তৃতীয় পর্ব
সকাল থেকেই সাজে সাজো রব আমাদের ঘরে। একাই একার আনন্দে মশগুল। রেডিওতে বেজে চলেছে হেমন্তর গান। মুখে গুন গুন করতে করতে শেষ বারের মতো দেখে নিচ্ছি আমার সব জিনিসপত্র ঠিকঠাক আছে কিনা। দুন এক্সপ্রেস হাওড়া থেকে রাত আট টা পঁয়ত্রিশ মিনিটে ছাড়বে। আমাকে সন্ধে ছটার মধ্যে ব্যান্ডেল স্টেশনে পৌঁছাতে হবে।
দুপুরের রান্না চাপিয়ে চুপ করে বসে আছি, ঠিক তখনই একটা নূপুরের শব্দ আমার কানে ঝুমঝুম করে বেজে উঠলো। তারপর একসময় থেমে গেল। একটু পরে আবার সেই নূপুরের শব্দ আমাকে চঞ্চল করে তুলল। দেখলাম ছোট্ট কিশোরীর মত ভয়ে ভয়ে আস্তে আস্তে ইভা আসছে আমার কাছে। আমি বললাম- কিরে তুই এখন?
ইভা উত্তর দেয় - কেন আসতে পারি না?
- পারিস কিন্তু এখন দুপুরবেলা তার মধ্যে তুই একা।
ইভা - তোমার বাড়ি থেকে আমাদের বাড়ি কি অনেক দূর, যে একা আসতে পারবো না?
- না সে কথা নয়। আচ্ছা বোস।
আমি একটা চেয়ার এগিয়ে দিলাম। ও বসলো মেঝেতে। আমার পাশে।
আমি বললাম - হ্যা রে লোকে কি বলবে, তুই এখানে বসলে?
ইভা- লোকে কি বলবে? বলবে দুপুর বেলায় অহিনের সঙ্গে মেঝেতে পাশাপাশি বসে গল্প করছিল ইভা। এর বেশি আর কি বলবে? অন্তত তোমার সঙ্গে থাকলে এর থেকে বেশি কিছু লোকে বলবে না।
- কেন বলবে না কেন?
ইভা - জানিনা। তুমি কখন যাচ্ছ বল?
- সন্ধ্যে ছটায়
ইভা - কোথায় কোথায় ঘুরবে? একটু বলো না। আমার সেই ছোটবেলায় তোমার কাছে গল্প শোনার রোগটা যায়নি।
আমি বললাম - শুরু করব হরিদ্বার থেকে তারপর ঋষিকেশ, দেরাদুন হয়ে প্রায় সমগ্র উত্তর ভারত।
ইভা - সারা জীবন তো একা একাই ঘুরলে। একা একা ঘুরতে ভালো লাগে?
- হয়তো কখনো কখনো ভালো লাগেনা। আবার বেশির ভাগ সময় ভালো লাগে। সেই ভালোলাগার আশাতেই বারবার ছুটে যাই।
ইভা - যখন ভালো লাগেনা তখন কি করো?
আমি উত্তর দিই - তখন উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে ঘুরে বেড়াই।
ইভা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলে - তোমার জীবন এবং তুমি দুটি রহস্যে মোড়া।
আমি কোন উত্তর করি না। চুপ করে ওর চোখ দুটো দেখি। একসময় ইভা বলে - কি দেখছো।
আমি বলি - তোর চোখ দুটো।
ইভা লজ্জায় রাঙা হয়ে ওঠে, মাথাটা নিচু করে ফেলে এবং বলে - কি আছে এ পোড়া চোখে?
আমি বললাম - হয়তো মহাসমুদ্র যা তুই জানিস না।
ইভা - আমার চোখ যদি মহা সমুদ্র হবে, তাহলে কেন তোমাকে আমার কাছে এনে দেয় না। তবে কি মহা সমুদ্রে ঢেউ নেই?
আমি বললাম - আছে আর এই দেখ আমি তোর পাশেই বসে আছি।
ইভা- যাক আমার মহা সমুদ্রের ঢেউ যেন তোমাকে আমার গহন বুকের মাঝে এনে দিতে পারে।
কথাটা বলে ইভা উঠে পড়ে। হঠাৎই যেন আমার বড্ড একা মনে হয়।
সন্ধ্যা ৬ টা নাগাদ বড় ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। কয়েকজন প্রতিবেশী জিজ্ঞাসা করল, আমি কোথায় যাচ্ছি। বেড়াতে। মাত্র এই ছোট্ট উত্তর দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ব্যান্ডেল স্টেশনে পৌঁছে দেখি ইভা আর তৃষা দাঁড়িয়ে আছে।
আমি প্রশ্ন করলাম- তোরা এখানে?
তৃষা - তোমাকে ট্রেনে তুলতে এলাম।
- আমি কি তোদের মত ছোট রে? একাই কত জায়গায় ঘুরে এলাম।
ইভা - তুমি কি রাগ করেছো আমাদের উপর?
আমি বললাম - রাগ? কিসের জোরে তোদের উপর রাগ করব বল?
ইভা - তোমার বয়স হলেও তুমি খুবই বোকা।
আমি বললাম - তোর কথা আমি স্বীকার করে নিলাম।
তৃষা - চলো তোমার হাওড়া যাওয়ার ট্রেন ছাড়বে বোধহয়।
তিনজনে দু'নম্বর প্ল্যাটফর্মে এসে ট্রেনে চাপলাম। আমাকে ঠিক করে বসিয়ে ওরা ট্রেন থেকে নেমে জানালার কাছে দাড়াল।
তৃষা বলে - ভালো করে ঘুরে এসো।
ইভা,- সাবধানে যেও। সময় মত খাওয়া দাওয়া করো। তোমার তো ঘোরা পেলে কিছুই মনে থাকে না।
আমি হেঁসে বললাম- আর কিছু মনে করিয়ে দে।
ইভা - হাবিজাবি কিছু খাবে না কিন্তু।
আমি- বেশ মনে থাকবে। এবার তোরা যা। ট্রেন ছাড়লো বলে।
ইভা জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে একটা ছোট্ট প্যাকেট আমার হাতে দিয়ে বলে- এটা রাখো। রাতে নিশ্চিন্ত হয়ে যখন ট্রেনে শুতে যাবে তখন খুলে দেখো।
আমি ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম ও বলল - আমরা আসি এখন।
সেই মুহূর্তে ট্রেনটা ছেড়ে দেয় একটু পরেই ব্যান্ডেল স্টেশন আমার কাছে অদৃশ্য হয়ে যায়।
দুন এক্সপ্রেস ছুটে চলেছে একটা গভীর রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে। রাত তখন ১১:০০ টা বাজে, রাতের টিফিন শেষ করে এবার নিশ্চিন্ত হয়ে শুতে যাব, হঠাৎ মনে পড়ল ইভার ছোট্ট প্যাকেটটার কথা। বার করলাম ধীরে ধীরে। আমার আশেপাশে সবাই শুয়ে পরেছে। মোড়ক খুলতে বেরিয়ে পরল আমার প্রিয় ফুল শালুক। আর একটা কাগজ। লেখা ভালো থেকো। তারপর আরেকটা ভাঁজ করা কাগজ। কৌতূহ হল। সেটা নিলাম পড়ব বলে। ভাজ খুলতেই ঝর ঝর করে কোলের মধ্যে ঝরে পড়লো কয়েকটা গোলাপের পাপড়ি। কাগজে লেখা একটা চিঠি। তাতে লেখা আছে -
পূজানীয়,
আমার শত শত প্রণাম রইল। ঈশ্বরের কাছেই তোমার মঙ্গল প্রার্থনা করি। তোমার যাত্রা শুভ হোক।
জানি, তুমি আমাকে কোনদিন ভালোবাসতে পারবে না। কিন্তু আমার এই ক্ষুদ্র হৃদয় তোমার পূজায় অঞ্জলি দিলাম। আমি জানি তুমি আমার থেকে বয়সে শিক্ষায় দীক্ষায় অনেক বড়। এমনকি তুমি আমার শিক্ষক আর তার থেকেও বড় কথা তুমি ছোট থেকে আমাকে অন্যরকম ভাবে ভালবেসেছ সব কিছুকে মেনে নিয়েই বলছি। হয়তো আমি তোমার যোগ্য নই। কিন্তু তোমাকে ছাড়া আর কাউকে ভালবাসতে পারব না।
পুরনো স্মৃতি ভুলে কি নতুন করে আবার নতুন স্বপ্ন দেখা যায় না। অতীতকে নিয়ে বর্তমানে বেঁচে থাকার কোন অর্থ নেই। একটা মেয়ে তার জীবনের সমস্ত ভালোবাসা, স্বপ্ন আর বুকের ভিতরের সমস্ত ফুল নিয়ে বসে থাকবে তোমার জন্য। ভালোবাসার প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখবে আর তুমি পুরুষ হয়ে পদে পদে অবহেলা করে দূরে সরিয়ে দেবে। ধিক তোমার পুরুষত্বের।
কিছু মনে করো না। রাগ করে লিখে ফেললাম। আসলে তোমাকে ছাড়া আর কার উপর রাগ করবো বলো? তুমি আমাকে ভালোবাসো অথবা না বাসলেও অন্তত এটা জানি যে রাগ করবে না। তুমি তোমার একটা কবিতা লিখেছিলে না?
যদি কেউ কোনদিন হায়
আমার এই ভালোবাসা জানায়।
ফিরিয়ে দেব না তাকে
স্থান দেব তারে আপন বুকে।
হোক না সে ফর্সা অথবা কালো
আমি বাসবো তাকে ভালো।
হ্যাঁ, আজ আমি তোমায় তোমার কবিতার লাইন গুলো ফিরিয়ে দিলাম। মনে করালাম। আর জানালাম আমার প্রেমের কথা। দেখি তোমার মন কি বলে। না আর কখনো জানাবো না আমার কথা। এটাই প্রথম আর এটাই শেষ। তুমি ভালোবাসো আর নাই বাসো শুধু এটা জেনে রাখো তোমার জন্য মৃত্যুর শেষ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করে যাব। ভালো আছি ভালো থেকো।
ইতি
তোমার অপেক্ষায় থাকা ইভা
আবার ভাজ করে রেখে দিলাম ব্যাগে। হাতে রইল একটা ফুল আর মন রইলো কোন এক অজানা গ্রামে। যেখানে একা একটা মেয়ে হাতে একটা ফুলের মালা নিয়ে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। কি যে করি না। কোথাও শান্তি নেই। ইভা টা যে কি করে না? কোথায় একটা ভালো ছেলের প্রেমে পড়বি। তোর বাবা- মা, আমরা কত আনন্দ করে তোর বিয়ে দেব, তা না এক হতভাগা, পাগল ছেলের জন্য তোর যত প্রেম। এই প্রেমের কথা শুনলেই আমার গায়ে জ্বর আসে। ওর মাথা নিশ্চয়ই খারাপ হয়েছে, না হলে আমার মত এক ছন্নছাড়াকে কারোর ভালো লাগে? না এবার ফিরে গিয়ে আগে ওকে মাথার ডাক্তার দেখাতে হবে।
হে ঠাকুর তুমি প্রেম প্রীতির হাত থেকে আমাকে রক্ষা করো। বিয়ে-টিয়ে করা আমার দ্বারা হবে না। শুধু শুধু একটা মেয়ে কষ্ট পাবে এটা আমি একদম চাই না। তার থেকে তুমি আমায় এই ট্রেনের তলায় …। হঠাৎ বিরাট একটা ঝাকুনি দিয়ে ট্রেনটা থেমে যায়। আমার সমস্ত চিন্তা ওলটপালট হয়ে যায়। আবার একটা ঝাকুনি। তারপর দুম দাম কয়েকটা শব্দ তারপর …।
0 মন্তব্যসমূহ