নূপুরের শব্দ ৮

   অষ্টম অধ্যায়

 


হ্যাঁ আমি অহিন। বেড়াতে গিয়েও বেড়ানো হলো না।  আবার ফিরে এলাম কাজের জগতে। কি করে ফিরে এলাম সে কথা আগেই বলেছি।  কাজের জগতে ফিরলেও মন যেন কোথাও একটু হারিয়ে গেছে। নাজিমা বলেছিল আমি নাকি অচৈতন্য অবস্থায় ইভাকেই বারবার ডেকে  ছিলাম।  কি জানি?  তা হবে হয়তো।  আমি জানিনা কখন কিভাবে সে আমাকে ভালোবেসে ফেলেছে।  আর আমি বা কিভাবে একটু একটু করে ভালোবেসে ফেলেছি এই জানা-অজানা আমার মধ্যেই বড় বাঁধা।  জীবনের সুতো হয়তোবা বাধা পড়ে যাবে আমার অসংলগ্ন মনের মাঝে। ইভা আমার মনে ঝড় তুলে এসেছিল কিন্তু আমি আজ ওর ভালোবাসাকে স্বীকৃতি দেবার জন্য প্রস্তুত নই।  আমার কাছে আমার ভালোবাসার কোন মূল্য নেই। যা কিছু আছে সব অর্থহীন বোকা। বোকা বোকা সব কেমন একটা ভাব। 

 

এই সেদিন দুপুরে জানলা ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। একটা মেয়ে এসে খবর দিল যে ইভার ঠাম্মা মারা গেছে।  ছুটে গেলাম ওদের বাড়িতে।  সমগ্র বাড়িটা একটা বিরাট শূন্যতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আজ বাড়ির সব মানুষের চোখে জল।  ইভা তারই ঘরে একটা জানালার ধারে লোহার রড ধরে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে আমি আস্তে আস্তে ওর কাঁধে হাত রাখলাম। ও চমকে ঘুরে তাকালো।  এবার আমাকে দেখে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। আমি সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করি।

আমি বললাম -  ইভা কেউ আর চিরদিন বাঁচবে না তোমার ঠাম্মা না ফেরার দেশে হয়তো সুখে থাকবে প্রত্যেকটা মানুষেরই জন্ম মৃত্যু রয়েছে।।  

ইভা  - আমি যে তোমার কথা  প্রথম ঠাম্মা কে বলের ছিলাম। 

  •  আমার কোন কথা?

ইভা -  তোমাকে আমি ভালোবাসি সেই কথা।

আমি আস্তে আস্তে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসি।  কেউ তো কারো দুঃখের ভার নিতে পারেনা।  যেটুকু সান্ত্বনা দেবার সেইটুকু সান্ত্বনা দিয়ে বেরিয়ে এলাম। বাড়ির উঠোনে একগাদা লোকের ভিড়। সকলেই আত্মীয়-স্বজনকে সান্ত্বনা দিতে ব্যস্ত কেউবা মৃত ব্যক্তিকে শ্মশানে নিয়ে যাবার যোগাযোগ ব্যবস্থা।

 

প্রায় মাসখানেক পরের কথা। আজ রবিবার। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত  স কাজ করে স্নান করে বসে আছি।  অনেকদিন পর খাতা কলম নিয়ে আবার বসি। লেখার চেষ্টা করি। সেই সাত সকালেই পশ্চিম আকাশে একটা কালো মেঘ আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে।  হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যে সব এলোমেলো করে দেবে।

যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই।  দেখতে দেখতে শুরু হলো বৃষ্টি আর সেই বৃষ্টির মধ্যে আমি দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় ইভা। 

আমি বললাম  - কিরে এই বৃষ্টিতে তুই এখানে। 

ইভা চুপ কোন উত্তর করে না। 

আমি ডাকলাম  - আয় ঘরে আয়। 

ইভা ঘরে ঢুকে একটা চেয়ারে বসে পড়ে তারপর বলে -  কাল রাতে মা-বাবাকে বলেছি তোমার আমার কথা। 

  • কাকু কি বললেন?
  • বাবার কথা তুমি ভালো ছেলে হতে পারো,  কিন্তু তোমার সঙ্গে তার মেয়ের বিয়ে হতে পারে না। 

আমি বললাম  - দেখেছিস তো প্রেমের কি পরিহাস।  না না  উনি ঠিকই বলেছেন।  আসলে তোর যোগ্য আমি নই।  হয়তো আরো অনেক যোগ্য ব্যক্তি কে তোর বাবা বেঁছে রেখেছে। 

ইভা  - তুমি পারো না আমাকে নিয়ে চলে যেতে।

আমি বললাম  - আমার পারা না পারার প্রশ্ন নয়।  এই ভাবেই তোকে নিয়ে চলে যাব আবার ফিরে আসবো এটা লোক হাসান হবে না? 

ইভা -  সাবাস সাবাস।  লোকের ভয়ে তুমি একটা মেয়ের জীবন নিয়ে ছেলে খেলা করবে? 

আমি বললাম -  তুই কী বলছিলস?  এখনই বেরিয়ে যা আমার ঘর থেকে,  তুই বলতে পারলি একথা?  ছোটবেলায় হয়তো মেরেছি পড়ে না পড়ার জন্য।  কিন্তু  থাক সে কথা । তুই যা। তোর সঙ্গে আমার কোন কথাই থাকতে পারে না

ইভা অঝর এ কেঁদে ফেলে।  তারপর অহিনের পায়ের কাছে নত জানু হয়ে বসে কাঁদতে কাঁদতে বলে  - ভুল হয়ে গেছে।  তুমি বিশ্বাস করো আমার মাথাটা ঠিক ছিল না।  হঠাৎ করে বলে দিলাম।  তুমি আমায় ক্ষমা করো।  ক্ষমা করে দাও।  আর কোনদিন তোমায় কিছু বলবো না।  অন্ধ ভালোবাসার মোহে যে বাজে কথা আমি বলেছি,  তার খেসারাত আমি সারা জীবন ধরে দেব।

ইভা নিজের কথা শেষ করে করে আমাকে একটা প্রণাম করে। তার পর আচলে চোখ মুছে বৃষ্টির মধ্যে দিয়েই বেরিয়ে পড়ে।  যাবার সময় ইভার চোখের দু ফোঁটা জল পড়ে আমার পায়ে।  আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি।  অনেকক্ষণ পর একটা পোড়া গন্ধে আমার সম্বিৎ ফিরে আসে। ছুটে যাই রান্নাঘরে।  দেখি কড়াইতে তরকারি সব পুড়ে  ধোঁয়া উঠছে। 

গ্যাসটা বন্ধ করে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি।  শোবার ঘরের জানালা দিয়ে জল ঢুকে বিছানা ভিজিয়ে দিচ্ছে।  খোলা জানালা দিয়ে অঝরে জল ঝরে পড়ে বিছানায়।

বৃষ্টির ফোতা গুলো আরো বড় হতে থাকে।  আর বৃষ্টির দাপট বাড়তে থাকে প্রতি মুহূর্তে।

 

আমার ঘরের জানালা দিয়ে দেখি দুরের সবুজ ধানক্ষেত ক্রমে ঝাপসা হতে থাকে।  আর মনের মধ্যে একটা ঝড় একটা আন্দোলন যেন দলা পাকিয়ে  ওঠে।

 

আসলে ইভার শেষ কথাটা আমি ঠিক মেনে নিতে পারিনি।  কারণ ওকে নিয়ে ছেলেখেলা করেছি এ কথাটা আমার কাছে বড্ড বেমানান।

 

জল যেমন বারান্দা ভিজিয়ে দিয়েছে তেমনি ভিজিয়ে দিয়েছে আমাকে ও আমার মনকে।  কারণ ঘরবাড়ি বারান্দার জানালা দরজা সবটাই খোলা। মুক্ত বাতাস ঘরের ভেতরেই যেন আন্দোলন করছে অহরহ। আমি জানতাম এসব ভালোবাসা আমার কাছে অর্থহীন।         জীবনে চলার পথে যার মূল্য আমি পাইনি। সেই অমূল্য রতন পাওয়ার আশা আমি করি না। আসলে ভালোবাসা একটা অমূল্য রতন সবাই সেটা লাভ করতে পারে না।

সেই বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম কটা দিন বাইরে  কাটাতে হবে।  আমাকে ঘুরতে যেতে হবে।  এবার সাগর। কাছাকাছি রয়েছে দিঘা, অথবা বকখালি। 

সিদ্ধান্ত নিলাম দীঘা যাব বেড়াতে। একা একা বসে সমুদ্রের ঢেউ, মুক্ত বাতাস আর খোলামেলা প্রকৃতির বুকে কটা দিন কাটিয়ে আসতে না পারলে আমার জীবনের শান্তি নেই।

 

কাজ শুরু করলাম।  সব এবার আমার গন্তব্য দীঘা। সেখানে মুক্ত বাতাসে নিজেকে একটু দেওয়া বলা যেতে পারে ভালো নিজের মনকে বিশ্রাম দেওয়া।

ভালোবাসার ইচ্ছা না থাকলেও মনের কোন এক গভীর হয়তো সে ধীরে ধীরে জায়গা করে নিচ্ছিল। ওর কাছে মনে হতো ওর ভালোবাসাটা একতরফা। আর সেই একতরফা ভালবাসার দাবি নিয়ে র একটা অহংকার ছিল। সেটা হতেই পারে তার কারণ আমার প্রথম থেকেই তেমন আকর্ষণ ছিল না।  কেন ছিল না সে কথা সকলেই জানে।

ইভা সুন্দরী,  তার চলন বলন আধুনিক।  চোখ দুতো  হরিণের মতন। আমার মন প্রথম থেকেই ভালোবাসায় সায় দেয়নি। যেহেতু একটি মেয়ে তার ভালোবাসার ডালি সাজিয়ে আমার কাছে আসতে চেয়েছিল তাই হয়তো আমিও একটু একটু করে দুর্বল হয়ে পড়ছিলাম।  আমার কাছে মান সম্মান অনেক বড় একটা প্রশ্ন ছিল।

আমি সারা জীবন একটা নীতি, একটা নিয়ম মেনে এসেছি। তাই সেই প্রতিপালিত জীবনের থেকে সহজে বেরিয়ে আসা যাবেনা।

ইভার বাবা বলেছে -  সব সময় ভালো ছেলেকে বিয়ের পাত্র করা যায় না।  তার কারণ সব ভালো ছেলেদের কাছে অর্থ বা সম্পদ নেই। মেয়ের বাবা-মা সম্পদ  খোঁজে। মেয়ের ভবিষ্যতের সুখ খোঁজে। অর্থের বিনিময়ে,  সম্পদের বিনিময়ে বা  অর্থ এবং সম্পদের বাইরে প্রত্যেকটা মেয়ের জীবনে একটা আলাদা মন আছে।  একটা  ভার রয়েছে,  একটা বিবেক রয়েছে,  সেখানে ভালোবাসা নামক এক অদেখা বুঝিয়ে রয়েছে। আসলে আমরা সেইসব ভেতরে থাকা বইয়ের ভিতরে থাকা অর্থগুলোকে এদের জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারি না।

এই সব সাধারণ কথাগুলো সাধারণ জীবনের সঙ্গে ধাতস্থ করা খুবই কষ্টকর।  কারণ যেখানে প্রশ্ন অর্থ আর সম্পদ নিয়ে,  সেখানে আমাদের মতন খেটে খাওয়া সাধারণ ব্যক্তির কাছে ইভা অনেক দূরের একটা স্বপ্ন। আমি ব্যক্তিগতভাবে ইভার  বাবাকে চিনি বা জানি। চিনি আর জানি বলেই ইভার কথাগুলো আমার কাছে নতুন করে কোন অনুভূতি আনেনি।  কারণ প্রথম দিন থেকেই আমি ধরে নিয়েছিলাম যে এই যাযাবর জীবনের সঙ্গে কেউ আসবেনা।  বা কেঊ কারোর মেয়েকে আমার সাথে বিবাহ দেবে না। 

বই আর বাস্তবের মধ্যে একটা বিরাট বড় ফারাক রয়েছে।  আমরা সেই ফারাক বা ব্যবধান কি খুজি? কি জানি। 

আমরা সবাই স্বপ্ন দেখি।  কিন্তু সেই স্বপ্ন গুলো কি ভাবে চারায় পরিনত হবে তা কি কেউ ভাবি? 

ভাবি হয়ত। আবার অনেক সময় স্বপ্ন রা হারিয়ে যায় নদীর অতল গভিরে।  হটাত মনে হল একটু বৃষ্টি তে ভিজি। নেমে গেলাম উঠোনে। ঝম ঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। আমার মন কে শান্ত করছি।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ