ষষ্ঠ অধ্যায়
এরপর থেকে দুই পুরনো বন্ধু দুপুরবেলা বসে গল্প করত। কত পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে দুজনের। অহিন আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে ওঠে। একদিন দুপুরে অহিন নাজিমাকে বলে - নাজিমা এবার তো ফিরতে হবে?
নাজিমা - ফিরবে ? ফিরতে তোমায় হবেই? তবে বয়স তো হলো। ঘর সংসার কর। নাকি কারোর জন্য অপেক্ষা করছ?
অহিন - সংসার করার ইচ্ছা নেই বলে বিয়ে করিনি। আর তাছাড়া কে আমাকে মেয়ে দেবে? আমার জন্য মেয়ে দেখা বা বিয়ের ঝামেলা কে পোহাবে? এর থেকে একাই ভালো আছি।
নাজিমা - না, তুমি দিব্যি নেই। তুমি ভালো নেই। সে কথা আমি জানতে পেরেছি। তুমি যখন অসুস্থ হয়ে জ্ঞান হারিয়েছিলে তখন তুমি মাঝে মাঝে কত কিছু বলতে জানো? বারবার শুনতাম ইভা নামের একটি মেয়ের কথা। তুমি কি তাকে ভালোবাসো?
অহিন - নাজিমা ওকে ভালোবাসি কিনা জানিনা। তবে যতদূর জানি ও আমাকেই ভালোবাসে।
নাজিমা - তাহলে ফিরে গিয়ে ওকে বিয়ে কর। একটা মেয়ের জীবনে দুঃখ দিয়ে কি হবে বলো।
অহিন - আমি কোথায় দুঃখ দিলাম বল? আমি তো দুঃখ দিতে চাই না। আমার তেমন কোন আগ্রহ নেই।
নাজিমা - আগ্রহ তৈরি করে নিতে হয়। একবার ভেবে দেখো ও যখন তোমার কোলে মাথা রেখে শোবে, যখন তোমার গলা জড়িয়ে ধরে তোমার মুখে সুখের চুম্বন এঁকে দেবে। তখন ভাবো একবার তুমি কত আনন্দ পাবে।
অহিন - সে অনুভুতির কথা তুমি বলতে পারবে । আর তা ছাড়া মেয়েদের শরীর নিয়ে খেলা আমার ভালো লাগেনা।
নাজিমা - বেশ তোমার যা ভালো লাগে করো। আর যদি কোনদিন এই হরভাগিনী কে মনে পড়ে তাহলে চলে এসো আমার কাছে। কটা দিন থেকে যেও।
অহিন - আসব। হয়ত আবার কন এক অমোঘ টানে আস্তে হবে এখানে। আর হ্যা, যেটুকু অন্ধকার তোমার জীবনে এসেছিল, সে অন্ধকার তোমার সন্তানদের নিয়ে ব্যস্ততার মধ্যে সেই চলে যাবে।
নাজিমা - তাই যেন হয়। আমার কথা যেন সত্যি হয়।
অহিন - যে ঋণ আমি টমার বাড়ি থেকে মাথায় করে নিয়ে যাব, জানিনা তা কোনদিন শোধ করতে পারব কিনা।
নাজিমা - ও কথা বলো না। বলো বন্ধুর প্রতি বান্ধবীর কর্তব্য। ঋণ বলে তুমি আমার বন্ধুত্বের অবমাননা করো না।
অহিন - নাজমা ……। আসলে আম ও ভাবে বলতে চাইনি। আসলে …
নাজিমা - ঋণ শোধ করার কথা বলে তুমি আমায় অপমান করোনা। আমার থেকে তোমার বেশি ঋণী থাকা উচিত আমার শ্বশুর মশায়ের উপর। যিনি না থাকলে তোমার কি হত জানি না। তিনি কোনভাবেই এই ঋণের দায়ভার নেবেন না। আমি তাকে জানি। এমন ভালো কাজের সঙ্গেই তিনি জড়িত থাকেন। ঋণ শোধ করা মানে তাকে অপমান করা।
অহিন আর কোন কথা বলে না। চুপ করে তাকিয়ে থাকে নাজিমার দুটি চোখের দিকে। সে চখের গভীরতা মাপা খুব কঠিন।
ভর দুপুরে দুটি নর নারী হেটে চলেছে। শূন্য মাঠ। রোদে জনপ্রাণীহীন। মাঠ খাঁ খাঁ করছে। তার মধ্যে দিয়ে অতি দ্রুত বেগে হেঁটে চলেছে অহীন। আর অহীনকে পৌঁছে দিতে এগিয়ে চলেছে নাজিমা। নাজিমা ফেরার পথে তার স্বামীর সাথে ফিরবে। স্টেশনে তার একটা বড় দোকান আছে।
কিছুক্ষণের মধ্যে ওরা স্টেশনে পৌঁছায়। তারপর বহুদিনের পুরনো বন্ধুর হয়তোবা চিরদিনের জন্য বিচ্ছেদ হয়ে জায়। চোখের জলে বিদায় নিয়ে অহিন হাওড়া গামী ট্রেনে চেপে বসে। আস্তে আস্তে ট্রেনটা দূরে সরে যায়। আস্তে আস্তে ট্রেনটা দুজনের মধ্যে ব্যবধান বাড়াতে থাকে। ধীরে ধীরে ট্রেনের গতিবেগ বাড়তে থাকে। তারপর একসময় অদৃশ্য হয়ে যায় হাওড়া গামী সেই ট্রেন। নাজিমা দাঁড়িয়ে থাকে চলে যাওয়া সেই ট্রেনের লাইনের দিকে তাকিয়ে। কয়েক ফোটা জল তার দু গাল বেয়ে পড়ে শাড়ির আঁচলে।
নাজিমা জানে হয়তো আর কখনো কোনদিন তার বন্ধুর সাথে দেখা হবে না। কথাও হবে না। বন্ধু ফিরে যাবে কলকাতায় তার বাড়িতে। আর নাজিমা কে পড়ে থাকতে হবে এই পোড়া গ্রামে। তার জন্য কিছু মনে করে না। সে ধরে নিয়েছে এটাই তার নিয়তি। তাই চুপটি করে বসে থাকে পেছনের একটা চেয়ারে।
ট্রেনে বসে অহিন ভাবতে থাকে ফেলে আসা সেই কলেজ জীবনের কত কথা। নাজিমাকে পাওয়ার জন্য কলেজের বন্ধুরা চেষ্টা করতো। শুধুমাত্র তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করার জন্য মুখিয়ে থাকতো অনেক জন। ভাবা যায় সেই নাজিমা যাকে পাওয়ার জন্য বা তাকে একটু ছোঁয়ার করার জন্য কতই না মারপিট গন্ডগোল করেছে সেই সময়ের রোমিওরা। যদিও নাজিমা কারোর জুলিয়েট হতে চাইয়নি। কিন্তু কিভাবে যে তমালের প্রেমে জড়িয়ে পড়ল সে কথা সকলের কাছেই অজানা।
অহিনের মনে পড়ে এক সময় কলেজের সোশ্যাল অথবা কলেজের নবীন বরণে এই নাজিমাই ছিল ছেলেদের আকর্ষণ। তার পোশাক তার স্টাইল সবকিছুই ছিল অনুকরণযোগ্য। আর আজ সে পড়ে আছে উত্তরপ্রদেশের নাম না জানা ছোট এক অজ পাড়ায়। যদিও সে সুখে আছে তবুও শহর থেকে অনেকটা দূরে। নাজিমার গায়ের রং এখন আর আগের মত চমকায় না। তবুও অস্বীকার করা যায় না যে তার লাবণ্য এখনও কমেনি। ট্রেনে জানালার পাশে বসে ভাবতে থাকে অহিন। জানালার পাশ দিয়ে দ্রুত বেগে ছুটে যায় ঘর বাড়ি আর সারি সারি গাছ। গাছপালা ঘরবাড়ি আর মন ছুটে যায় । অহিন ফিরেযায় যায় ফেলে আসা কলেজ জীবনে রোমান্টিক মুহূর্ত গুলিতে।
অহিন ভাবতে থাকে।, “ ভাবতে বেশি অবাক লাগে সেদিন সেই ট্রেন দুর্ঘটনার পর সে যে কিভাবে বেঁচে গেল আর কিভাবে এ যাত্রায় জীবনী বেঁচে উঠলো। কপালের জোর না থাকলে এইভাবে বিজেপিরা সম্ভব হতো না। কলেজ জীবনে নাজমা কে ছোঁয়া বা তার স্পর্শ ছিল খুবই গ্রস্ত গ্রহ একটি ব্যাপার। কিন্তু সেই নাজিমার আজ পুরটাই পরিবর্তন হয়েছে।জীবনের সব ঝড় ঝাপটা সামলে সে এখন দাঁড়িয়ে আছে এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা তাল গাছের মতন। হয়তো নাজিমাকে মনে রাখেনি তাদের বন্ধু মহলের কেউ। কিন্তু নাজিমার এই করুন পরিণতি বন্ধু মহলে হয়তো কখনো আসবে না। কিন্তু অহিনের মনের মধ্যে তার সেবা যত্নে সুস্থ হয়ে ওঠার ব্যাপ্ত ইতিহাস লুকিয়ে থাকবে সারা জীবন। ট্রেনটা চলছে ঝড়ের মতন। সইছে না বারবার বাড়ি ফেরার পালা যে উদ্দেশ্য নিয়ে অহিন বেরিয়েছিল সেই উদ্দেশ্য তার সফল হলো না তবুও তোর সঙ্গে বাড়ি ফিরতে পারছে এটাই তার কাছে একটা বড় প্রাপ্তি।
কখনো কখনো এমন এমন ঘটনা ঘটে যে ঘটনার ব্যাখ্যা দেওয়া যেমন সম্ভব নয়, তেমন ই সেই ঘটনার বর্ণনা দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু সেই ঘটনা ঘটে এবং মনের গভীরে তা দাগ কেটে যায়। ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরের শূন্য আকাশ খোলা মাঠ এক অপূর্ব মানসিক তৃপ্তি দেয় তাকে। অহিন গ্রাম্য জীবনের থেকে উঠে আসা এক তরুণ। গ্রামের পরিবেশের সঙ্গে তার রয়েছে সক্ষতা।
হঠাৎই তার মনে পড়ে যায়, ফেলে আসা সেই শৈশব। ছোটবেলায় গামছা দিয়ে দুপুরে মাছ ধরা অথবা বিকেলবেলা হলে ছেলেদের সঙ্গে মাঠে ফুটবল খেলা সবটাই তার মনের গভীরে যেমন দাগ কেটে গেছে। তেমনি উত্তরপ্রদেশের নাম না জানা কোন এক গ্রামে হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়া তার পুরনো বন্ধুর হাতের স্পর্শে শরীর ভালো হয়ে ওঠার অনুভূতি তাকে হয়তো অন্য মাত্র প্রদান করবে। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে থাকে তার বাংলা মায়ের প্রকৃতি। আর ততই মনের গভীরে একটু একটু করে ভেসে ওঠে ইভা আর তৃষা দের মুখ। অহিনের জীবনে ইভা অথবা তৃষা এখনো দাগ কেটে উঠতে পারেনি। তবুও তারা মনের বাইরের থেকে যায়। মনের অন্তরে ঢোকার চেষ্টা করে তারা।
0 মন্তব্যসমূহ