শশ্মানের সেই রাত ( বাংলা ভূতের গল্প, golpobitan)

 শশ্মানের সেই রাত  

অতনু সরকার




ছোটবেলা থেকে গল্প শোনার শখ আমার খুব। মাঝে মাঝে গল্প শোনার জন্য যেতাম আমার এক দাদুর কাছে। দাদু ছিল তান্ত্রিক তাই মাঝেমধ্যে তার কাছে রহস্যের গল্প শুনতে বেশ ভালই লাগতো। কোন কোন দিন দাদু যখন বাড়িতে আসতো তখন খুবই মজা হত।  আমরা ভাই-বোনেরা বই পত্র গুছিয়ে রেখে বসে পড়তাম দাদুকে নিয়ে গল্প শোনার জন্য। সে এক অদ্ভুত সময় ছিল। গল্প পেলে আমাদের কিছু লাগবে না। 


বর্ষাকাল, সকাল থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে। মেঘ ডাকছে মাঝে মাঝে।  কখনো কখনো ঝমঝম করে নেমে আসছে বৃষ্টি। বিকেলের দিকে একটু বৃষ্টিটা কমেছিল। আর সেই সময় দেখলাম একটা ছাতা নিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে আসছে দাদু। এই অসময়ে দাদুকে দেখে বেশ মজা পেলাম। বৃষ্টির দিনে দাদুকে পেয়ে বেশ কয়েকটা গল্প শোনা যাবে এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। 


আমি কিছুটা এগিয়ে গেলাম। দৌড়ে গিয়ে বললাম -  দাদু, তুমি বৃষ্টির মধ্যে?  

দাদু বলল -  সকাল থেকেই বৃষ্টি পড়ছে, ভালো লাগছিল না মনটা।  তাই ভাবলাম তোদের এখান থেকে একটু ঘুরেই যাই। তোর সঙ্গে দেখা হইয়ে যাবে। বর্ষার সময় বাড়ি থেকে বেরোতেও ভালো লাগেনা কিন্তু আজ আর বসে থাকতে ভালো লাগছে না, তাই চলে এলাম। 

আমি আনন্দে বললাম - বেশ তো, ভালো করেচ। এসেই যখন পড়েছ তখন আজকের রাতটা আমাদের বাড়িতে কাটিয়ে যাও। আর এই বৃষ্টির দিনে বসে তোমার গল্প শুনতে বেশ ভালো লাগবে। 

দাদু বললে - আচ্ছা ঠিক আছে এখন চল দেখি। 

আমরা বাড়িতে এসে ঢুকলাম। ঠিক সেই মুহূর্তে আবার ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো। সে বৃষ্টিতে চারিদিক খুব তাড়াতাড়ি অন্ধকার হয়ে গেল। সন্ধ্যা নেমে এলো খুব তাড়াতাড়ি। মাঝে মাঝে মেঘ ডাকছে। দাদুকে দেখে মা খাবার তৈরি করতে গেল। আমি বললাম- মুড়ি আর পিয়াজি ভাজা হলে বেশ জমবে। তাই না দাদু। 

দাদু বলল -  মুড়ি আর পিয়াজি হলে মন্দ হয় না সাথে একটা কাঁচা লঙ্কা পেলে হা হা হা। 

মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। গতকাল বৃষ্টি হয়েছিল কিন্তু আজকের মত এত তেজ ছিল না তার। দাদু কে বললাম -  দাদু, আজ একটা ভয়ংকর ভূতের গল্প বলো তো।  

দাদু বললে- দেখ গল্প তো অনেক আছে কিন্তু আজকে একটা সত্যি গল্প বলব। একেবারে আমার জীবনে একটা ঘটনা। 

আমি অবাক হয়ে বললাম-  তোমার জীবনের ঘটনা। তারমানে তুমি কি সত্যি সত্যি ভূত দেখেছিলে। 

দাদু বলল-  আরে বাবা গল্পটা শোন আগে, তারপরে তো প্রশ্ন করবি। 

আমরা  বসে পড়লাম গল্প রাসরে। আমরা বলতে আমি এবং আমার এক পিসত্ব ভাই অপু এবং আরেক পিসির ছেলে দেবু।  ওরাও বেড়াতে এসেছে আমাদের বাড়িতে। দাদুকে পেলে কেউই অবশ্য ছাড়ে না। কারণ দাদু বেশ রসিয়ে রসিয়ে গল্প বলতে পারে।  সে গল্প কতটা সত্যি বা কতটা মিথ্যে সে সব জানার প্রয়োজন আমাদের কখনো হয়নি। আমরা সেসব গল্প শুনে বেশ মজা পেতাম। কিন্তু আজকে যখন দাদু বলল, তার জীবনের সত্যিকারের ঘটনা তখন আর এ গল্প ছাড়া চলে না। এমনিতেই দাদু খুব গম্ভীর প্রকৃতির লোক কিন্তু কেন জানি না আমাদের বাড়িতে এলে একেবারে সহজ সরল হয়ে যায়। আমাদের জন্য বোধ হয়।  তো সে যাই হোক মুড়ি আর পিয়াজি দিয়ে গেল মা। মুড়ি পেঁয়াজি পেয়ে দাদু তো বেজায় খুশি। কাঁচা লঙ্কায় কামড় দিয়ে বললে -  বাহ লঙ্কার এত ঝাজ আছে দেখছি।  তবে আজ কিছু ঘটনাটা বলবো সেটাও বেশ ঝাঁঝালো বুঝলে দাদুভাই। 

আমি বললাম - আর অপেক্ষা করতে পারছি না দাদু তুমি শুরু করো। 

দাদু গল্প বলতে শুরু করল। গল্প বলার একটা শর্ত হচ্ছে গল্পের মধ্যে কেউ কথা বলতে পারবে না। কথা বললে গল্প যাবে থেমে সুতরাং দাদু যখন গল্প বলতে শুরু করলেন দরজা বন্ধ করে আমরা একেবারে চুপচাপ শুনছি তার গল্পের কথাগুলো। 


দাদু শুরু করল -  বুঝলে দাদু ভাই আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে আমি তখন আঠারো বছরের যুবক। আমার হঠাৎ ইচ্ছা হল তন্ত্রবিদ্যা শিখব।  তা সেই তন্ত্রবিদ্যা শেখার জন্য অনেক জায়গায় ঘুরতে লাগলাম। ঘুরতে ঘুরতে সুন্দরবনে এসে উপস্থিত হলাম। আমার এক বন্ধুর মারফত খবর পেয়েছিলাম সুন্দরবনে অনেক গুনিন বা মন্ত্রশুদ্ধ ব্যক্তি থাকেন তারা সুন্দরবনের বাঘকে পর্যন্ত বশ মানাতে পারে। এই খব শোনা মাত্র  খোঁজ খবর নিয়ে পৌছালাম সুন্দর বন। 

ধামাখালির অঘর বাবার নাম শুনেছে অনেকেই। যারা সুন্দর বনে মধু  বা মাছ সংগ্রহের জন্য বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায় তারা সকলেই অঘর বাবা বা অঘর সন্ন্যাসী কে চেনে। শুধু চেনে না তার অলৌকিক ক্ষমতার কথাও জানে। তাই তার বাড়ি খুজে পেতে অসুবিধা হল না। খুঁজে খুঁজে যখন তার বাড়ি গিয়ে পৌঁছলাম তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আমি সরাসরি তাকে প্রনাম করে বলেছিলাম -  বাবা আমি আপনার শিস্য হতে চাই। 

তিনি প্রথম টায় একটু হতবাক হয়ে গেছিলেন। আমাকে দেখে বললেন - তোমার বাড়ি কোথায় হে ছোকরা? 

 আমি ঝট করে নাম ঠিকানা সব বলেদিলাম। 

তিনি আবার বললেন- টা হটাত এই পথে কেন বাবা? এ যে খুব কঠিন পথ।  অনেক সাধনা করতে হয়। তুমি কি পারবে?

 আমি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলাম - খুব পারব। মন দিয়ে সব শিখে নেব। 

উনি বললেন - কার কাছে পেলে আমার সন্ধান? 

আমি বললাম - লোক মুখে আপনার কত নাম। লোকের মুখে শুনে শুনে চলেও এলাম।

তিনি বললেন - কিন্তু বাবা এ বিদ্যা বড় ভয়ঙ্কর। তবে তুমি যদি শিখতে চাও তাহলে আমি শেখাব। কারণ এ সব শিখতে গেলে খুব সাহসের দরকার হয়। সে তোমার আছে, না হলে হলে সুদুর হুগলী থেকে কেনই বা এই ধামাখালিতে এসে পোঁছাবে, তাই না।  


আমার প্রতি কি দয়া হল জানিনা। সে রাত থেকে আমাকে গোপন তন্ত্র বিদ্যা শেখাতে শুরু করলেন। আমিও মন দিয়ে শিখতে লাগলাম। বুজলে দাদু ভাই, এক সপ্তাহ পরে আমাকে নিয়ে যাওয়া হল ধামাখালি শশ্মানে। সেখানে এক ঝোপের আরালে রয়েছে তার আসন। গা ছম ছম করা সেই রাত। আকাশে সুধু তারা দেখা যাচ্ছে। রাত একটার সময় আমরা গিয়ে বসলাম সেই আসনে। সামনে রয়েছে কয়েক টা মাথার খুলি। আর কয়েক টা হাড়। একটা যজ্ঞ করার স্থান। সেখানে কাঠ আগে থেকেই জোগাড় করে রাখা ছিল। একটা মাথার খুলির গায়ে তিনি সিন্দুর পরিয়ে দিলেন। তার পর আরো কিছু ক্রিয়া করার পর শুরু হল সাধনা। ধুপ জ্বলছে। একটা ছোট প্রদীপ মিট মিট করে জ্বলছে মৃদু মৃদু বাতাসে। বাবা আমাকে বললেন - আমি যা বলব তাই বিলে জজ্ঞের আগুন ধরাবি।

আমি সেই মতো করে যখন আগুন দিলাম, দপ করে জলে উঠলো। অঘর বাবার মন্ত্রের শব্দ তখন সারা শশ্মান জুড়ে এক আলোড়ন ফেলেছে। আছের ডাল গুলো দোলা দিয়ে উঠলো। প্রথমে আমি একটু ভয় পেয়ে গেছিলাম। কিন্তু বাবা বললেন -ভয় পাবি না। ভয় পেলেই শেষ করে দেবে ওরা।

আমি আবার টান টান হয়ে বসলাম। মনে হচ্ছে আমাদের চার পাশে কারা যেন নিত্য করছে। মাঝে মাঝে কাদের যেন ফিস ফিস করে কথা বলার শব্দ পেলাম। বাবা আরো জোরে জোরে মন্ত্র উচ্চারণ করতে লাগলেন। হটাত দেখলাম সেই মাথার খুলি টা একটু একটু করে শূন্যে ভেসে উঠছে। আমার গায়ের রক্ত তখন হিম হয়ে গেছে। চারি দিকে নানান রকমের শব্দ। আমি সব ভয় কে উপেক্ষা করে বসে রইলাম। মনে হছে আমার ঠিক পিছনে কে যেন এসে দাড়িয়েছে। অনুভব করতে পারছি কিন্তু ঘুরতে পারছি না। কারণ অঘর বাবার বারণ আছে পিছনে ঘোরা যাবে না। তার পর দেখলাম সেই মাথাটা আগুনের শিখার উপর উঠে নাচ করছে। অঘর বাবা বললেন  - একে মন্ত্র সিদ্ধ কর। 

সঙ্গে সঙ্গে সেই মাথা আমার চারি পাশে ঘুরতে লাগলো। আমাকে ঘিরে যেন সে নাচ করছে। আমি বুঝতে পারছি আমার রক্ত প্রায় হিম হয়ে গেছে। গা দিয়ে দর দর  করে ঘাম ঝরছে। এক সময় সেটা এসে বসলো আমার কোলে। সঙ্গে সঙ্গে সব কোলাহল থেমে গেলো। অঘর বাবা বললেন - সামনে ভালো করে তাকিয়ে দেখ। 

 আমি ভালো করে তাকিয়ে দেখি আমার সামনে অসংখ কালো কালো ছায়া। তারা বলছে -  আদেশ করুন, আদেশ করুন। 

অঘর বাবা বললেন - ফিরে যেতে বল।

আমি তখন কোন জগতে ছিলাম জানি না। গলার স্বর গোম্ভির করে বললাম - চলে যাও,  চলে যাও। 

আমি বিশ্ময় চোখে তাকিয়ে দেখি সে ছায়া মূর্তি গুলো এক এক করে হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। 

আমারা চুপ করে দাদুর কথা শুনছিলাম। হটাত বাইরে আরো জরে বৃষ্টি এল।

 দাদু বললেন  - চোখ বুঝলেই সেই রাতের দৃশ্য টা আজো আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। 

অপু বলল -  শশ্মানে তোমার চার পাশে কারা ছিল? 

দাদু চোখ গোল গোল করে বলল -  তেনারা। যারা রাতের অন্ধকারে ঘাড় মটকে খায়। 

আমারা সবাই স্তব্ধ হয়ে রইলাম।      


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ