অপরাজেয় প্রেম -৪

  চতুর্থ পর্ব





   শশীকান্তবাবুর আনন্দে দিন কাটছিল।  বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে।  মেজ মেয়েটা বি এ পড়ছে।  আর প্রীতিশ তো এবার শুরু করল কলেজ জীবন। এ যেন এক সুন্দর এবং আশ্চর্যজনক জীবন।  আসলে সময় সবার জীবনে আসে।  সুযোগ ও আসে।  ঠাকুরের কৃপায় শশীকান্ত বাবুর সংসারে কোন অভাব অনাটন নেই।  শশীকান্ত বাবু খাটের উপর বসে তামাক সেবন করছে। প্রীতিশ কলেজ থেকে ফিরে খেতে বসেছে।  খেতে খেতে বাবাকে বলল - বাবা অ বাবা,  এ মাসে ২০০ টাকা লাগবে কলেজে মাইনে দিতে হবে যে । 

শশীকান্ত বাবু অবাক হয়ে বলল - ক’দিন আগে  ২০০ টাকা দিলাম। বললি কলেজের মাইনে।  আজ আবার।   

প্রীতিশ উত্তর দিল - গত মাসের টাকাটা দিয়ে দুটো বই কিনেছি। দেখো ব্যাগে রয়েছে।  

শশীকান্ত বাবু বললেন - দুটো বইয়ের দাম বুঝি ২০০ টাকা?  

প্রীতিশ - ২০০ টাকা হবে কেন?  খাতা পেন কিনেছি না।  


শশীকান্ত আর কোনো কথা বাড়ালো না। শুধু বলল দুদিন পরে নিস।  তারপর তামাক সেবন শেষ করে অন্যত্র কাজে চলে গেল।  বাবা চলে যেতেই প্রীতিশ মাকে গিয়ে ধরল। 

মায়ের কাছে গিয়ে বলল  - মা জানো তো কলেজে যাচ্ছি।  দু দশ টাকা  হাতে না থাকলে হয় নাকি ? 

মা বললো -  কলেজে টাকা দিয়ে কি করবি?  

প্রীতিশ - সাইকেলে করে যাই,  যদি পথে সাইকেলের কিছু হয় তাহলে বাড়ি ফিরব কি করে?  

মা উত্তর দেয় - বুঝলাম কিন্তু আমার কাছে তো …………… 

কথা শেষ হলো না প্রীতিশ বলল - কাল তোমার কাছে ৩০ টাকা দেখেছি।  ওর থেকে দাওনা। 

বড় বড় চোখ করে মা বললো  - ওবাবা ও টাকা তুই দেখলি কি করে ? 

প্রীতিশ  - দাও না মা।  দাও না।  তুমি তো দিদিকেও দাও।  

প্রীতিশের মা নিরুপায় হয়ে একটা দশ টাকার নোট বার করে দিল। 

প্রীতিশ আনন্দে খুব সাবধানে সেটা লুকিয়ে রাখল বইয়ের ভাঁজে।  কারণ দিদি জানতে পারলে নিয়ে নেবে।  ভাগ্যিস মেজদি বাড়ি নেই।  থাকলে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখত টাকাটা কোথায়? তারপর ব্যাস। 


ছয় ঋতুর শ্রেষ্ঠ ঋতু বসন্তের মতোই মনোরম এই যৌবন। নানা রঙে রাঙিয়ে তুলতে ইচ্ছা হয় নিজেকে। যৌবনের সাড়া দেয় প্রীতিশের চোখ,  কান,  মন।  কখনো প্রেম কখনো স্নেহ কখনো বিরহ কখনো বা সুখ-দুঃখের দোল দোলায় দুলতে থাকে সদ্য কৈশোর থেকে উঠে আসা যৌবন। রেখা পাত করে মনের গহীন প্রান্তরে।  এ সময় মানে না কোন ভয়। মানে না কোন বাধা।  শুধু সময় চলে তার আপন খেয়ালে,  আপন নিয়মে যৌবনের দুরন্ত স্রোতে গা ভাসিয়ে। 


সেদিন বসন্তকাল।  বাসন্তিক বিকেলে অস্তায়মান সূর্য যখন পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে,  আকাশ লালে লাল হয়ে উঠেছে। সেই রক্তিমাভো  আভা প্রকৃতির মাঝে কেমন আবির ছড়িয়ে দিয়েছে। পড়ন্ত বিকেলে গাছের পাতাগুলো যেন সেই আবির মেখে রং খেলায় মেতে উঠেছে।  শেষ বিকেলের ক্লান্ত কোকিল তখন সামনের জারুল গাছে বসে কুহু কুহু স্বরে ডাকছিল।  একলা প্রীতিশরের মন তোলপাড় করছিল। ভেসে উঠছিল কিছু রঙিন স্মরণীয় ঘটনা। সেই মুহূর্তকে স্মরণ করে মনে মনে আনন্দ পায় সে। অন্য ছেলেদের সঙ্গে তার ব্যবহার কলেজের সকলের মন জয় করে নেয়। সবাই প্রীতিসকে ভালবাসে। প্রীতিশও সবাইকে ভালোবাসে। এর মধ্যে তো একজন বান্ধবীকে  খুব ভালো লাগে ওর। ওর মধ্যে খুঁজে পায় প্রীতিশের ভালোলাগা। তারপর মেয়েটি তো দেখতে খুবই ভালো। নম্র মিষ্টি স্বভাব।  তাই সব কিছুকে অতিক্রম করতে উদ্যত হয় দুজনের। দু জন দুজনের  প্রতি ছিল  দুর্বল। দুর্বলতা ছিল বললে ভুল হবে না। দুর্বলতা এখনো আছে।  কিন্তু লজ্জায় মনের কথাটা বলে ওঠা সম্ভব হয়ে ওঠে না। কখনও  প্রীতিশ আবার কখনো তার সেই মেয়েটি কথা বলার জন্য তৈরি হয়েছে। কিন্তু পারেনি।  অন্য অনেক কথা হয়। সে কথা বলা সহজ কিন্তু মনের কথা তো আর সহজে বলা যায় না,  সহজে মুখ থেকে বের হতে চায় না। শুধু কলেজ নয় তাদের সঙ্গে দেখা হবার অনেক জায়গা রয়েছে। একেই তারা একই অঞ্চলে থাকে।  তার মধ্যে আবার একই গৃহ শিক্ষকের কাছে পড়ে।  কলেজের আরো অনেক বন্ধুরা সেখানে রয়েছে।  দুষ্টুমি হয়,   মজা হয়।  কিন্তু কাজের কথাটা বলা হয়ে ওঠে না। 


সময় থেমে থাকে না।  নদীর স্রোতের মতন সময় বয়ে চলে তার নিয়মে।  হুগলির নাম করা এই সরকারি কলেজ টি একেবারে গঙ্গার ধারে।  কলেজের ভিতরে একটি ঘাট গঙ্গার জল পর্যন্ত নেমে গেছে। এখান দিয়ে গঙ্গায় স্নান করা যায়। বহু আগে এই কলেজ বাড়িটি ছিল কোন এক ওলন্দাজের অধীনে।  তর্কবিতর্ক আর নানান গল্পে ঢাকা পড়ে বাড়িটা এখন কলেজে রূপান্তরিত হয়েছে। পাশে বড় বড়  কয়েকটি গাছ এখনো পূর্বের স্মৃতি বহন করে চলেছে। এখন আর এই বাড়ির আগের যৌবন নেই।  এখন এটি মহাসিন কলেজ।  কলেজের ছেলে - মেয়েরা শীতের সময় এই ঘাটে এসে রৌদ্র পোহায়।  অবসর সময় পার করে। আবার  গরমে গাছের ছায়ায় আশ্রয় নিয়ে গঙ্গার নির্মল বাতাস সেবন করে। অনেক পুরনো কয়েকটি মেহগনি গাছ আছে।  আরো কয়েকটি নতুন চারা লাগানো হয়েছে। বসন্ত অনেক আগেই চলে গেছে, এসেছে শরৎ।  শরৎ কালের এক মনোরম সকাল।  গঙ্গার ঘাটে একেবারে জলের ধারে দাঁড়িয়ে একটি মেয়ে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে আছে গঙ্গার জলের দিকে। স্নিগ্ধ গঙ্গার কোমল হাওয়ায় চুলগুলো ফুরফুর করে উড়ছে। মনে হচ্ছে চুলরাশি নেছে উঠছে তার কাঁধে। মেয়েটা উদাস হয়ে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে যেন কিছু একটা ভাব ছিল।  এমন নিরালায় হঠাৎ পিছন দিক থেকে কার যেন একটা হাত কাঁধে পড়তেই চমকে পিছন ফিরে দেখে প্রীতিশকে। দেখা মাত্রই উজ্জ্বল হয়ে উঠলো মেয়েটার মুখ।  মৃদু হাসিতে নির্ভয়ে মুখ তুলে মেয়েটি বলল  - বাপরে,  ভয় পেয়ে গেছিলাম যে। 

প্রীতিশ - তাই নাকি?  

প্রীতিশ  মুহূর্তের মধ্যে ভেবে নিল কি করতে হবে।  এই একমাত্র ভালো সময় মনকে শক্ত করার।  

তারপর মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল -  গঙ্গার ঘাটে একা দাঁড়িয়ে কি করছো উর্মি ? গঙ্গার হাওয়া খাচ্ছো বুঝি?  

মিষ্টি স্বভাবের মিষ্টি মেয়েটি মিষ্টি ভাষায় উত্তর দেয়- ঠিক হাওয়া খাচ্ছি না  ভাবছিলাম…………………… 

কথাটা মাঝপথে থামিয়ে প্রীতিশ  বলে -  তুমি সবসময় কি যে ভাবো কে জানে।  এসব ভাবা বন্ধ করো তো।  


কথাটা বলেই পরক্ষণেই আবার অতি কোমল স্বরে বলে -  উর্মি একটা কথা বলবো?  অনেকদিন ধরে ভাবছি বলবো,  কিন্তু বলা হচ্ছে না।  আর তোমাকে ঠিক একা পাইও না যে বলবো। 

ঊর্মি - বলোনা একটা কেন যত ইচ্ছা বলো। আমি শুনছি । 

প্রীতিশ  - রাগ করলে নাকি?  

ঊর্মি - রাগ করবো কেন?  তোমার কথা শেষ হলে আমারও তো কিছু বলার থাকতে পারে। 

প্রীতিশ অবাক হয়ে বলে  - তোমারও বলার আছে আমাকে?  

উর্মি গঙ্গার দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলে -  হ্যাঁ তোমাকে।  আগে তোমার কথাটা শুনি। 

প্রীতিশ  একবার চারিদিকে নির্জনতা দেখে নেয়,  তারপর ঊর্মির দিকে তাকিয়ে বলে  - ঊর্মি তোমাকে খুব ভালো লাগে।  আমি তোমাকে ভালোবাসি। 

ঊর্মি - সত্যি।  

প্রীতিশ -  মিথ্যা হলে বলতাম না।  

ঊর্মি - তাইতো সত্যি না হলে বলবেই বা কেন?  আমিও ঠিক এই কথাটা বলার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।  সময় খুজছিলাম।  আর জানতো  তোমার কথাই ভাবছিলাম এখানে দাঁড়িয়ে। 

প্রীতিশ  - সত্যি তুমি তাই ভাবছিলে ? 

ঊর্মি - সত্যি,  সত্যি, সত্যি। 

কথাটা বলেই হাসতে হাসতে এক দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে কলেজ প্রাঙ্গনে চলে এলো ক্লাস করার জন্য।  ক্লাসের সময় হয়েছে তাই প্রীতিশ ও ক্লাস করার জন্য চলে এলো। সকালে কলেজ তাই খুব সকালে আসতে হয়। বাড়ি ফিরতে দুপুর হয়ে যায়। দুজনে এক ক্লাসে পড়ে।  ক্লাসের মধ্যে আজ দুজনকে খুব উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল।  দু একজন বন্ধু  বান্ধবীরা জানতো  যে তাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক তৈরি হতে চলেছে। অন্যদিনের মতো বন্ধুরা মিলে গল্প করল।  সকলের অন্তরালে মাঝেমধ্যে দুজন দুজনের দিকে  তাকিয়ে হেসেছে।  কিন্তু কেউ তখন বুঝতে পারেনি।  সব বন্ধুরা চলে গেল।  কিন্তু প্রীতিশ  গেল না। দুজনে মিলে গঙ্গার ঘাটে গিয়ে বসলো। আরো অনেক ছেলে মেয়ে আছে সেখানে। যে যার মত গল্পে ব্যস্ত।  কোথাও এক দল ছেলে আবার কোথাও একবার মেয়ে। তারা  বসলো সেখানে একটা ফাঁকা জায়গা দেখে।  তারপর শুরু হল এতদিনের অপেক্ষার কথা।  কে কার সম্বন্ধে কি ভেবেছে,  কেন ভেবেছিল।  আরো কত কি। দুজনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত প্রেমের জাগরণ হল আজ থেকে।  মনে হয় দুজনের মধ্যে সম্পর্ক হাজার বছর আগের।  এমনি করে গল্প করে ভালোবেসে দিন যায়। আর যতদিন যায় ভালোবাসা তত গভীর হয়। এখন শুধু কলেজ নয়, গল্প করার জন্য রয়েছে পার্ক। গঙ্গাধারে সুন্দর জায়গা। কখন কলেজ থেকে আসার পথে কখনো বিকেলে খেলার শেষে বা পড়তে গিয়ে সেরে ফেলে প্রয়োজনীয় কথা। অনেকদিন পার হয়ে গেছে এখন সব বন্ধুরা ওদের সম্পর্কের কথা জানে।  অনেক বন্ধু তাদের সাহায্য করে।  গোপন প্রেম হলেও একদিন না একদিন সবাই জানতে পারবে। ওরা জানে না তাই ওদের এই প্রেমের সাগরে কোন বাধা আসে না।  প্রীতিশ আর মর্তের ডানা কাটা পরি  ঊর্মির প্রেম তাই এগিয়ে চলে আপন নিয়মে পূর্ণতার দিকে।  


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ