নুপূরের শব্দ ১

  নুপূরের শব্দ

অতনু সরকার

 

প্রথম অধ্যায়





 

আকাশ ঘন কালো মেঘে ঢাকা। ফাল্গুন মাস হলেও আজ আর পাঁচটা দিনের থেকে আলাদা। সকাল থেকে আকাশে মেঘ জমে জমে বিকেলে নেমেছে বৃষ্টি। এখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে তবুও বৃষ্টি পড়ছে অবিরাম। শীতের আভাস খুব অল্প অল্প রয়ে গেছে।  বৃষ্টি পড়ছে বলে  শীতের ভাবটা একটু লাগছে। এই সন্ধ্যেবেলায় ঠাকুর ঘরে দীপ জ্বেলে একটু অন্যমনস্ক হয়ে জালনার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় উনিশ বছরের তন্নী মেয়েটা। লাবণ্যময় তার শরীর। গায়ের রং শ্যামলা কিন্তু আকর্ষণীয় মুখ,  চোখ দুটো হরিণের মতন টানা টানা। যে কেউ ওর চোখ দুটোকেই ভালবাসবে। টানা চোখের মধ্যে রয়েছে এক অপূর্ব আকর্ষণ এবং তার থেকেও বেশি আছে গভীরতা। 

জানলার ধারে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি  দেখে মেয়েটা। হালকা শীত আছে বলে  গায়ে একটা চাদর।  মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাট আসছে তবু  সরে আসছে না সে। বৃষ্টিটা অসময়ে হলেও ভালো লাগে। কে বলবে এই মেয়েটার  নুপুরের শব্দে মুখরিত হয়ে থাকে বাড়িটা। মেয়েটা  নুপুর পড়তে ভীষণ ভালোবাসে। এক ঘর থেকে যখন অন্য ঘরে যায় তখন ওর পায়ের তালে তালে  রুনু ঝুনু সুর তোলে নুপুরগুলো।  

 

মেয়েটার বয়স উনিশ হলেও ঘরে সে বড় অশান্ত। কিন্তু বৃষ্টি তাকে  আজ শান্ত করে দিয়েছে।  হয়তো বৃষ্টিকে সে বেশি ভালোবাসে তাই। হ্যাঁ ও ভালোবাসে বৃষ্টিকে। কারণ ওর জন্ম যে বর্ষাকালে। বর্ষাকালে জন্মালে যে বৃষ্টিকে ভালবাসতে হবে তা নয়,  আসলে ভালোবাসাটা  জন্মেছে সেই শিশু কাল থেকেই।  বৃষ্টির ফোঁটা গুলো ওর কাছে বড় আপন মনে হয়।  আজ খুব ভিজতে ইচ্ছা করছিল তার কিন্তু শরীর খারাপ হতে পারে ভেবে আর ভেজা হলো না।  সেই জন্যই জলের ছাট গায়ে আসা সত্বেও সরে আসে না সে।  জানালার ঠিক পাশেই রাস্তা।  রাস্তার ধারে লাইটপোস্ট।  তার আলোতে বৃষ্টির ফোঁটা গুলো সুন্দর দেখা যাচ্ছে।  সেই দিকে তন্ময় হয়ে চেয়ে থাকে এই মেয়েটা।

 

ওকে অনেকক্ষণ দেখতে না পেয়ে ঘরে ঢোকে ওর ঠাম্মা।  ওকে ডাকে না।  আস্তে আস্তে ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।  তারপর খুব ধীরে ধীরে বলে -  সরে আই দিদি ভাই ভিজে যাবি যে। 

 

মেয়েটা কোন কথা না বলে সরে আসে।  ঠাম্মাকে বলে - দেখো দেখো ঠাম্মা ওই লাইট পোস্টের আলোয় বৃষ্টির ফোঁটা গুলো কি সুন্দর লাগছে। 

ঠাম্মা ওর উৎসাহে বাধা দেয় না।  জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে বলে-  বাহঃ তাই তো। সেই জন্যই তুই এতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছিস?

 

মেয়েটা হেসে বলে-  হ্যাঁ গো ঠাম্মা। বাইরে টা কত সুন্দর অথচ সেটাই কেউ দেখতে চায় না। আমরা পয়সা খরচ করে দূরে বেড়াতে যাই  কিন্তু কাছের এইসব সুন্দরকে দেখতে পাই না।  হয়তো দেখতে চাইও না। 

ঠাম্মা একগাল এসে বলে, - কাছের জিনিস তো আমরা গ্রাহ্য করি না। তাই দূরে ছুটি। 

মেয়েটা বলে, - জানো ঠাম্মা আমার না বৃষ্টি ভীষণ ভালো লাগে। 

ঠাম্মা -  লাগবেই তো এই যে ভালোলাগার বয়েস।

মেয়েটি ঠাম্মার কথায় উৎসাহিত হয়ে বলে, - তোমার ভালো লাগছে ঠাম্মা?

নাতনির এই প্রশ্ন শুনে ঠাম্মার মন উড়িয়ে নিয়ে যায় বহু দূর, বহু বছর আগের ফিলে আসা সেই শৈশবে। হ্যাঁ আজ হঠাৎই অনিতা দেবীর মনে পড়ে গেল তার ফেলে আসা শৈশব, কৈশোর ও যৌবনকে। অনিতাি দেবিও কম বয়সে বৃষ্টিকে ভালোবাসতো।  আর যখন কম বয়সে বিয়ে হয় তখন কোন কোন বৃষ্টির দিনে জানালার বড় বড় গুলো ধরে দাঁড়িয়ে থাকতো স্বামীর জন্য। 

ঠাম্মা কে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মেয়েটি আবার বলে -  ও ঠাম্মা কি ভাবছো এত?

 

ঠাম্মা আবার বাস্তব জগতে ফিরে এসে বলে চল ঘরে চল, তোকে আজ অনেক কথা শোনাবো।  ছোট মেয়েদের মত উনিশ বছরের মেয়েটাও ঠাকুরমাকে জড়িয়ে ধরে বলে চলো না ঠাকুরমা তোমার কথাই শুনি আজ।

 বাইরে তখনো অবিরত বৃষ্টি পড়ে চলেছে। ঠাম্মার খাটের উপরে,  ঠাম্মার কোলে মাথা দিয়ে ইভা শুনতে থাকে ঠাম্মার ফেলে আসা জীবনের ইতিকথা। অনিতা দেবী ও বহুদিন পর তার ফেলে আসা শৈশব কে মনে করার এক বিস্তারিত অবকাশ পেয়ে যায়। নাতনির আবদারে  ফিরে যায় বহু বছর আগে ফিরে আসা তার শৈশবে।

ঠাম্মা বলতে থাকে -  বুঝলি, আমার বাপের বাড়ি ছিল একটা গ্রামে। বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলার এক গ্রাম। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে বেতনা নদী। সেই নদীর দুই তীরে গড়ে উঠেছে জনবসতি। তবে খুব ঘন নয়। আমরা নদীকে বলতাম গাং। গাঙের দুই ধারে সবুজ ফসলে ভরা মাঠ। ছবিতে যে সবুজ ফসল তোরা দেখিস সেই সবুজ ফসলে ঘেরা জীবন্ত ধান খেত,  সর্ষের খেত অথবা পাটের খেত।  দুপুরে গামছায় খাবারের পাত্র বেঁধে নিয়ে ছুটতাম মাঠে বাবাকে দেবার জন্য। মাঠের ভিতর দিয়ে আলপথ ধরে আমি হেঁটে যেতাম অনেকটা দূর। তারপর বিকেল বেলায় যখন আমরা বন্ধুরা মিলে জড়ো হতাম কত না খেলা খেলেছি তখন। সে সব খেলা এখন আর দেখি না জানিস। আসলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গেছে অনেক কিছুই। হয়তো অনেক নতুন খেলা এসেছে, আরো হয়তো আসবে। তখনকার  দিনে সই পাতানোর অনেক নিয়ম ছিল। সই মানে বান্ধবি।  আমরা বন্ধু পাতাতাম আর সেই সব বন্ধুদের সই পাতাতে গিয়ে কত মজার মজার ঘটনা ঘটতো। সেসব কথা তোরা আর জানবি  কি করে।  শহরের বুকে গ্রামীণ জীবনের সেই সব কথা হারিয়ে গেছে রূপকথার মতন। জানিস আমার এমন অনেক সই ছিল। কারোর নাম ছিল বকুল ফুল কারো সঙ্গে সই পাতাতাম শিউলি ফুল অথবা লবঙ্গ লতা বলে। মানে তারা হত বকুল ফুল সই,  শিউলি ফুল সই অথবা লবঙ্গ সই।  সেসব মজার মজার দিনের কথাগুলো আজ যেন হঠাৎ জীবন্ত হয়ে উঠল তোর জন্য। যখন খুব ছোট ছিলাম তখন বিকেলে কারোর তেতুল বাগানে গিয়ে তেতুল পাড়া,  কুলবাগানে গিয়ে ফুল পাড়া বা আম পেড়ে সেই আমের আম মাখা বা আমচুর খাওয়া,  কত কিছুই না ঘটেছে।  তারপর  দেখতে দেখতে যেই না একটু বড় হয়েছি অমনি বাবা-মা দিল বিয়ে।  ব্যাস শেষ হলো শৈশব। গল্প কথার সেই গ্রাম ছেড়ে চলে এলাম ওই বে্তনা নদীর অপর পাড়ে। নদী ওপর পাড় হয়ে গেল শ্বশুর বাড়ি।  নদীর দুপাড়ের সঙ্গেই তখন তৈরি হল এক যোগাযোগ। তারপর এলো যুদ্ধ, হিন্দু মুসলমানের লড়াই,  দাঙ্গা, রক্ত।  রক্তাক্ত এক বাংলা।  সেখান থেকে যে কিভাবে পালিয়ে এলাম আমরা। সে এক শিহরণ জাগানো গল্প কথা। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ধান ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে রাতের অন্ধকারে হেঁটে চলেছি।  যে কোন সময় গুলি লাগতে পারে আমাদের গায়ে।  লুটিয়ে পড়বো ধান ক্ষেতে তবুও সেই মৃত্যু ভয় কে উপেক্ষা করে আমরা পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছি এবার বাংলায়।  তারপর কত সংগ্রাম কত লড়াই।  আর জীবন যুদ্ধে নেমে জীবনের সঙ্গে সংঘাত করতে করতে আজ এই সন্ধ্যায় এসে উপনীত হয়েছি।

মেয়েটি বলে ওঠে- আরে ঠাম্মা তোমার জীবন কাহিনী তো সিনেমার গল্পের মতন।

অনিতা দেবী তার নাতনির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে-  সিনেমার গল্পের মত নয় সেইসব কাহিনী নিয়েই তৈরি হয়েছে সিনেমা।  আসলে এই সিনেমা বাস্তবের কঠিন প্রেক্ষাপটে তৈরি,  এখানে কোন সিনেমার কল্পনা নেই ।  

 

মেয়েটির নাম ইভা। তার তরঙ্গময় শরীরের লাবণ্য আরো বেশি করে ফুটে ওঠে ওর কৃষ্ণবর্ণ টানা টানা চোখ দুটির জন্য।  যে চোখে আছে এক অসাধারণ দীপ্তি।  শহরের নামকরা কলেজের ছাত্রী বিএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। পড়াশোনা, খেলাধুলা থেকে শুরু করে যে কোন কাজেই সে  পারদর্শী।  তবে এখন আর আগের মত খেলাধুলা করেনা।  বাবা মা এবং ঠাম্মার খুব আদরের ইভা এখন বাড়ির বাইরে খুব কমই বেরোয়। 

 

তার সঙ্গে আমার পরিচয় অনেক দিনের। জন্মের পর থেকেই ওকে দেখে আসছি। তারপর যখন বড় হল,  তখন সে ছিল আমার ছাত্রী।  এখন আর আমি পড়াই না। একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করি।  যদিও তার সঙ্গে আমার একটা খুব সুন্দর সম্পর্ক সেই ছোটবেলা থেকেই ছিল।আজও আছে।  তবে এখন ও আর আগের মতন ছোট নেই।  এখন পূর্ণ যুবতি।  আর আমি ভবঘুরে একটা মানুষ। কবিতা, গান লেখা নিয়ে পড়ে থাকি।  পাড়ার এক প্রান্তেই ছোট্ট একটা ঘর।  বাবা মা দুবছর হলো গত হয়েছে।  আমি এখন একা।  জীবনে প্রেম, ভালবাসা, মায়া মমতা ছিল না বলেই বিয়ে করা হয়ে উঠেনি। ঘুরে সংসারী হতে পারেনি জানি এখনো প্রচুর সময় পড়ে রয়েছে তবুও বিয়ে করতে আর ইচ্ছা করে না আমার চাকরি টাকায় একার সংসার বেশ বিলাসি কাটে শুধু খাওয়ার একটু সমস্যা দীর্ঘ অবসর লেখালেখি করে কাটিয়ে ফেলি।

 

ইভার কথা বলছিলাম।  ও যখন আমার কাছে পড়তে আসতো তখন ওর পায়ের নুপুরের শব্দে ঘরের প্রতিটি কোন প্রাণোময় হয়ে উঠতো।  আমাদের বাড়িতে ছিল ওর অবারিত দার।  ওর পায়ের দাপাদাপিতে ওদের প্রত্যেকটি ঘর ছন্দময় হয়ে থাকতো।  ইভা কখন কিভাবে জানিনা আমাকে ভালোবেসে ফেলেছিল। একদিন এক বসন্তের সন্ধ্যায় ও আমাকে জানালো ওর নিবেদিতে প্রেম। 

আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে চেয়ে রইলাম ওর দিকে। মনে মনে ভাবলাম- এই মেয়ে বলে কি? 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ