হারিয়ে যাওয়া চিঠি

 হারিয়ে যাওয়া চিঠি

অতনু সরকার




১৯৪৫ সালের কলকাতা, যেখানে চাঁদের আলো মিশে যায় পুরনো ইটের বাড়ির দেয়ালে, আর যেখানে গঙ্গার হাওয়া নিয়ে আসে হারিয়ে যাওয়া গল্পের গন্ধ। শহরের এক প্রসিদ্ধ লাইব্রেরি ‘সুধাদেবী পাঠাগার’-এ প্রতিদিন অনেক মানুষ আসে—কেউ বই পড়তে, কেউ গবেষণা করতে, কেউ আবার শুধু সময় কাটাতে। আজ ১৯৯৫ সাল। এতো বছর পার হয়ে গেছে। আজও এখানে মানুষ আসেন বইয়ের টানে। 

একদিন সেখানে এলেন অনুরাধা সরকার, একজন তরুণী গবেষক। তিনি এই লাইব্রেরিতে এসেছেন একটি বিশেষ বিষয়ের উপর কাজ করতে। পুরনো  পাণ্ডুলিপি, চিঠি এবং সাহিত্য—এসব নিয়েই তার কাজ। একদিন সে পুরনো কাঠের আলমারিতে থাকা একটা প্রাচীন বইয়ের ভিতর  থেকে একটা হলুদ হয়ে যাওয়া চিঠি খুঁজে পায়। চিঠির খামে লেখা—"প্রতাপ সেনের অন্তিম প্রণয়-বার্তা"।

প্রথমে সে ভাবলো এটি হয়তো কোনো সাহিত্যিকের লেখা, কিন্তু খামের ভিতরে থাকা চিঠিটি খুলতেই সে স্তব্ধ হয়ে গেল! চিঠি খুলতেই ভেসে উঠলো সেই সময়ের প্রেমের অনুভূতি, সমাজের বাধা, আর দু’টি হৃদয়ের নিঃশব্দ কান্না। এটি একটি অসম্পূর্ণ প্রেমের চিঠি, যার সারমর্ম এই যে প্রতাপ সেন নামের এক যুবক ভালো বেসেছিলেন চারুলতাকে । যিনি এই লাইব্রেরির লাইব্রেরিয়ান ছিলেন। তাদের প্রেম এবং অনুরাগ ধরা পড়েছে এই চিঠিতে। যা লেখার পর কখনোই চারুলতার কাছে পৌঁছায়নি। প্রতাপ বাবু এই চিঠিতে লিখেছিলেন একটা তারিখ, যেদিন তারা একজাই গায় জড় হবেন এবং বিয়ে করবেন। 

অনুরাধা এরপর বিস্তর খোঁজ খবর করতে থাকে। ওর মনে একটা অজানাকে জানার আকাঙ্খা জেগে ওঠে। অনেক খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারে, প্রতাপ ছিলেন এক তরুণ সাহিত্যিক, যার কলম থেকে ঝরে পড়তো কবিতা, গল্প, আর মানুষের হৃদয়ের গভীরতম স্পর্শ। চারুলতা ছিলেন এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের কন্যা, যার চোখে ছিল স্বপ্ন, প্রেম, আর মুক্তির আকাঙ্ক্ষা।

তাদের দেখা হয়েছিল লাইব্রেরির এক সাহিত্য সভায়। চারুলতা ছিলেন লাইব্রেরিয়ান এবং সেই অনুঠানের সঞ্চালক। তার পর লাইব্রেরিতে দেখা হয় এবং ধীরে ধীরে দুজন  কাছে চলে আসে।  কিন্তু সেই সময় প্রেম সহজ ছিল না—সমাজের বাধা, পরিবারের নিয়ন্ত্রণ, আর সময়ের কৌশলে প্রতাপ ও চারুলতার প্রেম নীরব নদীর ধারার মত বয়ে যেত। যদিও শেষ পর্যন্ত টা অধরা রয়ে গেল।

প্রতাপ শেষবারের মতো একটি চিঠি লিখেছিল চারুলতাকে, কিন্তু সে চিঠি কখনো তার হাতে পৌঁছায়নি। পৌঁছালে এই বইয়ের মধ্যে থাকতো না। চিঠির শেষে লেখা ছিলো “তোমাকে সরা সরি দিতে পারলাম না। অন্য দিনের মতো এটাও বইয়ের মাঝে রেখে দিলাম”।  


অনুরাধা চিঠিটি হাতে নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়, সে এই প্রেমের গল্পের সত্য খুঁজে বের করবে।

সে খুঁজতে শুরু করে পুরনো নথি, লাইব্রেরিয়ান্দের নামের তালিকা এবং  পরিবারের ইতিহাস। বহু পুরনো একটা ফাইল থেকে অনুরাধা খুঁজে পায় চারুলতার ঠিকানা। জেটা দেখে তার চোখ ছানা বড়া হয়ে যায়। হাত থেকে হটাত চিঠিটা পড়ে যায়। এক মুহূর্তের নিরবতা ভেঙে সে আবার পড়লো ঠিকানা টা। “চারুলতা সরকার, প্রযত্নে দিবাকর সরকার। ৫৪/এ বিদ্যাসাগর সরণি। কলকাতা ০০৫। এ যে অদের বাড়ির ঠিকানা। তবে কি চারু ঠাম্মা। ওর বাবার পিসি। যিনি অবিবাহিত ছিলেন। গত বছর মারা গেলেন। 

চিঠি টা নিয়ে সে পড়ি মরি করে ছুটে আসে বাড়িতে। বাবার কাছে যায়। তারপর বলে - বাবা তোমার পিসির নাম চারুলতা সরকার। ঠাম্মা কি লাইব্রেরিতে কাজ করতেন। 

অনুরাধার বাবা অবাক হয়ে বলে - কেন রে হটাত এই সব প্রশ্ন? 

অনুরাধা - বল না বাবা। তোমার পিসি মানে আমার পিসি ঠাম্মা কেন বিয়ে করেনি। জান তুমি।

ভদ্রলোক ভাবলেন কি হল অনুরাধার আজ। বিস্মিত হয়ে বললেন  - কি হয়েছে বলবি তো? 


অনুরাধা ধীরে ধীরে বাবার কাছে চিঠিটা মেলে ধরে। চিঠিটা পরে সেও অবাক হয়ে যায় তারপর বলে - তুই এটা কোথা থেকে পেলি। 

অনুরাধা -  ওই বইয়ের মধ্যে থেকে। 

তিনি বলেলন - একদিন পিসি বলেছিল, তার ভালোবাসার মানুষ হারিয়ে গেছে তাই সে বিয়ে করেনি। 

পিতা ও পুত্রি একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। 

অনুরাধা আবার লাইব্রেরিতে যায়। এবার সে সদস্যদের  নামের তালিকা বার করে। খুজতে খুঁজতে পেয়ে যায় ১৯৪৫ সালের নামের তালিকা এবং তাদের ঠিকানা। সেই সুত্র ধরে অনুরাধা বেরিয়ে পড়ে। 

বেহালার সেন পাড়া। ৩২/বি মানব সেন লেন। বহু পুরনো একটা বাড়ি। কিন্তু তার সামনের দিক টা নতুন করা করা হয়েছে। সেখানে দিয়ে জিজ্ঞাসা করে ঢুকে পড়লো বাড়িটায়। তখন সবে সন্ধ্যে হবে হবে। মৃদু সূর্যের আলো আছে। বাড়ির ভিতরের বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিলেন এক যুবক। বয়স ত্রিশ কি পঁয়ত্রিশ হবে।  

অনুরাধা কে দেখে কিছুটা অবাক হয়ে তিনি উঠে দাঁড়ালেন এবং বলেলন - কাউকে খুঁজছেন নাকি?

অনুরাধা বলল- এটা কি প্রতাপ সেনের বাড়ি?

যুবক একেবারে অবাক হয়ে বললেন - হা কিন্তু তিনি তো … আপনি কে? 

অনুরাধা বলল-  একটু বসতে পারি। ভয় নেই। আমি একটা অজানা কৌতূহলে এসেছি। আপনার নাম টা যদি জানতে পারি। 

যুবক - প্রমিত সেন। 

অনুরাধা এরপর সমস্ত ঘটনা খুলে বললেন। এর মাঝে কখন যে প্রমিত বাবুর মা এসে দাড়িয়েছেন তা অনুরাধা খেয়াল করেননি। সব কথা সুনে তিনি বলেলন - উনি আমার কাকা শ্বশুর।  এক পথ দুর্ঘটনায় মারা যান, আসুন ওনার ছবি দেখাচ্ছি।   

চিঠিটা তখন প্রমিত বাবু এক মনে পড়ছিলেন আর অনুরাধাকে দেখছিলেন। অনুরাধা প্রতাপ সেনের ছবির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। এক সুদর্শন যুবকের ছবি। মায়া ময় একটা চোখ। অনুরাধা যেন এখানেই প্রেমে পড়ে যাচ্ছে। মনে মনে ভাবল পিসি ঠাম্মা এর প্রেমে না পড়লে আর কার প্রেমে পড়তো? তার পর দেখলো ছবির নিচে লেখা মৃত্যুর তারিখ ৫ই ডিসেম্বর। তার সরণে এল চিঠির তারিখ ৩রা ডিসেম্বর। অর্থাৎ চিঠি লেখার দুদিন পড় তিনি মারা জান। থাম্মার সাথে আর কখনো তার দেখা হয়নি। হলে নিশ্চয়ই এই চিঠির কথা তিনি জানিয়ে দিতেন। তার থাম্মা চারুলতা সরকার  আজীবন সেই উত্তরহীন ভালোবাসার স্মৃতি বয়ে বেড়িয়েছে।

অনুরাধা প্রমিতের সামনে এসে দাঁড়ায়। এক পলক দেখে তাকে। তারপর বলে চিঠিটা দিন। 

প্রমিত উত্তর দেয় - এটা যে আমার দাদুর সম্পত্তি। আপনাকে কেন দেব?

অনুরাধা উত্তর দেয় - চিঠিটা আপনার দাদু দিয়েছিলেন আমার থাম্মা কে সুতরাং এটা এখন আমার সম্পত্তি। 

প্রমিতের মা হাস্তে হাস্তে বলে - প্রমিত এটা অনার প্রাপ্য। দিয়ে দে। 

তারপর আবার বলে -  তুমি কি কর মা? 

অনুরাধা একটু সলজ্জ হয়ে বলে - কাকিমা আমি বাংলার একটা বিষয় নিয়ে গবেষণা করছি। সঙ্গে একটা কলেজে পড়াই। 

প্রমিত বলল- কোন কলেজ? আমিও তো প্রফেসর। 

প্রমিতের মা বলেলন - তোমারা কথা বল আমি বরণ একটু চা করে নিয়ে আসি।

অনুরাধা - না কাকিমা। আমি তো চা খাইনা। আপনি বসুন। আমি বরণ চলে যাই। চিঠিটা দিন। 

প্রমিত বাবুর মা অনিমা দেবী বললেন - আরে বস বস হারিয়ে যাওয়া এক্তাস সম্পর্ক কে তুমি খুঁজতে এসেছ। এটা কি কম কথা। কি যে ভাল লাগছে না তৈমাকে বোঝাতে পারব না। 

প্রমিত বাবু চিঠিটা অনুরাধার হাতে দিয়ে বলল - আমার দাদুর এই চিঠি তে আমার প্রেম জানালাম তার নাতনী কে। 

অনুরাধা। চিঠিটা হাতে নিয়ে প্রমিতের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর মাথাটা নামিয়ে নেয়।

অনিমা দেবী বললেন -  আমার কথা টা তুই বলে দিলি। মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে বলতে লজ্জা লাগলো না। 

বলে হাসতে লাগলেন তিনি। 

কয়েক যুগ পর চারুলতা প্রতাপের প্রেমের  অসম্পূর্ণতাকে  একটা পূর্ণতা দিল আজ।  অনুরাধা মিস্টি হেসে বারান্দা দিয়ে নেমে যাচ্ছিল ঠিক তখন অনিমা দেবী তার হাতটা ধরে বললেন - কোথায় পালাবে। পালালে তো প্রতাপ সেন আর চারুলতা দেবী শান্তি পাবেন না। 

তিনি হাসলেন। তার সেই হাসি বাতাসে এক মৃদু আলোড়ন ছড়িয়ে দিলো, যেন যুগ পেরিয়ে প্রেম নিজেকে খুঁজে পেল। 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ