দ্বিতীয় পর্ব
ইতিমধ্যে বড়দি পারমিতা শ্বশুর বাড়ি চলে গেছে। তাও অনেকদিন হলো। শ্বশুরবাড়িতে ভালোভাবেই কাটে তার সংসার জীবন। স্বামী, পুত্র নিয়ে সোনার সংসার তার। বারো বছরের বিবাহিত জীবনে তার কোনো দুঃখ আসেনি। একদিন সকালে কুসুমপুরের বাড়িতে পূজোর ফুল তুলতে ব্যস্ত পারমিতা। সেই সময় এক অপরিচিতা মহিলা সে ঢুকে পড়লো বাড়িতে।
পারমিতাকে জিজ্ঞাসা করল - অলোক বাড়ি আছে?
পারমিতা বিস্ময়ের সাথে উত্তর দিল - হ্যাঁ। ঘরে আছে।
অপরিচিতা ঘরে যেতে চাইল। পারমিতা তার নাম ও পরিচয় জানতে চাইলো। কিন্তু সেই অপরিচিতা কোন উত্তর না দিয়ে ঘরের মধ্যে প্রায় জোর করে ঢুকে পড়ল। পারমিতা বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে, কি একটা ভেবে নিজের কাজে গেল।
অলোক ঘরে বসে কাগজ পড়ছিল। হঠাৎ ছন্দাকে ঢুকতে দেখে অবাক হয়ে বলল - হঠাৎ বাড়িতে চলে এলে যে?
ছন্দা - কেন আসতে পারি না নাকি ?
অলোক উত্তর দিল - না, তা নয়। আসতে পারো ঠিকই। কিন্তু এই সাত সকালে আমি তো …
কথা শেষ করার আগেই ছন্দা বলল - তুমি কিছুই বুঝতে পারছ না, এইতো? হ্যাঁ না পারারই কথা। শোনো কাল রাতে ঠিক হয়েছে আজই আমি দিল্লি যাচ্ছি। তাই খবরটা জানাতে এলাম। না হলে তুমি আবার সিনেমার সামনে বোকার মত দাঁড়িয়ে থাকবে।
অলোক - হ্যাঁ ঠিকই করেছো। কিন্তু দিল্লি কি ব্যাপার?
ছন্দা - একটা নতুন চাকরির সন্ধানে। মামা নিয়ে যাচ্ছে।
অলোক পারমিতাকে ডাকল- ও পারু, পারু দুই কাপ চা দিয়ে যাও না।
তারপর ছন্দা কে বলল - তোমার মামাকে বলে যদি আমারও একটা ব্যবস্থা করতে পারতে, তাহলে ভালো হতো।
ছন্দা - তুমি এখানে ভালো পোস্টেই আছো। এই জায়গা ছেড়ে দেবে?
অলোক - তুমি দিল্লি চলে যাবে, আর আমি এখানে থাকবো তা হয় নাকি?
ছন্দা - কিন্তু আমি যে দিল্লিতে থাকবো এটা কে বললো?
অলোক - এখানে থাকলেই ভালো।
দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কথাগুলো শুনলো পারমিতা। রাগে মুখ লাল হয়ে উঠল তার। ঘরে ঢুকে টেবিলে চা রেখে একবার ছন্দার দিকে তাকিয়ে পুনরায় বেরিয়ে এলো। বাগানের দিকে বারান্দায় গিয়ে গিয়ে বসে পড়ল পারমিতা। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে আবার সংসারের কাজে মন দেয়। অফিসের জামা কাপড় প্রস্তুত করতে বলে অলোক স্নান করতে ঢুকে গেল। তার আগে ছন্দা বিদায় নিয়েছে। পারু আগেই খাবার প্রস্তুত করে রেখেছিল। বেশ রাগেশ্বরে বলল - যাও স্নান সেরে খেয়ে বেরিয়ে পড়ো।
আর কোন কথা হলো না। সোনার সংসারের বোধ হয় আগুনের ফুলকি এসে পড়ল। অলোক এখন আর সহ্য করতে পারছে না একদা প্রাণপ্রিয় তার সেই পারুকে। পারমিতা দেশ বুঝতে পারছে। তবু চুপচাপ থেকে নিজেকে সামলে চলেছে। পাড়ার ছেলে বুড়ো সবাই পারমিতাকে চেনে, জানে এবং সর্বোপরি তাকে সবাই ভালবাসে। পাড়ার সামান্য থেকে বড় যে কোন বিপদে আপদে সবার আগে পারমিতাই এগিয়ে আসে।
কার বাড়িতে অসুখ, তার ঠিক মতো দেখাশোনা হচ্ছে কিনা? কেউ ওষুধ কিনতে পারছে কিনা? আরো কত কি দেখাশোনা করে সে। তাই পাড়ার সকলেই থাকে ভালোবাসে।
শীতের দুপুর বেলা ইজি চেয়ারে বসে একটি গল্পের বই পড়ছিল পারমিতা। বাবার বাড়ির অবস্থা যাইহোক মেয়েকে ভালো ঘরে বিয়ে দিয়েছে শশীকান্ত বাবু। কুসুমপুর গ্রামের বেশ বনেদি ঘরের বউ সে। গল্পের বইয়ের গল্প তখন জমে উঠেছে। পারমিতার সমগ্র মন প্রাণ সব ওই বইয়ের মধ্যে। এমন সময় হঠাৎ পাশের বাড়ির রুপার মা এসে বলল - বৌঠান। ও বৌঠান। এইখানে বইসা তুমি বই পড়ত্যাছ। পাড়ায় এত বড় একখান ঘটনা ঘইটা গেল।
ধরফর করে উঠে দাঁড়ালো পারমিতা। জিজ্ঞাসা করল - কি হয়েছে মাসিমা?
রুপার মা পানের চিপ ফেলে বলল - কি হইছে মানে। আরে কও কি হয় নাই।
পারমিতা শান্তভাবে বলল - কি হয়েছে না বললে বুঝবো কি করে মাসিমা।
রুপার মা বলল - ও পাড়ার গোপাল চিনো তো? ওগো বাড়িটা ভাঙ্গা পড়ছে। কাঁচা মাটির দেওয়াল কি কইরা যে ভাইঙ্গা গেছে। হায়রে দেওয়াল ভাঙসে ক্ষতি নাই ভাইঙ্গা পড়ছে তো পর গোপালের নাতিটার ঘাড়ে।
কথাটা শেষ করেই হাউ মাউ করে কেঁদে পড়লো। পারমিতা কাপড়টা ঠিক করে পরে, গায়ে একটা চাদর চাপিয়ে রুপার মাকে নিয়ে রওনা দিল।
বাড়িতে কান্নাকাটি পড়ে গেছে। পারমিতা যেতেই গোপালের পুত্রবধূ সুজাতা এসে জড়িয়ে ধরল। বলল - আমার ছেলেটাকে বাঁচাও দিদি, তুমি না দেখলে কেউ বুঝতে পারবে না।
আসলে গ্রামের ব্যাপার। অজ পাড়া গায়ে মুখ্য সুখ্য মানুষ বোঝে না অনেক কিছুই। পারমিতা ঝড়ের মতো এগিয়ে গেল সুজাতার ছেলের দিকে। ছোট ছেলে ঘাড়ে দেওয়াল পড়েছে। মনে হচ্ছে অজ্ঞান হয়ে গেছে। সবাই ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। সবাইকে সরিয়ে দিয়ে, মাথায় বাতাস করছে, আর চোখে মুখে দু-একবার জল দিচ্ছে। হাতে নাড়ি দেখলো চলছে। সেবা চলছে পুরোদমে। পাশে দাঁড়িয়ে বাড়ির লোকেরা কান্নায় ভেঙে পড়েছে। মুখে তাদের সান্ত্বনা ও দিচ্ছে।
0 মন্তব্যসমূহ