চৌদ্দ পর্ব
ঘরে উর্মি আর সুজয় বাবু বসে টিভি দেখছিল। ভালো বাংলা বই। দেখতে দেখতে সুজয় বাবু বললেন- আজকাল টিভিতে এত অ্যাড দেখায় না, ভালো করে বই দেখবার মজাটাই পাওয়া যায় না।
উর্মি উত্তর দেয় - একদম ঠিক বলেছ বাবা।
সুজয় বাবু- সেদিন টিভিতে ওই ছেলেটাকে দেখাচ্ছিলো রে জানিস।
উর্মি - কোন ছেলেটাকে।
সুজয় - ওই যে ছেলেটা, তোদের কলেজে পড়তো সরকারি পুরস্কার পেল।
উর্মি - ও তাই নাকি।
সুজয় - শুনেছি ছেলেটা ভীষণ ভালো কিন্তু আবার অবস্থাটা ততটা ভালো না।
উর্মি - তাড়াতাড়ি বলে কে বলল? আমি তো শুনেছি যে অবস্থা ভালো।
সুজয় বাবু - যাক গে ওইসব নিয়ে আমাদের মাথা ব্যথায় লাভ নেই । কে?
দরজা পর্দা সরিয়ে উর্মির মা বলল - তোমায় ডাকছে সন্তোষ। কি যেন কথা আছে।
সুজয় বাবু - তা ওকে উপরে পাঠিয়ে দাও।
উর্মি - উপরে কেন বাবা। তুমি যাও না নিচে। এখানে এলে আমার বইটা আর দেখা হবে না।
সুজয় - কেন?
উর্মি - ও তুমি বুঝবে না। যাও তুমি নিচে।
এমন সময় ঘরের দরজার সামনে - আসতে পারি কাকু ?
সুজয় বাবু সন্তোষ কে দেখে বলে - ও সন্তোষ আরে এসো বাবা এসো।
হাতে একটা ব্যাগ গায়ে সবুজ রঙের শার্ট মাথার চুল একটু কোঁকরা কোঁকরা। সন্তোষ ঘরে এসে বসলো।
সুজয় বাবু একটি চিয়ারে এগিয়ে দিয়ে বসতে বলল। সন্তোষ বসার আগে ঊর্মীর দিকে একবার ভালো করে দেখে নিল।
সুজয় বাবু - হ্যাঁ কি ব্যাপার বলো।
সন্তোষ - জায়গাটা নিয়ে ওরা আবার মামলা করেছে তাই আপনার কাছে এলাম।
সুজয় - জায়গাটা কতটা হবে?
সন্তোষ- প্রায় ১০ কাঠা। জায়গাটা হলে ওখানে গুদামঘর আর একটা অফিস করতে হবে। না হলে ভীষণ অসুবিধায় পড়েছি। অত মাল রাখবার জায়গা তো দরকার।
সুজয় - তোমার কোন চিন্তা নেই। আমি তো আছি। আচ্ছা তুমি বস। আমি নিচ থেকে তোমার কাগজ আর নোটিশ গুলো নিয়ে আসি।
বলে নিচে চলে গেলেন। ঘরের সন্তোষ আর উর্মি।
সন্তোষ বলল- তুমি আমায় চিনতে পারছ না নাকি? আমি এলে তুমি একেবারে চুপচাপ হয়ে যাও কেন?
উর্মি - তোমায় না চেনার কি আছে? একসঙ্গে পড়েছি অনেক দিন মনে থাকবে না?
সন্তোষের মনে আশার আলো দেখা দিলো, বলল - কিন্তু আমি এলে তুমি অন্য কোথাও যাও। না হলে চুপ করে বসে থাকো। ব্যাপারটা ঠিক বুঝিনা।
উর্মি - তুমি আসো তোমার কাজে। তাই সেখানে আমি নাক গলাই না, তাছাড়া ওটা আমার ভালোও লাগে না। আর এক সঙ্গে পড়েছি বলে এই নয় যে গায়ে পরে বন্ধুত্ব করতে হবে। তাছাড়া আমার ভালো লাগে না।
সন্তোষ - আমাকে ভালো লাগে না?
উর্মি - সেরকম তো মনে হচ্ছে । এখানে অন্য কাউকে নেই।
সন্তোষ - কিন্তু আমি তো তোমায় …
উর্মি উত্তর দেয় - ভালবাস।
সন্তোষ - হ্যাঁ ভীষণ।
উর্মি - তোমরা কি মনে কর মেয়ে রা ভালোবাসার যন্ত্র। বললেই হলো। আমি তোমায় কোনদিনও ভালবাসতে পারব না।
সন্তোষ - তোমার বাবা-মা তোমার বিষয়ে আমার সঙ্গে কথা বলেছেন।
উর্মি - তারা বলতেই পারে, কিন্তু আমি তো এখন বড় হয়েছি আমারও একটা স্বাধীন মতামত আছে।
সন্তোষ - তুমি কি অন্য কাউকে…
উর্মি - সে কথার উত্তর আমি তোমায় দেবো না।
সন্তোষ - তোমার জন্য তোমার সুখের জন্য আমি সবকিছু দিয়ে দেব। শুধু তুমি বলো আমায়…
কথা শেষ হওয়ার আগেই উর্মি বলে ওঠে থাক আর আদিখ্যেতা করতে হবে না। আমি তোমার হাতে আমার সুখ চাই না।
সন্তোষ - রেগে গেলে? মাথা ঠান্ডা করো।
উর্মি - আমার মাথা সবসময় ঠান্ডাই থাকে।
বাইরে পায়ের শব্দ হতে দুজনে চুপ করে গেল। সুজয় বাবু এবং তার স্ত্রী দুজনে এলেন। সুজয় বাবুর স্ত্রী নির্মলা দেবী বিছানায় বসলেন উর্মির পাশে।
নির্মলা - তোরা বোবা নাকি ঘরে দুজনে বসে আছিস কোথায় গল্প করবি, কথা বলবি তা না চুপ করে বসে আছিস।
উর্মি - তোমরা কথা বলো মা। আমি নিচে যাচ্ছি। কথাটা শেষ করে উর্মি বিদ্যুৎ বেগে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।।
নির্মলা - দেখলে মেয়ের কাজ দেখলে।
সুজয় - ওর রাগ হল এই বাংলা বইটা দেখতে পেল না তাই।
নির্মলা - কি এমন বই। যাক তুমি ওর কাজটা সেরে ফেল। আমার কিছু কথা আছে। আমি পাশের ঘরে আছি তোমাদের কাজ হলে আমায় ডাক দিও।
নির্মলা দেবী অন্য ঘরে চলে গেলেন কিন্তু মিনিট পাঁচেক পরে আবার ফিরে এলেন।
কি কাজ হল?
এইমাত্র শেষ হলো
তবে কথা বলি
হ্যাঁ যা বলার বলে ফেলো
নির্মলা দেবী সন্তোষের দিকে দৃষ্টি নিপাত করে বললেন তোমার কি বলেছিলাম মনে আছে সন্তোষ।
সন্তোষ উত্তর দেয় - কি কথা বলুন তো? আমার তো ঠিক মনে পড়ছে না।
নির্মলা দেবী বললেন - ওই যে বিয়ের কথাটা।
সন্তোষ - আমিতো রাজি কিন্তু কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। ঘরটা এখনো শেষ হয়নি।
সুজয় বাবু এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন তিনি বললেন - শেষ করে তবেই দিনক্ষণ ঠিক করব।
সন্তোষ - কিন্তু উর্মি যদি রাজি না হয়।
নির্মালা দেবী বললেন তোমায় কোনো চিন্তা করতে হবে না ও আমাদের কথা অমান্য করতে পারবে না।
সন্তোষ - আজ উঠি তাহলে।
নির্মলা - আচ্ছা আবার এসো তাহলে।
সন্তোষ আসবো।
নির্মলা দেবী - এসো বাবা দুগ্গা দুগ্গা।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার পথে। সূর্য তার রক্তিম আভা দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছে প্রাকৃতিক পরিবেশ। শরৎকাল মৃদু মৃদু বাতাস বইছে। গাছপালা গুলি গা দুলিয়ে নাচে মেতে উঠেছে। পাখিরা বাসায় ফিরেছে। রাস্তার ধারে ধারে বড় বড় প্রাসাদের মতো বাড়ি। এক পাশে নির্মিত হচ্ছে সন্তোষের বাড়ি এবং অফিস। প্রতিদিন সন্তোষ বিকেল বেলা বাড়ির কাজ দেখতে আসে। বাড়ির কাজ দেখা শেষ হলে, রাস্তার ধারে রেলিংটা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। হঠাৎ অনেক দূরে, কাকে দেখে যেন একটু বিস্মিত হয়ে গেল। ভালো করে তাকিয়ে দেখলো তার ভাবনাই ঠিক। উর্মি এই বিকেলে একলা কোথায় গিয়েছিল কে জানে। কোন বন্ধুর বাড়ি হতে পারে কিন্তু বন্ধুর বাড়ি এদিকে? হতে পারে। এই পথে আসতে দেখে, একটু অবাকই হলো সন্তোষ।। সন্তোষ ভাবল ও এদিক থেকে যদি যায় তবে ওর বাড়ি যেতে তো অনেকটা ঘুর পথ হবে। তাহলে এদিকে কেন আসে। যাক আসলে জিজ্ঞাসা করে জানা যাবে। আহা কি অপরূপ রূপ লাবণ্য ভরা নদীর মতো যৌবন টলমল করছে। বাতাসে মাথার অগ্রভাগের চুলগুলি মুখের উপর এসে পড়েছে। কতগুলি আবার ডানা মেলে উড়তে চাইছে । সন্তোষ মনে মনে বলে ধীরে উর্মী ধীরে হাঁট। আমি তোমায় একটু দেখি। আজ তোমায় ভীষণ ভালো লাগছে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে সে তন্ময় হয়ে যায়। উর্মি ও কাছে এসে পড়েছে। সন্তোষ একবার ভাবল ডাকবে কিন্তু সাহস হলো না। দ্রুত পদব্রজে উর্মি বাড়ির দিকে চলে গেল। সন্তোষ হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো সন্তোষ ধীরে ধীরে বাড়ি ফিরল কিন্তু কিছুই ভালো লাগলো না ওর। কি করবে ভাবতে ভাবতে বিছানায় শুয়ে অর্ধনিদ্রায় ডুবে গেল স্বপ্নপুরীর লাল নীল দেশে। কত ছবি ভেসে এলো তার চোখে। পাহাড়ের গা দিয়ে নেমে এসেছে স্রোতস্বিনী তিস্তা নদী। কি পরিষ্কার তার জল। ঠান্ডা জল কুলু কুলু করতে করতে বয়ে চলেছে আপন মনে তার আপন পথে। আর তার তীরে অর্ধ নিমজ্জিত এক নারী। না নারী নয় যৌবনবতী এক যুবতী। আর অনেক দূরে একটা গাছের আড়ালে সন্তোষ। ভেজা শরীর যৌবন যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। সন্তোষ, ধীরে যাও উর্মী। ধীরে যাও। জলে বড় স্রোত। আরেকটু দাড়াও ওইখানে তোমায় একটু দেখি দাড়াও উঠোনা। বাইরের দরজায় কড়া নাড়া চলছে। হঠাৎ তার ঘুম ভেঙে গেল হারিয়ে গেল। স্বপ্ন হারিয়ে গেল তিস্তার শীতল জলে।
সন্তোষ দরজা খুলে দেখে প্রীতিশ।
প্রীতিশ - বাবা কখন থেকে ডেকে চলেছি।
সন্তোষ - একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম রে। আয় ঘরে আয়। কিন্তু তুই এই সময়ে কি ব্যাপার?
প্রীতিশ - অসময়ে এটাই তো সময়। সারাদিন সময় পাইনা তাই রাতে তোর সঙ্গে একটু গল্প করতে এলাম। অনেকদিন হলো তোর সঙ্গে তো কোন দেখা-সাক্ষাৎ নেই আর তুইও যাস না।
সন্তোষ - আমিও সময় করে উঠতে পারি না রে। তারপর তোর লেখার কাজ কেমন চলছে বল?
প্রীতিশ - এখন একটু কমিয়ে দিয়েছি। আশা করছি একটা চাকরি পাব তাই এদিক-ওদিক সময় দিতে হচ্ছে। এদিকে আবার মাঠের ফসলও দেখাশোনা করতে হচ্ছে। চাকরিটা হয়ে গেলে জমিগুলো ভাগে চাষ করতে দেব।
সন্তোষ - হ্যাঁ ঠিক ভেবেছিস, কিন্তু কিসের চাকরি রে?
প্রীতিশ- শিক্ষকতার আমাদের স্কুলে। এই পুরস্কারটা পেয়েই অনেক সুবিধা করে দিল। এতক্ষণ তো সব আমার কথা হল। তোর ব্যবসা কেমন চলছে বল।
সন্তোষ - ভালো। বাড়িটাও প্রায় শেষ হওয়ার পথে।
প্রীতিশ - এবার একটা বিয়ে করলে করে ফেল।
সন্তোষ - তুই থাকতে আমি আগে, তোর যা পরিচিতি।
প্রীতিশ - আমার তো কিছুই নেই। কে মেয়ে দেবে।
সন্তোষ - তোর যা আছে। চাষের লাভ আমি বুঝিনা?
প্রীতিশ - মনে?
সন্তোষ - মানে আর কি বাইরের লোক জানে না অথচ দিন দিন ….
প্রীতিশ - বাজারের অবস্থা তুই আমার থেকে ভালো জানিস। তবুও যদি।
সন্তোষ - আচ্ছা বাদ দে এসব । নতুন লেখা কিছু বেরোলো
প্রীতিশ - আগামী মাসে একটা ছোট গল্প সংকলন বেরোবে।
সন্তোষ - প্রথম বইটা আমায় দিস।
প্রীতিশ - না ভাই প্রথমটা অন্য এক জনের, তুই দ্বিতীয় টা নিস।
সন্তোষ হেসে - কেরে তোর…
প্রীতিশ - পরে বলব। বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। আজ আসি রে তুই যাস একদিন বাড়িতে।
বলেই চলে গেল। সন্তোষ ভাবলো কেন এলো ওর কি কোন দরকার ছিল? যা বলতে পারল না আমায়। না এমনিতেই এসেছিল। কিছু তো বুঝতে পারছি না। কোন এক মানসিক ঘোর যে আমার মনকে নাড়া দিচ্ছে কি জানি। আমি বোধহয় .. এমন সময় সন্তোষ এর মা এসে বলে চল বাবা খেতে চল। আগেও একবার ডেকেছি।
সন্তোষ মায়ের সাথে খেতে চলে গেল।
সবার খাওয়া শেষ প্রীতিশ এসে পড়াতে সন্তোষের খাওয়া হয়নি। অবশ্য মারও তখন খাওয়া হয়নি, মা ছেলে খেতে বসল। খেতে খেতে মা বলল - অনেকদিন ধরে ভাবছি তোকে একটা কথা বলি। কিন্তু সে রকম সময় পাইনা। আজকেও নেই তাও বলছি, তোর তো বয়স হয়েছে এবার যদি মত দিস তো একটা মেয়ে দেখি।
সন্তোষ - আগে নতুন বাড়িটা হোক। আর তোমায় কষ্ট করে এই মেয়ে দেখতে যেতে হবে না।
মা বললেন - তুই কাউকে ভালবাসিস। দেখ তোরা বড় হয়েছিস আজ আর আমার কিছু বলার নেই। তবে মেয়েটা ভালো তো কোথায় থাকে।
সুজয়বাবুর মেয়ে।
ও তাই নাকি? তা অত বড় ঘরের মেয়ে আমাদের ঘরে মানিয়ে নিতে পারবে তো?
পারবে।
তাহলে একদিন গিয়ে দেখে আসতে হয়। আর হ্যাঁ ওর বাড়ির লোক রাজি হবে কিনা।
সন্তোষ উত্তর দেয় - ওর বাবা- মাই তো আমাকে বলল।
মা বললেন তাহলে তো কোন কথা নেই।
কথা বলতে বলতে খাওয়া শেষ হয়ে এলো। খাওয়া শেষ হলে মা চলে গেলেন নিজের ঘরে। সন্তোষ চলে এলো সন্তোষের ঘরে।
0 মন্তব্যসমূহ