পঞ্চম অধ্যায়
চোখ খুলে অহীন দেখে অচেনা একটা ঘরেই শুয়ে আছে ও। ঘরের উপরে খড়ের চালা। পাশের দেওয়াল টিনের। তার মাথায় ব্যান্ডেজ বাধা। সারা গায়ে হাত পায়ে অনেক অনেক কেটে যাওয়া ক্ষত। হাঁটুতে বড় একটা ব্যান্ডেজ। চোখটাও যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছে।
বাইরে থেকে কিছু কথা আসছে তার কানে। কিন্তু সে কথাগুলো বুঝতে পারছে না। কারণ কথাগুলো যে বাংলায় নয় সেটা সে ভালই বুঝতে পারে। তারপর একটু একটু করেই মনে পড়ে যায় ট্রেন এক্সিডেন্ট এর কথা। হঠাৎই একটা ঝাকুনি। তারপর বিরাট শব্দ এবং নিস্তব্ধতা। সেই ঘটনার পর চোখ খুলে এই নিরালা অচেনা একটা ঘর কেমন যেন সব এলোমেলো মনে হতে লাগলো অহিনের। আর ঠিক তখনই একটা অল্প বয়সী স্ত্রীলোক হাতে গরম দুধের গ্লাস আর চামচ নিয়ে এসে হাজির হলো। অহিনের চোখ দুটো খোলা দেখে চমকে গেলো সে। একটু দাঁড়ালো। তারপর কাছে এসে পরিষ্কার বাংলায় বলল। এখন কেমন লাগছে?
অহিন কোন রকমে বলে - ভালো। কিন্তু আমি এখানে কেন।
মহিলা - চার দিন আগের ঘটনা, আপনার মনে নেই। আপনার মনে নেই গত চার দিন আগে যে ট্রেন দুর্ঘটনাটি ঘটেছে, সেই দুর্ঘটনা ঘটার পরদিন সকালে আপনি একটা বাগানের উপর পড়েছিলেন। আমার শ্বশুরমশাই আপনাকে ওখানে পড়ে থাকতে দেখে, নিয়ে আসে আমাদের বাড়িতে। এতদিন আপনি বেহুশ হয়েছিলেন। কাল থেকে একটু একটু হা করে কি যেন বলতে চাইছিলেন। ডাক্তার বলে গেছেন চামচে করে গরম দুধ খাওয়াতে। আপনি হা করুন আমি খাইয়ে দিয়ে যাই। আশা করি আপনি আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠবেন।
অহিন হা করে আর সেই অপরিচিতা তার মুখে চামচ করে দুধ দিতে শুরু করে। মাঝে মাঝে উঠে চলে যায় বাড়ির কাজে। আবার মাঝে মাঝে ফিরে আসে। কখনো ওষুধ নিয়ে, কখনো বা ক্ষতস্থান গুলি গরম জলে ধুয়ে পরিষ্কার করে দিতে।
অনেক দিন ধরে তার এইরকম সেবা যত্নে সে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠতে থাকে। তবে হাঁটুটা ভীষণ ফোলা রয়েছে। ডাক্তার বাবু এক্সরে করে জানতে পেরেছেন হাঁটুর মালাই চাকি টা সরে গেছে। তাই সেটা সেট হতে সময় লাগবে। এমনকি অপারেশনও পর্যন্ত হতে পারে। এই অজানা পরিবার তার জন্য এত চিন্তিত কেন তা অহিন বুজতে পারে না।
একদিন দুপুর বেলা অহিন বুঝতে পারে বাড়িতে কেউ নেই। হঠাৎ-ই ঝুমঝুম করে একটা নুপুরের শব্দ এগিয়ে আসতে থাকে তার দিকে। অহিন চোখ খোলে না। ও ভাবে অনেকদিন আগেই অতীত হয়ে যাওয়া ইভার কথা। ইভা যখন পড়তে আসতো তখন এমনি করেই সুরের ঝংকার তুলে ঢুকে পড়তো ঘরে। ইভার নুপুরের শব্দে প্রত্যেকেই বুঝত ইভা আসছে। আজ পুরোনো দিনের সেই স্মৃতি মনে পড়লেও চোখ খোলে না অহিন। কারণ চোখ খুললেই সে তো আগের মতো ইভাকে দেখতে পাবে না। একসময় নুপুরের শব্দ আরো জোরালো হয়ে এসে থেমে যায় তার কাছে। তারপর একটা নরম ঠান্ডা হাতের ছোঁয়া কপালে এসে লাগে। হাতের আঙুলগুলো চুলের মধ্যে বিলি কাটতে থাকে। অহিনের চোখ পড়ে সেই অপরিচিতার দিকে। সেও তাকিয়ে থাকে অহিনের দিকে। তারপর সেই ভদ্র মহিলা বলে -, - চিনতে পারছো অহিন?
অহিন আরো অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে মহিলার দিকে।
মহিলাটি আবার বলে - চিনতে পারছো না তো? সেটাই স্বাভাবিক। আগের মত রং বা চেহারা কিছুই নেই আমার। নাম মনে নেই বোধ হয় দেখো মনে করতে পারো কিনা।
অহিন আরো তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে দেখে। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারে না মেয়েটি কে।
অবশেষে মেয়েটি বলে - আমি নাজিমা।
অহিন চমকে ওঠে। নাজিমা।
নিজেকে সংযত করে অহীন বলে - তুমি এখানে? কি করে এলে এখানে? এই জায়গার নাম কি
নাজিমা বলে এই জায়গার নাম চৌরিচৌরা। এই জায়গা একটা ইতিহাস আছে কিন্তু তার থেকেও আমার ইতিহাস আরও বেশি ভয়ংকর।
অহিন - চৌরিচৌরার ইতিহাস জানি। কিন্তু তোমার ইতিহাসটা কি?
নাজিমা - জানলে আমাকে ঘৃণা করবে। আমরা এক কলেজে পড়তাম। কলেজের সহপাঠী। তাই তোমাকে বলতে আপত্তি নেই। কিন্তু বল আমার কথা শোনার পর তুমি আমায় ঘৃণা করবে না।
অহিন - জীবনকে ঘৃণা করার অভ্যাস আমার নেই। কারণ মানুষই মানুষকে ঘৃণিত করে তোলে। যারা মানুষকে ঘৃণিত করে তোলে আমি তাদেরকে ঘৃণা করি।
নাজিমা - এইজন্যই তুমি কলেজে সবার প্রিয় ছিলে। হয়তো আমিও অন্যদের মতো মনে মনে একটু হলেও তোমাকে ভালোবেসেছিলাম।
অহিন- হাতের ঘি অনেকদিন আগেই শুকিয়ে গেছে। সেই ঘি এর গন্ধ আর নেই।
নাজিমা - তাই জন্য ঘি নিয়ে আর ভাবি না।
আহিন - কি বলবে বলছিলে?
নাজিমা শুনবে তবে
নাজিমা ধীরে ধীরে অহিনের পাশে বসে। এখানে বসে তোমার বাড়ির লোক দেখলে কি বলবে?
নাজিমা - সবাই কাজে গেছে। সন্ধ্যের আগে কেউ ফিরবে না।
আহিন - বেশ, তবে বলো তোমার ইতিহাস।
নাজিমা শুরু করে তার চৌরিচৌরায় আসার কাহিনী।
জানো আহিন, একদিন পড়িয়ে ফিরছি। সন্ধ্যে হয়ে গেছে। রাস্তা একদিকে লোক চলাচল করছে। হঠাৎ একটা ছেলে এসে দাঁড়ালো আমার সম্মুখে। সুন্দর চেহারা। সুন্দর টেরি কাটা চুল। ভীষণ স্মার্ট দেখতে। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম - কি হলো সামনে দাঁড়ালে যে?
ছেলেটি উত্তর দিল - আমি তোমাকে ভালোবাসি, তাই তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চাই।
আমি তো হতবাক। হঠাৎ এইভাবে একটা ছেলে এসে বলল, আমাকে ভালবাসে। কি করব কি বলবো ভাবছি ? কিছুটা বুঝে ওঠার মধ্যেই আবার জিজ্ঞাসা করে - তোমার নাম কি?
আমি আমার নাম বলে দাঁড়িয়ে থাকি। ছেলেটি আগের মত স্প্রতিভ হয়ে ওর নাম বলল - তমাল।
তারপর বলল - আমি জানি তুমি অন্য ধর্মের। তবে আমার কোন বাধা নেই। আমি একা থাকি।
আমি এবার বললাম - একা বলেই কি? শুনুন এই মুহূর্তে কিছু বলার মত ভাষা আমার নেই। আমাকে একটু সময় দিন পরে জানাবো।
ছেলেটি বলে - কাল কাল আমি এখানে দাঁড়াবো।
আমি বললাম - ভালোবাসা জিনিসটা ছেলে খেলা নয়। আজ বললে কাল হবে সেটা কি সম্ভব?
তমাল কথাগুলো শুনে চলে যায়। একবার দেখেই তমালের প্রেমে পড়ে গেলাম। তারপর দিন থেকে দুজনের পরিচয় এবং অনেক পরে আস্তে আস্তে কখন জানি না ওকে ভালোবেসে ফেললাম। দুজনে ডেটিং করে বেড়াতাম। পার্কে পাশাপাশি বসে বাদাম খেতাম। তারপর একদিন তমাল বিয়ের প্রস্তাব দিল। আমি বাড়িতে মাকে বললাম। মা রাজি হল না হিন্দু ছেলের সঙ্গে বিয়েতে। আর মা রাজি না হলে বাবা রাজি হবে না। কারণ বাবা ছিল আরো গোড়া মুসলিম। একদিন ঠিক করলাম পালিয়ে যাব। গেলাম পালিয়ে। একটা হিন্দু মন্দিরে ও আমার মাথায় সিঁদুর পরিয়ে দেয়। কিছুদিন একসঙ্গে কাটাই। বেশ আনন্দে ছিলাম সেই দিনগুলো। একদিন ওরা বন্ধু জয় এলো বাড়িতে। আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। আর যাবার বেলায় আমাদের দুজনকে নিমন্ত্রণ করে গেল ওর বাড়িতে। এক সন্ধ্যায় সেই বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে আনন্দ করলাম এবং সেই দিনে ঠিক করলাম দূরে কোথাও বেড়াতে যাব আমরা। আমি তমাল আর তমালের বন্ধু জয়।
সাজগোজ করে চেপে পড়লাম ট্রেনে। আমাদের যাওয়ার কথা গুয়াহাটি। সেখান থেকে শিলং। আগেই কথা হয়েছিল নিউ জলপাইগুড়িতে তমাল নেমে ওর অফিসের কাজ মিটিয়ে চলে যাবে গুয়াহাটি। আগে থেকেই হোটেলের বুকিং ছিল। এক দেড় ঘন্টা অফিসের কাজ। সেইমতো নিউ জলপাইগুড়িতে তমাল নেমে গেল। এক দেড় ঘন্টা অফিসের কাজ মিটিয়ে ও চলে যাবে পরের বাসে। দুপুর বারোটা নাগাদ আমি আর জয় গুয়াহাটিতে নেমে গেলাম। হোটেলে দুটো ঘর ছিল। খাওয়া-দাওয়া করে বিশ্রাম নিলাম। সন্ধ্যে হলো তবুও তমাল এলো না। মাঝে, হোটেলে ফোন করে জানালো যে তমালের কাজ শেষ হয়নি। আজ আসতে পারবেনা। নিরুপায় হয়ে জয়ের ঘরে গেলাম জয়কে বলতে। জয় শুনে আফসোস করল। দুজনে কিছুক্ষণ কথা বলে ফিরে এলাম আমার ঘরে। কিন্তু একা ভালো লাগছিল না। আবার জয়ের ঘরে গেলাম। এর মধ্যে আমি টয়লেটে গিয়েছি। ফিরে এসে দেখি দরজাটা বন্ধ। তমাল একটু একটু করে আমার দিকে সরে আসতে শুরু করলো। আমি কিছু করার আগেই আমাকে জাপটে ধরল। চিৎকার করতে থাকি। আমার চিৎকার ঘরের চার দেওয়ালে লেগে ফিরে আসে। আমার পরনের কাপড় জামা জোর করে খুলে ফেলে ও। তারপর পশুর মতন আমার শরীরে হুল ফুটিয়ে দেয়। কয়েক ঘণ্টা অত্যাচার করার পর ও ক্লান্ত হয়ে আমাকে ছেড়ে দেয়।
জয় বলে - তমাল তোমাকে আমার কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। মানিব্যাগ থেকে একটা কাগজ বের করে দেখায়। যাতে আমাকে বিক্রির সমস্ত ছক এবং টাকার অংক লেখা আছে। আমি কাগজটা ছিড়ে ফেলে কাঁদতে থাকি। নিজের এই পরিণামের জন্য। জয়কে দোষ দিয়ে কি হবে। ও তো আমাকে ভোগ করবে বলেই কিনেছে। তাই নিজের জন্য নিজেই কাঁদি। সেই রাতে জয় আরও কয়েকবার আমার উপর অত্যাচার চালায়। আমি খেলনা পুতুলের মত শুয়ে থাকি ওর শরীরের নিচে। সকালে ওর সঙ্গে আবার বেরিয়ে পড়ি। এবার কোথায় যাচ্ছি জানিনা। রাতে একবার ট্রেন পাল্টে অন্য আর একটা ট্রেন ধরলাম। কোন স্টেশনে, কোথায় যাচ্ছি সেসব দেখার বা জানার কোন আগ্রহ আমার ছিল না।
তারপর ট্রেনে থামলো চৌরিচৌরায়। তখন সকাল হয়েছে। ট্রেন থেকে নেমে একটা চায়ের দোকানে গেলাম অর সাথে। সেখানে একটা লোকের সঙ্গে কি যেন কথা বলল জয়। আমি বুঝলাম আমাকে আবার কেউ কিনবে। আবার কারোর বিকৃত যৌনতার শিকার হতে হবে আমায়। নিজের নিয়তির পরিনাম দেখার জন্য চুপ করে বসে থাকি। কিছুক্ষণ পর এসে ডেকে নিয়ে গেল অন্য এক জায়গায়। সেখানে থেকে এই গ্রামে। এখন যে আমার স্বামী, সে কিনলো আমায়। সেই দিনই বিয়ে হল। এরা মুসলমান। একটা ছেলে হয়েছে। এখানে এসে অনেক কষ্ট করে হিন্দিটা শিখতে হল। প্রায় তিন চার বছর পর এই তোমার সঙ্গে বাংলা বলছি। তবে একটা কথা আমার স্বামী জানে আমার জীবনের সব অন্ধকার দিনের কথা। এবার আমায় ঘৃণা করবে তো।
অহিন দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলে - মেয়েরা কি করে ছেলেদের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে জানিনা। এখন আর ছেলেদের ভালোবাসা, ভালোবাসার মত নেই। ভালোবাসা মানে দেহ। তবে তোমাকে ঘৃণা করব কিনা বলছিলে না? না না তোমাকে ঘৃণা করব না। তোমাকে অসহায় করে যারা তোমার জীবনে কলঙ্কের দাগ দিয়েছে আমি তাদের ঘৃণা করবো। আর শ্রদ্ধা জানাবো তাকে যে তোমাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছে।
0 মন্তব্যসমূহ