অধ্যায় ৪: নতুন শুরু
গ্রামের মানুষেরা অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল রাধা আর অভিরূপের দিকে।
তিন বছর পর অভিরূপ ফিরে এসেছে—চোখে পরিণত মানুষের স্থিরতা, অথচ সেই পুরোনো হাসিটা আজও মুখে।
সেই সন্ধ্যেটা যেন গোটা দেবগ্রামে নতুন আলো নিয়ে এসেছিল।
রাধার বাবা প্রথমে চুপচাপ ছিলেন। কোনো অভিযোগ করেননি, কেবল জিজ্ঞেস করেছিলেন—“তুই সত্যিই চিঠি লিখেছিস?”
অভিরূপ পকেট থেকে বের করেছিল পুরনো খামভরা চিঠিগুলো।
প্রমাণের আর দরকার ছিল না কিছুই। রাধার বাবা আর কিছু বলতে পারে না। বলার কিছু থাকেও না।
অঘ্রায়ন মাসের এক সন্ধ্যায় নির্দিষ্ট হল তাদের বিয়ের দিন। দুজনের মন খুসিতে মেতে উঠলো। সানাইয়ের সুরে আকাশ বাতাস মোহিত হয়ে গেল। তাদের বিয়ে হল একেবারে সাধারণভাবে—তবু যেন মন ভরে উঠেছিল সবার।
রাধা লাল বেনারসী পরে বসেছিল বিয়ের পিঁড়িতে। অভিরূপ সুন্দর পাঞ্জাবি আর ধুতি পরে এসেছিল। মুখে ছিল কাঞ্চনজঙ্ঘার মতো উজ্জ্বল হাসি নিয়ে।
শুভদৃষ্টির সময় চোখে চোখ রাখতেই যেন দুই হৃদয় কথা বলেছিল—“এবারে শুরু, দু’জনে একসাথে।”
বিয়ের পর রাধাকে নিয়ে কলকাতায় ফিরল অভিরূপ। ভাড়া ফ্ল্যাট ছোট, কিন্তু তাতে সাজানো একগুচ্ছ স্বপ্ন—একসাথে রান্না করা, রাতে ছাদে হাওয়া খাওয়া, একে অপরকে বই পড়ে শোনানো। রাধা প্রথমে অবাক হয়ে গিয়েছিল শহরের জীবন দেখে, কিন্তু ধীরে ধীরে অভিরূপের হাত ধরে সে মানিয়ে নিতে শিখল।
রাধা বলত- তুই চাকরির পর ক্লান্ত হয়ে যাস তাই রাতে আমি রাঁধব। তুই আমার চিঠির মতো—নীরব, অথচ কত কথা বলা যায় তোকে নিয়ে।
এই ভাবে ভালোবেসে দিন কাটে তাদের। একদিন, অভিরূপ একটি বিশেষ প্রতিবেদন লেখে—
“হারানো চিঠির গল্প”—নন্দীগ্রামের এক পোস্ট অফিস আর দুই প্রেমিকের বাস্তব কাহিনি।
এই গল্পটা পড়ে সারা বাংলা কেঁপে উঠল।
অনেকেই বলল—
“আমরা ভুলে গিয়েছিলাম চিঠি লিখতে।
তোমরা মনে করিয়ে দিলে—ভালোবাসা শুধু প্রযুক্তি নয়, অনুভবের জায়গা।”
পত্রিকা অফিসে আসতে থাকল শত শত পুরনো চিঠি—
যা কোনোদিন পোস্ট হয়নি, যেগুলো আবার প্রাণ পেল।
এক সন্ধ্যায় অভিরূপ ছাদে বসে রাধাকে জিজ্ঞেস করল—
“রাধা, যদি আমি না ফিরতাম, তাহলে?”
রাধা হাসল, বলল— তাহলে আমি লিখে যেতাম... যতদিন না ডাকবাক্স আমাকে ফিরিয়ে দিত তোর খবর।
অভিরূপ মাথা নিচু করে বলল— আর আমি তো তোকেই ডাকবাক্স ভেবে লিখেছি এতদিন।
মায়াবি চাঁদের আলোয় দুই প্রেমিকের মুখ যেন এক অদৃশ্য গল্পের পৃষ্ঠা হয়ে উঠে।
0 মন্তব্যসমূহ