দ্বিতীয় পর্ব
এক বসন্তের মনোরম সন্ধ্যা। হঠাৎই এক কালো মেঘ তারাময় নীল আকাশ ঢেকে ফেলল ক্ষণিকের মধ্যে। আমি অফিস থেকে দ্রুত বাড়ি ফিরছি। কিন্তু পথে নামল বৃষ্টি। তাই উপায় না দেখে আমাকে আশ্রয় নিতে হল ইভাদের বাড়ির শেডের নিচে। বেশ কিছুক্ষণ পর বন্ধ দরজা খুলে গেল। ঘুরেই দেখি ইভা। আমার কিছু বলার আগে ইভা বলে - এখানে দাঁড়িয়ে ভিজে যাচ্ছ, আমাকে ডাকলে না কেন?
আমি বললাম - ভাবলাম তুই কাজে ব্যস্ত।
ইভা- কাজে ব্যস্ত বলে ডাকবে না? এসো ঘরে।
আমাকে ঢুকতে হলো ঘরে। ফাঁকা ঘর দেখে বললাম- তোর মা, ঠাম্মা কোথায়?
ইভা উত্তর দিল- দুজনেই গেছে দোকানে। বৃষ্টির জন্য হয়তো ফিরতে পারছে না।
আমি - তোর বাবা বোধহয় কাজ থেকে ফিরিনি এখনও?
ইভা -বাবার তো অনেক রাত হয় ফিরতে। তুমি বস আমি চা করি।
আমি বললাম- না না চা করিস না এখন আমি খাব না।
ইভা - এখনো তুমি চা খাও না?
আমি বললাম- নারে, একা থাকি তাই কে করবে ও সব ঝামেলা?
ইভা- বিয়ে করো না।
আমি - ওরে বোকা আমার মত ছন্ন ছাড়া ছেলেকে কে বিয়ে করবে?
ইভা বলল - চেষ্টা করেছ কোনদিন?
আমি- না যখন স্কুল বা কলেজে পড়তাম তখন ছিলাম লাজুক, চাকরি পেলাম এখন সময় পাই না। যেটুকু সময় পাই লেখালেখি করে কাটাই।
- এভাবে আর কতদিন কাটাবে?
আমি বললাম - কি জানি হয়তো সারা জীবন।
ইভা - কোনদিন কারোর দিকে তাকিয়ে দেখেছো, কেউ তোমাকে ভালোবাসে কিনা?
আমি বললাম- দেখেই বা কি আর না দেখেই বা কি? আমাকে কেউ ভালবাসবে না। আর আমাকে ভাসলেও হয়তো আমি পারবো না।
ইভা খুব কাছে এসে বসে, বাইরে আরো জোরে বৃষ্টি নেমেছে। তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা অন্য রকমের। তবুও বলছি আমি তোমাকে মনে মনে ……।।
আমি- মনে মনে কি করিস? ঘৃণা?
- ঘৃণা? তোমাকে আমি তোমাকে ভালোবাসি।
কথাটা বলেই দৌড়ে পালিয়ে যায় পাশের ঘরে, হয়তো লজ্জায়। যাওয়ার সময় ওর পায়ের নূপুরের ধ্বনি ঝম ঝম করে বেজে ওঠে।
বেশ কিছুক্ষণ পর একটা থালায় করে আমের আচার নিয়ে দিয়ে মুড়ি মেখে নিয়ে আসে। আমার সামনে রেখে খাও এই কথাটা হয়তো লজ্জাই বলতে পারেনা।
আমি বললাম- বোস।
ইভা বসে। তারপর বলি তোর - মাথায় কি ভূত চেপেছে? লোকে যখন শুনবে কি মনে করবে বলতো? তুই আমার ছাত্রী।
- সারা জীবন তুমি লোকের ভয় করে গেলে। একটা মেয়ের অন্তরের ভালোবাসা বুঝতে চেষ্টা করলে না। নাকি আমাকে ভালোবাসার ক্ষমতা বা ইচ্ছা কোনটাই তোমার নেই।
আমি কি উত্তর দেবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। এই মেয়ে তো এখন আর আগের মত ছোট নেই যে আমার সব কথা মেনে চলবে ও এখন উনিশ বছরের যুবতী। এতদিন আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে ও আর আজ ওর প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারলাম না। সত্যি ওকে ভালবাসতেই আমি অক্ষম। বাইরে বোধহয় আর বৃষ্টির শব্দ হচ্ছে না।
আমি উঠে দাঁড়িয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম - মাথা ঠান্ডা কর। ভাববার সময় এখনো আছে। ভালো করে ভেবে দেখ।
বাড়ি আসব বলে পা বাড়িয়েছি। আমার একটা হাত পিছন থেকে টেনে নিয়ে বলল- আমার ভাবার কিছু নেই। তোমাকে নিয়ে ভাবনা টা অনেক বছর আগের।
বলেই হাতটা ছেড়ে দেয়। তারপর আমি ধীরে ধীরে বাইরে বেরিয়ে আসি।
রাতে খেয়ে যখন ঘুরতে গেলাম তখন দেখলাম মাথাটা ঝিম ধরে আছে। চোখে ঘুম আসছেনা। সন্ধ্যায় বৃষ্টি হয়ে যাওয়ায় প্রকৃতির এখন ঠান্ডা। আকাশে মেঘ নেই। একরাশ তারা যেন সারা আকাশময় ছড়িয়ে পড়েছে। ঘর দিয়ে বারান্দা দিয়ে পাইচারি করতে লাগলাম। আর তখন বারবার মনে পড়ছিল “সারা জীবন তুমি লোকের ভয় করে গেলে। একটা মেয়ের অন্তরের ভালোবাসা বুঝতে চেষ্টা করলে না”। এমন যে হবে ভাবি নি। যাকে ভালোবাসার কথা স্বপ্নেও ভাবি না তাকে কি করে বলি ভালোবাসার কথা।
এ যে আমার কাছে বড় অগ্নিপরীক্ষার মতন। জীবনের সব পরীক্ষায় পাশ করে এ কোন পরীক্ষার সামনে এসে পড়লাম, জানিনা। ও তো জানে আমার জীবনে মায়া, মমতা, ভালবাসা নেই। আমার ছন্নছাড়া জীবন। ছন্দহীন গতিতে চলে। আমার মনের বা জীবনের কোন স্থিতি নেই। ও কেন ও এমন একটা ছেলের জন্য ওর অন্তর বেদনা অনুভব করে। ও জানে আমি ওর শিক্ষক তবুও কেন আমাকে ভালোবাসা জানায়। হয়তো ওর মনের মোহ। মেয়েটা মোহের জালে জড়াল নাকি?
বিছানায় আমার শরীর ছটফট করে ওঠে। আমার চির অশান্ত মনে আর এক অশান্তির ঢেউ জাগে। বিছানা থেকে উঠে আবার কিছুক্ষন উদ্দেশ্য হীন ভাবে ঘরের মধ্যে পাইচারি করতে থাকি। দূরে কোন নির্জন বুনে শিয়াল ডেকে উঠে। খোলা জানালা দিয়ে দুটি জ্যোস্না পোকা ঘরে ঢুকে অন্ধকার ঘরে তারার মতো জ্বলজ্বল করতে থাকে। আমি আবার শুয়ে পড়ি। আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে ফেলে আসা অতীতের কিশোরী, চঞ্চল, প্রাণময়, ছটফটে একটি কিশোরী মেয়ে। কখনো হেসে লুটপাটি খাচ্ছে। আবার কখনো মুখ দিয়ে বৃষ্টির মতো কথা বেরোচ্ছে। আবার কখনো বা একেবারেই চুপ। সেদিনের সেই কিশোরী আজ যুবতি।
অফিস বা বাড়ি কোথাও শান্তি পাচ্ছিনা। কি যেন একটা চিন্তা আমাকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। আমার অশান্ত মনের অবস্থা জানালাম আমার এক বন্ধুকে। ও বলল সামনে দোলের ছুটি। শুক্র, শনি আর রবি তিন দিন ছুটি থাকবে। বেরিয়ে পর কোথাও। আমারও মনে ধরল কথাটা। গেলাম টিকিট কাটতে। কিন্তু টিকিট হলো শনিবার। কয়েক দিন ছুটি নিলাম। যদিও আমার কয়েকটা ছুটি পাওনা ছিল তাই ছুটি পেতে অসুবিধা হয়নি।
আজ শুক্রবার। দোল উৎসব। বসন্তের রং লেগেছে প্রকৃতির বুকে। চারিদিকে ফুলের সমরহ। আমার বেড়াতে যাবার সব আয়োজন শেষ,। সকাল সকাল রান্না শেষ করে একটা লেখার খাতা নিয়ে বসলাম। জানালা দিয়ে বাইরের কিশোর কিশোরীদের দৌড়াদৌড়ি রং খেলা দেখছি। যা মনে আসছে তাই খাতায় লিখছি। পাশে পুরনো দিনের একটা টেপ চলছে, প্রিয় হেমন্তের গান চলছে সেখানে। বেলা বাড়ছে রৌদ্র বাড়ছে কিন্তু রং খেলার কোন খামতি নেই। এমনিতেই সব সময় আমার এইটা নির্জন লোকজনের কোন কোলাহল নেই গান শুনতে শুনতে একটা কবিতা লিখছি। হঠাৎ কে যেন পিছন থেকে আমার চোখ দুটো এঁটে ধরল। খোলা দরজা দিযটে।কে বা কারা কখন ঢুকে পড়েছে বুঝতে পারিনি। একজন ধরেছে চোখ। আর একজন আবীর মাখাতে ব্যাস্ত। বেশ কিছুক্ষণ পর যখন ছাড়া পেলাম তখন দেখলাম লেখার খাতাটা সামনে নেই। বিছানার চারিধারে লাল সবুজ আবির ছড়িয়ে আছে। সামনে তাকিয়ে দেখি তৃষা।
আমি প্রশ্ন করি -কাজটা ঠিক করলি?
তৃষা - বা রে আমি কি তোমার গায়ে রং দিয়েছি নাকি।
-তবে?
তৃষা - মাথায় তো আমি দিইনি
-তবে কে দিল?
- যে দিয়েছে সে পালিয়েছে।
- বাহ রং ও দিল আবার পালিয়ে গেল।
তৃষা উত্তর দিল - তোমার ভয়ে পালিয়েছে।
- আমাকে যদি এত ভয় করে তবে রং মাখাতেই বা এলো কেন?
তোমাকে ভয় পাই না ছাই। আমি এমনি লুকিয়ে ছিলাম। কথাগুলো বলতে বলতে ইভা ঘরে ঢোকে। হাতে আবিরের প্লেট তাতে কয়েকটা রংবেরঙের মঠ।
আমি হাসতে হাসতে বলি - বেশ দুই বন্ধুতে যখন চুপি চুপি এসেছিস, আবির মাখিয়েছিস আমিও কিন্তু প্রতিশোধ নেব।
তৃষা- এখনই নাও।
- এখন নয় সময় বুঝে
ইভা বলে - বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াও না একটু।
-কেন আরো রং দিবি নাকি
-না যা দেবার দিয়েছি। এখন একটু নামোতো দেখি।
-তোরা না বড্ড জ্বালাস। আমাকে রং মাখালি আবার বিছানাটাকেও রং মাখালি এবার কি করবি কে জানে।
তৃষা- খুন তো করবো না।
-তাই করে দে না বেঁচে যাই এ যাত্রায়।
তৃষা- তুমি না হয় বেঁচে গেলে। কিন্তু তুমি যার মন খুন করেছ তার কি হবে?
আমি হেসে ফেলি। তারপর বলি - মনও আজকাল খুন হচ্ছে তাহলে।
ইভা- তুমি নেমে আসবে?
আমি নেমে আসি। আমার হাতে একটা মঠ দিয়ে করে একটা প্রণাম করে ইভা। তারপর তৃষা। আমি ওদের মাথায় আবির দিয়ে ঈশ্বরের কাছে তাদের শান্তি কামনা করি। ওরা যখন বাড়ি ফিরছে তখন আমার মনে হল আমার বেড়াতে যাওয়ার কথাটা জানানো দরকার ইভা কে। না হলে ভাববে আমি পালিয়ে গেছি। হয়তো ভাবে ওর জন্যই। এইসব ভেবে না জানি কোন অঘটন ঘটিয়ে বসে। তার থেকে বলে দেওয়াই ভালো। আমার তো কারোর কোন অনুভূতি পাওয়ার দরকার হয়না। আমি ডাকলাম ইভাকে। ইভা ঘুরে দাঁড়ালো আমার ডাকে।
আমি বলি - শোন।
ও কাছে আসে তারপর বলে - বলো?
-কাল আমি হরিদ্দার যাচ্ছি, তাই কথাটা তোকে বলে গেলাম।
দেখলাম ইভার হাসি মাখা মুখের উপর দিয়ে কে যেন ছুরি চালিয়ে দিয়ে গেছে। ইভা অস্পষ্টভাবে বলল - কবে ফিরবে?
-৪-৫ দিন পর
ইভা আরো কাছে এসে বলে- আমাকে শাস্তি দেবার জন্যই তুমি চলে যাবে?
-কোথায় যাব বল। আবার ফিরে আসতে হবে। আর তোকে কেনই বা শাস্তি দেবো।
ইভা- আজ কিন্তু আমি আর ছোট টি নেই।
বলে ইভা চলে যায়। আমি আবার বিছানায় বসি। জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকি দূরে, বহু দূরে। তারপর একসময় বাঁকা রাস্তা দিয়ে হারিয়ে যায় ইভা আর তৃষা।
0 মন্তব্যসমূহ