজুকভাবে বলল, আমি রিয়া, একজন চিত্রকর। আপনার সুর শুনে আমার মনে হলো, এই মুহূর্তটা আমার ক্যানভাসে বন্দি করতে হবে। 

এভাবেই তাদের আলাপ শুরু। রিয়া তার রঙে অয়নের বাঁশির সুর আঁকতে চেষ্টা করত। অয়ন তার সুরে রিয়ার আঁকা ক্যানভাসের গল্প বলত।

কিন্তু রিয়ার এক অদ্ভুত প্রশ্ন ছিল—অয়নকে সে দিনের আলোয় কখনো দেখেনি। সে শুধুই রাতের অন্ধকারে আসে, যখন পুরো গ্রাম ঘুমিয়ে থাকে।

একদিন রিয়া সাহস করে অয়নকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি দিনে কোথায় থাকো?”
অয়ন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “আমি দিনের আলোয় নেই। আমি সেই ছায়া, যা আলো এসে পড়লে হারিয়ে যায়। আমি তোমার ক্যানভাসে ধরা পড়তে পারি, কিন্তু বাস্তব জীবনে নয়।”

রিয়া বিস্মিত হয়ে বুঝতে পারল, অয়ন যেন এই গ্রামের জোছনার আত্মা। কিন্তু তারপরও, অয়ন এবং রিয়ার বন্ধুত্ব যেন দুটি ভিন্ন দুনিয়ার মেলবন্ধন হয়ে উঠল।

এক পূর্ণিমার রাতে রিয়া তার শেষ চিত্রটি আঁকছিল—অয়নের প্রতিচ্ছবি জোছনায় ঢেকে থাকা পাহাড়ের পটভূমিতে। সেই রাতে অয়ন বলল, “যদি কখনো দিনের আলোয় আমাকে দেখতে চাও, আমার এই বাঁশিটি তোমার কাছে রাখো। যখন সুর বাজাবে, আমি ঠিক তোমার কল্পনায় ফিরে আসব।”

এরপর রিয়া ফিরে গেল শহরে। তার সব চিত্র প্রদর্শনীতে একটি অদ্ভুত রহস্য ছিল—অয়ন নামের ছায়ামূর্তি। দর্শকরা কখনো বুঝতে পারেনি, এটি বাস্তব নাকি একটি গল্প। তবে রিয়ার প্রতিটি ছবিতে অয়নের বাঁশির সুর ঠিকই ছুঁয়ে যেত।


রিয়া শহরে ফিরে গিয়েছিল, কিন্তু তার মন যেন কুসুমপুরের পাহাড়ে আটকে ছিল। অয়নের দেওয়া বাঁশিটি তার স্টুডিওতে জায়গা পায়। যখন সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে বা অনুপ্রেরণার অভাব বোধ করে, তখন সেই বাঁশিটি হাতে নিয়ে সুর তোলে। অবাক ব্যাপার হলো, বাঁশির প্রতিটি নোট যেন তাকে সেই পাহাড়ে ফিরিয়ে নিয়ে যায়, অয়নের সঙ্গ দেয়।

একদিন, রিয়ার একটি চিত্র প্রদর্শনীতে একজন দর্শক তার একটি ছবি দেখে থমকে যায়। ছবিটি ছিল পাহাড়ের নিচে পূর্ণিমার আলোয় অয়নের ছায়া।
দর্শকটি বলল, "এই ছবিটি কীভাবে সম্ভব? আমি এই জায়গাটিকে চিনি। এটি কুসুমপুরের পাহাড়। কিন্তু ছবির এই ছায়া... আমি তাকে আগে কোথাও দেখেছি।"

রিয়া বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, "আপনি কীভাবে তাকে চেনেন?"
দর্শকটি বলল, "অনেক বছর আগে এই পাহাড়ে একজন তরুণ বাঁশিওয়ালা থাকত। তার সুর এতই মুগ্ধকর ছিল যে পুরো গ্রাম তাকে ভালোবাসত। কিন্তু এক রাতে, এক দুর্ঘটনায় সে মারা যায়। তবে গ্রামের অনেকেই বলে যে পূর্ণিমার রাতে তার আত্মা ফিরে আসে এবং বাঁশি বাজায়।"

রিয়ার হৃদয় ধাক্কা খেল। সে বিশ্বাস করতে পারছিল না। তাহলে, অয়ন কি আসলে ওই বাঁশিওয়ালার আত্মা? তার ক্যানভাসের ছায়া কি বাস্তবে কখনোই ছিল না?

রিয়া সিদ্ধান্ত নেয় কুসুমপুরে ফিরে যাওয়ার। সে পাহাড়ে গিয়ে আবার সেই জায়গায় বসে, যেখানে প্রথমবার অয়নের সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল। পূর্ণিমার রাত ছিল, জোছনায় পাহাড় উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল।

হঠাৎ, সে দূরে বাঁশির সুর শুনতে পায়। সুরটি অদ্ভুতভাবে পরিচিত। রিয়া বাঁশিটি হাতে নিয়ে সুর তুলল, আর সেই মুহূর্তেই অয়নের ছায়া তার সামনে উপস্থিত হয়।
অয়ন বলল, "তুমি ফিরে এসেছ। আমি জানতাম, তুমি একদিন ফিরে আসবে।"

রিয়া: "তুমি কে, অয়ন? তুমি কি সত্যিই এখানে আছো, নাকি তুমি একটি স্মৃতি?"
অয়ন মৃদু হেসে বলল, "আমি সেই সুর যা হৃদয় ছুঁয়ে যায়। আমি সেই ছায়া যা আলো আসলেই দেখা যায় না। কিন্তু আমি তোমার কল্পনায় চিরকাল থাকব।"

রিয়া চোখের জল ধরে রাখতে পারল না। তার জীবনে অয়ন একটি অধ্যায় হয়ে থাকবে, যা তাকে সৃষ্টিশীলতার নতুন দিশা দেখিয়েছে। সে তার বাঁশির সুর এবং অয়নের স্মৃতিকে ক্যানভাসে বন্দি করতে থাকবে।

সেই পাহাড়ের নীচে, পূর্ণিমার রাতে, একটি চিত্রকরের আর একটি আত্মার গল্প চিরকাল বেঁচে থাকবে

রিয়া কুসুমপুর থেকে ফিরে শহরে তার কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায়। কিন্তু অয়নের স্মৃতি এবং বাঁশিটির সুর তার মনে সবসময় জেগে থাকে। সে ঠিক করে, তার আগামী প্রদর্শনীতে একটি বিশেষ অংশ তৈরি করবে, যেখানে অয়ন এবং কুসুমপুরের গল্প ফুটে উঠবে।

তবে শহরে থাকার সময়, সে লক্ষ্য করে বাঁশিটির সুর মাঝে মাঝে তাকে কিছু নতুন কিছু জানানোর চেষ্টা করে। সুরটি যেন একধরনের ইঙ্গিত দেয়। একদিন, সে বাঁশির শব্দ অনুসরণ করতে করতে নিজের মনের গভীরে পৌঁছে যায়।

সেই রাতে রিয়া স্বপ্নে দেখতে পায় অয়নকে। অয়ন বলছে, "রিয়া, জোছনার আলোতে আমি তোমার সঙ্গে আছি, কিন্তু দিনের আলোয় আমাকে পাবে অন্যভাবে। তুমি যা খুঁজছ, তা কুসুমপুরের এক পুরানো মন্দিরে লুকানো।"

রিয়া অবাক হয়ে উঠে বসে। স্বপ্নটি এতটা বাস্তব ছিল যে মনে হচ্ছিল অয়ন সত্যিই কথা বলছিল। পরদিন, সে আবার কুসুমপুরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

কুসুমপুরে ফিরে গিয়ে সে গ্রামের বৃদ্ধদের সঙ্গে কথা বলে। তারা বলে, "হ্যাঁ, মন্দিরটি পাহাড়ের ওপরে। বহু আগে সেটি গ্রামের আত্মিক শক্তির কেন্দ্রস্থল ছিল। কিন্তু এখন এটি পরিত্যক্ত। সেখানে কেউ যায় না।"

অবশেষে রিয়া সেই মন্দিরে পৌঁছায়। মন্দিরটি জীর্ণ, কিন্তু তার গায়ে থাকা খোদাই চিত্র এবং বাঁশির অনুরূপ একটি প্রতীক দেখে রিয়া বিস্মিত হয়। মন্দিরের এক কোণে, একটি পুরনো কাগজের টুকরো পড়ে ছিল। সেটি ছিল অয়নের লেখা একটি গান—যা জীবনের শাশ্বত সুর নিয়ে লেখা ছিল।

রিয়া বুঝতে পারে, অয়ন শুধুমাত্র কুসুমপুরের একটি স্মৃতি নয়, বরং তার নিজের সৃষ্টিশীলতার অংশ হয়ে গেছে। সেই গানকে সে তার আঁকা ছবিগুলোর সঙ্গে যুক্ত করে, প্রদর্শনীতে নতুনভাবে তুলে ধরার সিদ্ধান্ত নেয়।

রিয়া মন্দির থেকে অয়নের গানটি নিয়ে শহরে ফিরে আসে। তবে সেই গান শুধু একটি গান ছিল না; এটি যেন একধরনের সংকেত, যা তাকে আরও বড় কিছুর দিকে নিয়ে যেতে চায়। রিয়া গানটি তার প্রদর্শনীতে যোগ করার আগে এক বিশেষ উপস্থাপনা পরিকল্পনা করে। সে গানটির সুর বাঁশি দিয়ে তুলে ধরে এবং তার ছবিগুলো এমনভাবে সাজায়, যেন প্রতিটি ছবি সেই সুরের প্রতিধ্বনি।

প্রদর্শনীটি একটি নতুন অধ্যায়ের শুরু হয়। দর্শকরা সুর শুনে যেন মোহিত হয়ে যায় এবং ছবিগুলোর গভীর অর্থ নিয়ে কথা বলতে থাকে। কিন্তু একটি দর্শক রিয়ার কাছে এসে একটি প্রশ্ন করে, যা তার মনকে নতুন দিশায় নিয়ে যায়।
দর্শক: "তুমি কি জানো, এই গানটি শুধু একটি সুর নয়। এটি আমাদের পুরানো ইতিহাসের অংশ। এই সুরের মাধ্যমেই একসময় এই গ্রামকে বাঁচানো হয়েছিল।"
রিয়া বিস্ময়ে বলল, "আপনি কী বলতে চাইছেন? এই সুরের গল্প আমি জানি না। আমাকে বলুন।"

দর্শক: "এই গান ছিল এক প্রাচীন আচার অনুষ্ঠানের অংশ। যখন গ্রামের মানুষ বিপদে পড়ত, তখন তারা এই সুর বাজিয়ে সাহায্য চাইত। মন্দিরের দেবতা সেই সুরের মাধ্যমে সংকেত পেতেন এবং গ্রামের মানুষদের রক্ষা করতেন।"

রিয়া এই তথ্য শুনে অভিভূত হয়। সে বুঝতে পারে, অয়নের দেওয়া গান শুধু তার সৃষ্টিশীলতা নয়, বরং এই গ্রামের ইতিহাসের একটি অংশ।

রিয়া আবার কুসুমপুরে ফিরে যায় এবং গ্রামের মানুষের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে। সে মন্দিরের ইতিহাস নিয়ে আরও গবেষণা করে এবং জানতে পারে যে মন্দিরটি পুনরুদ্ধারের কাজ শুরু করলে গ্রামের আত্মিক শক্তি আবার ফিরে আসতে পারে।

তবে, এই কাজে অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল। গ্রামের মানুষ বিশ্বাস করতে চায় না যে পুরনো বিশ্বাস আবার ফিরিয়ে আনা সম্ভব। রিয়া অয়নের গান এবং তার ছবিগুলো ব্যবহার করে গ্রামের মানুষদের উদ্বুদ্ধ করে।

রিয়া: "এই গান এবং এই মন্দির শুধু ইতিহাস নয়। এটি আমাদের বিশ্বাস এবং আমাদের সংস্কৃতির প্রতীক। আমরা যদি একসঙ্গে কাজ করি, তবে এটি আমাদের জন্য নতুন অধ্যায় নিয়ে আসতে পারে।"

অবশেষে, গ্রামের মানুষ সম্মত হয়। তারা একসঙ্গে মন্দির পুনরুদ্ধারের কাজ শুরু করে। পূর্ণিমার রাতে, যখন মন্দিরটি সম্পূর্ণ হয়, রিয়া অয়নের দেওয়া বাঁশিতে সেই সুর তোলে। পুরো গ্রাম জোছনায় মোহিত হয়ে যায়।হঠাৎ, রিয়া দেখতে পায় অয়নের ছায়া মন্দিরের আলোয়।

অয়ন: "তুমি পেরেছ, রিয়া। তুমি আমার সুরকে জীবিত করেছ। এখন আমি চিরদিনের জন্য তোমার স্মৃতিতে বেঁচে থাকব।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ