সিঁদুর

 


 

সিঁদুর

অতনু সরকার

সুতপার আজ বিয়ে। পাড়ার যে মোড়টা একটু এগিয়ে গেলে আমাদের বাড়ি, ঠিক সেইখানে সুতপা দের বাড়ি । বিয়েতে আমার নিমন্ত্রণ ছিল। দুপুর বেলা পাশের বাড়ির দীপা নামে একটি মেয়ে আমার কাছে একটা খাতা দিয়ে গেল। বলে গেল সুতপা দি পাঠিয়েছে। কৌতুহল সংবরণ করতে পারলাম না। আমার ঘরে এসে খাতাটা খুললাম। খাতার মধ্যে লেখা একটি  চিঠি। এতদিনের গোপন লুকোনো প্রেম চিঠির মধ্যে দিয়ে আজ প্রকাশ করল ,যদিও আমি কখনও  ভাবিনি'যে সুতপা আমাকে ভালবাসতে পারে।

দীর্ঘদিনের গোপন প্রেম হঠাৎ প্রকাশ করে ফেলে বিয়ের দিন। জানায় যে আর কাউকে এমন করেই ভালবাসতে পারবেনা।আগে কেন বললো না জানি না। হঠাৎ কেন জানি না মনটা উদাস হয়ে গেল। আসলে আমি কখনও ভাবিনি যে সুতপা আমাকে ভালবাসতে পারে বা আমি ওকে ভালবাসতে পারি। পাড়ার মেয়ে হিসেবে কথা বলতাম এইটুকু যা। ভেবেছিলাম বিয়েতে যাব না কিন্তু শেষ পর্যন্ত যেতেই হল। কারণ আমার দিক থেকে কোনো ত্রুটি অন্তত আমি দেখিনা। তাছাড়া সুতপা বার বার করে লিখেছিল আমি যেন ওর বিয়েতে যাই। বিয়ের সময় যেন আমি ওখানেই থাকি। বৌভাতের দিনও গেলাম ওর শ্বশুরবাড়ী। যখন ফিরে আসছিলাম তখন আমার হাতদুটো ধরে হঠাৎ ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলল।কেউ বুঝতে না পারলেও আমি বুঝলাম মনের মধ্যে যে স্বপ্নের জাল বুনে ছিল সেই স্বপ্ন জাল ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে আজ। আমি সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলাম তুমি সুখী হও ভাল থাক। এই ছিল ওর সঙ্গে আমার শেষ কথা। তারপর দশ বারো বছর পেরিয়ে গেছে আর কখনো দুজন মুখোমুখি হইনি। যদিও দেখা হয়েছে অনেকবার। জানিনা এক সন্তানের জননী এখন আমাকে যুবতী বেলার মত ভালবাসে কিনা। না বাসাই ভালো। যেখানে শিকড় গজিয়ে যায় সেই শিকড়ের টানে সংসার আলোকিত করতে হয়। তবে সুতপাকে আমি মনে রেখেছি এই কারণেই যে ওই প্রথম হয়তো আমাকে ভালোবেসে ছিল । হোক না লুকিয়ে। কিন্তু আমি যাকে চেয়েছিলাম তাকে কি পেলাম। পেলাম কিন্তু ...।

আমি রসিক। মানে রসিকলাল সরকার। বাড়ি বা ঠিকানা কোনটাই আমার নেই। সেই কবে ঘর ছাড়া হয়ে এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে হাজির হলাম হুগলির এক প্রত্যন্ত গ্রামে। সেখানে অনেক কষ্টে পড়াশুনাটা শেষ করলাম। সেই সময় হঠাৎই প্রেমে পড়লাম। যদিও প্রেমে পড়ার কথা আমার ছিল না। সহায়-সম্বলহীন পরের বাড়ীতে মানুষ হওয়া এক কিশোর। তবু সেই কিশোর বয়সে প্রেমে পড়েছিলাম এক কিশোরীর। ঘটনাটি খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু আমার কাছে ছিল বেদনাদায়ক। সেই মেয়েটি লুকিয়ে লুকিয়ে বই বা খাতা কেনার জন্য আমাকে টাকা দিত। টিফিন বক্সে করে বাড়ি থেকে রান্না হওয়া ভালো খাবার নিয়ে আসত আমার জন্য। নির্জন বাঁশবনের আবডালে খাইয়ে দিত আমাকে কেন  হঠাৎ ও আমাকে ভাল বেসেছিল জানি না । হয়তো আমার জীবনের কথা ওকে দুঃখ দিয়েছিল। আমাদের গোপন প্রেম একটু একটু করে বেড়ে যেতে লাগলো। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করতেই ওর জন্য সম্বন্ধ দেখতে লাগলো বাড়ির লোক। আমি তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। পরের বাড়িতে থেকে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ কে সঙ্গে নিয়ে মেয়েটিকে বিয়ে করা আমার সম্ভব হয়নি। সেকথা মেয়েটি বুঝেছিল। বুজে ছিল বলেই বাঁশ বাগানের আড়ালে সন্ধ্যার অন্ধকারে আমাকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিল। আমিও কেঁদে ছিলাম ওকে পাবনা বলে, স্বপ্নগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে। তারপর একদিন ওর বাড়িতে বিয়ের সানাই বাজলো।। ঘটা করে বিয়ে হয়ে গেল মেয়েটার। সেই বাঁশ বাগানের আড়ালে থেকে দেখেছিলাম অচেনা এক পুরুষের হাত ধরে চোখের জলে বুক ভাসিয়ে হেঁটে চলেছে আমার সুপর্ণা। একবার তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। আমার চোখেও তখন জল ছলছল করছে।

যখনই বাপের বাড়ি আসত তখন সকলের অজান্তে আমার সঙ্গে দেখা করত। কথা বলতাম। তারপর একদিন হঠাৎ আমার সঙ্গে দেখা করা ছেড়ে দিল। আমি তখন তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। পরীক্ষার পরেই স্কুলে কাজ পেয়ে গেলাম। বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে। যার কাছে মানুষ হয়েছিলাম সেও মারা গেল। তাই এখানকার পাট চুকিয়ে স্কুলের কাছাকাছি একটা বাড়ি ভাড়া নিলাম। আবার শুরু হলো সেই একক জীবন। হঠাৎ একদিন রোগা বিবর্ণ একটা মেয়ে এসে দাঁড়ালো আমার সামনে। বলল – “কাকু আমার মা আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়”। মেয়েটির সঙ্গে আমি গেলাম। দেখলাম সাদা শতছিন্ন কাপড় পড়া একটা মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। কাছে যেতেই মহিলা সেই মেয়েটিকে বলল –“তুই বাড়ি যা আমি যাচ্ছি”। আমার দিকে ফিরে তাকাতেই আমি অবাক হয়ে দেখলাম আমার সেই সুপর্ণা। আমি বললাম –“ সুপর্ণা তুমি? তোমার এমন বেশ? কেন? কেন কি হয়েছে তোমার?

 শান্ত গলায় সুপর্ণা বলল-  “আমার স্বামী আর বেঁচে নেই। মদ, গাজা, জুয়া কেড়ে নিয়েছে তারা প্রাণ। ভালো ছেলে বলে বাবা যার সঙ্গে আমার বিয়ে দিল, দু বছর পর দেখলাম তার আসল রূপ। আমি বললাম –“তারপর”?


“তার আর পর কি এখন আমি আর আমার মেয়ে। শ্বশুরবাড়ি থেকে দেখেনা। তাই তোমার কাছে ছুটে এলাম। চৈতি পড়াশুনায় ভালো। প্রতিবছর প্রথম হয়। এ বছর এখনও বই-খাতা কিছুই দিতে পারিনি। আমি মেয়েটিকে চিন্তাম। আমার স্কুলেই পড়ে। গরিব বলে জানি। কিন্তু সে যে সুপর্ণার মেয়ে তা এই প্রথম জানলাম। দিনের আলোয় হলেও সাহসে ভর করে সুপর্ণার হাত ধরে বললাম-  " আজ থেকে তোমার মেয়ের দায়িত্ব আমার। আমি দেখব ওকে। পড়াশুনার সব খরচ আমি দেব। কিন্তু তুমি আমায় কেমন করে দেখলে? কেমন করে জানলে আমি এখানে আছি"।

সুপর্মেণা - য়েকে স্কুলে দিতে এসে হঠাৎ একদিন তোমাকে দেখলাম।

আমি বললাম –“তোমার সংসার চলে কি করে কি করে”?

সুপর্ণা কোন উত্তর দিল না। চুপ করে রইলো।

আমি বললাম – “কিছু বলছো না।   চুপ করে রইলে কেন?

আগের মতোই শান্ত গলায় সুপর্ণা উত্তর দিল – “লোকের বাড়ি ঝি এর কাজ করতে হয় আমাকে”।

হঠাৎ মাথা ঘুরে গেল। যে সুপর্ণা চুরি করে আমাকে খাওয়াতো, আমার বই কেনার টাকা এনে দিত, সেই সুপর্ণা ঝি এর কাজ করবে? আমি বললাম – “সুপর্ণা, যদি তোমার কোন আপত্তি না থাকে  তাহলে আমি আমার ভালোবাসাকে আমার কাছে নিতে চাই”। সুপর্ণা বলল –“তা হয় না সমাজ মেনে নেবে না”। আমি বললাম – “সমাজ তোমাকে খাওয়াবে না, সমাজ তোমাকে পরাবেনা, সমাজ তোমাকে দেখবে না। হাত ধর এসো আমার সাথে”। সুপর্ণা আমার দিকে তাকাল, তারপর – “বলল মেয়েটা”? আমি বললাম – “আজ থেকে ও আমার মেয়ে”। নির্জন সেই দুপুর বেলায়  সুপর্ণা আগের মতো করেই আবার জড়িয়ে ধরল আমায়।


        আজ পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। ভাড়া বাড়ির ছাদের উপরে লাল শাড়ি পরা আমার সুপর্ণার সিঁথি রাঙিয়ে দিলাম নতুন সিঁদুরে।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ