নূপুরের শব্দ ১১

  একাদশ অধ্যায়

 

 



একপ্রকার জোর করে অহিনকে দেখানোর জন্য ইভা একটু একটু করে প্রসুনকে ভালবাসতে শুরু করে।  এই প্রসুন কেই একদিন ইভা প্রত্যাখ্যান করেছিল।  যদিও সে তার বাবার কাছে প্রত্যাখ্যানের কথা বলেছিল। তার বাবাও জেদ করেছিল প্রসুনের সঙ্গেই বিয়ে দেওয়ার জন্য । কিন্তু আজ ইভা সরাসরি তার মাকে বলে দেয় প্রসুন কে  বিয়ে করতে তার কোন বাধা নেই। ইভার কথা শুনে ওর মা  জড়িয়ে ধরে বলে বড়লোক ছেলে।  বড় ব্যবসা দেখবি কত সুখে থাকবি।

ইভা মাকে ছেড়ে বলে  - বড়লোক হলে কি সুখ পাওয়া যায়? 

মা উত্তর দেয় -  সুখ খুঁজে নিতে হয়।  নিজেকে সুখের উপযুক্ত করে নিতে হয়। 

ইভা উত্তর দেয়  - এই সুখ শান্তির কচকচানি আমার কাছে ভালো লাগেনা। যা হবার তা হবে।  ওসব নিয়ে আর ভাবতে ভালো লাগেনা। ভাবতেই কেমন বৃথা লাগে।

মা উত্তর দেয়  - বেশ আমি তাহলে তোর বাবাকে বলি। 

  • বল
  • প্রসুনের সঙ্গে এ বিষয়ে তোর কোন কথা হয়েছে? 

ইভা একটু আড়াল করার চেষ্টা করেন নিজেকে। বলে-  না ওর সঙ্গে কোন কথা হয়নি এ বিষয়ে।  তবে আজ বাড়িতে এসেছিল তুমি তো  দেখেছিলে।  যদিও এই বিষয় নিয়ে কোন কথা আমি বলিনি।

  • কেন একটু তো বলতে পারতিস
  • তুমি একটু যাও আমি একটু একা থাকবো।

ইভার মা চলে যায় রান্না ঘরে।  ইভার আবার গা মেলে দেয় বিছানায়।  ইভা ফিরে যায় সেই ছোট্টবেলায়।  ওর পায়ের নুপুর শব্দ করে বাড়িময় ঝংকার তুলতো।  তারপর অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। ইভা এখন যথেষ্ট বড় হয়েছে তার সরল মনে এসেছে জটিলতা। বিছানায় শুয়ে ঠাকুমার কথা মনে পড়ে।  ঠাকুমা নিজেও কেমন যেন ইভার প্রতি একটা দুর্বল ছিল।  একদিন সন্ধ্যায় ঠাম্মা  তাকে শিনিয়ে ছিল শৈশব তার যৌবনের অনেক কথা।  কথাগুলো হঠাৎ ইভার মনের মধ্যে ভেসে ওঠে।  চোখ বুজলেই শুনতে পায় ঠাম্মার সেই কথাগুলো।  যে কথাগুলো হয়তো বৃদ্ধ বয়সে যৌবনা নাতনির কাছে ব্যক্ত করেছিলেন।

ভাবতে ভাবতে কখন চোখ বুঝে যায়।  যখন শুয়ে থাকে তখন মনে হয় ঠাম্মা তাকে বলছে - তার যৌবন আর পরবর্তী জীবনের কাহিনী।

- স্কুল ও কলেজ জীবনে  ভীষণ কড়াকড়ি ছিল তখন।  তখন বাইরে ছেলেদের সঙ্গে কথা বলার কোন উপায় ছিল না।  বিকেলে হয়তো পাড়ার কোন বান্ধবীর বাড়িতে চার-পাঁচজন বা ছয় সাত জন মিলে গল্পের আসর  বসত।  সেখানে পড়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ আলোচনা চলতো। আড্ডা হতো। মজা হতো। খাওয়া-দাওয়া হতো। একবার তাদের দলের একটা মেয়ে জেদ করে লুকিয়ে প্রেম করে বিয়ে করে ছিল।  তাকে নিয়ে বান্ধবীদের মধ্যে প্রায় একমাস আলোচনা চলেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া কালীন তার সঙ্গে পরিচয় হয় একটা ছেলের। লম্বা চওড়া শরীর কিন্তু রোগা। গায়ের রং যদিও ফর্সা।  ঠাম্মার গায়ের রং মোটেই ফর্সা বলা যাবে না। একদিন সে নিজেই এসে পরিচয় করে তার  সঙ্গে।  তারপর বন্ধুত্ব আর সেই বন্ধুত্ব গড়িয়ে যায় প্রেমে। দেখাশোনা করে শেষ পর্যন্ত সেই ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয়।  তাও তো প্রায় ৫৫ বছর আগের ঘটনা। সেদিনের সেই বিশ্ববিদ্যালয় পড়া মিনতি,  পঞ্চান্ন বছর আগে হঠাৎ করেই শুভেন্দুর প্রেমে পড়েছিল।  কিন্তু ওদের প্রেম কোনদিন কেউ বুঝতে পারেনি। কোন কোন দিন দুজন সময় পেলে হয়তো দু একটা সুখ দুঃখের কথা বা ভালো-মন্দের কথা হতো। দেখা হতো খুব কম।  কিন্তু দুজনের প্রতি দুজনার আকর্ষণ ছিল ভীষণ।  দুজনের অজান্তেই যে ভালোবাসার বীজ বপন হয়ে ছিল পরবর্তীকালে তা বিয়েতে গড়ায়।  সেদিনের সেই প্রেম আর আজকে ইভার প্রেম মিনতি কিছুই বুঝে উঠতে পারত না। কথাটা  মিনতি ইভাকে বারবার বলত।  ৭৫ বছর বয়সে যখন তিনি চলে গেলেন তার আগে পর্যন্ত এই আধুনিক ভালবাসার তার কাছে কেমন যেন ফ্যাকাশই লাগতো। 

ঠাম্মাকে তার খুব মনে পড়ছিল আজ।  মনে হচ্ছিল ঠাম্মার কোলে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে একটু শুয়ে থাকবে।  আর মাথায় হাত বুলিয়ে দিত ৭৫ বছরের সেই বৃদ্ধ।

কিছুই ভালো লাগছে না। কিন্তু মনের মধ্যে যে প্রতিহিংসার আগুন সে আগুন কিছুতেই নিভাতে পারছে না। মনকে শান্ত করার জন্য সদ্য কেনা অতনু সরকারের লেখা কাব্যগ্রন্থ “অবলা কথা” বইটা নিয়ে খোলা জানালার ধারে বসে পড়তে থাকে।

ইভা যখন বইতে মশগুল থিক সেই সময় হটাত তৃষা এসে ঢোকে তার ঘরে।

তৃষা - কি রে কি পড়ছিস?

ইভা একটু অবাক হয়ে বলে- এই অবেলায় না মানে এই রাতে তুই?

তৃষা - রাত কোথায় সবে ত সন্ধ্যা হল।

ইভা - হবে হয়ত, বল কি মনে করে?

তৃষা - একটা কথা বলবি আমায়?

ইভা - কি কয়হা?

তৃষা - বলছি তুই কি সত্যি অহিন দা ভাল বাসিস নি?

ইভা - দেখ তৃষা ওর নাম আমার কাছে করবি না। আর করলে আমার কাছে আসবি না।

তৃষা - ইভা। 

ইভা - অহিনের জন্য দেখছি খুব দরদ। জা না তুই গিয়ে ভাল বাসগে যা।

তৃষা - ইভা কি বলছিস।

ইভা - দেখ ওর মতো ছেলের সঙ্গে কন সম্পর্ক রাখার মানে হয় না।

তৃষা - তাহলে এত দিন যা করেছিস সব তাই কি মিথ্যে?

ইভা -  না, আবেগ। যা করেছি আবেগের বসে করেছি। আর বুঝেছি আবেগ দিয়ে পথ চলা যায় না। সংসার তো নাই না।

তৃষা - তা ঠিক। তবু মাঝে মাঝে আবেগ টাই জিতে যায়।

ইভা - এই রাতে কি তুই এই কথা বলার জন্য আসলি? আমার মনে হয় অহিনের জন্য তোর দুঃখ হচ্ছে?

তৃষা - হওয়া টা কি অস্বাভাবিক? যার কাছে এতোদিন…,  থাক তোকে বলে কি লাভ। 

ইভা - বলিস না ভাই তৃষা। আমার মন ভাল নেই। তুই যা এখন।

তৃষা - তাড়িয়ে দিচ্ছিস?

ইভা - ধর তাই।

তৃষা - আচ্ছা চলিরে। কথায় বলে নারীর মন বোঝা ভারি কঠিন। আমিও বুঝলাম সেটা।

ইভা - তুই ও যে নারী সেটা ভুলে জাস না আবার। 

তৃষা - ভুলব না বলেই তো বললাম। চলি রে। 

 

ঠিক যে ভাবে তৃষা এসেছিল সেই ভাবেই আবার বিদায় নিল। রাতের আকাশে অখন পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। কিছুটা পথ হাতলেই তৃষার বাড়ি। মাথার উপর নিল আকাশ আর বড় একটা চাঁদ। তৃষার মন যেন হটাত অহিনের জন্য কেমন করে ওঠে। ভাবে থাকে কোথায় আছে তাদের প্রিয় অহিন দা, কি করছে কে জানে। রাতে বিছায় ভাল ঘুম হয় না তৃষার। মন টা কেমন জেন উচাটন। 

এর পরের কটা  দিন ও কেমন যেন উদাসীন লাগে তাকে। আজ সোম বার। রাত এখন বারোটা বা তার আসে পাশে হবে। তৃষা একা ছাদের ওপর এসে দাঁড়ায়। পূর্ণিমার চাঁদ তখন তার মাথার উপরে। হাজার হাজার তারা মিট মিট করছে আকাশের বুকে। অহিনের কথা খুব মনে পড়ছে আজ তৃষার। 

তৃষা মনে মনে ভাবে - (স্বগত) - আমি কি অহন দা কে ভালবেসে ফেললাম। আমরা সবাই অহিন দার কাছে সেই ছোটো থেকেই পরিচিত। আমারা সবাই তাকে সম্মান করি আবার ভালও বাসি। মাঝখান থেকে ইভার জন্য বেচারি কে পাড়া ছাড়তে হল। এখন কোথায় আছে কেমন আছে কেউ জানে না। কটা দিন ধরে দেখি অহন দার কথা খুব মনে পড়ছে। কেন জানি না, তাকে আমার খুব দেখতে ইছহা করছে। আমি যদি আবার তাকে ভাল বেসে এখানে ফেরাতে পারি কেমন হবে। ইভা কে একটা জবাব দেওয়া যাবে। বুঝিয়ে দেব ভালবাসা টা খেলনার পাত্র নয়। কিন্তু অহিন দা আমার মতো মেয়ে কে ভাল বাসবে? আমি তো সুন্দরী নই। তবে কি আমার যৌবন নেই। এই ভরা যৌবন ইভার থেকে কম কিসে? আমার জন্য ও তো অনেকে পাগল। হয়তো ফর্শা নই তাই বলে ……। আমি কি পারব আমার যউবনের সাগরে অহিন দা ভাসিয়ে দিতে? পারব। চাঁদ তুমি সাথে থেকো।

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ