নুপূরের শব্দ ১৫
তৃষা বাঁকুড়ায় তার মাসির বাড়িতে যখন পৌঁছালো তখন ঠিক সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। তৃষা অনেক কষ্ট করে অহীনের এক বন্ধুকে ধরে বাঁকুড়ায় যেখানে অহীন থাকে তার ঠিকানা জোগাড় করে ফেলল। ঝাউ তলায় তার এক মাসি থাকে। মায়ের কাছে আবদার করলো মাসির বাড়ি যাবার জন্য। শুধু আবদার নয় একেবারে মাসিকে নিয়ে এখানে আসবে এই শর্তে মাকে কোন রকমে রাজি করিয়ে তৃষা এসেছে এখানে। তৃষা অনেক ছোটবেলায় একবার এসেছিল রাস্তাঘাট আবছা আবছা মনে পড়ে। বাঁকুড়া শহর থেকে ঝাউতলায় আসতে বেশ রাত হয়ে গেছে। বিশেষ করে এইসব পাড়া ঘরে রাত আটটা নটা মানেই অনেক রাত। বাস থেকে নেমে তৃষা সোজা হাঁটতে থাকে। রাস্তায় তখন একটা কি দুটো লোক। রাস্তার ধারে দোকানপাট প্রায় সবগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। তৃষার বুকটা ধরাস ধরাস করে কাঁপতে থাকে। হঠাৎই সে পিছন ফিরে দেখে দুটি লোক তার পিছু পিছু আসছে। প্রথমে সাধারণ লোক বলে মনে হল। তৃষা হাটার গতি বাড়ালো। ওরাও গতি বাড়ালো। তাই দেখে তৃষা বুঝল ওরা সুবিধার নয়। । তৃষা বারবার ভগবানের নাম করতে থাকে । বেশ খানিকটা যাওয়ার পর তৃষা পথ হারিয়ে ফেলে। সামনে কেউ নেই , যাকে জিজ্ঞাসা করবে তার মাসির বাড়ির ঠিকানা। বাধ্য হয়ে তৃষা দাঁড়িয়ে পড়ে। মনকে শক্ত করে। দুটো লোকও কাছে এসে পড়ে। তৃষা তাদের জিজ্ঞাসা করে - আচ্ছা দাদা ঝাউ তলা সরকারি কোয়ার্টার গুলো কোন দিকে?
মোটা করে একজন বলে - আমরা তো ওই দিকে যাব। আসুন আমাদের সঙ্গে। তৃষা - আপনারা কি ওখানে থাকেন?
দ্বিতীয় লোকটি উত্তর দেয় - হ্যাঁ,
প্রথমজন বলে - চলুন আমাদের তাড়া আছে।
তৃষা - চলুন।
লোকদুটো আগে আগে আর তৃষা তাদের পিছনে অনুসরণ করতে থাকে। একজন বলে - আপনার বাড়ি কোথায়?
তৃষা - হুগলি
দ্বিতীয়জন - এখানে কার বাড়ি?
তৃষা - মাসির বাড়ি। আমার মেসোমশাই সরকারি চাকরি করেন।
প্রথমজন- কি নাম?
তৃষা - দেবেন্দ্রনাথ রায়।
প্রথম লোক অপর লোকটির মুখের দিকে তাকিয়ে আবার ঘাড় ঘুরিয়ে নেয়। তারপর একটা অন্য রাস্তা ধরে। তৃষার এ রাস্তা কেমন যেন অচেনা লাগে। তবুও হাটতে থাকে। লোক দুটো একটু এগিয়ে গিয়ে কানে কানে কি যেন বলতে শুরু করে। তৃষা লক্ষণ ভালো নয় ভেবে দাঁড়িয়ে পড়ে। হৃদপিণ্ডটা আরো জোরে ওঠানামা করছে যেন তার। একজন লোক এগিয়ে আসে। তারপর বলে - কি ব্যাপার আপনি দাঁড়িয়ে পড়লেন যে? চলুন।
তৃষা জানে তার মাথা এখন ঠান্ডা রাখতে হবে।
তৃষা বলে - দাদা আপনারা একটু দাঁড়াবেন? আমি পাশের গলি থেকে একটু টয়লেট করে আসি। এত জোরে পেয়েছি দাঁড়াতেও পারছি না।
এর মধ্যে সেই মোটা লোকটা এসে পড়েছে। সে বলে - জান তবে দেরি করবেন না। আমরা আপনার মেসোমশাইয়ের বাড়ির কাছাকাছি থাকি আমাদেরও তারা আছে।
তৃষা দ্রুত চলে যায় পাশের গুলিতে। অন্ধকার চারিধার। দি একটা বাড়ির ভিতরে আলো জ্বলছে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কোন সাড়াশব্দ নেই। তৃষা জুতো দুটো হাতে নিয়ে অন্ধকারে দ্রুত অন্য আরেকটা গুলির মধ্যে ঢুকে পড়ে। তারপর দৌড় শুরু করে। অনেকক্ষণ ধরে উদ্দেশ্যহীন এর মত অচেনা পাড়ার মধ্যে দৌড়াতে থাকে। রাস্তাঘাট ঘুটঘুটে অন্ধকার অনেকটা দূরে আসার পর আবার কুকুরে তাড়া করে। তৃষা পাগলের মত দৌড়াতে থাকে একটা ছোট বাড়ির দরজায় ধাক্কা মেরে পড়ে যায়। দুটো কুকুর দৌড়ে আসে কাছে। কিন্তু হয়তো বা মেয়ে বলে একটু দূরে দাঁড়িয়েই দু'একবার ডেকে দাঁড়িয়ে পড়ে।
ওদিকে লোক দুটো দেরি হচ্ছে দেখে গলির মধ্যে খুঁজতে শুরু করে। শিকারির হাত থেকে পাখি পালিয়ে গেলে শিকারি যেমন আরো হিংস্র হয়ে ওঠে লোক দুটো তেমনি ক্ষুধার্ত বাঘের মত গর্জন করতে করতে দ্রুত এগলি থেকে ওগলিতে খোঁজাখুঁজি শুরু করে।
দরজায় ধরাস করে শব্দ হতেই অহিন উঠে পড়ে। এত তাড়াতাড়ি অহিনের ঘুম আসে না। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সবের নটা বাজে। অহিন তখন অতনু সরকারের লেখা একটা গল্পের বই পড়ছিল। সেটা টেবিলে রেখে উঠে এসে দরজা খোলে। দরজা খুলতেই একটা মাথা এসে পড়ে তার পায়ে। অহিন প্রথমে আঁতকে উঠেছিল। একটা নারী, তাও আবার চেনা মনে হচ্ছে।এতক্ষণে তৃষা কথা বলে - আমাকে বাঁচান। আগে ঘরে নিয়ে চলুন। আমি সব বলছি।
অহিন কোনক্রমে ঘরে নিয়ে গিয়ে তৃষাকে চৌকির উপর শুয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। তারপর ফিরে এসে চুপ করে তাকিয়ে থাকে মেয়েটির মুখের দিকে। সেই সময় মেয়েটির চোখ খোলে চোখ খুলেই চিনতে পারে। তারপর অস্পষ্ট স্বরে বলে - তুমি যাক বাঁচলাম।
অহিনের মনে আর কোন দ্বিধা দ্বন্দ্ব থাকে না।
অহিন বলে - তৃষা তুই এখানে কি ব্যাপার? কি করে আসলি?
তৃষা - বলবো সব বলবো। আগে একটু জিরিয়ে নিই।
অহিন এক বোতল জল নিয়ে আসে। গ্লাসে ঢালে। তৃষ্ণা মুখের কাছে ধরে। পিপাসায় কাতর তৃষা সঙ্গে সঙ্গে খেয়ে নেয় এক গ্লাস জল। ফাল্গুন মাস হলেও বেশ গরম পরেছে সেবার। ঘরের সিলিং ফ্যানের জোরটা একটু বাড়িয়ে দিল অহিন। বেশ কিছুক্ষণ পর তৃষা উঠে বসলো। তারপর বলল -ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন।
অহিন - কেন? বল দেখি কি হলো? তুই হঠাৎ কোথা থেকে চলে আসলি এখন?
তৃষা - তোমার খোঁজে এসেছিলাম। ভেবেছিলাম তোমাকে পাবো না। কিন্তু রাতে বদ লোকের পাল্লায় পড়ে ওদের হাত থেকে বাঁচার জন্য দেখো যার বাড়ির কাছে এলাম। সেই তুমি।
অহিন - কি হয়েছে বল দেখি?
তৃষা ঝাউতলায় বাস থেকে নামার পর কি কি হয়েছে সবটাই বলল। সমস্ত ঘটনা শোনার পর অহিন একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলে - যাক তোর কোন বিপদ হয়নি এটাই ভালো। এখানে তোর কোন বিপদ হবে না। কিন্তু হঠাৎ বাঁকুড়ায় কি মনে করে?
তৃষা - ইভার সঙ্গে আমার ছোটবেলার বন্ধুত্ব টিকলো না।
অহিন - কেন?
তৃষা - আমি ইভাকে বলেছিলাম তোর জন্য অহিন দা কে নিজের ভিটেবাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হল। তুই ওর সঙ্গে অভিনয় করেছিস। ব্যাস তাতেই ওর রাগ। ও কি বলল জানো? আমি যেন তোমার নাম আর ওর সামনে না তুলি।
অহিন একটু ম্লান হেসে বলল - তারপর?
তৃষা - তারপর তোমার নাম জড়িয়ে আমাকে যা নয় তাই করে বলল। আমিও চিরদিনের মত ওর সঙ্গে বন্ধুত্বের পাট চুকিয়ে দিলাম।
অহিন - প্রসুনের কি খবর?
তৃষা- ওর সঙ্গেই তো বিয়ে। এতক্ষণ হয়তো বিয়ে হয়ে গেছে। ওর বিয়েতে থাকব না বলে পালিয়ে এলাম।
অহিন - পালিয়ে বাঁকুড়ায় আসতে হলো।
তৃষা - তোমার এক বন্ধুর কাছ থেকে ঠিকানা জোগাড় করে দেখলাম তুমি ঝাউ তলায় থাকো। এখানেই আমার এক মাসি থাকে। তাই আসতে অসুবিধা হলো না। অসুবিধা যা হলো সে তো এখানে এসে।
অহিন - হঠাৎ আমার খোঁজ করলি?
তৃষা - সত্যি কথা বলতে হয়তো খোঁজ করতাম না। কিন্তু ইভার কয়েকটা কথা আমাকে এতটাই আঘাত দিয়েছে যে আমাকে তোমার কাছে আসতে বাধ্য করেছে।
অহিন - শুনতে পারি কি কথা?
তৃষা - মেয়েদের সব কথা শুনে কি লাভ অহিন দা। তবে আমি এসেছি অনেক আশা নিয়ে।
অহিন - আশাই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। আর আশাই মানুষকে মারে। আমি তো কত কিছুই আশা করেছিলাম ।
তৃষা - জানি। হয়তো পুরোটা জানিনা। তবে যা জানি তাও কম নয়।
অহিন - যাক বাকি কথা না হয় কাল হবে। এখন আয় খাওয়া দাওয়া করি। সারাদিন তো তোর কিছুই খাওয়া হয়নি চল দুজনে মিলে হাতে হাতে করে দুটো রান্না করিনি আমারও নিজের তো কিছু খাবার নেই।
তৃষা - আমি না এলে কি করতে?
অহিন - দুটো মুড়ি খেয়ে শুয়ে পড়তাম।
তৃষা - এই জন্যই তোমার শরীর আরো খারাপ হয়ে গেছে। চলো কি করতে হবে করি এসো।
সেই রাতে কোন রকমে দুটো রান্না করে খেয়ে নেয় দুজন। কিন্তু একটা ঘরে শোবার অসুবিধা। কে কোথায় থাকবে। অহিন একটা মাদুর পেতে ফেলে মেঝেতে। তার উপর একটা চাদর পেতে নেয়। খাটটা ছেড়ে দেয় তৃষাকে। তৃষা রাজি হয় না একা খাটে শুতে।
তৃষা - তোমার বাড়িতে তুমি নিচে? আমি কিন্তু তোমাকে অবিস্বাশ করিছি না। চাইলে অপরে শুতে পারো।
অহিন - তুই করতে পারিস বিশ্বাস। কিন্তু আমি নিজেকে একদমই বিশ্বাস করিনা।
তৃষা - তাহলে আমি নিচে শুয়ে পড়ি।
অহিন - যা বলছি তাই কর।
তৃষা অহিনের মুখের উপর কিছু বলতে পারে না। ঘরের ফ্যানটা জোরে চালিয়ে শুয়ে পড়ে দুজন। গভীর রাতে মহা নিস্তব্ধতার মধ্যে তৃষা ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু অহিন ঘুমাতে পারে না। সারারাত এদিক ওদিক করে জেগে থাকে। ভোরের দিকে একটু ঘুমিয়ে পড়ে সে।
0 মন্তব্যসমূহ