নুপূরের শব্দ ১৮

  পর্ব ১৮   




সময়ের হাত ধরে প্রায় পাঁচটা বছর এগিয়ে গেছে।  অনেক জল বয়ে গেছে নদী দিয়ে। গাছের  হাজার হাজার পাতা ঝরে গেছে আবার নতুন পাতাও গজিয়েছে। অনেক উত্থান পতন ঘটে গেছে এই পাঁচ বছরে। ইভা তার নিজের ঘরে দাঁড়িয়ে থাকে। চোখ তার দূরে রাস্তার দিকে।  ওর মনে পড়ে যাচ্ছে আজ থেকে পাঁচ বছর আগে এইরকম এক ফাল্গুন মাসের শেষ দিকে ধুমধাম করে বিয়ে হয়েছিল। একটা বছর ওর ভীষণ ভালো কেটে ছিলো  প্রসুনের সঙ্গে।  কিন্তু হঠাৎই একদিন ইভা আবিষ্কার করলো প্রসুন অন্য একটা মেয়ের সম্পর্কে জড়িয়েছে। প্রথম প্রথম ইভা ভেবেছিল তার মনের ভুল।  কিন্তু একদিন গোপনে অনুসরণ করতে থাকে প্রসুন কে। প্রসুন বাড়ি থেকে বেরিয়েছে বন্ধু জন্মদিনের পার্টিতে যাবে বলে।  ওর পিছু নিল ইভা। ইভা প্রসুন কে দূর থেকে অনুসরণ করেছিল। প্রসুন একটা একতলা বাড়িতে এসে কড়া নাড়ালো।  দূরে দাঁড়িয়ে রইলো ইভা।  প্রসুনের কড়া নাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এল একটা মাঝ বয়সি মহিলা। দরজা খুলে দিতেই প্রসুন ঢুকে গেল ঘরে।  বন্ধ হল দরজা।  


ইভা দেখল।  একটু অপেক্ষা করল ওর বাড়িতে আর কেউ আশে কিনা জানার জন্য। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর ইভা এগিয়ে যায়  সেই বাড়ির দিকে।  খুব সাবধানে একটা জানালার পাশে দাঁড়ায়।  দু-একটা কথার শব্দ আসছে। ইভা উকি মারার চেষ্টা করে।  পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ইভা দেখতে পায় ,  প্রসুন আর সেই মেয়েটাকে। ঘরের ভিতরে দুজনে জড়াজড়ি করে বিশ্রী ভাবে শুয়ে আছে।  ইভার মাথা ঘুরে যায়। সে দ্রুত বাড়ি ফেরার রাস্তা ধরে। বাড়ি এসে ঘরের দরজা দিয়ে শুয়ে পড়ে থাকে।  শ্বশুর-শাশুড়ি ডাকাডাকি করে চলে যায়।  রাত হয় কিন্তু ইভার কোন শব্দ নেই।  অবশেষে ওর শ্বশুর এসে ডাকতে উঠে পড়ে। দরজা খুলে দেয়। 

শ্বশুর - তোমার শরীর খারাপ নাকি বৌমা?  

ইভা উত্তর দেয়-  হ্যাঁ।

                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                               শ্বশুর  -ডাক্তার  ডাকব নাকি ? 

ইভা -না। আমার ভালো লাগছে না।  আজ আমি খাবোনা ।  আমার খিদে পাচ্ছে না। তুমি যাও। আমি পরে শোব। 


সেদিন রাতেই প্রসুনের সঙ্গে ঝগড়া শুরু হয় ইভার । তারপর শখের আয়নার মতন তাদের সম্পর্ক ভেঙে যায়।  ভাঙ্গা আয়না যেমন ভেঙে গেলে আর জোড়া লাগেনা, ঠিক তেমন।

   

পর পর সে বুঝতে পারে প্রসুন কোনদিন তাকে  ভালোবাসেনি। সে শুধু ভালবেসেছিল ইভার শরীর। এমনি করে নাকি অনেক মেয়ের সর্বনাশ করেছে।  কিন্তু ইভা যখন বুঝতে পারলো,  তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।  এখন আর কিছুই করার নেই।  তবুও ইভা চেয়েছিল কষ্ট করে টিকে থেকে সন্তান হলে,  সন্তানের মুখ চেয়ে বেঁচে থাকবে। তাও হলো না।  এই পাঁচ বছরের সন্তানের মুখ দেখা হয়নি ইভার।  অবশেষে সম্পর্ক ভাঙতে ভাঙতে একদিন ডিভোর্স হয়ে যায়। এখন ইভা বাবার কাছে থাকে ওর ছোটবেলার সেই ঘরে। 


আজ সেই ঘরের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ভাবলেস হীন তাকিয়ে থাকে বাইরের দিকে।  হয়তো খুঁজে পেতে চায় কিছু হারানো অতীত।  ওর মা পিছন থেকে এসে ওর কাঁধে হাত রাখে।  ইভা কেঁপে ওঠে। পিছনে তাকায় আবার মুখ ঘুরিয়ে নেয়।  

মা বলে - চল ছাদে চল।  একটু হাঁটি।   

ইভা - আমি যাব না।  ভালো লাগছে না। 

মা - যা হবার হয়েছে।  ওসব নিয়ে যত ভাবি শরীর তত খারাপ হবে।  

ইভা বিরক্তি প্রকাশ করে বলে -  কার জন্য শরীর ভালো রাখবো মা?  

মা একটু থেমে যায়। তারপর আবার বলে - নিজের জন্য ভাবতে হবে মা ইভা।  

ইভা -  নিজের জন্য?  

কথা তা বলে  একটু হাসে।  তারপর বলে - তুমি যাও মা।  আমি আজ এখানেই থাকবো। 

অগত্যা ওর মা চলে যায়।  ফাল্গুনের শেষ বেলায় বেশ মিষ্টি একটা ঠান্ডা বাতাস বইছে। সেই বাতাসে খোলা চুল গুলো উড়তে থাকে।  


হঠাৎ ইভা  দেখল একজোড়া নর-নারী হেঁটে  আসছে।  দূর থেকে প্রসুন কে  ঠিক চিনতে পারল।  কিন্তু পাশে কে বুঝতে একটু অপেক্ষা করতে হলো।  একটু কাছে এলেই বুঝল সেই মেয়েটি।  যার ঘরে দুজনকে দেখেছিল।  মাথায় সিঁদুর মনে হলো না?  একটু ভালো করে দেখার চেষ্টা করল ইভা।  প্রসুন ইচ্ছা করে এই পথ দিয়ে যাচ্ছে।  একসময় আশা এসে ঘরে ঢোকে।  আশার ও বিয়ে হয়ে গেছে।  ওর বাচ্চা হবে বলে বাপের বাড়িতে এসেছে। আশা ম্লান মুখে এসে দাঁড়ায় ইভার সামনে।  তারপর বলে - শুনলি কিছু?  

ইভা - দেখলাম।  

আশা -  দেখলি মানে?  কি দেখলি ?

ইভা - তুই যা শুনেছিস।যা  আমাকে বলতে এসেছিস,  সেটাই দেখলাম। 

আশা  - কোথায় দেখলি?  

ইভা - এইমাত্র দুজন গেল।  

আশা - ঘটনাটা তাহলে সত্যি। 

ইভা - তুই কি শুনেছিস শুনি?  

আশা  - আমি শুনলাম প্রসুন আবার কোন এক মেয়েকে বিয়ে করেছে।  তার নাকি পেটে বাচ্চা । 

ইভা  - ওর হবে। দুজনের তো অনেক দিনের সম্পর্ক।  

আশা -  ভালোই করেছিস তুই ডিভোর্স নিয়ে।  

ইভা - এখন বুঝছি,  ওর সন্তান আমার পেটে না এসে আরো ভালো হয়েছে।  ওর ওই দূষিত রক্তের সন্তান আর কত ভালো হতো বল?  

আশা - টিভিতে ভালো বই হচ্ছে। চল দেখি।  

ইভা - আমার আর কিছু ভালো লাগে লাগে না রে।  

আশা ওর পিঠের উপর হাত রেখে বলে - একটা কথা বলব? 

ইভা - বল। 

আশা  - ও ঘরে চল।  টিভি দেখতে দেখতে বলবো। 

ইভার ইচ্ছা না থাকলেও টিভির ঘরে এসে বসে।  তারপর বলে -  বল তুই কি বলবি বলছিলি?  

আশা - এটা কাজ খুজে নে।  কোন একটা কাজের মধ্যে থাকলে তোর সময়ও কাটবে আর দেখবি সবকিছু আস্তে আস্তে ভুলে যাচ্ছিস। 

ইভা - ঠিক বলেছিস।  এই কথাটা তো আমার মাথায় আসিনি।  কাল থেকে চেষ্টা করব। তোর কথা ফেলে দেবার মতো না। আচ্ছা কোথায় চেষ্টা করা যায় বলত? 

আশা  - একটু চোখ কান খোলা রাখ। দু একজন কে বল। দেখ হয়তো হয়ে যাবে। ঘরে বসে জার জন্য শোক করছিস সে তো দিব্যি আনন্দে আছে। তাই না।

ইভা - তোর কোথাও জানা শোনা থাকলে বলিস?

আশা - বলব।   


আরো কিছু টা সময় গল্প করে আশা চলে যায়। ইভা জানালার ধারে দাঁড়ায়। দূরে আকাশ টা যেখানে মাটিতে মিশে গেছে সে দীগন্ত রেখায় যে লাল আভা ফুটে ওঠে। 

রাতের বেলা শুয়ে কিছুতেই আর ঘুম আসে না। কত স্মৃতি যেন মনের মধ্যে তোলপাড় করতে থাকে। ইওভা শুনেছে তার প্রিয় বান্ধবী তৃষা অহিন কে বিয়ে করেছে। শুধু মাত্র ইভা কে দেখানোর জন্য। জীবন কই না বেদনার।   বিছানায় একবার এদিন একবার ওদিক করতে  থাকে, ঘুম আসেনা।  পাঁচ বছর আগে হলে পায়ের নুপূর আর হাতের কঙ্কন দোলা দিয়ে উঠতে। কিন্তু ইভা এখন নুপূর পরে না।  হাতে কঙ্কনও পরে না।   অলংকার বলতে শরীরে কিছুই নেই। 


শুয়ে শুয়ে মনে পড়ে নুপুরের কথা ছোটবেলায় কথা।  যখন অহিন দের বাড়িতে যেত।  ওর পায়ের নুপূরের শব্দ জানিয়ে দিত ওর আগমন বার্তা। নুপুরের শব্দে ঝংকার দিয়ে উঠতো ঘরের প্রতিটা কোন।  ইচ্ছা করে লাফিয়ে লাফিয়ে চলাফেরা করত যাতে নুপূরের শব্দ সবাই শুনতে পায়। যখন বড় হল যৌবনের পদার্পণ করল তখনও ওই একই ভাবে হেঁটে চলে বেড়াত ইভা। ইভার নুপূরের শব্দ ছিল অহিনের ভীষণ চেনা।  

আজ ইভা ভুল বুঝতে পারে। অহিন বা তৃষার সঙ্গে এমন ব্যাবহার করাটা ঠিক হয়নি। কিন্তু আজ আর ভুল শুধরেও লাভ হবে না। মাঝে মাঝে চোখের জলে বালিশ ভিজে যায়। হাতড়ে বেরায় ফেলে আসা জীবিনের যত স্মৃতি।  হয়তো ভোরের দিকে একটু ঘুম আসে। 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ