নূপুরের শব্দ ১৪

  অধায়্য চোদ্দ



পড়ন্ত বিকেলের রোদ গায়ে লাগেনা বলে ইভা আর তৃষা ছাদের উপর এসে বসে।  এই কদিন আগেই দোলযাত্রা হয়ে গেছে। এখনো বেশ গরম আছে। ফাল্গুনের শেষ দিক।  প্রসূন আর ইভা  মাঝে মধ্যেই এখন থেকে এদিক ওদিক বেরিয়ে পড়ে।  প্রসূনের সঙ্গে ঘুরতে ও যে ভীষণ আনন্দ পায় সে কথা তৃষাকে গর্ব করে বলে। আজও বলছিল গতকালের ঘটনা।  

তৃষা তার মধ্যে হঠাৎই প্রশ্ন করে - তবে তুই সত্যিই কি অহিন দা কে ভালোবাসিস নি ?

 

ইভা হঠাৎই রেগে যায় বলে - তোকে বলেছিলাম অহিনের নাম আমার সামনে উচ্চারণ করবি না।

 

তৃষা-  অথচ ভাব,  একদিন তুই কত চোখের জল ফেলেছিস ওর জন্য।

 

ইভা - ফেলেছি। ভুল করেছি। যদি একটা পাথরকে ভালবাসতাম তাহলে আরো বেশি ভালো হতো।

 

তৃষা - কি বলছিস তুই? তুই হয়তো ওকে চিনতে পারিস নি। 

 

ইভা- ঠিকই বলেছিস ? তুই আমাকে ছেলে চেনাবি?  তুই নিজে ভালো করে চেনার চেষ্টা কর।  হয়তো কাজে লাগবে। 

তৃষা - আমি শুধু বলছিলাম অহিন দার প্রতি তোর ব্যবহারটা ঠিক হয়নি। 

ইভা  - এতো যখন তোর দরদ,  যা না ওকে ফিরিয়ে নিয়ে এসে ঘর কর।

 

তৃষা অবাক হয়ে তাকায়  তারপর বলে - তুই বলতে পারলি এ কথা? 

ইভা উত্তর দেয় - বলতাম না। তুই বাধ্য করলি, জানতাম না অহীনের জন্য তোর এত টান। 

তৃষা ঘৃণা আর বিরক্তি প্রকাশ করে বলে - এইরকম কথা বলতে তোর জিভে বাধেনা। 

ইভা - আমার থেকে তো তুই বেশি ভালবেসেছিস মনে হচ্ছে।

তৃষা - তোর মুখে এ কথা মানায় না ভাই। একথা টা আগেও একবার বলেছিলি । যেটা বললি সেটা কি তোর মনের কথা?

ইভা - ওর সম্পর্কে কোনো কথাই আমার বলতে ইচ্ছা করছে না। তুই ভাবিস ভাব। মনে হছহে তুই খুব ব্যাথা পেয়েছিস? 

তৃষা - পেয়েছি, কিন্তু সেটা তোর ব্যাবহারে।  শুধু তাই নয় আজকের পর থেকে তোর সঙ্গে আর বন্ধুত্ব রাখা চলে না।  হয়তো কোন দিন আমার মুখেও  থু থু দিবি।  আর শোন বলছিলি না  অহিন দাকে আমি  ভালবাসি কিনা? বাসতাম না।  আজ থেকে বাসবো। আর শোন হয় তো সত্যি ঘর ও করব। প্রথম বার যখন বলেছিলাম তখন এমনি বলেছিলাম তোর মন পরিখা করার জন্য। আজ মন থেকে বললাম। অহিন কে বিয়ে করে দেখাব। চলি রে ………।  

 

তৃষা দৌড়ে নেমে যায় ছাদ থেকে।  ইভা হতভম্বের মতো বসে থাকে।  মুখে একটাও কথা ফোটে না। তৃষাকে  এই ভাবে বলাটা হয়তো তার মোটেই ঠিক হয়নি।  একা একা ছাদে পায়চারি করতে থাকে। উপরে নীল আকাশ ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে মনে হচ্ছে।  কি করবে ভেবে পায় না।

 

সকাল থেকে সানাই বেজে চলেছে বাড়িতে।  বাড়িময় লোকজন ভর্তি। আজ ইভার বিয়ে। আত্মীয়-স্বজন বাড়িতে পা দেবার জায়গা নেই।  ওর বাবা-মা তৃষাকে আমন্ত্রণ করে এসেছে কিন্তু সকাল থেকেই পাত্তা নেই তৃষার।  অন্যান্য বান্ধবীরা সকাল থেকে ইভার  সঙ্গে রয়েছে।  সকাল দশটা নাগাদ প্রসূন দের বাড়ি থেকে গায়ে হলুদ এসে পৌঁছে গেল।  গায়ে হলুদ হল ইভারও।  গায়ে হলুদ হল, কত আনন্দ হল  সকাল থেকে, কিন্তু ইভার মনটা সত্যিই একটু খারাপ তৃষার জন্য। 

ইভা আশাকে একটু আড়ালে ডেকে বলল -  যা না তৃষাকে একবার ডাক না।  হয়তো আমার ওপর রাগ করে আসছে না।  

আশা উত্তর দেয় - কাল থেকেই তৃষা বাড়িতে নেই। 

ইভা  - বাড়িতে নেই। 

আশা -  না। 

ইভা - কোথায় গেছে জানিস? 

আশা  - শুনেছি বাঁকুড়ায়?  ওখানে ওর কোন মাসি থাকে, তার বাড়ি গেছে।

ইভা  - সত্যি বলছিস? 

আশা - ওর মা তো সে কথাই বলল।

 

পাশে তাদের আরেক বান্ধবী পার্বতী দাঁড়িয়ে ছিল।  সে সব কথা শুনে বলল - আমরা জানতাম তৃষা তোর সবথেকে ভালো বন্ধু।  আর সেই তোর বিয়েতে  নেই। ব্যাপারটা কি বলত?

ইভা আগের ঘটনা চাপা দেবার জন্য বলল -  হয়তো হঠাৎ করে কোন কাজ পড়ে গেছে।  নয়তো বা জরুরি কোন খবর পেয়ে হয়তো যেতে হয়েছে ওকে।

 

আশা -  যাই বলিস প্রিয় বন্ধুর বিয়েতে থাকবো না তা কি হয়।কি বলিস পার্বতী?  তৃষা এটা ঠিক করল না। ওকে ত সবার আগে আশা উচিৎ ছিল। 

পার্বতী - একশো বার।  আমার হাজার কাজ থাকলেও যেতাম না। 

ইভা - ছাড় ওর কথা, চল আমরা ঘরে গিয়ে বসি। হয় তো যেকোনো সময় চলে আসবে। মানুষের কি কাজ পড়ে না। দরকার থাক্তেই পারে। 

পার্বতী  - চল ওদিকে আবার মৌমিতা রা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। 

ইভা - হ্যাঁ রে পার্বত তোর স্বপনের কি খবর রে? অনেক দিন দেখি না এদিকে।  

আশা - স্বপন?  আমরা তো ওর নাম বদলে রেখেছি শিব।

পার্বতী - সে তোরা যা ইচ্ছা রাখ, আমার কোন আপত্তি নেই।   

ইভা  - কোথায় আছে রে তোর শিব? 

পার্বতী - কোথায় আবার? এখন কলকাতায় থাকে।  সপ্তাহে দুদিন বাড়ি আসে। ওই দু দিন যা একটু  দেখা হয়। কাজের চাপ। তাই আসতে পারে না। বে সরকারি অফিসের কাজ। তবে এখন তনুন তো তাই একটু চাপ। 

আশা - তাও ভালো দু একদিন দেখা হয় বলে টান টা খুব বেশি জানিস। 

পার্বতী -  জানি তোর হিংসা হয়? আরে বা বা তোর হিংসার কি আচে বলতো। আমি কি তোর বরের ব্যাপারে কিছু বলেছি। 

ইভা -  বর? তাপর  আবার হিংসা? হিংসা  হবে কেন রে আশা? 

পার্বতী  - হবে না,  তোকে কিছু বলেনি আশা? 

ইভা - কই নাতো। আশা তো কিছু বলেনি।  কি ব্যাপারে আশা? 

আশা - ব্যাপার কিছুই না,  হব হব করছে ব্যাপারটা। 

ইভা - তা তোর বর মশাইটি কে শুনি? 

আশা - বর। হাসালি ইভা। এখন ও কিছুই হল না। 

ইভা - মশাই তী কে জান্কতে পারি কি?

আশা - কে  আবার। 

ইভা - হবু বরের নাম মুখে আনবি না নাকি? 

আশা- বলার সময় আর দিলি কোথায়?

ইভা - বল। 

আশা - সুজিত। 

ইভা - সুজিত? তাই নাকি।  শেষ পর্যন্ত সুজিত তোর প্রেমে হাবুডুবু তাহলে।

পার্বতী - হাবুডুব মানে,  আশা কে দেখে তো ফিদা। জান বলে চিঠি দিচ্ছে।  

ইভা - ওমা তাই। আর আমি কিছুই জানি না। তুই কিন্তু ভীষণ চাপা, জানিস আশা। 

আশা - কিছু হলে তো জানাবো। এখনো তো কিছু হল না। সবে পা দিয়েছি। 

পার্বতী - চল দেখি ঘরে।  ওই দেখ মৌমিতারা এদিকেই আসছে।

তিনজনেই এবার ঘরের দিকে হাটা দিল।তাদের হাসির কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে ওঠে সারা বাড়ি।ইভার অন্য বন্ধু বান্ধবী রা সবাই আসতে শুরু করেছে একে একে।    

 

রাতের সানাই এর সুর আরো দূর থেকে দূরে ছড়িয়ে পড়ে। আলোক  মালায় সেজে উঠেছে গোটা বাড়িটা।পাড়াময় একটা আলোর রোশনাই দেখা যাচ্ছে। কারণ প্রসুন দের বাড়িটাও তো বেশ দূরে নয়। অন্ধকারে পড়ে থাকে অহিনের বাড়িটা। সেখানে আলো জ্বালাবার কেউ নেই। জীবন এমনই বেদনাময়। কাউকে  কাঁদায় তো কাউ কে হাসায়।  

সুন্দর বেনারসিতে ভালো মানিয়েছে ইভা কে ।  ঠিক যেন সদ্য ফোঁটা কোন গোলাপ।  দলে দলে যুবক যুবতিরা আসে যাচ্ছে। কত আত্মীয় সজনের ভীড়। খাওয়া দাওয়া সে এক এলাহি ব্যাপার। রাত ন্টার নাগাদ শুরু হল বিয়ের আনুষ্ঠানিক পর্ব। মেয়েদের উলু ধ্বনি তে কেঁপে উঠছে বিবাহ মণ্ডপ। 

বাসর রাত ও বেশ জমে উঠল ইভার বান্ধবী আর প্রসূনের বন্ধু দের মধ্যে। সারা রাত যে কি ভাবে কেতে গেল কেউ বুজতেই পারল না।   

খুব ঘনঘটা করে বিয়ে হয়ে গেল  ইভার।  আত্মীয় থেকে শুরু করে বন্ধু- বান্ধবী সবাই ভীষণ আনন্দ করল।  পরের দিন সকালে বাবা মা পিসি আর আত্মীয়দের চোখের জলে ভাসিয়ে মৃদু মৃদু  নূপুরের শব্দ তুলে বিদায় নেয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ