নূপুরের শব্দ ১২

  বারো অধ্যায়

 


সম্পূর্ণ এক নতুন জায়গায় এসে উপস্থিত হয় অহীন। অফিসের কাছাকাছি একটা ছোট্ট বাড়ি ভাড়া নিয়ে অহিন বেশ ভালো আছে সে।  একটু একটু করে গুছিয়ে নেয় ঘরটা। একা থাকাটা অহিনের কাছে নতুন নয়। সবই পারে। বিগত কয়েক বছর ধরে চেষ্টা করে কোনরকমে দুটো ফুটিয়ে নিয়ে খাওয়াতে অভ্যস্ত  হয়ে উঠেছে। কয়েক বছর ধরে চেষ্টা করেও রান্নাটা ভাল করে শিখে উঠতে পারল না।  কোনরকম রান্না করে দুবেলা খাওয়াতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছে। খাওয়া নিয়ে অহীনের কোনদিন কোন ঝামেলা ছিল না, আজও নেই। অহিন এখন যেখানে এসেছে তার নাম ঝাউতলা। বাঁকুড়ার একটা আধা শহর, আধা গ্রাম। মানুষগুলো সরল সাদাসিদে ।  নতুন অফিসের দু-একজনের সঙ্গে বেশ ভালো পরিচয় হয়েছে।  মাঝে মাঝে সন্ধ্যেবেলায় তাদের বাড়িতে একদিন দুদিন গিয়ে সময় কাটিয়ে আসে।  বাকি দিনগুলো অলস ভাবে জানালায় দাঁড়িয়ে অথবা শুয়ে গল্পের বই পড়ে কেটে যায়। ঝাউ তলাটা ঠিক গ্রাম বলা চলে না।  আবার শহরও বলা চলে না।  শহরের ছোঁয়া যেমন আছে তেমনি আছে গ্রামের ছোঁয়া। পাড়ার মোড়ে মোড়ে কয়েকটা দোকান।  চায়ের দোকানে সকাল সন্ধ্যায় যুবকদের আড্ডা আছে। কোনো কোনদিন অফিস থেকে না ফিরে বেরিয়ে পড়ে অজানা অচেনা গ্রাম বা শহরটি দেখতে।  বাড়ি ফেরে হয়তোবা রাত নটা বা দশটা‍য়। তবু যেন সময় কাটেনা।  হঠাৎই ওর মনে হয় সন্ধ্যাটা কয়েকজন ছাত্র পড়ালে বেশ সময়টা কাটে।  পয়সা যা পাক আর না পাক তাতে আসে যায় না।  অন্তত সময়টা তো কাটবে।  কয়েকদিনের মধ্যেই মিলে গেল দুটো ছাত্র। সন্ধ্যা হলে অহিন চলে যায় তাদের বাড়িতে পড়াতে। একজনের নাম অজয়, আর একজনের নাম বিজয়। অলস পায় কখনো বাড়ি ফেরে কখনো বা পাড়ার কোন একটা চায়ের দোকানে ঢোকে সেখানে দু-একজনের সঙ্গে পরিচয় আছে। সেখানেই তাদের সঙ্গে একটু-আধটু গল্প গুজব করে বাড়ি ফেরে। 

 

এমন ই একদিন পড়তে গেছে সে,  কিন্তু ঘরে গিয়ে শোনে অজয় বা  বিজয় কেউ বাড়িতে নেই। ওরা মামার বাড়ি গেছে। অহিন ঘর থেকে সবে পা বাড়িয়েছে ফিরবে বলে। তখন এক ভদ্রমহিলা এসে দাঁড়ালো তার সামনে,  বলল -  আপনি বসুন না? বাড়ি গিয়ে কি করবেন ওরা বাড়ি থাকলে তো পড়াতেন। 

অহিন এর আগে কখনো এই ভদ্র মহিলাকে এ বাড়িতে দেখেছে বলে মনে করতে পারেনা।  

  • আপনি কে?  আপনাকে তো দেখিনি কখনো। 

মহিলা উত্তর দেয়। আমি ওদের দিদি। বাড়ির ভিতরে কাজে ব্যাস্ত থাকি তাই কখন দেখেন নি আমায়। আপনার যদি আপত্তি না থাকে তাহলে একটু বসুন না। 

অহিন একটু ইতস্তত বোধ করে,  

বলে - না মানে আপনি একা আছেন তো তাই। 

জয়া  - তাতে কি? আপনার সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছা হল তাই।

অহিন  - এতদিন ছিলেন কোথায়? 

জয়া  - এইভাবে দাঁড়িয়ে কথা বলা থেকে বসে কথা বলি। 

ইচ্ছা না থাকলে অহিন  উত্তর দেয়  - চলুন বসি। 

দুজনেই ঘরের ভিতরে ঢোকে। অহিন  একটা চেয়ার আর জয়া বসে চৌকির উপর। 

অহিন -  আপনি এখানে ছিলেন,  অথচ আপনাকে দেখলাম প্রথম কেন বলুন তো/ 

জয়া -  আপনি যখন আসেন তখন আমাকে ঘরের কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়।  অনেকবার ইচ্ছা হয় আপনার সঙ্গে গিয়ে কথা বলি কিন্তু সময় পাই না।  তাই আজ ঠিক করে রেখেছিলাম আপনার সঙ্গে কথা বলব।  আগে থেকেই সব ঠিক করে রেখেছি। কাজও গুছিয়ে রেখেছি।

 

অহিন - আপনি পড়াশোনা করেন কিছু?  

জয়া - পড়তাম ক্লাস নাইনে পড়ার সময় বাবা আমার বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল। 

অহিন  - আপনি বিবাহিত? 

জয়া  একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে,  বলে - বিবাহিত ছিলাম কিন্তু এখন বিধবা। 

অহিন -  বিধবা । 

জয়া -  বিশ্বাস হচ্ছে না দেখে?  তিন বছর আগে আমার বিয়ে হয়। আর গত দেড় বছর আগে একটা গাড়ির ধাক্কায় আমার স্বামী মারা যায়।  তারপরে বাবা এখানে এনে রেখেছে।  যদিও না এনে উপায় ছিল না। 

অহিন -  শ্বশুর বাড়ির লোক খুব অত্যাচার করতে বুঝি? 

জয়া - সে কথা শুনে কি হবে?  আপনার কথা বলুন না।  আপনার বউকে নিয়ে আসবেন একদিন।

অহিন  - আমার কথা আর কি শুনবেন।  সারাদিনেও শেষ হবে না।  আর বউয়ের কথা বলছেন ,  বিয়েই তো করলাম না।

জয়া - সেকি এটা কিন্তু আপনি ঠিক কাজ করেননি।

  •  কেন বলুন তো বিয়ে না করে  ঠিক কাজ করিনি কেন? 

 

  •  উপযুক্ত বয়স হয়েছে, তাই বললাম। 
  •  বিয়ে করতেই হবে এমন দিব্যি বা কে দিল। 
  •  বিবাহিত জীবনের সুখটা আপনি পাচ্ছেন না অথচ ইচ্ছা করলেই পেতে পারেন। 
  •  কাকে বিয়ে করবো বলুন। কেউ তো আমাকে চায় না। 

জয়া হেসে বলে  - মশাই কি প্রেমে পড়ে ঠকে গেছেন? 

  •  না তেমন কোনো ব্যাপার নেই। 
  • তাহলে আপনাকে পছন্দ না করার কথা বলছেন। আপনাকে পছন্দ না হওয়ারও তো কারণ নেই। 
  •  আপনি নিজে হলে কি করতেন? 

জয়া একটু থামে।  একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। তারপর বলে - যদি সে সুযোগ থাকতো তাহলে দেখতেন। 

  •  এমনি করেই সব সুযোগগুলোই হারিয়ে যায় আর আসে না। 

 

জয়া একটুখানি হেসে উত্তর দেয় -  আপনি চেষ্টা করুন।  উপযুক্ত সঙ্গী ঠিক জুটে যাবে। 

  • বলছেন
  • বলছি, যদি দায়িত্ব দেন তো একটা খুঁজেও দেখতে পারি।
  • আপনার মত সুন্দরী হওয়া চাই কিন্তু।

জয়া একটু হেসে বলে - আমাকে সুন্দরী বলছেন । আপনার জন্য মেয়ে খুঁজে দেবো বলে।

  •  আপনি খুজবেন না   তৈরি করবেন সেটা আপনার ব্যাপার। কিন্তু সুন্দরকে সুন্দর বলতে কখনো পিছু  পা হইনা।
  • তাহলে সত্যিই খুঁজবো বলছেন? 
  • দেখুন যদি খুঁজে দিতে পারেন। 
  • বিয়েতে কোন আপত্তি থাকবে না তো?
  • আগে তো খুঁজুন। আচ্ছা আজ কিন্তু আমায় উঠতে হবে।
  • একটু বসুন।
  • পরিচয় তো হলো।  অন্য দিন না হয় কথা বলা যাবে। 
  • চলুন আপনাকে একটু এগিয়ে দিয়ে আসি। 
  • আপনি একা আছেন,  হয়তো আপনাকে আবার পৌঁছে দিতে হবে।

জয়া হাসতে হাসতে বলে -  ভালোই হবে এইভাবেই রাত কেটে যাবে।

অহিন - ভালোই হবে।  আজ থাক। 

অহিন ঘর থেকে বেরিয়ে পা বাড়ায় রাস্তার দিকে, ঘরের চৌকাঠে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে জয়া। 




এক রবিবারের সকাল বাড়ির কাজ শেষ করে অহিন উদ্দেশ্যহীনভাবে বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়।  হাঁটতে থাকে এদিক ওদিক।  হঠাৎ করে কেউ দেখে বলবে হয়তো পাগল। পাকা রাস্তা শেষ করে কাঁচা রাস্তা ধরে। বোঝাই যায় বর্ষাকালে এই রাস্তার হাল কেমন থাকে।  এখন বর্ষাকাল নয়, রাস্তা বেশ ভালো কোথাও কোথাও একটু উঁচু উঁচু হয়ে রয়েছে রাস্তার দু-ধার দিয়ে সবুজ গাছপালা রাস্তার উপরে এসে পড়েছে।  গাছের ছায়া একটা বিরল মায়া সৃষ্টি করেছে রাস্তার মাঝে । অহিন আরো আনন্দ পায়। হাঁটতে থাকে সে।  রাস্তার দুপাশ থেকে কত রকমের পাখির ডাক আসে । মাঝে মাঝে দু একটা বোন ফুলের গন্ধ আসে না্কে।  কোথাও কোথাও দু একটা প্রজাপতি উড়ে যায়।  কেমন একটা নতুন জগৎ বলে মনে হয়।  এমনিতেই রাস্তাটা ফাঁকা মাঝেমাঝে একজন দুজন সাইকেল আরোহি বা দু একজন হেঁটে চলেছে। রবিবারের সকাল বলে অহিনের তেমন কোন তাড়াহুড়া নেই।  উদ্দেশ্যহীন এর মতন হেঁটে চলেছে সে। কখনো হয়তো মনে পড়ে যাচ্ছিল তার শৈশবের কথা। এমনি করেই শৈশবের আমবাগান জাম বাগান আর বাঁশ ঝাড়েরের মধ্যে দিয়ে ঘুরে বেড়াতে যে কি ভালই না লাগতো তখন।  আজ অনেকদিন পর সেই ভালোলাগাগুলোই আবার ফিরে এলো মনে।  কখনো বা দু একটা ক্লান্ত পাখির অস্পষ্ট ডাক শোনা যায়। অমনি ঘুরে দেখে কোন পাখি কোথায় আছে। হঠাৎ পিছন থেকে সাইকেলের কলিংবেলের বিকট আওয়াজ এ দাঁড়িয়ে পড়ে অহিন । পিছনে ঘুরে দেখে জয়াকে।  কিছুটা অবাক হয়েই প্রশ্ন করে  - আপনি? 

জয়া একগান হেসে বলে -  আমিও তো তাই ভাবলাম আপনি? আর  কোথায় চলেছেন  কানে তালা চাবি লাগিয়ে?  বাপরে বাপ সেই কখন থেকে বেল বাজিয়ে যাচ্ছি।  তো যাই হোক আমারও তো একই প্রশ্ন আপনি এই পথে একা?অহিন  - রবিবার ছুটির দিন। কাজ নেই। তাই প্রকৃতি দেখতে বেরোলাম।

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ