ছায়ার মতো তুমি
✍️ অতনু সরকার
অধ্যায় ৪: নীরব চিঠির গল্প
বৈদ্যপুরে এসে সৌরভের দু’দিন কেটে গেছে। চারপাশের পরিবেশ ধীরে ধীরে তার আপন হয়ে উঠছে। মেঘলার ব্যবহারে কোথাও কোনো ভণিতা নেই। যেন সেই ছোটবেলার মামাবাড়ির মতো—নির্ভরতা আর আত্মার প্রশান্তি।
সকালের আলো পড়েছে মেঘলার উঠোনে। মেঘলা আজ একটু বেশি চুপচাপ।
হাতের কাজ সেরে এসে সে সৌরভকে বলল,
— “আজ আমি তোমাকে কিছু দেখাবো।”
সৌরভ বুঝতে পারল, আজ হয়তো সে জানতে পারবে সেই অনুচ্চার ভালোবাসার গল্প।
মেঘলা কাঠের আলমারির নিচ থেকে একটি পিতলের ছোট বাক্স বের করল। খুলে ধীরে ধীরে একেকটা চিঠি বের করতে লাগল। প্রতিটি চিঠি হলুদ হয়ে গেছে, কালি ফিকে, কিন্তু লেখাগুলো যেন এখনও জীবন্ত।
প্রথম চিঠিটা মেঘলা সৌরভের হাতে দিয়ে পড়তে বলল সে নিজেই।
সৌরভ খুলে পড়তে লাগল—
“মেঘলা,
আমি জানি না কেন তোমার মুখটা আমার চোখে ঘুরে বেড়ায়। তুমি আমার ছাত্রী, তবু আমি একজন মানুষ হিসেবেই এখন তোমায় দেখতে শুরু করেছি। এটা ভুল কি না, জানি না। কিন্তু আমি জানি, আমি একা নই—তুমি যদি না বোঝো, তাও লিখে রাখলাম।
— অরবিন্দ”
সৌরভ থেমে গেল। কণ্ঠটা শুকিয়ে এল।
মেঘলা নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকল চিঠিটার দিকে।
এরপর একে একে সে আরও কিছু চিঠি পড়ল। একটায় লেখা ছিল—
“আজ তুমি আমায় বললে—'আপনার চিঠি আমি উত্তর দিই না, কিন্তু ফেলে দিই না।'
জানো, এটুকুই আমার কাছে যেন পৃথিবীটা পেয়ে যাওয়ার মতো।”
আরও একটায়—
“তুমি এখনো চুপচাপ, মেঘলা। কিন্তু তোমার চুপ করাটাও এক ধরনের স্বীকৃতি। আমি অপেক্ষা করতে জানি। আমার ভালোবাসা তোমার বোঝার জন্য নয়, শুধু পাশে থেকে যাওয়ার জন্য। ছায়া হয়ে।”
চিঠিগুলোর ভাষা ছিল সংযত, সংবেদনশীল, কিন্তু ভীষণ গভীর। সৌরভ যেন চোখে দেখতে পাচ্ছিল এক তরুণ শিক্ষক, যার হৃদয় নিঃশব্দে আকুল হয়ে উঠেছিল এক নিষ্পাপ ছাত্রীর প্রতি।
মেঘলা ধীরে বলল,
— “আমি কোনোদিন উত্তর দিইনি। কারণ আমি জানতাম, এই সম্পর্ক সমাজ মেনে নেবে না। আর আমি জানতাম, তোমার ঠাকুরদা একদিন নিজে থেকেই থেমে যাবেন।
কিন্তু জানো, তিনি থামেননি—আমি থামিয়ে দিয়েছিলাম।”
সৌরভ চুপ করে রইল। মাথায় যেন অজস্র ঢেউ উঠছে।
এই প্রথম সে বুঝতে পারল—ভালোবাসা শুধু জোর করে পাওয়ার বিষয় নয়, কখনও কখনও সেটা ত্যাগের ভাষায় বেশি নিখাদ।
চিঠিগুলো যত পড়া যাচ্ছিল, সৌরভের মনে হচ্ছিল, সে তার ঠাকুরদাকে নতুনভাবে চিনছে।
শেষ চিঠিটা ছিল মৃত্যুর এক বছর আগের—
“মেঘলা,
তুমি কি জানো, আমি এখনও ভাবি, তুমি চিঠিগুলো রেখে দিয়েছ?
যদি রেখেও থাকো, জানি তুমি কাউকে দেখাওনি।
কিন্তু আমি আশায় থাকি—একদিন আমার নাতি যদি কখনও তোমার কাছে আসে, তুমি তাকেও চিঠিগুলো দেখাবে।
তাহলেই আমি জানব—তুমি কোনোদিন আমাকে ভোলোনি।
— চিরছায়া হয়ে,
অরবিন্দ”
চিঠির শেষে সৌরভ আর কিছুই বলতে পারল না।
সে মাথা নিচু করে বসে রইল।
আর মেঘলার চোখে তখন যেন শুধু একটাই কথা ভাসছিল—
ভালোবাসা ফুরোয় না, রয়ে যায়… ছায়ার মতো।
0 মন্তব্যসমূহ