দশম পর্ব
প্রায় সব কাগজে বড় বড় করে ছাপা হলো প্রীতিশের খবর। রাতে বাড়ির সবাইকে বলতে তারা তো আনন্দে আত্ম হারা। সকালে পারা সুদ্দু লোক জেনে গেল। যারা বুঝলো না তারা ভাবল বিরাট কিছু একটা ঘটেছে। হ্যাঁ ব্যাপারটা বিরাট ই হবে। একসঙ্গে দু- দুটো বড় পুরস্কার পাওয়া চাড্ডিখানি কথা নয়। সকাল থেকে বন্ধুরা সবাই প্রীতিশকে শুভেচ্ছা জানাতে আসছে।
মায়ের বুক গর্ভে ভরে গেল। পাড়ার লোক এসে মিষ্টির আবদার করে গেল অনেকে। আত্মীয়রা এসেছে। তাদের সঙ্গে ভালো খাওয়া দাওয়া হল। কিন্তু প্রীতিশের প্রতি মুহূর্তে ঊর্মির কথা মনে পড়ছিল। কারণ প্রতিবারই সুখবর গুলি উর্মির কাছ থেকে পায় সে। বুকের মধ্যে উথাল-পাথাল করছিল উর্মির প্রতি তার গভীর প্রেম। কিন্তু বাড়িতে এত লোকজন এসেছে তাদের ছেড়ে ও বের হতে পারছে না।
উর্মির বাবা সুজয় বাবু আজ দেরি করে ফিরেছে অফিস থেকে। গাড়ি শব্দ শুনে উর্মি দরজা খুলে দিল। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে সুজয় বাবু বললেন - হ্যাঁ রে, কলেজের একটা ছেলে…………
উর্মি - সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছে। শুধু সাহিত্য পুরস্কার নয় - রাজ্য অ্যাকাডেমী পুরস্কারও পেয়েছে ।
সুজয় বাবু - তাই নাকি?
হাতের ব্যাগটা রাখতে রাখতে আবার বলল - তোর সঙ্গে পরিচয় আছে নাকি?
ঊর্মি - ছেলেটা কারো সঙ্গে খুব একটা কথা বলতে না। তবে মাঝেমধ্যে একটা দুটো কথা বলতে কারণ আমরা একসঙ্গেই একই ক্লাসে পড়তাম।
সুজয় বাবু - পড়া শুনা শেষ করে কৃষি কাজ করে।
উর্মি - কৃষি কাজ করে কিন্তু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রী নিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক কৃষি কাজ করছে। শুনেছি লাভ ও প্রচুর।
সুজয় বাবু - এই বললি কারো সঙ্গে বেশি কথা বলে না। তুই কি করে এত কথা জানলি?
ঊর্মি - শুনেছি তাই বললাম। নাও বাবা, মা তোমায় ডাকছে। যাও খেয়ে নাও আজ দেরি করলে যে?
সুজয় বাবু - অফিসের কাজ ছিল মা, তাই দেরি হয়ে গেল
এর মধ্যে গিন্নির তিনবার ডাকা হয়ে গেছে। সুজয় বাবু হাত মুখ ধুয়ে খেতে চলে গেল। উর্মি উপরের ঘরে গিয়ে বসল। রাস্তার ধারে জানালাটা খোলা। আলো বেশ ভালই ঢোকে ঘরটাতে। এটা ঊর্মির পড়ার ঘর ছিল। আগের দিন বাবা-মা বিয়ে নিয়ে আলোচনা করছিল। এ বছরেই তাকে বিয়ে দিতে চায় তারা ।ওদিকে প্রীতিশ আবার ঘরবাড়ি ঠিক করে তবে বিয়ের কথা বলবে বলে জানিয়েছে। একলা জানলা ধরে বসে এইসব ভাবছিল সে। নানান কথা উথাল পাথাল করে ওর মনে। একটা একঘেয়েমি জীবন কাটতে থাকে তার। জানালা থেকে সরে এসে হাতের কাছে থাকা প্রীতিীর “নয়ন তারা” কাব্যগ্রন্থটি টেনে নিয়ে পড়তে থাকে। খুঁজে খুঁজে বার করে তার সেই প্রিয় কবিতা “নীল নয়না”। গুনগুন করে পড়তে থাকে।
“কৃষ্ণ চূড়ায় ডাকিছে কোকিল কুহু কুহু সুরে,
আমার প্রিয়ার কন্ঠ সে আজ নিয়েছে কেড়ে।
গাছের তলায় প্রিয়া মোর বসে আছে একা,
নীলে নয়ন মনি তার ভালোবাসা মাখা।
নীল সাগরের নীল পাথরে বাঁধানো তার নয়ন,
ওই চোখেতে করেছি সে আমার মন হরণ।
কৃষ্ণ চুড়ার লাল ফুল …”
হঠাৎ জানলা দিয়ে চোখ বাইরে পড়তেই দেখে দূর থেকে প্রীতিশ আসছে। সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসলো উর্মি। জানলা দিয়ে ঈশারা করে দিল কোথায় থাকতে হবে। তারপর একটি কলম বার করলো। নতুন চকচক করছে। অনেকদিন ধরে ঠিক করেছে প্রীতিশকে সে এটি উপহার দেবে। কিন্তু কেমন কলম দেবে ভেবে উঠতে চলে যায় বেশ কয়েকটি দিন। অবশেষে একটি রুপোর কলম তৈরি করতে দেয়। “চোখের তারা” উপন্যাস শেষ হওয়ার পর ঊর্মি এই কলমটি দেবে বলে ঠিক করেছিল। কিন্তু এই দুর্লভ সম্মান পাওয়ার পর সে ঠিক করে এখনই উপহার দেওয়ার ভালো সময়। সুন্দর কারুকার্য করা কলমটি দেখতে খুব সুন্দর। কলমের ঢাকনার উপরের দিকে একটি নীল পাথর দেওয়া। বন্ধুরা সবাই জানে ওর নীল খুব পছন্দ।কলমটা একটা সুদৃশ্য বাক্সে রাখা। কলমটা নিয়ে ধীরে ধীরে নেমে এলো। তখন ঘড়িতে তিনটি বাজে। যদিও সময়টা বিকেল বলা যায় না তবুও বিকেল হতে আর বাকি নেই। বাবা মা ঘুমাচ্ছে খুব সাবধানে দরজা খুলে বেরিয়ে এল। তারপর দ্রুত চলে গেল তাদের যেখানে যাওয়ার কথা ছিল সেখানে। একটা আম বাগান। আম বাগানটা বেশ বড়।
ঊর্মি- চল ঋতু দের বাড়ি। ওখানে সব কথা হবে। ওর বাবা-মা বেড়াতে গেছে।
প্রীতিশ -চল।
ঋতু এদের অনেক দিনের বন্ধু এবং অনেক সাহায্য করে। বাগানের এক প্রান্তে ওর বাড়ি। আশে পাশে আর কোন বাড়ি নেই। বাড়ি যা আছে তা অনেক দূরে। দুজনে মিলে ঋতুদের বাড়ি গেল। ও তখন শুয়ে শুয়ে গল্পের বই পড়ছিল। ঊর্মির ডাকাডাকি শুনি বেরিয়ে এল। দুজনকে দেখে বলল - এই অবেলায় কি ব্যাপার ভাই? আয় আয় ঘরে আয়। এতো বড় সাহিত্যিক আমার বাড়িতে। কি সৌভাগ্য আমার।
ঊর্মি - আড্ডা দেব বলে এলাম। প্রীতিশকে একটা উপহার দেব। তারপর আড্ডা দিয়ে চলে যাবো। ভাবলাম রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলার থেকে তোর বাড়িতেই ভালো ।
ঋতু - তা তোরা বোস আমি চা করি।
কথাটা বলে হাসতে হাসতে চলে গেল।
প্রীতিশ - এখানে নাইলেই ভালো হতো উর্মি ।
উর্মি - কেন? আরে ওর কথায় কান দিও না ও জানো তো কি রকম প্রচুর ইয়ার্কি করে আমার সঙ্গে।
প্রীতিশ - তোমার হাতে ওটা কি?
ঊর্মি - আগে চোখ বন্ধ কর।
ঋতু - আমি কি করবো। তাকাবো?
ঊর্মি - তুই না।
প্রীতিশ - এই নাও চোখ বন্ধ করলাম।
উর্মি - আরে হাতটা দাও।
হাতটা টেনে নিয়ে হাতের মধ্যে গুঁজে দিল সেই উপহারের বাক্সটা। তারপর বলল- ক্ষুদ্র হলেও আমার ভালবাসার উপহার। তোমার লেখার কাজে উৎসাহ দেবার জন্য এই উপহার।
প্রীতিশ চোখ খুলে দেখে খুব সুন্দর একটি কলম চকচক করছে।
ঊর্মি - কেমন লাগছে?
প্রীতিশ - ভীষণ সুন্দর। ধন্যবাদ তোমায়।
ঊর্মি - তোমার সাফল্য কামনা করে মা সরস্বতীকে পূজা দিয়ে এই কলমটা তৈরি করিয়েছি । আর ঐ নীল পাথরটা ওটা তো আমার প্রিয় রং তাই না।
প্রীতিশ - নীল পাথর তার উপর আবার কারুকার্য করা। যেন মনে হচ্ছে কোন বিখ্যাত শিল্পীর প্রথম শিল্পকর্ম রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পাওয়ার আশায় তৈরি করেছে।
উর্মি - পছন্দ হয়নি নাকি? তবে পছন্দ হোক আর নাই হোক এর ব্যবহার হলে আমি সার্থক।
ঋতু - খুব সুন্দর হয়েছে কিন্তু।
প্রীতিশ - সত্য তাই। আজ থেকেই আমি এর ব্যবহার করব। আজ থেকেই এই কলম দিয়ে আমি লিখতে শুরু করব নতুন কাব্য। খুশি তো?
উর্মি - খুশি না হয়ে যাব কোথায়। চলো আজ আর দেরি করবো না। বাবা আবার রাগ করবে। ও তোমাকে তো বলা হয়নি বাবা আমার বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।
প্রীতিশ - এতদিন অপেক্ষা করলে, আর একটা বছর অন্তত যা হোক করে কাটিয়ে দাও।
উর্মি - আমি ব্যবস্থা করে নেব যাই হোক করে।
ঋতু - আমাকে ভুলে যাস না আবার। নিমন্ত্রন টা যেন পাই।
সবাই হাসিতে ফেটে পড়ল। কিছু ক্ষণ আড্ডা দিয়ে যে যার বাড়ি চলে গেল।
0 মন্তব্যসমূহ