ছায়ার মতো তুমি, অধ্যায় ১: শহরের নিঃশব্দতা

ছায়ার মতো তুমি

✍️ অতনু সরকার





অধ্যায় ১: শহরের নিঃশব্দতা

কলকাতা এক অদ্ভুত শহর। লাখো মানুষের হাজারো কোলাহল। কখনো কখনো মনে হয়, এ শহরটা একটা যান্ত্রিক যন্ত্র, যেখানে সবাই শুধু নিজের কাজে ব্যস্ত। তবু প্রতিদিন এখানে সৃষ্টি হয় অগণন শিল্পকর্ম—রচিত হয় প্রেম, আবার হারিয়ে যায় নিঃশব্দে।

এই শহরের কোলাহলের মধ্যেও কেউ কেউ এমন নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে, যেন হাজার মানুষের মাঝেও হারিয়ে যাওয়া এক সুর। সৌরভ তেমনই এক ছেলে—বয়স তেইশ, সদ্য কলেজ শেষ করেছে। কিন্তু জীবনের রঙ যেন কোথাও ফিকে। তারুণ্য হারিয়ে যাচ্ছে কোনো এক অজানা কারণে।

ভবানীপুরের এই পুরনো দোতলা বাড়িটা অনেক গল্প জানে। একসময় ছিল প্রাণে ভরা—মা, বাবা, ঠাকুরদা, পিসি… একে একে সবাই যেন সময়ের যাত্রায় হারিয়ে গেছে।

সৌরভ যখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে, তখনই তার মা মারা যান। বাবা ব্যাঙ্কের চাকরির সুবাদে এখন গোয়ায় থাকেন। ছেলেকে নিয়ে যাননি, কারণ—“ওর পড়াশোনা, ওর ভবিষ্যৎ… ও এখানেই ভালো থাকবে।”

এখন বাড়িতে শুধুই ঠাকুরদা আর এক বয়স্ক মাসি, যিনি রান্না-বান্না আর দেখাশোনা করেন। ঠাকুরদা—অরবিন্দ ঘোষ, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, সাহিত্য আর দেশপ্রেম যার রক্তে। সৌরভ তাঁকে ভালোবাসত, আবার একরকম ভয়ও করত। তিনি ছিলেন সৌরভের জীবনের একমাত্র অবলম্বন।

কিন্তু কখনো কখনো ভাগ্য আর নিয়তি বড়ই নিষ্ঠুর হয়।
গতকাল ঠাকুরদা চিরবিদায় নিয়েছেন।



ঘরজুড়ে নেমে এসেছে নিঃসঙ্গতা আর নীরবতা।
ছোট ছোট কাগজের স্তুপ, কিছু পুরোনো চিঠি, ডায়েরি, চশমা, কলম—সৌরভ নিজেই ঠাকুরদার বইয়ের আলমারি খুলে পরিষ্কার করতে করতে হঠাৎ দেখতে পেল এক পুরনো নীল কাপড়ে মোড়ানো ছোট্ট কাঠের বাক্স।

বাক্স খুলতেই প্রথমেই পড়ে যায় একটি ধুলোমাখা সাদাকালো ছবি।
ছবিটায় একটা মেয়ে, বয়স ষোলো-সতেরো, চোখে সরলতা, ঠোঁটে হালকা হাসি।
ছবির পেছনে লেখা—
“আমার ছায়া — মেঘলা।”

সৌরভ চমকে ওঠে।
মেঘলা কে?
আর ঠাকুরদা, যিনি এত গম্ভীর, এত কঠিন মানুষ—তাঁর জীবনে কেউ এমন “ছায়া” হয়ে থাকতে পারেন?

ভাবতে ভাবতে সৌরভ ডায়েরির পাতাগুলো উল্টে দেখতে থাকে—একটার পর একটা লেখা, যার মধ্যে যেন লুকিয়ে আছে এক সম্পর্ক, এক রহস্য… আর এক অজানা গ্রাম—বৈদ্যপুর

ডায়েরির শেষ পাতায় ঠাকুরদার কাঁপা কাঁপা হাতে লেখা—

“যদি কখনো আমার গল্প জানতে চাস, বৈদ্যপুর চলে যাস।
মেঘলা হয়তো এখনো চিঠিগুলো রেখে দিয়েছে…”

সৌরভের বুকের ভিতর কেমন এক অজানা টান লাগে। বুকের মধ্যে যেন সমুদ্রের ঢেউ ওঠে। হাজার প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে মনে।
সে তাকিয়ে থাকে ছবিটার দিকে অনেকক্ষণ।
তাকিয়ে থাকে এক নিরব কিশোরীর দিকে—মেঘলা
তারপর…

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ