নুপূরের শব্দ ১৬

  নুপূরের শব্দ ১৬ 





খুব ভোরে উঠে বাড়ির প্রায় সব কাজ সেরে ফেলে তৃষা।  এলোমেলো হয়ে পড়ে থাকা জামাকাপড় গুলো পর্যন্ত সাজিয়ে রাখে সুন্দর করে। সকালে ঘুম থেকে উঠে অহিনের কাছে ঘরটাই যেন একটু নতুন লাগে।  অহিন চৌকির দিকে তাকিয়ে দেখে তৃষা শুয়ে নেই।  রান্নাঘরে মনে হয় কিছু একটা করছে।  অহিন রান্নাঘরের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।  তারপর বলে - বাহ তৃষা তুই সত্যি গিন্নির মত সব গুছিয়ে ফেলেছিস দেখছি।  


তৃষা  আটপৌরে কাপড়টা সামলে নিয়ে বলে -  সবই তো হলো । কিন্তু তোমার বাড়িতে চা কই? 

অহিন একগাল হেসে বলে - বাঃ রে, আমাকে আবার কবে চা খেতে দেখলি কবে?

তৃষা দাঁতে জিভ কেটে বলে -  ও তাইতো।  তুমি তো চা খাওনা। একেবারে ভুলে গেছি।

অহিন - তোর বুঝি সকালে চা খাওয়ার নেশা আছে? 

তৃষা উত্তর দেয় - ছিলো না। কিন্তু  চায়ের নেশাটা চলে এলো। 

অহিন- চল  না হয় মর্নিং ওয়ার্কে গিয়ে কোন দোকান থেকে চা খেয়ে নিস।

তৃষা -  সে দেখা যাবে। তুমি মর্নিং ওয়ার্ক করতে যাও নাকি? 

অহিন -  হ্যাঁ যাই।

তৃষা -  চলো তাহলে আজ তোমার সঙ্গে আমিও একটু হেঁটে আসি। 

কথা টা বলে তৃষা কাপড়টা বেশ করে গুছিয়ে এসে অহিনকে বলে -  চলো অহিনদা  আমি রেডি।

অহিন  - তুই কি সত্যি যাবি? 

তৃষা -  হ্যাঁ। 

অহিন -  চল তবে।  

হাটতে হাঁটতে প্রশ্ন করে অহিন -  রাতে এক ঘরে শুতে তোর কোন ভয় করলো না। 

তৃষা উত্তর দেয় -  না। মানুষ চিনতে আমার  ভুল হয় না। 

অহিন -  তবু এক ঘরে একটা ছেলের সঙ্গে…। রাত কাটানোর অভিজ্ঞতা তো কম নয়।  

তৃষা - সে কথা ঠিক।  কিন্তু সে যদি দেবতার মত হয় তাহলে ভয় কিসের বল। 

অহিন -  জানিস তৃষা,  সাধারণ মানুষ হিসেবেই তো থাকতে চেয়েছিলাম।  আর হয়তো মনে প্রাণে একটু হলেও  ইভাকে ভালোবেসে ছিলাম। 

তৃষা – জানি।  আর সেই জন্যই তো তোমার হয়ে বলতে গেলাম ইভার কাছে।  

অহিন - ছাড়ের। ওর যখন বিয়ে হয়ে গেছে ওর কথা তুলে আর কি লাভ।  ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি ওর মঙ্গল হবে।। 

তৃষা  একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলে - ইভা যদি তোমার জন্য এমনটা ভাবত।  

অহিন - তোর কি খবর বল? কাল রাতে তো কিছুই শোনা হলো না। 

তৃষা  একটা ম্লান হেসে বলে  - আমার আর খবর। চলছে কোন রকম।  

অহিন -  বিয়ে নিয়ে কিছু ভেবেছিস।  

তৃষা - আমার আবার বিয়ে।  আমাকে নিয়ে চিন্তা করি না।  মাও বিয়ের আশা ছেড়ে দিয়েছে।  যা হোক করে বিয়ে দিতে গেলেও যে টাকা দরকার হয় তাও মার হাতে নেই। 

অহিন -  যদি কেউ তোকে বিয়ে করতে চায়?  

তৃষা - বিনা পয়সায় আমাকে বিয়ে করে নিয়ে যাবে কে? আমি তো সুন্দরী না।  

অহিন - সুন্দরী ছাড়াও কি কারো ভালোলাগা থাকে না?  পৃথিবীর সবাই কি সুন্দরী হয় ? 

তৃষা -  পৃথিবীর সবাই যেমন সুন্দরী হয় না তেমন সবার ভাগ্যেও তো সায় দেয় না। 

অহিন -  সে কথা সত্যিই।  ভালোলাগা আর ভালোবাসা সবকিছু নির্ভর করে হয়তো কিছুটা হলেও ভাগ্যের উপর। 

তৃষা - তুমি এখানে একটা বিয়ে করো।  তারপর আবার ফিরে চলো আমাদের এখানে।  অন্তত ইভা দেখুক তুমি ভালবাসতে জানো । 

অহিন  - বলছিস।  

তৃষা - শুধু বলে কি হবে।  করে দেখাতে হবে। তুমি হেরে যেওনা। আমি তোমাকে সাহায্য করবো। 

অহিন - সত্যি সাহায্য করবি?  

তৃষা - হ্যাঁ করব।  অন্তত আমি যতটা পারি ততটাই করব। 

অহিন -  মনে থাকবে তো?  

তৃষা - থাকবে।  

অহিন -  যখন দরকার হবে তখন বলবো তোকে। 

-তোমার সেই অল্প ডাকের জন্য আমি অপেক্ষা করে থাকবো। - দেখব সেই ডাকে তুই সারা দিস কিনা।

 -দেখো । 

অহিন চুপ করে থাকে।  তৃষাও  চুপ করে যায়।  একটু একটু করে বেলা বাড়ছে।  দুজন আবার বাড়ির দিকে ফিরতে থাকে।


তৃষাকে একা রেখে অফিসে চলে যায় অহিন।  তৃষা সারাদিন ধরে ঘর পরিষ্কার করে।  সবকিছু সুন্দর করে সাজিয়ে রাখে।  বইয়ের র‍্যাক,  পড়ার টেবিল সব নতুন করে সেজে ওঠে।  ঘরে বসে দু তিন রকমের পদ রান্না করে, নিজের হাতে অহিনকে খাওয়ানোর জন্য। 

রাতে অহিন খেতে বসে, বহুদিন পর একটু অন্যরকম রান্না পেয়ে তৃপ্তি করে খায়। নিজের হাতে  অহিঙ্কে খাওয়াতে পেরে তৃষা মনে মনে ভীষণ পরিতৃপ্তি লাভ করে।  হয়তো মনের কোণে লুকিয়ে থাকা স্বপ্ন একটু উঁকি দিয়ে যায়। 


দুজন খাওয়া শেষ করে টেবিলের দুই প্রান্তে বসে। ঠিক সেই সময় কারেন্ট চলে যায়। অহিন একটা মোমবাতি জ্বালায়।  টেবিলের মাঝখানে জ্বলতে থাকে মোমবাতি।  টেবিলের দুই প্রান্তে দুজন।  আর মাঝখানে মোম বাতি আর  ঘন অন্ধকার রাত। অন্ধকারের মধ্যে থেকেও জ্বলজ্বল করে উঠছে  দুজনের মুখ। মৃদু প্রদীপের আলোয় দুজনের দুটি মনের কোনায় অজানা জমে উঠছে হয়তো নব রাগ। 

বহুক্ষণ পর অহিন ডাকে তৃষাকে -  তৃষা 

তৃষা কথা না বলে উত্তর দেয়  - হু

- কারেন্ট এ গিয়ে ভালোই হলো তাই না। 

- হুম

- কি আমাকে ভয় পাচ্ছিস নাকি? 

- না। ভয় পাবো কেন? অবশ্যই তুমি যে ভয়ের কথা বলছো সে ভয় নেই। নারীর নারীত্ব হরণের ভয় তোমার কাছে নেই। কিন্তু এমনিতে তোমাকে ভয় করে।  

- এমনি ভয় করে তাহলে বল?  

- ভয় করবেনা?  এই ভয় শ্রদ্ধা থেকেই জন্ম নেয়।  সেই কোন ছোটবেলা থেকে তোমাকে ভয় করে আসলাম।  মনে পড়ে রাস্তায় বেরোলে তুমি বকাবকি করতে ? 

- মনে থাকবে না আবার।  

- তোমার ভয়ে  লুকিয়ে লুকিয়ে বাইরে বেরোতাম।  হয়তো সেই জন্যই আর পাঁচটা মেয়ের মত আমি বখাটে হয়ে যাইনি।  

- কিন্তু তখন খুব রাগ হতো, না তাই না?  

- তা একটু হতো।  তখন ভাবতাম তুমি আমাদের একটু বেশি শাস্তি দিচ্ছে।  

অহিন হেসে ওঠে। তারপর বলে -সেদিন গুলো ভালো ছিল তাই না ?  

তৃষা -  মাঝে কয়েকটা বছর শুধু পেরিয়ে গেছে। 

- হ্যাঁ সময়কে তো আর ধরে রাখা যায় না।  সময় তারা আপন নিয়ম নিয়ে বয়ে যায় । 

- মনে পড়ে অহিন দা তুমি একবার খুব মেরে ছিলে।

- কই নাতো? 

- আমার কিন্তু প্রায় মনে পড়ে সে কথা। 

- এসব কথা খুব মনে থাকে আমার। কোন কোন ঘটনা মনের মাঝে  থেকে যায়। 

- আচ্ছা তৃষা,  তুই কোনদিন কাউকে ভালবেসেছিস? 

তৃষা উত্তর দেয় না। 

অহিন - কাউকে কোনদিন ভালো লাগেনি তোর? 

তৃষা - লেগেছে।  কিন্তু তা শুধু আমার নিজের কাছে।  সবাই যেমন সব সুখের অধিকারী হয় না, তেমন সবার সব ভালো লাগা বাইরে প্রকাশ পায় না।  

অহিন -  আচ্ছা তুই সত্যি করে বলতো তুই কেন আমার খোঁজ নিয়ে এতদূর আমার কাছে এসেছিস? 

তৃষা - তোমার কাছে আসতে পারলাম কই।  ভগবানই তো তোমার কাছে নিয়ে এসে ফেলল। 

অহিন  - বাঁকুড়ায় তো তুই নিজেই এসেছিস। 

- হ্যাঁ এসেছি, তোমার জন্য।  হয়তো কিছুটা ইভার সঙ্গে জেদ করে।

-  আমার জন্য?  আমাকে দেখলি তো  এবার কি করবি? 

- এবার চলে যাব তাই তো? 

 - না যেতে বললাম কোথায়।  তুই কি কিছু বলতে চাস? 

তৃষা একটু ঘাবড়ে যায়।  তবে নিজেকে সামলে নিয়ে  বলে -  কিছু বলবো বলে তো আসেনি। 

- শুধু শুধু এতটা দূর আসার মত মেয়ে তো তুই না। 

-  একটা কথা বলবে?  

- কি কথা বল।  

- যদি কেউ তোমাকে সত্যিকারের ভালবাসে,  তুমি তাকে ভালবাসতে পারবে?  

-  জানি না।  

- তবে একটা কথা বলি। কিছু মনে করবে না তো?  

- তুই তো আর আগের মতো ছোট নেই। বল।  যা বলবি বল।  

তৃষা নিজেকে সামলে ধীরে ধীরে বলে  - যদি কোনদিন তোমার জন্য আমার হৃদয় তোলপাড় করে,  তাহলে তুমি কি পারবে শান্ত করতে । - - তোর হৃদয় কি তোলপাড় করে আমার জন্য?  আগে করুক।  

- এই অন্ধকার রাতে মৃদু মোমবাতির আলোয় আমার দিকে তাকিয়ে একবার ভাবো তো।  একটা মেয়ে কেন ছুটে আসে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হুগলি থেকে বাঁকুড়ায়। একবার ভাবো অহিন দা। 


অহিন তাকিয়ে থাকে তৃষার তৃষিত  চোখের দিকে।  বুঝতে পারে ওর চোখ কি বলতে চায়। 

তার পর বলে - পারবি  তোর ভালোবাসা দিয়ে আমার বুকের পাথর নামিয়ে দিতে।  

- পারব আমাকে পারতে হবে।  

- বেশ। এখন আর রাত জেগে কি হবে।  শুয়ে পড়। হিসাব শেষ।  

- তুমি শোবে না? 

-  হুম.


অহিন ঞ্চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে তৃষার পাশে দাঁড়ায়।  তৃষা ও  উঠে আসে অহিনের কাছে। তারপর অহিন কে জড়িয়ে ধরে। অহিন  শান্ত ভাবে তৃষার  মুখে একটা দীর্ঘ চুম্বন করে বলে -  তুই তোর জায়গায় থাক। আমি আমার জায়গায়।  যখন সময় হবে তোকে বলতে হবে না।  আমি নিজেই তোকে আমার পাশে টেনে নেব। 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ