সন্ধ্যার পরপরই এই শহরের ব্যস্ততা কমে আসে। এখানে শহর শেষ আর গ্রামের শুরু। হুগলী জেলার প্রাচীন এক জনপদ পান্ডুয়া। মূল শহর থেকে ত্রিশ কিলো মিটার ভিতরে রয়েছে প্রাচীন এক জমিদার বাড়ি। গ্রামের নাম দেবনরগর। এখান কার নির্জনতা যেন রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও গা ছমছমে হয়ে ওঠে।
সেই গ্রামের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে জরা জীর্ণ প্রায় তিনশো বছরের পুরোনো একটা প্রাসাদ, যার বেশির ভাগটাই আজ ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। কিন্তু মূল বাড়িটা আজো দাঁড়িয়ে আছে, পুরোন ইতিহাস নিয়ে। কথিতে আছে পান্ডুয়া রাজবাড়ির জামাই দীবাকর সরকার এই খানে জমিদারি পত্তন করেছিলেন প্রায় তিনশো বছর আগে। ক্রমে সেই জমিদারি বিরাত বিস্তার লাভ করেছিল। সে সব কথা আজ ইতিহাস। তবে তাদের বংশধররা আজো আছে।
গল্প আছে, এই বাড়ির দক্ষিণের দেওয়ালে একটা কালো দরজা আছে, যা কোনোদিন কেউ খোলেনি। রাত নামলেই নাকি সেই দরজার ভেতর থেকে চাপা ফিসফিসানি আর অদ্ভুত আওয়াজ আসে!
অনেকেই চেষ্টা করেছিল সেই দরজা খোলার, কিন্তু কেউ ফিরে আসেনি...
ইতিহাস গবেষক রূপক সেন এসব লোককথা বিশ্বাস করেন না। তিনি গবেষণার কাজে বহু পুরোনো বাড়ি পরিদর্শন করেন। একদিন তিনি জানতে পারেন, সরকার বাড়ির ভাঙ্গা রাজ প্রাসাদ বিক্রি করা হবে। এই সুযোগে তিনি বাড়িটি ঘুরে দেখার অনুমতি নেন।
সন্ধ্যায় বাড়ির বর্তমান মালিক অলোক সরকার তাকে বাড়ি দেখাতে নিয়ে গেলেন। ধ্বংসস্তুপের মাঝেও বোঝা যায়, একসময় এটি কতটা জমকালো ছিল।
ঘুরতে ঘুরতে রূপকের চোখ পড়ল সেই কালো দরজার দিকে।
সে জানতে চাইল - এই দরজাটা খোলা যায় না?
অলোক কেমন যেন থমকে গেলেন। তারপর বললেন - আমি জানি না। আমার দাদু বলেছিলেন, কেউ যেন এটা না খোলে।
রূপক - এর পেছনে কী কোন ইতিহাস আছে?
অলোক মৃদু স্বরে বললেন- গল্প আছে, আমার এক পূর্বপুরুষ এই দরজা খোলার চেষ্টা করেছিলেন... তারপর তিনি আর জীবিত ফিরে আসেননি।"
রূপক হাসলেন। বললেন - ভূতের গল্প শুনতে ভালোই লাগে, কিন্তু বাস্তবের সাথে এগুলো মেলে না।
সেই রাতেই রূপক ঠিক করলেন, দরজাটা খুলবেন। তাঁর ধারণা, ভেতরে হয়তো কোনো পুরোনো চেম্বার আছে, যেখানে কোনো গুপ্তধন বা ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন থাকতে পারে।
একটি শক্ত টর্চলাইট আর ক্যামেরা নিয়ে রাত ১২টা নাগাদ তিনি আবার বাড়িতে প্রবেশ করলেন। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। টর্চের আলোয় সারা বাড়িটা ঘুরে দেখতে লাগলেন।
চাপা শ্বাস নেওয়ার শব্দ আসছে... যেন দরজার ও-পারে কেউ দাঁড়িয়ে আছে!
দরজার হাতলটা ঠেলে ধরতেই একটা ঠাণ্ডা অনুভূতি হলো। মনে হলো, শরীরের সমস্ত শক্তি যেন হারিয়ে যাচ্ছে!
কিন্তু রূপক হাল ছাড়লেন না। পুরোনো তালাটা একটা লোহার রড দিয়ে ভাঙতে লাগলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই দরজাটা "কড়াৎ" করে খুলে গেল!
হঠাৎ বাতাসের এক প্রবল ঝাপটা এসে টর্চলাইটটা নিভিয়ে দিল। অন্ধকারের মাঝখানে রূপক দেখলেন—
ভেতরে একটা পাথরের চেম্বার। চারপাশে অদ্ভুত চিহ্ন খোদাই করা, আর মেঝেতে একটা পুরোনো লোহার খাঁচা পড়ে আছে।
ঠিক তখনই, কানের কাছে একটা ফিসফিসানি শোনা গেল—
তুমি কেন এখানে এসেছো?
রূপক দ্রুত টর্চ জ্বালালেন। কিন্তু আশেপাশে কেউ নেই!
তিনি খাঁচার কাছে গিয়ে দেখলেন, ভেতরে একটা কঙ্কাল পড়ে আছে, আর তার হাতে শক্ত করে ধরা একটা ছোট্ট চিরকুট।
রূপক ধীরে ধীরে চিরকুট খুললেন— লেখা আছে। আমি, দেবনারায়ণ বোস। এই দরজা খোলার শাস্তি আমি পেয়েছি। এবার তুমি পালাও, যতক্ষণ সময় আছে!"
ঠিক তখনই পিছন থেকে একটা ঠাণ্ডা হাত রূপকের কাঁধে পড়ল!
রূপক আতঙ্কে ঘুরে দাঁড়ালেন। চোখের সামনে কোনো মানুষ নেই, কিন্তু বাতাসে অদ্ভুত একটা গন্ধ ভাসছে, যেন পোড়া মাংসের মতো!
চেম্বারের কোণ থেকে একটা ছায়া ধীরে ধীরে গড়িয়ে আসছে...
তারপর হঠাৎই দরজাটা প্রচণ্ড শব্দ করে বন্ধ হয়ে গেল!
রূপক বুঝতে পারলেন, তিনি একটা অভিশপ্ত জায়গায় আটকা পড়েছেন।
সেই রাতে রূপক আর ফিরে আসেননি।
পরদিন সকালবেলা অলোক বোস বাড়িতে এসে দেখলেন, কালো দরজাটা আগের মতোই বন্ধ, তালাও অক্ষত!
কিন্তু রূপক কোথায়?
গ্রামের লোকেরা বলল, "ওই দরজা যারাই খোলে, তারা আর ফেরে না..."
বোস ম্যানশন আজও দাঁড়িয়ে আছে। রাতের অন্ধকারে এখনো সেই দরজার কাছ থেকে শোনা যায় চাপা ফিসফিসানি।
কেউ বলে, ওটা বাতাসের আওয়াজ।
কিন্তু কেউ কেউ জানে— ওটা হারিয়ে যাওয়া রূপকের কণ্ঠ!
0 মন্তব্যসমূহ