নূপুরের শব্দ ৯

  নবম অধ্যায়

 




ঘরের দরজা জানালা জানালা বন্ধ করে শুয়ে পড়ে ইভা। বাবা বাড়িতে  নেই,  মা অনেকবার ডেকে তুলতে পারল না ইভাকে। ইভার মা অন্য এক দুশ্চিন্তায় দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগলো।  কয়েকবার দরজায় আর জানালায় ধাক্কা দিয়ে চলেছে মা।  কিন্তু কোন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। ঘরের ভিতরেই বিন্যস্ত ভাবে পড়ে আছে জামাকাপড়।   বিছানায় এলোমেলো ভাবে পড়ে আছে ইভা।  গায়ের কাপড় সরে গেছে। মাথার চুল পাগলের মতন ছড়িয়ে রয়েছে। বাইরে থেকে তার মায়ের ডাক পৌঁছেছে তার কানে।  চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে বালিশ।  একসময় মায়ের কান্নার শব্দ শুনতে পায়।  বাড়ির সবাইকে তার শত্রু মনে হলেও মায়ের কান্না কে সে কিছুতেই অগ্রাহ্য করতে পারে না।  উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। তারপর অত্যন্ত রেগে বলে -  তোমরা কি আমায় একটু শান্তিতে শুতে দেবে না।

ইভার মা শান্ত গলায় উত্তর দেয় - দরজাটা বন্ধ করার কি দরকার?

ইভা - আমাকে নিয়ে কারোর চিন্তা করতে হবে না। 

মা -  চল বা খেয়ে নিবি।  তুই না খেলে আমি খেতে পারছি না। 

ইভা ততোধিক রুড়তার সঙ্গে বলে - তোমরা তোমাদের মত খেয়ে নাও আমি আমার মতন খেয়ে নেব।  এখন আমার খিদে নেই।

কথা গুলো বলে আবার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে।

ইভার মা কোন উপায় না দেখে নিচে চলে আসে।

 

সেই সময় পাড়ার কারো কাছ থেকে সেই খবর পৌঁছে যায় পাশের পাড়ায় থাকা ইভার পিসির কাছে।

ইভার পিসি তাকে খুবই স্নেহ করে। কেউ একজন তাকে গিয়ে খবর  দিয়েছিল যে ইভা ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।  দরজা খুলছে না। তার মায়ের কান্নাকাটি সত্ত্বেও কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না ঘর থেকে। খবর শুনে ইভার  পিসি সুমতি ছুটে আসে তাদের বাড়িতে। ইভার ঠাকুরমা যখন বেঁচে ছিল সেই সময় ঠাম্মার সঙ্গে ইভা পিসির বাড়িতে গিয়ে সমস্ত ঘটনা পিসিকে খুলে বলেছিল। সুমতি দেরি না করে ছুটে উপরের তলায় উঠে যায় এবার ঘরে। ঘরে ঢুকে সুমতি দেখলো এলোমেলো অবস্থায় হয়ে রয়েছে ঘর আর বিছানায় পড়ে রয়েছে ইভা।

সুমতি ধীরে ধীরে ইভার পাশে গিয়ে বসে। তারপর তার মাথায় আস্তে আস্তে হাত বুলাতে থাকে। চোখ খুলে সুমতি কে দেখে উঠে বসে ইভা।

ইভা - তুমি কখন এলে পিসি

  • তোর কি হয়েছে শুনি
  • কিছু না পিসি
  • কিছুতো একটা হয়েছে, কি হয়েছে বল।  আমাকে অন্তত লুকিয়ে যাস না।

ইভা - পিসি তোমাকে লুকানোর কিছু নেই । আমার মনের কথা। ঠাম্মাকে আর তোমাকে বলেছিলাম কিন্তু যার জন্য আমার এই প্রেম ভালবাসা। তার হৃদয়ে আমার জন্য একটাও জায়গা নেই।

কথাগুলো বলতে বলতে ইভার দু চোখের কোনা দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল।

সুমতি দেবী আঁচল দিয়ে ইভার দুই চোখ মুছে তাকে সান্ত্বনা দিতে থাকে।  

  • নারী জীবনের অনেক ব্যথা, যন্ত্রণা দুঃখ থাকে।  যদি ওর থেকে ভালো না লাগে বা তোকে না চায় তাহলে কেন তুই ওর পিছনে পড়ে থাকবি।  তুই যদি বলিস আমরা ভালো সম্বন্ধে তোর জন্য করতে পারি।।
  • কিন্তু এর বদলা আমি  নেব।  ওকেও আমি কঠিন যন্ত্রণা দেব, যেভাবে আমি মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছি সেই ভাবে আমিও ওকে যন্ত্রণায় দগ্ধ করবো।

সুমতি - ওসব কিছু করে লাভ নেই।  ইভা যা হবার তা হয়েছে।  তুই ভালোবেসে ছিলি এর বেশি তো কিছু না।  ছাড় নতুন করে চিন্তা-ভাবনা কর। হয়তো ওর থেকে হাজারগুণ ভাল পাত্র ভালো সংসার তোর জন্য অপেক্ষা করে আছে। সেইসব নিয়ে ভাব।

 

ইভা চোখের জল মুছতে মুছতে উত্তর দেয় - তাই ভাবব। তাই ভাববো । মনের সব ভালোবাসাকে নদীর জলে বিসর্জন দিয়ে আবার অন্য বাসা খোঁজার চেষ্টা করি। তোমরা তো আছো,  যেটা ভালো সেটা করো কিন্তু  পিসি যে মানসিক যন্ত্রণায় আমি পেয়েছি,  সেই মানসিক যন্ত্রণায় অহীন কেও দগ্ধ হতে হবে।  

 

সুমতি-  চল ওসব নিয়ে ভেবে লাভ নেই।  মনকে শক্ত কর। যে তোকে চায় না তার জন্য তোর জীবনের এই দুর্লভ সময় নষ্ট করে কি লাভ চল তোর মা বাবা এখনো খাইনি। তুই যদি না খাস তাহলে ওরা কেমন করে খাবে বল আর তাই জন্য তো আমাকে ছুটে আসতে হলো এখানে। আয় আমার সাথে।

ইভা-  সে কি আমি তো ওদের বলে এলাম তোমরা খাও আমার শরীর ভালো নেই।

সুমতি  - চল আমার সাথে আয়।

ইভা তার পিসি সুমতির সঙ্গে নিচে নেমে যায়।  আর একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে তারপর মনকে শক্ত করে। দোতলার খোলা খোলা বারান্দা থেকে অহিন দের বাড়ির দিকে  তাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে চলে যায়।

নারীর মন বোঝা ভারী কঠিন। হয়তো তাই নারীকে চেনা ভারি কঠিন।

অহিন ভাবতে থাকে,  আমি কি একটু বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেললাম।  ইভাকে ওভাবে কথা বলে কি ঠিক করলাম। মাথাটা হঠাৎ গরম হয়ে গেল।  যাক যা হবার হবে এখন ভেবে কি লাভ যা কপালে আছে তাই হবে । আমি যদি ইভাকে ভালো না বাসি তবে কেন ওর জন্য আমার মন উতলা হয়।  আসলে একটু একটু করে ওর প্রতি হয়তো আমার ভালো লাগাটা এসে গেছে।  আর তাই আমিও একটু হলেও ওর প্রতি দুর্বল। ভালো হয়তো আমিও বেসে ফেলেছি। আজকের কথাগুলো হয়তো আমি না বললেও পারতাম কিন্তু রাগের মাথায় আমার কথাগুলো বেরিয়ে গেছে।

ভাবতে ভাবতে অহিন বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়।  রাস্তা পেরিয়ে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে একটা পার্ক।  যেকোনো দিন বিকেলে এই পার্কের একটি নির্দিষ্ট জায়গায় অহিনকে দেখতে পাওয়া যায়।  মাঝে দু'দিন মন খারাপ ছিল বলে বাড়িতে শুয়ে শুয়ে কাটিয়েছে। কিন্তু আজ আর ভালো লাগছে না

অন্য কোন এক নতুন সৃষ্টির সন্ধানে যখন মশগুল তখন অহিনের চোখ  পড়ল ইভার দিকে।  দেখল ইভা একা নয়।  ওর সঙ্গে রয়েছে একটি ছেলে। অহিনের মনে প্রশ্ন জাগলো ছেলেটি কি দেখার জন্য। অহিন একবার ঘাড় ঘুরিয়ে নেয়।  দেখল ইভা তাদেরই পাড়ার প্রসুনের খুব ঘনিষ্ট হয়ে হাতে হাত রেখে গল্প করতে করতে পার্কের একটা কোনায় বসলো। হয়তো অহিনকে কিছুটা দেখানোর জন্য ইভা ইচ্ছাকৃতভাবে অহিনের সামনাসামনি একটা গাছের তলায় এসে বসলো।  তারপর প্রসুনের সঙ্গে এমন ভাব আর হাসাহাসি করতে লাগল যা বড়ই দৃষ্টিকটু লাগছিল  অহিনের কাছে। ইভার হাসিটা বড় বেশি কানে লাগছিল  অহিনের।  অহিনকে শোনানোর জন্যই হয়তো ইভা একটু জোরেই হাসছিল।  না হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু অহিন এবার নতুন কল্পনা থেকে নেমে আসে বাস্তবের রাস্তায়। তার মনে যে ইভার প্রতি ভালোবাসা এবং মমতা দুর্বলতা জন্মেছিল এক লহমায় যেন ছারখার হয়ে যায়।  ইভাকে প্রসুনের সঙ্গে দেখে । অহিন ভাবতে থাকে তাহলে এতদিন বাকি তার  সঙ্গে অভিনয় করেছে ইভা?  কিন্তু কি লাভ তাতে অভিনয় করে?  কি লাভ পেল সে? অহিনকে সরল সাদাসিধা ভেবে তার সঙ্গে কি প্রেমের খেলা খেলতে চেয়েছিল ? ভাবতে ভাবতে অহিনের সারা গা রি রি করে ওঠে। জীবনে অনেক কিছু হারানোর শূন্যতা তাকে ব্যথা দিয়েছে তার হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে বারবার। কিন্তু আজ যেন আরো একবার তার শূন্যতার মধ্যে আরও একটা শূন্য বড় আকার ধারণ করল। মনের কোনায় ইভাকে নিয়ে যে স্বপ্ন যে স্বপ্ন জাল বুনতে চেয়েছিল,  অচিন সেই স্বপ্নজাল ছিড়ে চুরমার হয়ে গেল এক মুহূর্তেই। ইভা সম্পর্কে তার সমস্ত ধারণা চুরমার হয়ে গেল।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ