সপ্তম পর্ব
বেশ কয়েক দিন অতিক্রান্ত হয়ে গেল কুসুমপুরে ডাকাতের ভয় অনেক কমে গেছে। না পারমিতাদের বাড়িতে কোন বিপদ হয়নি। তবে বিপদের কথা তো আর বলা যায় না। এদিকে প্রীতিশের মন বাড়ি আসার জন্য ছটপট করছে। দিদিকে অনেক বুঝিয়ে কলেজের দোহাই দিয়ে মাত্র এক বেলার জন্য বাড়ি আসার সময় বার করে নিল। সব ঠিকঠাক। সকাল ন'টা হবে তখন এক ভদ্রলোক এসে হাজির। তিনি পারমিতাকে খোঁজ করছিলেন। প্রীতিশ তাকে চেনে না তাই দিদিকে ডেকে নিয়ে আসলো। পারমিতা তাকে খাতির করে বসালো। ইনি সমর রায়। অলোকের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বয়সে অলকের থেকে কয়েক দিনের ছোট কিন্তু ছোটবেলা থেকেই একসঙ্গে ওঠাবসা। বন্ধুত্বটা বেশ গভীর। সমর বাবুকে এই অবেলায় দেখে পারমিতা প্রশ্ন করলেন - হঠাৎ কি মনে করে সমর দা?
সমর - মনে করে না বৌদি এসেছি একটা খারাপ খবর দিতে।
পারমিতা - খারাপ খবর?
সমর - হ্যা খারাপ খবর?
পারমিতা - কি সেই খারাপ খবর?
সমর - সে বড় দুঃখের কথা।
- যত দুঃখের কথাই হোক, বলতে যখন এসেছ বলেই ফেলো।
- বৌদি এটা কে?
- আমার ছোট ভাই।
- আপনার সেই ছোট ভাই। হ্যাঁ নাম শুনেছি। বৌদি এখানে কি বলা যাবে কথাটা। যদিও বলতে কেমন লাগছে তবুও বলতে তো হবে।
- যাইহোক, যত দুঃখের কথাই হোক কথাটা তুমি বলেই ফেল। আর ধৈর্য থাকছে না।
- বৌদি অলোক আবার বিয়ে করেছে ।
- বিয়ে?
পারমিতা আকাশ থেকে পড়লো।
- আমাদের অফিসের ছন্দাকে। ওরা এখন কলকাতায়। ছন্দাদের বাড়িতে আছে।
পারমিতার মাথায় বজ্রা্ঘাত। তবুও শান্তভাবে বলল - কিন্তু কিছুদিন আগে যে ও চিঠি দিয়েছে গোয়াতে আছে, আরো একমাস থাকতে হবে।
সমর উত্তর দেয় - ওটা তো কলকাতা থেকে পোস্ট করেছে।
পারমিতা একটা দীর্ঘ নিশ্বাস নিয়ে বলে - কতদিন হলো বলতে পারবে?
সমর - পরশু দেখলাম ছন্দার মাথায় সিঁদুর। দুজনে এক গাড়িতে এলো, আবার অফিসের পর এক গাড়িতেই চলে গেল। কাল ওর কাছে শুনলাম সব। অলোক আর বাড়ি ফিরবে না। তাই ভাবলাম খবরটা তোমাকে একবার জানানো দরকার।
পারমিতা - ও তোমাকে সব বলল?
সমর - আমার সঙ্গে কোন কথাই গোপন করে না ।
- আমি জানি। যদি একটু আগে বলতে।
- আগে তো কেউ বুঝতে পারিনি।
- একটু একটু বিপদের গন্ধ পাচ্ছিলাম, কিন্তু এতটা ভাবিনি।
প্রীতিশ চুপ করে সব শুনছিল। সব শুনে প্রীতিশ বলল - আচ্ছা দাদা ওই ছন্দা নাকি নাম বললেন ওনার বাড়ি আপনি চেনেন?
সমর উত্তর দেয় - না, বাড়ি চিনি না ভাই।
প্রীতিশ - আপনি আমার একটা উপকার করতে পারবেন?
সমর - বলুন কি উপকার করতে হবে?
প্রীতিশ - আমায় তুমি করে বললে খুশি হব।
সমর - আচ্ছা বল ভাই কি উপকার করতে পারি।
প্রীতিশ - দয়া করে যদি ওদের ঠিকানা টা জোগার করে দিতেন।
সমর - বুঝতে পেরেছি।, আচ্ছা আমি চেষ্টা করব। খবরটা দিয়ে গেলাম যদি কিছু করতে পারেন তবে দেখবেন। আজ তাহলে উঠি বৌদি। আসলে এই খবরটা না দিলেই নয় তাই বলে গেলাম।
সমর বিদায় নিল। পারমিতা কিছু বলল না। চুপ করে বসে রইল। চিৎকার চেঁচামেচি করল না। মাথা ঠান্ডা রেখে ভাবতে থাকল। ক,ই করা উচিৎ। কিছুক্ষণ পরে পারমিতা প্রীতিশ কে বলল - তুই বাড়ি গিয়ে ঘুরে আয়। আমি একটু একা থাকি। আমায় একটু একা থাকতে দে।
প্রীতিশ দিদির মনের অবস্থা বুঝে বাড়ির দিকে পা বাড়ালো। এই সব কথা বাড়িতে বলতে বারণ করে দিল পারমিতা। বাড়িতে যেতে একদম ইচ্ছা করছিল না প্রীতিশের। দিদির পাশে থাকতে না পারলে ওর মন ভেঙে পড়বে। চিন্তা করতে করতে প্রীতিশ পৌঁছে গেল বাড়ি। বাবা মাঠে কাজ করছিল মেজদি কলেজে মা বাড়ির কাজ করছে। প্রীতিশকে দেখে তার মা ছুটে এসে বলল - কিরে চলে এলি যে?
প্রীতিশ কোন উত্তর দিল না। সোজা ঘরে গিয়ে বসে পড়ল। প্রীতিশের মন ভালো নেই দেখ ওর মা ছুটে এলো। বলল - কিরে দিদির সঙ্গে ঝগড়া করেছিস নাকি?
প্রীতিশ - হ্যাঁ ।
মিথ্যাটা বলতেই হল, কারণ মনের ভিতরে দুঃখটাকে বাইরে প্রকাশ করা যাবে না।
প্রীতিশের মা বিস্ময়ে বলে - ওমা। কেন ঝগড়া করেছিস? তাহলে কি আর যাবিনা?
প্রীতিশ - ও সামান্য কারণ। তুমি বুঝবে না, বিকেলে আবার চলে যাব।
বিকেলে চলে যাবার কথা শুনে মা আর কোন কথা বলল না, নিজের কাজে চলে গেল।
প্রীতিশ ভালো কবিতা লেখে, কলেজে ওর ভালো নাম আছে। এছাড়া ওর কয়েকটি কবিতা কাগজে ছাপা হয়েছে বেশ কিছুদিন আগে। দিদির বাড়ি যেতে না হলে এবার ওর কবিতার সংকলন “তোমার পথ চেয়ে” শেষ করতে পারত। অনেকেই এই সংকলনটি ছাপানোর জন্য সাহায্য করবে বলে আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু শেষ হলো না। ভাবলো দিদির বাড়ি নিয়ে যাবে। সেটাও হলো না। হাতের কাছে খাতাটা ছিল টেনে নিয়ে দুটো কবিতা পড়তে পড়তে মনে পড়ে গেল ঊর্মির কথা। দুরন্ত প্রেমের কবিতা সে সব। খাতাটা ঠিক জায়গায় রেখে। ঊর্মির বাড়ির দিকে পা বাড়ালো। তখন বেলা চারটে হবে। সূর্য একেবারে পশ্চিম আকাশের উপর ঢলে পড়েছে। ঊর্মি ছাদের উপর টবে লাগানো ফুল গাছগুলিতে জল দিচ্ছিল। হঠাৎ প্রীতিশ কে দেখে নেমে এলো নিচে। কিন্তু কর্মীর মা বড় ভয়ানক এক চক্কর মেরে এলো ঘর থেকে। মাকে বলল শোন মা আমি একটু ও পড়ায় যাব ঋতুর কাছে। আমার একটা খাতা আছে। আজ লাগবে। না নিয়ে এলে হবে না।
মা ব্যস্ততার মধ্যে ধমক দিয়ে বলল - এই অবেলায় তোর খাতার কথা মনে পড়ল? যা তাড়াতাড়ি আসিস।
ঋতু উর্মীর বান্ধবী। ওর বাড়ি ঊর্মির কোন খাতা ছিল না। মায়ের অনুমতি পেয়ে লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে পড়ল সে। বাড়ির পিছনে অপেক্ষা একটা গাছের তলায় অপেক্ষা করছিল প্রীতিশ।
ঊর্মিকে দেখে এগিয়ে এসে বলল - চলো নদীর ধারে।
- চল। ঋতুদের বাড়ি যাব বলে এসেছি। বাড়ি গিয়ে আবার কিছু একটা কথা সাজাতে হবে।
- সব দিকে দেখছি ওস্তাদ।
উর্মি হেসে বলে - হ্যা শুধু তোমার জন্য।
নদীর ধারে গিয়ে ওরা বসলো, তারপর প্রীতিশ বলল - বল কেমন কাটলো তোমার তাজমহল যাত্রা?
- খুব ভালো। না দেখে বিশ্বাস করা যায় না। জানো কাল কলেজে রেজাল্ট জানতে গেছিলাম। বলল এক সপ্তাহ পরে দেবে। আর সবথেকে বড় খবর এবার তুম…………… থাক বলবো না।
- বলো না কি হলো ।
- বললে কি দেবে
প্রীতিশ ইশারা করে দেখালো।
- আমি জানি তুমি ওটাই দেবে, কোথায় গালে?
- আগে বলতো কি হয়েছে?
- তুমি এবার কলেজে সেরা কবি নির্বাচিত হয়েছো। সামনের মাসে স্যোসালে তুমি পুরস্কার পাবে।
প্রীতিশ আনন্দের সাথে বলে ওঠে - সত্যি কথা বলছো তুমি?
- একেবারে সত্যি। এবার দাও………
- আজ নয়। যেদিন পাবো সেদিন দেব। আজকে খুব আনন্দ করতে ইচ্ছা করছে কিন্তু আনন্দ আসছেনা।
- কেন
প্রীতিশ একবার ভাবল বলে কাজ নেই। কিন্তু পরে সব কথা খুলে বলল।
- ছন্দা নামটা খুব চেনা চেনা লাগছে।
- তোমার কেউ হয় নাকি।
উর্মি ধীরে ধীরে বলে - কলকাতায় আমার পিসি থাকে। পিসির বড় মেয়ের নাম ছন্দা। চাকরি করে।
প্রীতিশ সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয় - লেক গার্ডেন?
- তবে ঠিক আমার দিদি হবে
- খুব বাজে মেয়ে ছেলে জানো। জানে ছেল বউ আছে তবুও বিয়ে করল। অবশ্য জামাইবাবুর দোষটা অস্বীকার করা যায় না। কারণ দুই পক্ষ রাজি না হলে………… যাক কি আর করা যাবে।
উর্মির মুখ কালো হয়ে এল ভয়ে। ভয় পেল কারন ওই ঘটনায় যদি ওদের দুজনের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। কি দরকার ছিল বলার যে ও আমার দিদি । এইসব কথা চুপ করে ভাবছিল।
প্রীতিশ বলে - চুপ করলে যে?
ঊর্মি ওর মনের কথা গুলো বলল।
প্রীতিশ বলল - না না। এই জন্য তোমার আমার সম্পর্ক কেন নষ্ট হবে। তুমি তোমার দিদির ঠিকানাটা বলতে পারো?
ঊর্মি একটু স্বস্তি পায় বলে - কাগজ থাকলে লিখে দিতাম।
প্রীতিশ - কাগজ দরকার নেই, তুমি মুখে বলো।
ঊর্মি ঠিকানাটা টা বলে। প্রীতিশ মন দিয়ে শুনে নেয়। তারপর কলেজের রেজাল্ট এর বিষয়ে জেনে আর দেরি করল না প্রীতিশ। দেরি করলে দিদির বাড়ি যেতেও দেরি হবে তাই তাড়াতাড়ি বিদায় নিল। ঊর্মিকেও তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছাতে হবে তাই সেও নিজের বাড়ির পথ ধরল।
0 মন্তব্যসমূহ