অপরাজেয় প্রেম
অতনু সরকার
প্রথম পর্ব
আমতলা বাসস্ট্যান্ডের পাশ দিয়ে একটি রাস্তা ডানদিকে বেঁকে ভিতর দিকে প্রবেশ করেছে। সেই রাস্তা ধরে বেশ কিছুটা পথ হেঁটে গেলে, ঠিক তার শেষ প্রান্তে পড়বে বিশাল এক আম বাগান। এই আম বাগানের মধ্যে দিয়ে একটি সরু রাস্তা গ্রামের মধ্যে প্রবেশ করেছে। গ্রামের প্রায় মাঝখানে একটি আম গাছের তলায় বড় একটি মাটির বাড়ি। মাটির দেওয়াল সুন্দরভাবে পরিষ্কার করা। গ্রামগঞ্জে মাটির বাড়ি খুব দেখা যায়। মাটির দেওয়াল সুন্দরভাবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। কোন কোন বাড়ি আবার রং করা। উঠোনটি পরিষ্কার ঝকঝক করছে। তার এক প্রান্তে দু চারটি ফুল গাছ। তাতে আবার লাল নীল কয়েকটি চাষ তার প্রধান জীবিকা। রয়েছে কয়েকটি পুলুর। সেখানে মাছ চাষ হয়। সংসারে তার কোন অভাব নেই। ভালোভাবেই চলে যায় সংসার। শশীকান্তর দুই মেয়ে এবং এক ছেলে। বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছে কুসুমপুর গ্রামে। মেজ মেয়েটি কলেজে পড়ে। ছেলে এবার স্কুল ফাইনাল দিয়েছে। মেজ মেয়ে সুমিতা সর্বদাই বাড়িতে থাকে। বাড়ির কাজ আর মায়ের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করে দেওয়া আর সময় মত কলেজে যাওয়াই তার প্রধান কাজ বলে মনে করে সে। গ্রামে তাদের একটা সুপরিচিতি আছে। কয়েকদিন হল কুসুমপুর গ্রাম থেকে বড় মেয়ে পারমিতা বেড়াতে এসেছে। সঙ্গে তার একমাত্র ছেলে অভিষেক। তার স্বামী অলক কাজের চাপে আসতে পারেনি।পারমিতা অনেকদিন পরে এসেছে এখানে, কিছুদিন থাকবে। কিছুদিন পরে তার ছোট ভাই প্রীতিশের রেজাল্ট বের হবে। রেজাল্ট কি হয় তা না জেনে কি বাড়ি যেতে পারে? ছেলে হিসেবে প্রীতিশ খুবই ভালো। পাড়ার আর সব ছেলেদের মত নয়। তাদের থেকে অনেকটাই আলাদা। পাড়ার ছেলেরা কেউ ভালো করে পড়াশোনা করে না। দিনরাত ঘুরে বেড়ায়, আড্ডা মারে। কিন্তু এসবের দলে প্রীতিশকে পাওয়া যাবে না। সকালে পড়া অথবা চাষবাস দেখাশোনা করা, আর বিকেলে হলে বন্ধুদের সঙ্গে মাঠে ফুটবল খেলা। পড়াশোনায় ভালো সে কিন্তু যেহেতু পরীক্ষা শেষ তাই এখন পড়ার চাপ নেই। রেজাল্টের দিন একটা একটা করে ঘনিয়ে আসতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত ঘনিয়ে এলো রেজাল্টের দিন। রাতের দিদিদের সাথে গল্পের ফাঁকে তার বারবারই মনে হচ্ছিল পরের দিন রেজাল্ট বের হওয়ার কথা। মাঝেমধ্যে ভেসে উঠছে দু একজন চেনা সহপাঠীর মুখ। সন্তোষ, সুভাষ ওরা কেমন আছে? কোথায় আছে? কি করছে? আরো কত কি মনে হতে লাগলো প্রীতিশের। তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছে মনে নেই। বড়দি পারমিতা ডেকে তুলে ঘুম চোখে খাইয়ে দিয়েছে। তারপর আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। এসবের কিছুই ওর মনে নেই।
অনেক দিনের অপেক্ষার অবসান। সকাল থেকেই একটা তাড়াহুড়া সকলের মধ্যে। প্রীতিশ খেয়ে বেরিয়ে পড়ল। বাড়ির সবাই উৎকণ্ঠের মধ্যে আছে। কি হয় না হয় তা জানার জন্য। সবাই প্রতীক্ষা করছে। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার পথে সন্তোসের সাথে দেখা হল। দুজনের গল্প করতে করতে প্রবেশ করল স্কুলের মধ্যে। গ্রামের স্কুল। অনেক পুরনো। তার বাবার মুখে শুনেছে তিনিও এই স্কুলে পড়তেন। দেয়ালের কোথাও কোথাও রং নেই, কোথাও বা দেওয়াল চটে গেছে। দু একটি দরজা জানালা ভেঙে গেছে । স্কুলের হেড স্যার না এলে রেজাল্ট টানানো হবে না বলে জানিয়ে দিলেন সুবোধ বাবু। তিনি স্কুলের অনেক পুরনো মাস্টার মশাই। ছেলেরা কেউ আর ঠান্ডা হয়ে অপেক্ষা করতে পারছে না। কেউবা ক্লান্ত হয়ে স্কুলের সামনে বড় শিশু গাছটার তলায় মাটিতেই বসে পড়ল। যেমন ভাবে ছোট ক্লাসে থাকতে ওরা এই গাছ তলায় গিয়ে বসতো ঠিক তেমনি ভাবে। কোথাও বা জোট বেঁধে গল্প হচ্ছে। এমন সময় সব প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে হেড স্যার বৈদ্যনাথ বাবু রেজাল্টটা নিয়ে দিলেন। বোর্ডের সামনে ভীষণ ভিড়। কোনক্রমে এপ্রীতিশ নিজের নামটা খুঁজে দেখে, তারপর এক লাফে স্কুলের বারান্দা থেকে নিচে। পা-স পা- স বলে চিৎকার করেতে থাকে। আরো কয়েক জনের চিৎকার- পা - স। স্যারদের প্রণাম করে গেট থেকে বেরোবার পথে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল প্রীতিশ। আরে সন্তোষ না। কিন্তু ও এখানে দাঁড়িয়ে কেন? যাই হোক প্রীতিশ এগিয়ে গেল সন্তোসের দিকে। তারপর বলে - এখানে দাঁড়িয়ে কি করছিস?
সন্তোষ পাচিলের আড়ালে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। প্রীতিশের ডাক শুনে এগিয়ে এসে কেঁদে ফেলল।
তারপর বলল - পাস করতে পারলাম না। ফেল করে গেলাম রে ভাই। তাই ওখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
দুঃখে ভরে উঠলো প্রীতিশের মন। প্রিয় বন্ধুর খবর শুনে মনটা ভীষণ রকম খারাপ হয়ে গেল। পাস করার আনন্দ মিলিয়ে গেল কিছুক্ষনের জন্য। কাছে গিয়ে জোড়িয়ে ধরল সন্তোস কে। অনেক সান্তনা দিল । তার পর দুজনের বাড়ির দিকে পা বাড়ালো। দুপাড়ায় বাড়ি দুজনার। ফেরার পথে প্রীতিশ বার বার বলে দিয়েছে বিকেলে মাঠে যাওয়ার কথা। মাঠে ফুটবল খেললে মনটা একটু হালকা হয়ে যাবে। সন্তোস মাথা নেড়ে চলে যায়।
দিদিরা বাড়ির গেটের কাছে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে ওর জন্য। প্রীতিশ এক লাফে মাকে জড়িয়ে ধরল। দিদিরা বুঝলো পাস করেছে। পাড়ার মধ্যে দ্রুত খবর ছড়িয়ে পড়ল। পাড়ার দু একজন সমঝদার লোক এসে অভিনন্দন জানিয়ে গেল। গর্ভে ভরে উঠল মায়ের বুক।
প্রীতিশ প্রথম এই গ্রাম থেকে এমন ভালো ফল করেছে। কিন্তু প্রীতিশের মনে আনন্দ বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। ও বারবার মনে করছিল সন্তোসের কথা। মনে মনে ভাবছিল - কে জানে ও বাড়ি গিয়ে কি করছে? ওরা দুই ভাই। অবস্থা খারাপ নয়। ওর বাবা অবস্থাবান চাষী। কিন্তু হলে কি হবে, সন্তোষের মন ভীষণ অভিমানী। বাড়িতে গেলে সবাই ওকে তিরস্কার করবে। আর ও কি করে সামলাবে কে জানে। সন্তোষ বড় অভিমানী। সন্তোষের কথা ভাবতে ভাবতে প্রীতিশের মন ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ল। বাড়ির সবাই যখন আনন্দের মাতোয়ারা তখন প্রীতিশ বারান্দার এক কোণে বসে। দিদিরা অবাক। দিদিরা যখন জানলো তখন তাদেরও মনে একটু দুঃখ হলো। তারপর দুপুর গড়িয়ে বিকেল। সবাই মাঠে উপস্থিত। কিন্তু সন্তোষের দেখা নেই। ফুটবলটা সে ভালো খেলে। রোজ মাঠে ওর যাওয়া চাই। কামাই নেই একদিনও। কিন্তু আজ কি হলো।
নাড়ু বলল - আসবে হয়তো একটু দেরি করে।
সবাই ভাবল হয়তো তাই। কিন্তু সেদিন আর সন্তোষ আসে নি।
এদিকে বাড়িতেও তার পাত্তা নেই। সন্ধ্যা হলো। সন্তোষ বাড়ি ফিরল না। অন্য দিন সন্ধ্যে হলেই বাড়ি ফিরে আসে। সন্তোষের বাবা-মা অস্থির হয়ে উঠলো। সন্তোষের বাবা রথীন বাবু প্রীতিশদের বাড়িতে খোঁজ নিল। অন্য আরও যেখানে খোঁজ নেওয়ার দরকার সেখানে খোঁজ-খবর নেওয়া হল। কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না। কাউকে দিয়ে আত্মীয়র বাড়িতেও খোঁজ নিতে পাঠানো হলো। প্রীতিশ ছুটে গেল তাদের আড্ডাখানায়। যেখানে ওরা দুই বন্ধু মাঝেমধ্যে গল্পের আসর বসাতো। সেই মাঠের ধারে জঙ্গলের মধ্যে গেল প্রীতিশ , কিন্তু সেখানেও নেই। শুধু একটা ভাঁজ করা কাগজ ফুল দিয়ে মোড়া আছে। প্রীতিশ সঙ্গে সঙ্গে তুলে নিলো কাগজটা। টর্চের আলোয় ভালো করে পড়া যাবে না ভেবে, কাগজটা পকেটে ঢুকিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এলো। বাড়ি ফিরে হ্যারিকেনের আলোয় সেটা পড়ে অবাক হয়ে গেল প্রীতিশ। লেখা আছে -
প্রিয় বন্ধু প্রীতিশ,
ফেল করা জ্বালা আমি সহ্য করতে পারছি না। বাড়িতে থাকলে অশান্তির সৃষ্টি হচ্ছে। তুই তো জানিস এসব আমি সহ্য করতে পারি না। ইচ্ছে করছিল আত্মঘাতি হই, কিন্তু মরার জন্য তো আমি আসিনি। তাই যে দিকে মন চায় সেদিকে চললাম। আমার জন্য কোন চিন্তা নেই। বাড়িতে একটা খবর দিয়ে দিস। এখানে বসে লিখলাম, আর যাতে কাগজটা নজরে আসে তার জন্য একটা ফুল রেখে দিলাম।
ইতি সন্তোষ।
পড়া শেষ করে প্রীতিশ সেই অন্ধকারে দৌড় দিল সন্তোষদের বাড়ির দিকে। ওর বাবা-মা সন্তোষের এই খবর শুনে কান্নায় ভেঙে পড়ল। তারপর থেকে আর কেউ কোনোদিন সন্তোষকে এই অঞ্চলে দেখেনি।
এই অঞ্চলে কোন উচ্চ বিদ্যালয় নেই, যেখানে একাদশ বা দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়া যায়। একটি কলেজ রয়েছে কাছাকাছি। সেখানে ভর্তির জন্য প্রায় দৌড়াদৌড়ি করতে হচ্ছে প্রীতিশকে। আশির বা নব্বই এর দশকের কলেজে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হওয়া যেত। বাড়ির সকলেরই ইচ্ছা প্রীতিশ কলেজে পড়ুক। আরো বড় হোক । অনেক ছোটাছুটির পর প্রীতিশ ভর্তি হল গ্রাম থেকে বারো মাইল দূরে হুগলির, হুগলি মহসিন কলেজে। বাড়ি থেকে সাইকেলে কলেজে যেতে হয়। বাসের ব্যবস্থা থাকলেও বাড়ি থেকে দু মাইল দূরে। অর্থাৎ দু মাইল সাইকেলে গিয়ে সেখানে কোথাও সাইকেল রেখে তারপরে বাসে যেতে হবে। কলেজে কত নতুন নতুন মুখ। কত নতুন ছেলে মেয়েদের সঙ্গে পরিচয় হলো। কেউ বা বন্ধু কেউ বা বান্ধবী। কলেজের দিনগুলি বেশ ভালোভাবে কাটতে থাকে তার।
0 মন্তব্যসমূহ