প্রতিশ্রুতি

 প্রতিশ্রুতি 

অতনু সরকার




শহরতলীর ব্যস্ততাপূর্ণ একঘেয়েমি জীবন ছেড়ে বহুদিন পর এই বালি মাটি গ্রামে এসে আমার জীবন সার্থক হল। আমি যখন এখানে এসে পৌঁছেছি তখন সবে রাত শেষ হতে চলেছে.  ট্রেন থেকে নেমে একটি গরুর গাড়ি চেপে এই বালি মাটির দিকে রওনা হয়েছিলাম গতকাল রাত দুটোয়। গরুর  গাড়ি কথাটা শুনলে নিশ্চয়ই আপনাদের একটু অবাক লাগবে। আসলে এখানে এখনো আধুনিকতার ছোঁয়া এসে পৌঁছায়নি।  গাড়ি ঘোড়া এখানে খুব একটা চলেই না বললে চলে।  ১৯৮০ সাল। গ্রাম বাংলায় তখনো বিদ্যুতের আলো পৌঁছায়নি সব জায়গায়।  গরুর গাড়ি থেকে যখন নামলাম তখন শেষ রাত। 

রাতে ভালো ঘুম হয়নি।  চারিদিকে গাছ পালায় ঘেরা একটি গ্রাম।  দু একটি করে পাখি ও ডাকতে শুরু করেছে।  কাকের বিকট ডাকে সবে কান ঝালাপেলা করতে শুরু করেছে। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ছোট্ট নদী ঝিল্লি।  ভোরের আলোয় ঝকঝক করছে তার পরিষ্কার জল। সেই ঝিল্লী নদীর ধার দিয়ে সবুজ গাছপালার মধ্যে দিয়ে একটি মাটির হাঁটা পথ। সেই হাঁটা পথ  দিয়ে আমি এগিয়ে চললাম আমার অভিন্ন হৃদয় বাল্যবন্ধু শ্রীমান অমর মন্ডল এর বাড়ির দিকে।  ঝিল্লির উপরে গাছ পালার মধ্যে দিয়ে পূর্বাকাশে রক্তিম বর্ণ সূর্য উঠেছে।  এই উষা কালীন  সূর্য দেখতে কেমন লাগে তা চোখে না দেখলে বলে বোঝানো যায় না।  কিছুক্ষণ সেই সুন্দর দৃশ্য দেখে আবার পথ চলতে শুরু করলাম। যখন অমরদের বাড়ি গিয়ে সে পৌছালাম তখন তারা সবে ঘুম থেকে উঠেছে। 

আমাকে দেখে খুব একটা যে অবাক হয়েছে তা নয়, কারণ চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলাম আমার আসার কথা।  


অমরের বাবা বন বিভাগে কাজ করে, কিছুদিন আগে তিনি আসামের কোন এক জঙ্গলে গেছেন।  দুতিন মাস পরে ফিরবেন।  ওদের বাড়ির সবার সঙ্গে আমার অনেক দিনের পরিচয়। দু বছর আগেও অমররা হুগলিতে ছিল।  আমরা ছোটবেলা থেকেই একই সঙ্গে একই স্কুলে, কলেজে পড়েছি,  খেলেছি একই খেলার মাঠে একসঙ্গে। 


কিছুদিন যাবত আমার মনটা তেমন ভালো লাগছিল না।  ক্রমেই বিষন্ন হয়ে পড়ছিলাম।  আর সে কথা ওকে চিঠিতে জানাতেই ও আমাকে এখানে আসতে বলেছিল।  আমিও চলে এসেছি। দুপুরে শুয়ে পুরনো দিনের কথা একে অপরকে শোনাচ্ছিলাম আমরা।  আর ঠিক তখনই আমাদের বিছানার পাশ দিয়ে এক যুবতি ধীর পদব্রজে অবনতমস্তকে চলে গেল।  আশা করি বয়স আঠারো কি   ঊনিশ হবে।  


অমর কে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম যে মেয়েটির নাম লাবনী।  তার বাবা মারা যাওয়ার পর মায়ের কাছেই মানুষ। অমরদের বাড়িতে ছোট থেকেই মানুষ এবং প্রতি বছর তাকে ভাইফোঁটা দেয়।  তাতে অবশ্য আমার কোন যায় আসে না।  প্রসঙ্গ বদল করে আবার অন্য গল্প শুরু করলাম।  বিকেলবেলা আমি একা হাঁটতে শুরু করলাম। অমরের কি একটা কাজ ছিল তাই সে আমার সঙ্গে আসতে পারেনি।  তাই একা একাই পথ চলতে শুরু করলাম।  ছোট চঞ্চল ঝিল্লি নদী আর একপাশে সু বিস্তর সবুজ ধানক্ষেত আর বড় বড় গাছ।  চারিদিকে কি সুন্দর।ক্ষণে ক্ষণে পাখির ডাক আমার মনকে বড় চঞ্চল করে তুলছিল।  নদীর ধারে এক বিরাট বট গাছ।  চারিদিকে তার বড় বড় শিকড়। আমি গিয়ে বস্লাম তার  উপর গিয়ে।


মৃদু মৃদু বাতাস এসে আমাকে প্রকৃতির গান শুনিয়ে গেল।  আমি শুধু দেখছিলাম প্রকৃতির অপরূপ রূপের ছন্দময় সহাবস্থান। আর কখন যেন ভুলে গেলাম আমি কে?  কেন এসেছি? কোথায় এসেছি? ভুলে গেলাম আমার অতীত, বর্তমান।  আমি এখন মুক্ত বিহঙ্গ।  উন্মুক্ত নীল আকাশের নিচে সম্পূর্ণ একা।  আর উপরে সীমাহীন আকাশ। সম্মুখে কল্লোলিনি ঝিল্লি নদী। 


দুদিন  অতিক্রান্ত হয়ে গেল।  আমি আর অমর সারাদিন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়াই।  সবুজ বন আর কোথাও ধানক্ষেত।  নদীর পাড় ধরে সারাদিন ঘুরে বেড়ানো।  শুধু একবার খেতে ফিরে যাওয়া। তারপর আবার যতক্ষণ না সন্ধ্যা হয় ততক্ষণ ঘুরে বেড়ানোর পালা।  সন্ধ্যার সময় বাড়ি ফিরে যখন মাসীমার কাছে  গল্প শুনতাম তখন মনে হতো আমরা আমাদের পুরনো শৈশব ফিরে পেয়েছি।  মাঝে মাঝে দেখতাম লাবনীয় মাসিমার কাছে বসত।  কখনো কখনো চোখে চোখ পড়লে আমি চোখ ফিরিয়ে নিতাম। এখনও ওর সঙ্গে পরিচয় হয় আমার। গল্প শেষ করে যখন বাড়ী ফিরে যেত,  পিছন ফিরে  কয়েকবার দেখে নিতো আমি ওকে দেখছি কিনা। 

চোখে চোখ পড়লে দৌড়ে ঘরে ঢুকে যেতে।  আমি সেই দিকে চেয়ে থাকতাম।  অমরের ডাক শুনে সম্বিত ফিরে পাই।  আমি খেতে খুব ভালোবাসি তা মাসিমা বেশ ভালো করেই জানে। তাই প্রায়ই দিন নানা  রকমের নতুন নতুন রান্না করে খাওয়াতেন। একদিন দুপুর বেলা আমি আর অমর খেতে বসেছি।  হঠাৎ পিছন দিক থেকে ঝুম ঝুম  শব্দ শুনে ফিরে তাকাতেই চোখ পরল লাবনীর দিকে।  হাতে তার কি একটা পাত্র। ধীর পায়ে আমাদের অতিক্রম করে রান্নাঘরে ঢুকে গেল।  সে ফেরার পথে অমর জিজ্ঞাসা করল-  কিরে লাবনী লুকিয়ে লুকিয়ে কি দিয়ে গেলি রে?  

লাবনী উত্তর দেয় - জানিনা। 

তারপর দৌড়ে পালিয়ে যায়।  খেতে খেতে ভেটকি মাছের তরকারিটা কয়েকবার দুজনেই চেয়ে নিলাম। বেশ ভালো হয়েছিল। খাওয়ার পরে মাসিমার কাছে জানতে পারলাম সেই তরকারিটা নাকি লাবনী রান্না করে দিয়ে গিয়েছিল। সে যে ভালো রান্না করতে পারে তা বোধহয় জানিয়ে গেল।  


বিকেলে অমর পড়াতে যায়।  রোজকার মতো আজও পড়াতে গেছে আমি একটা চেয়ার নিয়ে দক্ষিণ দিকের বারান্দায় বসে পড়লাম। এই দিকটায় কতগুলো ফুলের গাছ , আর বড় বড় দুটো দেবদারু গাছ ছাড়া আর কিছু নেই। আমি সেই ফুল গাছের দিকে তাকিয়ে ফুটন্ত ফুলগুলি তন্ময় হয়ে দেখছিলাম হঠাৎ কি খেয়াল করলাম গাছের আড়ালে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। কিছু দেখা যাচ্ছে না।  তবে কোনো মহিলার শাড়ির আঁচল দেখা যাচ্ছে। আমি সেই ফুল আর তার উপর বসা প্রজাপতিগুলো দেখছিলাম।  কিন্তু কখন যেন আমার চোখ দুটো আবার ওদিকে চলে গেল বুঝলাম না।  দেখলাম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে লাবনী চোখে চোখ পড়তেই চুপ করে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল।  আমি চেয়ে রইলাম সেই দিকে।  এবার বোধহয় লাবনী নিজেকে শক্ত করে উঠে দাঁড়ালো।  আমাকে ইঙ্গিতে ডাকল।  আমি অবাক বিস্ময়ে ইঙ্গিত করে বললাম -  আমি? 

সে  ইঙ্গিত করে বলল -  হ্যাঁ?  

আমি কি করবো আর কি করবো না ভেবে উঠতে  পারলাম না।  

মাসিমাকে বললাম - নদীর ধারে বেড়াতে যাচ্ছি।

 তারপর খুব সাবধানে সেই গাছের দিকে যেতেই দেখলাম লাবনী নদীর দিকে হাঁটতে শুরু করেছে।  আমি ভাবলাম এ আবার কেমন?  আমাকে ডেকে নিজেই চলে যাচ্ছে। আমি অগত্তা ওর পিছু নিলাম।  কিছুটা হাটার পর একটা নির্জন নদীর ধারে দাঁড়ালো সে।  আমিও তার পিছনে গিয়ে দাঁড়ালাম।  লাবনী অল্প ঘুরে দেখল,  যে আমি আছি কিনা।  তারপর আবার চুপচাপ। কারোর মুখে কোন কথা নেই।  

আমি সেই দীর্ঘ নীরবতা ভঙ্গ করে বললাম - ডাকলে কেন?  

লাবনী কোন কথা বলল না। আমি আবার বললাম -  ডাকলে কেন?  

সে বলল  - এমনি কিছু না।  

আমি বললাম -  এমনি তো কেউ কাউকে ডাকেনা?  

এবার লাবনী আমার দিকে ঘুরে দাঁড়ালো।  এতক্ষণ নদীর দিকে তাকিয়ে কি ভাবছিল কি জানি।  ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল- রাগ করলে নাকি?  

আমি – রাগ?  কই না তো।  

লাবনী - তোমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করলো,  তাই ডাকলাম।  

আমি বললাম-  বেশ তো বলো না?  

লাবনি - মাসিমার  কাছে তোমার সব কথা শুনেছি। 

আমি বললাম -  আর কিছু জানতে চাইলে বলো আমি অবশ্য তোমার কথা শুনেছি।  উত্তর  আমার কাছে শুনেছি 

লাবনী - কি শুনেছো? 

আমি বললাম - সুনেছি তোমার কথা। তোমার গুনের কথা। 

লাবনী - অমর দার শুধু বাড়াবাড়ি। 

কথাটা বলে সে দৌড় দিয়ে চলে গেল। আমি দাক্লাম - লাবনী,  শোনো  লাবনী।  

কে কার কথা শোনে। অনেক দূর গিয়ে একবার পিছন ফিরে তাকালো।  তারপর কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল সেই জানে।  ততক্ষণ আমি চুপ করে দাঁড়িয়েছিলাম।  ওর ছুটি চলে যাওয়া দেখছিলাম।  এবার আপন মনে চলতে শুরু করলাম।  


পরের দিন সকাল বেলা অমর বেরিয়ে গেল ওর কাজে।  আমার ঘরের সব কটা জানালা খোলা।  নদীর দিক থেকে বেশ হাওয়া আসছে।  সকালে সূর্যের আলো আর ফুরফুরে হওয়া ঘরে ঢুকেছে। মাসিমা রান্নাঘরে  রান্নার ব্যস্ত।  আমি মন দিয়ে একটা গল্পের বই  পড়ছিলাম। এক দল যুবতীর সমবেত চিৎকারে আমার  একাগ্রতা ভেঙ্গে গেল। আমি পড়া ছেড়ে জানার দিকে তাকাতে যাব, এমন সময়  আমার গায়ে একটা কাগজের টুকরো এসে পড়ল।  সেই সঙ্গে একটি ছায়ামূর্তি জানালা থেকে সরে গেল।  আমি কাগজটি কুড়িয়ে ধীরে ধীরে পড়ার চেষ্টা করলাম। 


একটা সাদা কাগজে একটাই লাইন লেখা।  “আমি তোমাকে ভালোবাসি”।  

এইটুকুই ব্যাস। আমি বুঝতে পারলাম ওর মনের কথা।  কিন্তু আমি যে অপারক সেটা ওকে জানাতে হবে।  এই ভবঘুরে যাযাবর জীবনে কাউকে সঙ্গী করা খুব একটা সুখের কাজ হবে না। জীবনের বেশির ভাগ  সময় এই ভাবে নানান জায়গায় ঘুরে কেটে যায়। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলাম আমাকে যেতে হবে ওর কাছে।  বইটা বন্ধ করে ওদের বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম। 


বিধবা লাবনীর মা গৃহকর্মে ব্যস্ত ছিল। আমাকে দেখে তাড়াতাড়ি একটা মাদুর পেতে দিল।  এখানে বেশিরভাগ বাড়ি কাঁচামাটির। সুন্দর পরিপাটি ও পরিচ্ছন্ন করে সাজানো গোছানো। উঠোন পরিষ্কার ঝকঝকে।  মাটির বাড়িগুলো বেশ ভালই লাগে।  আমি বসার সঙ্গে সঙ্গে লাবনী ঝড়ের মতো ঘরে ঢুকলো।  মাসিমা জলের পাত্র নিয়ে বেরিয়ে গেলেন জল আনতে। হয়তো জলের খুব দরকার ছিল। তা না হলে আমাকে বসিয়ে যাবে কেন। লাবনী আমার পাশে এসে বসলো।  তারপর বলল - মা জল তুলতে গেছে। ফিরতে হয়তো দেরি হবে।  

আমি উত্তর দিলাম - তবে আমি কি চলে যাব?  

লাবনী চুপ করে রইল।  আমি কিছুক্ষণ চুপ করে তারপর বললাম -  পাগলামি না করলেই কি নয়?  

লাবনী ধীরে ধীরে মুখ তুলে বললো - কিসের পাগলামি?  

আমি বললাম - ওই যে তোমার চিরকুটে কি লিখেছ?  

লাবনী - যা সত্য তাই।  

আমি বললাম -  সবই ঠিক।  কিন্তু আমি যে এখানেই থাকতে আসিনি।  তাছাড়া ক্ষনিকের ভালোলাগা আর ভালোবাসা এক নয়।  এ ভালোবাসা দীর্ঘদিন থাকেনা।  চোখের আড়াল হলেই হারিয়ে যায়। হয়তো এখন ভাল লাগছে। আমার জীবনের কথা শুনলে ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালাবে। 

লাবনী -  কেন?  কেন?  পালাবে কেন?  

আমি বললাম - চোখের আড়াল হলেই ক্ষণিকের ভালোলাগা একদিন ঝরে যাবে শুকনো পাতার মতোন।  তাছাড়া কাউকে জীবন সঙ্গী করে দুঃখ দিতে চাইনি আর চাইনা।  তবুও বলবো ভেবে দেখো ভালো করে। 

লাবনী - ভেবেছি আর ভেবেছি বলেই বলেছি।  

আমি - অল্প সময়ে দেখায় অনেকেরই অনেককে ভালো লাগে। অবশ্য আমারও লেগেছে। সবকিছুকে সবসময় বাস্তবে রূপান্তর করা যায় না। একে অপরকে বিশ্বাস না করলে বা বুঝতে না পারলে এ সম্পর্ক টেকে না। তাছাড়া আমরা কেউ কাউকে জানি না । বিশ্বাস তো অনেক দুরের কথা। 

লাবনী উত্তর দিলো - ওটা কোন কথা নয়।  যাক আজ কোথায় যাওয়া হবে শুনি?  

আমি বললাম -  তুমি যাবে নাকি? 

লাবনী - নিয়ে যাবে?  যেতে ইচ্ছা করলেও অমর দা থাকতে আমাকে নিয়ে যাবে না।  

আমি বললাম - দেখা যাক অমর আসুক।  

বলতে বলতেই অমরের ডাক শুনে লাবনীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম। 

অমর বলল - আজ পাহাড় দেখতে যাব। 

আমি বললাম - পাহাড়?  বাহ কখন যেতে হবে?  

অমর বলল -  দুপুরে খেয়ে বেরোবো।  

আমি বললাম - তবে চল আজ নদী থেকে স্নান করে আসি।  

অমর বলল - চল 

ঝিল্লির জলে এই প্রথম অবগাহন করলাম। তারপর দুপুরে খেয়েদেয়ে বেরিয়ে পড়লাম পাহাড়ের সন্ধানে।  


দুজনে হাঁটতে শুরু করলাম।  কিন্তু বারবার আমার মনে পড়ছিল লাবনীর কথা। একবার ভাবলাম অমরকে বলি। তারপর ভাবলাম না থাক।  পরে বলা যাবে।  আমি নিজেই আগে একটা সমাধান বার করি তারপর দেখা যাবে। লাবনী তো দেখতে খারাপ তা নয়।  বেশ গোলগাল মুখ।  টানা টানা চোখ। লম্বাটে, ফর্সা গড়ন।  তাহলে আমারই বা আপত্তি কোথায়? আর একটু ভাবি। আমি আমার এই জীবন যাযাবরের মতো কাটাবো নাকি সংসার জীবনের বাঁধনে বাঁধা পড়বো, সেটাই তো ঠিক করে উঠতে পারলাম না।  আমার এই আঠাশ বছরের নাতি দীর্ঘ জীবনটা ঘুরে ঘুরেই তো কাটলো।  জীবনে কোথায় কখন থাকি তা আমি নিজেও জানিনা।  তার মধ্যে যদি আবার একজনকে সঙ্গে নিই তাহলে তার কি হবে?  

হঠাৎ অমর বলল - কিরে কি ভাবছিস?  কোন কথা বলছিস না যে।  

আমি সম্বিত ফিরে পেলাম। বললাম -  দেখছি এই সুন্দর জঙ্গল।  

তারপর আবার পথ চলা। রাঙ্গামাটির পথ আর ছোট ছোট টিলায় ভরা পাহাড়  দেখে ফিরে এলাম সন্ধ্যায়।  এখানে এসেছি বারোটা দিন অতিক্রান্ত হয়ে গেল। এবার ফেরার পালা।  অনেকগুলো দিন পেরিয়ে গেল  আমি ঘর ছেড়ে এসেছি। এখানে অবশ্য একাকীত্ব কোন ছাপ ফেলতে পারেনি।  কলকাতায় একটা ছোট্ট ফ্লাট।  আজ এখানে কাল ওখানে করেই কেটে গেছে প্রায় পাঁচটা  বছর। নিজের বাড়ি আর ফেরা হলো না। কেউ নেই সেখানে। বাবা মা কে হারিয়েছি সে কোন শৈশবে। জায়গা জমি সব দখল করে নিয়েছে কাকারা- জেঠারা।  এখান থেকে ফিরে কোথায় যাব তারও ঠিক নেই। ফেরার জন্য রাতে সব গুছিয়ে রেখেছি।  অমর আর মাসিমাকে বলেছি ওরা জানে আমি কালকে যাব। 


রাতে ঘুম এলনা। পরদিন সকালে গেলাম  ঝিল্লিতে স্নান করতে।  ভাবলাম শরীরের ক্লান্তি নদীর জলে ধুয়ে আসবো।  ঘাটে তখন অনেক সমবয়সী যুবতীরা স্নান করছে।  তাদেরকে দেখে আমি অন্য ঘাটে যাব এমন সময় কানে এলো চিৎকার।  ঘুরে দেখলাম ঘাটের অল্প জলে দাঁড়িয়ে মেয়ে গুলো বাঁচাও বাঁচাও করে চিৎকার করছে। আমি দৌড়ে কাছে গিয়ে দেখলাম একটি মেয়ে জলে হাবুডুবু খাচ্ছে। চেনা যাচ্ছে না।  আস্তে আস্তে ভাসতে ভাসতে অল্প অল্প করে ডুবছে।  আমি মুহূর্ত দেরি না করে ঝাঁপিয়ে পড়লাম জলে।  তখন মেয়েগুলোর বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার থেমে গেছে। আমি আমার সাধ্যমত জোরে সাঁতার কেটে পৌছালাম সেখানে।  তারপর কাছে গিয়ে দেখলাম লাবনী। আমি ওর চুলের মুঠি ধরে টানার চেষ্টা করলাম। ও ভয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে।  আমি জোরে তার কাছ থেকে নিজেকে মুক্ত করেই চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে ডাঙায় নিয়ে এলাম।  জলে ডোবা কোন মানুষকে চুল ধরেই তুলতে হয় এটা আমি জানতাম।  সেটা সঠিক নাকি ঠিক তা আমার বিচার করা হয়নি। যদিও ততক্ষণ ডাঙ্গায় অনেক লোক জমা হয়ে গেছে । ডাঙ্গায় যখন লাবনীকে  তোলা হলো তখন সে অজ্ঞান হয়ে গেছে। 


অনেকক্ষণ পর পেটের জল বেরিয়ে গেল ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরলো।  সেদিন আর আমার ফেরা হলো না।  সারাদিন লাবনীকে নিয়ে কেটে গেল।  সেদিন রাতে ওর মা আমাকে কত কি বলে যে গৌরবান্বিত করেছিল তা আর আদর করেছিল সে কথা বলে বোঝাতে পারবো না।  আমারও ভালো লেগেছিল ওকে বাঁচাতে পেরে।  দুদিন পর আমি প্রস্তুত হলাম বাড়ি ফেরার জন্য। দুপুর শেষে বেলা পড়লে আমার গরুর গাড়ি এসে থামলো।  আগেই বলেছি এ পথে কোন সাধারণ গাড়ি চলে না। আজও সাল তারিখ বেশ মনে আজে। দিন টা ছিল চোদ্দই জুলাই ঊনিশ আশি সাল।  আমার দুটো ব্যাগ গাড়িতে তুলে মাসিমার কাছ থেকে বিদায় নিলাম।  অমর আমার সঙ্গে কিছু দূর যাবে। তাই সেও গাড়িতে চাপলো। কিন্তু একবারের জন্যও লাবনীকে দেখতে পেলাম না। মন খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু কেন হল জানি না। অমর আমার সঙ্গে কিছুদুর যাবে।  আমাদের গরুর গাড়ি ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল স্টেশনের দিকে।  কিছুদুর এসে আমি অমর কে বিদায় দিলাম।  তারপর একা একা অতি দুঃখে মায়াময় এই বালিমাটি গ্রামের দৃশ্য দেখতে দেখতে এগিয়ে চললাম।  হঠাৎ বনের মধ্যে থেকে একটা চেনা নারী কন্ঠে আমার মন উতলা হয়ে উঠল। আমি মুখ বাড়িয়ে দেখলাম লাবনীকে। গাড়ি থামাতে বলে আমি এক লাফে নেমে এলাম ওর কাছে। তখনও সূর্য পশ্চিম আকাশে দেখা যাচ্ছে। সন্ধ্যা হতে তখনও অনেক দেরি।  আমি ওর কাছে যেতেই ও আমায় জড়িয়ে ধরল।  তারপর অঝোরে কাঁদতে লাগলো। আমি নিরুপায় হয়ে সান্ত্বনা দিতে লাগলাম।  কিছুতেই বুঝবার চেষ্টা করছে না।  ও আমার সঙ্গে যেতে চায়।  আমি বললাম - মা কে ফেলে কেন যাবে আমার সাথে?  নিজে কখন কোথায় থাকি তা জানি না।  নিজের বাড়ি আছে বটে আমি সেখানে যাই না। কলকাতায় একটা ছোট কোয়ার্টার ছাড়া আমার কাছে আর কিছু নেই। আর আমি কোন বাঁধনে বাধা করতে চাইনি। ভবঘুরে এই জীবন আমার ভালো লাগে।  আমি স্বাধীনভাবে বাঁচতে চাই।  আমি আমার লক্ষ্যে পৌঁছেছি আমি সব পেয়েছি খেলার মাঠ থেকে। সেখানে তুমি গিয়ে কি করে থাকবে?   


লাবনী - তুমি যেখানে থাকবে, তুমি যা করবে আমি না তাই করব। তোমার পথই হবে আমার পথ। তোমার স্বপ্ন নিয়ে না হয় সারাটা জীবন কাটবে আমার জীবন।  নারীর ভালোবাসা তুমি কি বুঝবে বলো।  

আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বললাম  - লাবনী।  

লাবনী -  নারীর ভালোবাসা কখনো বোঝার চেষ্টা করে না পুরুষ।  

কাপড়ের আঁচল দিয়ে চোখ মোছে। একটা কথা আজ আমারও বলতে দ্বিধা নেই যে ওকে আমিও ভীষণ ভালোবেসে ফেলে ছিলাম। শেষ পর্যন্ত বেলা পড়ে আসছে দেখে লাবনীর কাছ থেকে বিদায় নিলাম এই বলে - যদি জীবনকে সঙ্গীর দরকার হয়, তাহলে তোমাকে নিয়ে বাঁচবো এবং আমি আবার ফিরে আসবো। অপেখা করো।  


কোন মতে রাজি করিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম।  গাড়ি ছাড়লে লাবনী আমার দিকে তাকিয়ে রইল। ওর চোখ দিয়ে জল পড়তে থাকল।  আমি দূর থেকে তাই দেখতে দেখতে বিদায় নিলাম।  আর তখন আমার অজান্তেই এক ফোটা জল চোখের কোন দিয়ে গড়িয়ে এসে পড়ল আমার বুকের উপর। 


৪ ঠা ডিসেম্বর ২০০২ 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ