নূপুরের শব্দ ৭

  সপ্তম অধ্যায়

  


বিকেলের পড়ন্ত বেলায় যখন ছাদে বড় আম গাছটার ছায়া পড়ে যায়,  তখন পাড়ার তিন চারটে মেয়ে এই ছাদে বসে আড্ডা দেয়। রোজকার মত আজও ইভা আর তৃষা চেয়ার নিয়ে খোলা আকাশের নিচে এসে বসে। হয়তো আর কিছুক্ষনের মধ্যে আরও এক কয়েকজন বান্ধবী এসে যাবে।  ইভা আর তৃষা ওদের পরীক্ষার পড়া নিয়ে যখন আলোচনায় ব্যস্ত,  ঠিক তখনই আশা দৌড়ে আসে ছাদে। হাঁপাতে  হাঁপাতে -  বলে অহিন দা ফিরেছে রে?

ইভা চঞ্চলা হরিণীর মত লাফিয়ে ওঠে পড়ে আনন্দে জড়িয়ে ধরে  তৃষাকে। 

ইভা বলে - তুই কোথায় দেখলি আশা? 

আশা - আমি এইমাত্র ওই পথ দিয়ে ফিরছিলাম।  আমার সঙ্গে কথা বলল। 

তৃষা -  তোর সঙ্গে কোথায় দেখা হলো? 

আশা  - কালী মন্দিরের সামনে। 

তিনজন তিনটি চেয়ার নিয়ে আগ্রহ ভরে অপেক্ষা করতে থাকে। 

তৃষা -  বলে দেখ দেখ ইভা অহীন দা এইদিকেই আসছে। 

তিনজনই ঘুরে তাকায় দুরের রাস্তার দিকে। এলোমেলো  চুল,  শুস্ক শরীরের একটা মানুষ। কাধে দুটো ব্যাগ নিয়ে ঘিরে খুব ধীরে হেটে আসছে।  মাঝে মাঝে রাস্তায় দু-একটা লোকের সঙ্গে হেসে হেসে কি সব যেন বলছে।  আর এই দিকে ছাদের তিন জোড়া চোখ বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে সেই দিকে। 

 

অহিন কোন দিকে তাকায় না। আস্তে আস্তে নিজের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।  দরজা খুলে কোন রকমে বেড পরিষ্কার করে এলিয়ে দেয় শরীর। 

কি করবে ভেবে না পেয়ে ধপাশ করে চেয়ারে বসে পড়ে ইভা। একি চেহারা হয়েছে অহিনের?  চোখগুলো বসে গেছে।  শরীর শূস্ক হয়ে গেছে। ইভার চোখে জল।  কিন্তু  তৃষা আর আশা যুক্তি করে ওকে নিয়ে হাজির হয় অহিনের বাড়িতে।

 

তুষা সাহস করে এগিয়ে যায় দরজার কাছে। তারপর ডাক দেয় -   অহিন দা ভিতরে আস্তে পারি?

অহিন চোখ বুজে শুয়ে ছিল। চোখ না খুলেই উত্তর দেয়  - আয়।

 

কিছুক্ষণ পর একটা নুপুরের শব্দ অহিনের কানে যেতেই অহিন উঠে বসে।  হয়তো ইভাকে দেখতে পাবে এই আশায়।  সত্যি নুপুরের মৃদু সুর তুলে ঘরে প্রবেশ করে ইভা। সেই ইভা ছোটবেলার যার দৌড়ত্ব যার পায়ের নুপুরের শব্দ বাড়ির দেওয়ালে লেগে ফিরে আসত।  মনে হতো কোন নর্তকীর পায়ের তালে তালে ছন্দিত হচ্ছে কোন এক সুর।

ইভা তৃষা আর আশাকে বসার জায়গা করে দিয়ে অহিন আবার শুয়ে পড়ে।  শরীরের ক্লান্তি তাকে জাপ্টে ধরেছে। 

প্রথমে  কথা শুরু করে  তৃষা, বলে -  বাপরে বাপ অহিন দা, তুমি পারও বটে। 

অহিন - কেন কি হয়েছে?

ইভা  - বা রে এতদিন হয়ে গেল,  আমরা বুঝি চিন্তা না করে থাকতে পারি? 

অহিন উত্তর দেয় - যাক শুনে খুশি হলাম,  কেউ আমার জন্য চিন্তা করে ।

ইভা  - সবাইকে নিজের মত স্বার্থপর ভেবোনা।

অহিন -  ও খুব রাগ হয়েছে দেখছি।

 তৃষা - ট্রেন এক্সিডেন্ট এর পর থেকে তো ইভা কেমন যেন হয়ে গেল। ঠিক সময় খাওয়া দাওয়া করে না।  চুপ করে তোমার কথা চিন্তা করে আর ঈশ্বরকে ডাকে।

অহিন উত্তর দেয় -  তোদের ঈশ্বরের ডাকই হোক  আর জার কারনেই হোক, ফিরে যখন এসেছি তখন আর রাগ করে কি লাভ বল।

ইভা - মানুষ তো একটা খবর দেয়।

অহিন - কি করে খবর দেবো?  আমি নিজেই তিন চারদিন বেহুশ হয়ে পড়েছিলাম।  মাথা ফেটে গেছে।  সারা গা হাত পা কেটে জর্জরিত হয়ে আছে। সবাই তো  বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ফিরে এলাম। 

ইভা -  বল কি? 

অহিন -  যাচ্ছিলাম বেড়াতে। মনের মাঝে কত আনন্দ।  হতাত চারিদিক কেমন যেন সব এলোমেলো হয়ে গেল। বোমার শব্দে সব কিছু  এলোমেলো হয়ে গেল। অন্ধকার চারিদিক।  চোখ খুলে দেখি শুয়ে আছি একটা ঘরে। সেখানে কেউ আমার চেনা নয়। সেই অচেনা ঘরেই দেখা হয়ে গেল বহু  দিনের পুরোন বন্ধু নাজিমার  সঙ্গে।  ওই আমাকে মা বল বা বোন বল আর দিদি বল যেভাবেই হোক সেবা করে আমাকে সুস্থ করে দিয়েছে। 

 

আশা - এদিকে ইভা তোমার আসার পথের দিকে তাকিয়ে চোখ দিয়েজল ফেলছে। 

অহিন -  তাই বুঝি?

ইভা - শোনো অহিন দা আমরা দুজন পাশের ঘরে জাচ্ছি।  তোমরা দুজনে একটু কথা বলো।  আমরা পাশের ঘরে আছি। আয় রে আশা, আমরা পাশের ঘরেই অপেক্ষা করি।

 

 তৃষা আর আশা পাশের ঘরে গিয়ে বসে।  অহিন ইভার হাতটি ধরে আস্তে আস্তে নিজের কাছে টেনে নেয়। তারপর বলে সত্যি তুমি আমার জন্য চিন্তা কর।

ইভা - যদি আমার বুক চিরে দেখালে তুমি বিশ্বাস কর, তাহলে চলো মন্দিরে গিয়ে বুক চিরে রক্ত দেখাবো।  তুমি কি ভাবো,  তোমাকে কেউ ভালোবাসে না?  আমি বাসি এবং বাসবো।

অহিন - ইভাকে   দুই হাতে আরো কাছে টেনে আনে।  তারপর আলতো করে একটা চুম্বন করে অর মুখে। ইভা লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে পাশের ঘরের বন্ধুদের কাছে ছুটে পালায়। 

 

কিন্তু ইভা এত সহজে অহিন পাবে একথা বিশ্বাস করতে পারিনি ইভা।  পাশের ঘর থেকে আবার একটা হাসির কলরব।  তারপর আবার ফিরে আসে ইভা।

অহিন  - কি হলো দূরে চলে গেলে যে? 

ইভা  - না এমনি। 

অহিন -  কিছু মনে করলে না তো? 

ইভা - না।

 একটা ছোট্ট উত্তর। তারপর মাথাটা নিচু করে অহিনের পাশে চুপ করে বসে থাকে। 

অহিন - খবর দেওয়ার কোন উপায় ছিল না। হয়তো এই যাত্রায় কোন রকম বেঁচে গেলাম। 

ইভা  - আমরা তো খুব চিন্তায় ছিলাম জানো? 

অহিন -  নাজিমা যদি না থাকতো আর ওর বাড়ির লোক যদি না থাকতো তাহলে হয়তো আমার বাড়ি ফেরা হতো না।  যে জঙ্গলে আমি পড়েছিলাম সেই জঙ্গলের শিয়াল বা  কুকুরে টেনে নিয়ে যেত আমায়। নাজিমার শ্বশুর আমায় জঙ্গলে বিশেষ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে তাদের বাড়িতে নিয়ে যায়।  সৌভাগ্য হোক আর দুর্ভাগ্যই হোক নাজিমা আমাকে দেখে চিনতে পারে। আর তারপর এক রাশ স্নেহ মায়া মমতা দিয়ে আমাকে সেবা করতে থাকে। দীর্ঘ এক মাসের সেবা এবং স্নেহ মায়া মমতায় আমি একটু একটু করে সুস্থ হয়ে উঠলাম।

ইভা - কে এই নাজিমা? কি তার পরিচয়? 

অহিন উত্তর দেয়- নাজিমা আমার কলেজ জীবনের বন্ধু।  আমরা কলেজের সহপাঠী।  একসঙ্গে এক ক্লাসে পড়তাম এইমাত্র। বন্ধুত্বের সূত্র ধরেই হয়তো সে পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল আমার।  তা না হলে হয়তো আর এ বাড়িতে এরা হতো না।

ইভা -  এই একমাস যে কিভাবে কাটিয়েছি,  সে কথা তোমাকে বলে বোঝানো যাবে না। 

অহিন -  তুমি মনে হয় এখনো ভুল করছ ইভা?  আসলে প্রেম ভালোবাসা এগুলো আমার জন্য নয়।  আমি এক বোহেমিয়ান জীবনের অধিকারী।  আমার জীবন সমুদ্রের তরঙ্গের মতো বয়ে যাওয়া ঠিকানাহীন এক পথ।

ইভা - আমি কি সেই ঠিকানাহীন পথের সঙ্গী হতে পারি না? 

অহিন একটু হা্সে তারপর উত্তর দেয় -  খুবই কঠিন,  সেখানে আবেগ আছে,  হয়তো ভালোবাসা আছে।  কিন্তু বাস্তবতা নেই। কারণ বাস্তব বড় নির্মম এবং বেদনাদায়ক।

ইভা- সেই বেদনার সাগরে ভাসলাম আমি। 

অহিন -  বেদনার সাগরে ভেসে সারা জীবন কে নষ্ট করে কি লাভ?  আমি এক সাধারণ মানুষ।  যেটুকু অর্থ উপার্জন হয় তাতে সংসার চালিয়ে এই ভ্রমণের ইচ্ছাটুকু বাচিয়ে রেখেছি। জীবনের স্বাদ আর আহ্লাদ মেটানোর জন্য। 

ইভা -  যতোই নিষ্ঠুর এবং নির্মম জীবন বাস্তবতার উপর প্রতিষ্ঠিত হও।  সেখানে একে অপরের বেঁচে থাকার জন্য একজন মানুষ দরকার একজন মানুষ।  মানুষ ছাড়া তুমি বাঁচবে কি করে? 

 

অহিন -  তবে সেই আকাশ কুসুম কল্পনা আমার বাস্তবতার ভিত্তি নাড়িয়ে দেয়। তাই আকাশ কুসুম কল্পনা আর করি না। যেটুকু সম্ভব এই বাস্তবের মাটিতে ফলাতে চাই। ভোগ করতে চাই না।।

ইভা   কি বলবে কিছু উঠতে পারেনা।  অহিনের হাতটা ধরে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে এক দৃষ্টিতে।। যেন কত দিনের কত বছরের চেনা এক মানুষ।  কিন্তু বাস্তবতার  জমিতে সেই চেনা মানুষও অচেনা থাকে তার কাছে। আশাহত হয় না ইভা। হাতটা জড়িয়ে ধরে নিজের কোলের মধ্যে রেখে বলে  - এমনি করে তোমার হাত ধরে চলতে চাই। সারাটা জীবন।

অহিন  - আমার সমস্ত পরিকল্পনা হঠাৎ ব্যর্থ হয়ে যায় এই প্রশ্ন বাণে।  তোমারা ফিরে যাও ।  আমাকে দুটো দিন একটু নিরালায় একা থাকতে দাও।  অসুস্থ জীবনটাকে আর বয়ে নিয়ে যেতে পারছি না।

ইভা তার দুহাত প্রসারিত করে অহিনের হাত দুটো ধরে  অহিনের চোখে চোখ রেখে নিশ্চল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ