তেরো অধ্যায়
সাইকেল থেকে নেমে জয়া অহিনের পাশে পাশে হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে বলে - আমার একটু কাজ আছে এই দিকে। দেখুন না বাড়িতে বসে ভালো লাগে না বলেই টুকটাক সেলাই করি। সেই সেলাই এর মাল আনতে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ আপনার সঙ্গে দেখা।
অহিন - কতদূর যাবেন?
জয়া - এখনো অনেকটা পথ। যাবেন নাকি সঙ্গে?
অহিন - না না আপনি যান। আমি হাটতে থাকি।
জয়া - চলুন আপনার সঙ্গে কিছুটা হাঁটি।
অহিন - আপনার কোন অসুবিধা না থাকলে আমার কোন আপত্তি নেই।
জয়া - না আমার আবার অসুবিধা কোথায়?
অহিন - মেয়েদের তো কত অসুবিধাই থাকে। লোক লজ্জা থেকে শুরু করে আরো কত কি।
জয়া - হ্যাঁ তার মধ্যে আবার আমি বিধবা।
অহিন -দেখুন কারো সঙ্গে কারো কোন রকম গল্প করতে আমার কোন আপত্তি নেই সে যেই হোক।
জয়া - তাইতো হওয়া উচিত।
অহিন - কিন্তু চারপাশের নজর আমাদের জটিল করে তোলে।
জয়া বলে - তারপর বলুন কতদূর যাবেন।
অহিন- যতদূর পারি হাঁটতে থাকি।
জয়া - সামনে একটা ছোট নদী পড়বে। তার ধারে যেতে পারেন।
অহিন আনন্দিত হয়ে বলে - নদী? কি নাম তার?
জয়া - এককালে সেই নদীর চেহারা ছিল ভয়ংকর। এখন তার চেহারা ক্ষীণ। নদীর নাম ফুলমতি?
অহিন হাসতে হাসতে বলে - নদীর চেহারা ছোট বা বড় যাই হোক না কেন , নামটা কিন্তু সুন্দর। ফুলমতি।
জয়া উত্তর দেয় - আরো সুন্দর তার দু পাড়।
অহিন - কেন?
জয়া - আমি যদি বলে দিই, তাহলে আপনার আগ্রহটা হারিয়ে যাবে।
অহিন - আমি তো চিনি না, যাবেন আমার সঙ্গে?
জয়া একটু মুচকি হেসে বলে - আপনি বললেন যখন যাব। ছোটবেলার স্কুল জীবনের অনেক স্মৃতি আছে ওখানে আমার।
অহিন - তাহলে তো বেশ ভালোই হবে। আপনার সেই স্মৃতি কথা শুনবো।
জয়া - আমার কথা শুনবেন? আর আপনার কথা কিছু বলবেন না?
অহিন - আমার জীবনটাই যে ফাঁকা। .
জয়া - সেদিন কিন্তু বলেছিলেন আপনার জীবন কাহিনী শুনতে গেলে প্রায় একরাত লেগে যাবে। মনে পড়ে?
অহিন - এত তুচ্ছ বিষয় যে আপনি মনে রাখবেন সে কথা ভাবতেই পারিনি। আচ্ছা আচ্ছা সে কথা বলা যাবে।
জয়া - এটা আবার মনে রাখার কি আছে বড় প্রশ্নের উত্তর তো নয় যে মনে রাখতে পারবো না।
অহিন - স্কুলের প্রশ্নের উত্তর আর আমার কথা কি কখনো এক হয়?
জয়া কোন উত্তর করে না। অহিন আর কথা খুঁজে পায়না। পায়ে পায়ে আরো বেশ খানিকটা এগিয়ে যাবার পর জয়া একটা বাঁকের কাছে এসে দূর থেকে নদী টা দেখায়। তারপর সেই বাঁক ঘুরে দুজনে এসে হাজির হয় ফুলমতি তীরে। ছিন্ন ভিন্ন একটা জলধারা অজগর সাপের মতন একে বেকে বয়ে চলেছে। নদীর স্রোত খুবই কম কিন্তু সত্যিই নদীর দু'ধারটা খুবই সুন্দর। সুন্দর একটা জায়গা দেখে দুজন বসে পড়ে। পাশে আড়াল করে দাঁড়িয়ে থাকে সাইকেলটা। যদিও সে আড়ালকে আড়াল বলা চলে না। ফুলমতির দুই ধারে গাছের সারি। রাতের অন্ধকারে মনে হবে কেউ হয়তো হাতে হাত রেখে সারবেধে পাহারা দিচ্ছে নদী টাকে। যেখানে ওরা বসেছে, সেটা একটা সবুজ ঘাসের সুন্দর চাতাল। সামনে দিয়ে ধীরগতিতে বয়ে চলেছে ফুলমতি, এই সুন্দর দৃশ্য অহিনকে আরো পুলকিত করে। নীল আকাশে উড়ে যাওয়া এক ঝাঁক পাখি দেখতে দেখতে বলে - অনেক ধন্যবাদ আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
জয়া মুচকি হেসে বলে - এতে ধন্যবাদ দেওয়ার কি দরকার?
অহিন - আপনার সঙ্গে দেখা না হলে বা আপনি না এলে এত সুন্দর একটা প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখা থেকে বঞ্চিত হতাম।
জয়া - কোন না কোনদিন ঠিক এই জায়গায় সন্ধান পেতেন।
অহিন - সে কথা থাক। আপনি বলছিলেন আপনার স্কুল জীবনের কি কি সব স্মৃতি কথা আছে এখানে।
জয়া - ছেলেবেলার স্মৃতি এখন কি আর ভালো লাগবে?
অহিন - আপনি না বললে ভালো লাগবে কি করে।
জয়া- বেশ শুনুন।
জয়া বলতে শুরু করে। অনেকদিন আগের কথা তখন সবাই প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে হাই স্কুলে ঢুকেছি। এক দুই বছর হবে। আমরা একদিন ক্লাস ফাকি দিয়ে চলে এলাম এখানে। এখান থেকে সামান্য এগিয়ে আমাদের স্কুলটা । ছোটবেলায় ভীষণ দুষ্টু ছিলাম। একটা দুষ্টু ছেলের থেকেও বোধ হয় আমি বেশি দুষ্টুমি করতাম। লোকের গাছের ডাঁসা পেয়ারা, কারোর গাছের পাকা কুল চুরি করে খাওয়া ছিল একটা সাধারন ব্যাপার। স্কুল থেকে পালিয়ে লোকের শসা খেতে শসা, কারোর গাছের পেয়ারা বা কুল চুরি করে এসে বসতাম এখানে। আমরা তিন-চারটে মেয়ে ছিলাম। এখানে এসে নদীর জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকবো। কোন কোন দিন নিজেদের ইচ্ছামত এ বাগান সে বাগান ঘুরে বেড়াতাম। ছোট ছোট গাছে পাখিদের বাসা ভেঙে দিয়ে আনন্দ পেতাম। হয়তো তাই ঘর ছাড়া হয়ে থাকতে হচ্ছে আমায়।
অহিন - তাই কি কখনো হয়।
জয়া একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলে - হয় অহিন দা হয়। ছোটবেলার গল্প বলতেও ভালো লাগে। ভেসে যেতে ইচ্ছা করে সেই ছোটবেলার দিনগুলোতে।
একটু থেমে জয়া আবার বলে - এবার আপনার কথা শুনবো।
অহিন - আমার তো কোন কথাই নেই , কি শুনবেন?
জয়া - আপনার ইচ্ছা না হয় বলবেন না।
অহিন - সে অনেক কথা। বহুদিন আগেই বাবা মাকে হারিয়ে একা হয়ে গেলাম। তারপর নিজের ইচ্ছামত ঘুরে ফিরে কোনদিন খাওয়া হতো কোনদিন হতো না। তার মধ্যে পড়াশোনা কোন রকমে চালিয়ে গেলাম। পড়ার মধ্যে অন্যদেরও পড়াতাম। আমার বন্ধুবান্ধব সাহায্য করত আমাকে। অভাব বুঝতে দেয়নি কোনদিন। তারপর এই কাজ পেলাম। একা ভালই চলছে। কোনক্রমে দুটো ভাত ফুটিয়ে রেখে চলে যাই। রাতে এসে তাই খেয়ে শুয়ে পড়া। নিজের বাড়ি কারো কিছু বলার নেই। কারো সাথে ঝামেলা নেই। কারো সাতে পাঁচে এ থাকার ব্যাপার নেই।
জয়া প্রশ্ন করে - আপনি কোনদিন কাউকে ভালবাসিনি? অথবা আপনাকে কেউ?
অহিন - কাউকে ভালোবাসার সুযোগ আসেনি। যদিও বা ভালোবাসি, সে আবার আমায় বাসে না। তবে ভালো লেগেছিল একজনকে।
জয়া - কি হল তারপর?
অহিন - জানিনা কি হলো। এই প্রথম জানিয়েছিল আমায় ভালোবাসার কথা।
জয়া একটু কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করে - তারপর কি হলো?
অহিন- তারপর আমিও যখন একটু একটু করে ভালবাসতে শুরু করলাম, তখন হঠাৎ সব এলোমেলো হয়ে গেল।
জয়া খুব আগ্রহ সহকারে বলল - কি হল বলুন তো?
অহিন - আমার স্বপ্ন ভেঙ্গে দিয়ে অন্য একটা ছেলের হাত ধরে আমারই সম্মুখে ………
জয়া - থাক, থাক আর বলতে হবে না। তবে আমার মনে হয় আপনি আরো আগে থেকে বেশি সতর্ক হতে পারতেন।
অহিন - ছোটবেলার চেনা জানা মেয়েটা কি করে এমন করবে কি করে জানবো।
জয়া - আপনি ওকে আগেই বলতে পারতেন?
অহিন - আমি অপেক্ষা করে দেখতে চাইছিলাম ও সত্যিই আমাকে ভালোবাসি কিনা। কিন্তু পরীক্ষায় পুরো ব্যর্থ।
জয়া - তাই বোধহয় রাগ করে চলে এলেন?
অহিন - ঠিকই ধরেছেন?
জয়া - কোন কথা খুঁজে পায় না। অহিন ও কিছু বলে না। সূর্য ধীরে ধীরে মাথার উপর উঠে গেছে। রোদ বেশি চড়া হয়েছে। গাছের ছায়া দুজনার মাথা থেকে সরে গেছে। জয়া - চলুন ওঠা যাক আর বসা যাবে না।
অহিন বলল - চলুন ওঠা যাক। আপনি আবার আপনার কাজে যাবেন।
জয়া - একদিন নাইবা গেলাম। আপনার সঙ্গেই বাড়ি ফিরব।
দুজনেই চলতে শুরু করে। মনে হয় দীর্ঘদিনের চেনা দুটি মানুষ হেটে চলেছে আপন মনে। বেলা তখন বেশ বেড়েছে। রোদের জোরও বেড়েছে অনেকটাই। কিন্তু নতুন একটা বন্ধুত্ব হয়ত সেসব কিকে ভুলিয়ে দিচ্ছিল।
0 মন্তব্যসমূহ