অশরীরীর অভিশাপ ( বাংলা ভূতের গল্প, golpobitan)

 অশরীরীর অভিশাপ

অতনু সরকার 




শীতের রাতে ধূসর আকাশের নিচে রয়েছে বিদ্যানগর নামে একটা ক্ষুদ্র গ্রাম। শহুরে ব্যস্ততা থেকে দূরে এই গ্রামের নীরবতা অনেক কে আকর্ষণ করে কিন্তু এখানে রয়েছে  যেন একটা ভূতুড়ে ব্যাপার। গ্রামের এক কোণে দাঁড়িয়ে রয়েছে শতাব্দী প্রাচীন এক পোড়ো বাড়ি। সেই বাড়ির চারপাশে বাঁশঝাড় আর কুঁচকানো পাথরের পথ। লোককথা বলেছে, এই বাড়িতে রাতে শোনা যায় কান্নার শব্দ। অনেকে দাবি করে, এখানে অশরীরীর অস্তিত্ব রয়েছে।


একদিন এই গ্রামে আসে তরুণ লেখক অনির্বাণ। ভূতুড়ে কাহিনির প্রতি তার এক অদ্ভুত ঝোঁক। এই পোড়ো বাড়ি সম্পর্কে শোনা গল্পগুলো তাকে আকৃষ্ট করেছিল।  

অনির্বাণ, এক তরুণ লেখক ও গবেষক, তার গবেষণার জন্য সে এই গ্রামে  আসে। ভূতুড়ে কাহিনির প্রতি তার প্রবল আকর্ষণ। সে স্থির করে এই গ্রামে কিছুদিন থাকবে এবং পোড়ো বাড়ির রহস্য উন্মোচন করবে। গ্রামের লোকেরা তাকে সাবধান করে, কিন্তু সে তাদের কথায় কান দেয় না।


অনির্বাণ তার গবেষণার খাতিরে গ্রামে একটি পুরোনো চৌচালা বাড়িতে উঠেছে। প্রথম দিন থেকেই সে গ্রামের লোকদের কাছ থেকে শুনতে পাচ্ছিল পোড়ো বাড়ির অন্ধকার গল্প। যারা সেখানে গিয়েছে, তাদের কেউ ফিরেনি বা ফিরলেও তাদের মানসিক অবস্থা আর স্বাভাবিক ছিল না। অনির্বাণ এসবের তোয়াক্কা করল না। বরং তার মনে হলো, এমন একটা অভিজ্ঞতা তার লেখার জন্য দুর্লভ সম্পদ হতে পারে।

রাতে সে তার ডায়েরি এবং টর্চ নিয়ে বাড়িটিতে প্রবেশ করার সিদ্ধান্ত নিল। পথটা ছিল বাঁশঝাড়ে ঘেরা। রাতের অন্ধকারে বাঁশপাতার সোঁ সোঁ আওয়াজ যেন এক ধরণের মন্ত্রের মতো তাকে ওই বাড়ির দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। বাড়িটির সামনে পৌঁছে সে একটা গভীর শ্বাস নিল, এবং ভাঙা দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকল।  

বাড়ির ভেতরে ঢুকেই সে টের পেল একটা অদ্ভুত শীতলতা। মেঝেতে ধূলোর আস্তরণ এবং করিডোরের কোণে মোচড়ানো মাকড়সার জাল। দেয়ালের ওপর অদ্ভুত চিহ্ন যেন কোনো এক প্রাচীন অভিশাপের কথা বলছে। রাত যত গভীর হতে লাগল, তত বাড়ির ভেতরের পরিবেশ যেন থমথমে হয়ে উঠতে লাগল।

একটা নির্দিষ্ট রুম থেকে হালকা কাঁপাকাঁপা আওয়াজ আসছিল। টর্চের আলোতে দেখল দরজার খিলটা ভাঙা। সে ধীরে ধীরে দরজা ঠেলে ঘরে প্রবেশ করল। ঘরটার এক কোণে পুরোনো কাঠের আলমারির চাপে প্রায় ভেঙে পড়া টেবিলের ওপর একটি ধূলোমাখা ছবি। ছবিতে এক যুবতী নারীর করুণ মুখ। ছবির নিচে লেখা: “নিরুপমা, ১৯১০”।


এরপর অনির্বাণ অনুভব করল, তার পায়ের নিচে যেন মাটি ঠান্ডা হয়ে আসছে। হঠাৎ করেই বাতাস থেমে গেল। একটি অশরীরী কণ্ঠস্বর ফিসফিস করে বলল, “কেন এলে তুমি? এই অভিশপ্ত জমির শান্তি নষ্ট করছো!” 

ভয় তাকে ঘিরে ফেলল। কিন্তু তার কৌতূহল এক পা পিছিয়ে যেতে দিল না।

অনির্বাণ বলল - কে কে আপনি ?  আমি শুধু জানতে চাই, এখানে কী হয়েছিল। 

সেই অশরীরী বলে - আমি নিরুপমা। আপনি ফিরে যান। কেন আমাকে জ্বালাতে এসেছেন। না হলে আমি আপনাকে মেরে দেব।

অনির্বাণ বলল - আমি আপনার আত্মার শান্তি ফিরিয়ে দিতে চাই।

কণ্ঠস্বর আবারও বলল - তোমার সাহস আছে। কিন্তু এ সাহসই তোমার সর্বনাশের কারণ হবে।

অনির্বাণের হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছিল। সে বুঝতে পারল, কিছু একটার উপস্থিতি তাকে পরীক্ষা করছে। কিন্তু যতবারই সে বের হওয়ার চেষ্টা করে, তাকে মনে হয় দরজা আরো দূরে চলে যাচ্ছে। বাড়িটির অভিশপ্ত শক্তি তাকে বন্দি করে রেখেছে।

অনির্বাণ বুঝতে পারে যে এখানে শুধু ভূতুড়ে শক্তি নয়, এক ধরণের দুঃখ আর অভিশাপ জড়িয়ে রয়েছে। গ্রামবাসীর থেকে অনির্বাণ শুনেছিল যে সে ছিল এক জমিদারের কন্যা, যার জীবন এক অভিশপ্ত রাতে ধূলিসাৎ হয়। জমিদারবাড়ির একটি জটিল প্রেমের ফাঁদে তার মৃত্যু হয়। সেই রাতেই নিরুপমার আত্মা আটকে যায় এই পোড়ো বাড়ির দেয়ালে।

অনির্বাণ নিরুপমার আত্মাকে শান্তি দেওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নেয়। সে গ্রামের পুরোনো রেকর্ড ঘেঁটে দেখতে পায় সেই জমিদারের পৈত্রিক সম্পত্তি নিয়ে এক গোপন পাণ্ডুলিপি রয়েছে, যার ফলে নিরুপমাকে হত্যা করা হয়েছিল।  তার নিজের পরিবারের সদস্য দের মধ্যে সম্পত্তি নিয়ে এবং গোপন প্রেমের কারনে তার মৃত্যু হয়। অনির্বাণ ভাবল, এই পাণ্ডুলিপি এখনো হয়ত এই বাড়ির ভেতরে কোথাও লুকিয়ে আছে। 

অনির্বাণ আবার ফিরে যায় সেই পোড়ো বাড়িতে। সেখানকার একটি গোপন কুঠুরিতে সন্ধান করে একটি সিন্দুকে পাণ্ডুলিপি খুঁজে পায়। কিন্তু ঠিক তখনই একটি অশরীরীর চিৎকারে ঘরটি কেঁপে উঠে। নিরুপমার আত্মা তখনই তার সামনে আবির্ভূত হয়। সে এক বীভৎস রুপ ফুটে ওঠে। যা কোন সাধারন মানুষ দেখলে হয়তো সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে যেত।  


নিরুপমা অনির্বাণকে বলে- তুমি একমাত্র ব্যক্তি যে আমার সত্যিটা জানতে চেয়েছ। কিন্তু আমার অভিশাপ মুছতে হলে তোমাকে এই পাণ্ডুলিপি জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে।

অনির্বাণ সিদ্ধান্ত নেয়, সে জীবনের ঝুঁকি নিয়েও এটি প্রকাশ করবে। পরের দিন সকালে সে গ্রামে ফিরে এসে এটি প্রকাশ করে। নিরুপমার আত্মা সেই মুহূর্তে শান্তি পায়। বাড়িটার একটা বিরাট অংশ ভেঙে পড়ে।  পোড়ো বাড়িটা  আর অভিশপ্ত থাকে না। অনির্বাণ একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে গ্রাম ত্যাগ করে। 


ভূতের গল্প পড়ুন বাংলায়


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ