তেরো পর্ব
সন্তোষের বাড়িতে এমনকি পাড়ায় আজ খুব আনন্দ। বহুদিন পর সে ঘরে ফিরেছে। আবার পাড়ার দুটি ছেলে দুদিন হল নতুন চাকরি পেয়েছে। পাড়ার সকলের মুখে হাসি ফুটেছে। পাড়ার তরুণরা সব দল বেঁধে চলেছে রাস্তার দিকে। এরা সব প্রীতিশের ভক্ত। বেলা তখন যায়যায়। আমতলায় তরুণ তরুণীদের ভিড়ে একেবারে একাকার হয়ে গেছে। দুজন পথ চলার মাঝে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করছে ব্যাপার কি? একটা ছোকরা বলে - আরে মশাই জানেন না? আজ আমাদের প্রীতিশদা কলকাতা থেকে বিখ্যাত সব পুরস্কার নিয়ে ফিরবে। আমরা তো ওর জন্যই অপেক্ষা করছি।
বলতে বলতে বাস এলো। বাস থেকে নামলো অনেকেই কিন্তু প্রীতিশ কই ? আবার অপেক্ষা করতে হলে। পরের বাসের জন্য। পরের বাসায় চলে গেল কিন্তু প্রীতিস কোথায়। হঠাৎ একটা পুলিশের গাড়ি এসে দাঁড়াল। সবাই চুপ। একটা পুলিশ বেরিয়ে এসে বলল আপনারা যার জন্য অপেক্ষা করছেন তিনি আমাদের সঙ্গে আছেন, তবে ভয় নেই আমরাই ওনাকে নিয়ে এসেছি। এটা সরকারি নির্দেশ। সঙ্গে সঙ্গে সবার মুখে হাসি ফুটল। প্রীতিশ বেরিয়ে এলো। গলায় সোনার পদক। সবাই করতালি দিয়ে অভিনন্দন জানাতে লাগলো। পুলিশ ভ্যান বিদায় নিল। পাড়ার ছেলেরা প্রীতিশ কে কাঁধে করে তুলে নিয়ে এলো গ্রামে। সে কি আনন্দ। দু তিন দিন ধরে চলল আনন্দের বন্যা। এটাই গ্রামের রীতি, গ্রামীন আনন্দের অন্যরকম অনুভূতি।
বাড়িতে একটা ভোজের আয়োজন করা হয়েছে। এখানে প্রীতিশের সব বন্ধু-বান্ধবরা আসবে। দুই দিদি এসেছে। পারমিতা প্রায় ছয় বছর পর বাপের বাড়ি এসেছে। আগের বাড়ির চেহারা আর নেই। মাটির বাড়ি সুন্দর পাকা হয়ে গেছে। ছোটবেলায় মানুষ হওয়া নিজের গ্রামে ঢুকে অপরের মুখে শুনে নিজের বাড়ি চিনতে হয়েছে। মেজটার দু'বছর হলো বিয়ে হয়েছে ও আগেই এসেছে এখানে। বন্ধুদের মধ্যে প্রদীপ সন্তোষ আর পাড়ার কয়েকজন আছে। আগামী দিনগুলোর জন্য প্রার্থনা করলো সবাই। খাওয়া শেষে একে একে বিদায় নিল। প্রদীপ একটু দেরি করেই যাবে। মাসে দু তিনবার প্রদীপ এখানে আসে। প্রীতিশ মাঝেমধ্যে যায় প্রদীপের বাড়িতে।
দুইজন একটা ঘরে এসে বসে। প্রদীপ বলল - সন্তোষ এ কদিনে তো বিরাট ব্যবসা করে নিল রে, তারপর আবার দেখি বিশাল বাড়ি তৈরি করেছে ব্যাপার কি? এত তাড়াতাড়ি এত টাকা পেল কোথায় বলতো।
প্রীতিশ সবই জানে তবু বলল - আমিও তো তাই ভাবি। এ বাজারে কয়েক লক্ষ টাকার বাড়ি, আমদানি রপ্তানির ব্যবসা, কি করে সম্ভব কি জানি!
প্রদীপ - দু'নম্বরী ব্যবসা বা কালো টাকা ছাড়া এসব সম্ভব না। উর্মির বাবার সঙ্গে ওর কি করে পরিচয় হলো ঠিক জানিনা। উর্মি বলছিল ওর বাবার নাকি সন্তোষকে খুব ভালো লাগে। কি একটা দরকারে ওর বাবা সন্তোষের সাহায্য পেয়েছিল ব্যাস। ব্যাপারটা লক্ষ্য রাখিস কিন্তু। সেদিন উর্মির সঙ্গে দেখা হয়ে ছিল, ওর কাছে শুনলাম। আর হ্যাঁ ও তোকে দেখা করতে বলেছে।
প্রীতিশ - কদিন এত ব্যস্ত না, একদম সময় পাচ্ছিনা। খুব রাগ করছিল বোধহয় তাই না।
প্রদীপ - তা তো একটু করবেই ভাই। এই রে আমার আবার বাসের সময় হয়ে গেল। চল আজ উঠবো।
প্রীতিশ -চল তোকে পৌঁছে দিয়ে আসি।
দুজন চলল রাস্তার দিকে। প্রদীপকে বাসে তুলে দিয়ে এলো। বাড়ি এসে চুপিচুপি পারমিতাকে বলে - চল দিদি তোকে দেখিয়ে নিয়ে আসি। মাকে বলবি না কিন্তু। তাহলে এক্ষুনি চিৎকার শুরু হবে। মা আবার কাকে যেন দেখে রেখেছে।
পারমিতা দেখল মা আর সুমিতা এক ঘরে ঘুমাচ্ছে। দুজনে চলল আম বাগানের পথ ধরে। তখন দুপুর সবে গড়িয়েছে। সূর্য অল্প অল্প করে পশ্চিমে হেলে পড়েছে পাখিরা কিচিরমিচির করছে, এখন তাদের বাসায় ফেরার পালা। পাখির ডাকে কান একেবারে ঝালাপালা করছে। দূর থেকে উর্মীদের বাড়িটা দেখিয়ে দিল ব্রিটিশ। বাগানের আঁকাবাঁকা পথ ধরে দুই ভাই বোন এগিয়ে চলেছে। পথটা উর্মীদের বাড়ির পিছন দিকে বেরিয়ে গেছে।
ওরা বাড়িতে পিছনে এসে দাঁড়ালো। প্রতিদিনের মতো আজও উর্মির ঘরের জানালাটা খোলা উপরের ওই ঘরে উর্মি থাকে।
উর্মি জানালার ধারে বসে উপন্যাস পড়ে অথবা গল্পের বই পড়ে। মাঝে মাঝে বাইরের দিকে চোখ যায় হঠাৎ সেদিনও বাইরে চোখ যেতেই দেখে প্রীতিশ আর ওর দিদি এদিকেই আসছে। ভয় করলেও মনে সাহস নিয়ে দোতালা থেকে সোজা নেমে এলো নিচে।
প্রীতিশ ভাবছিল কি ভাবে ডাকা যায়, ঠিক সেই সময় অনতিদূরে দেখে উর্মি দাঁড়িয়ে আছে। আসতে বোধহয় সাহস হচ্ছে না। হাতের ইশারায় ডাকলো উর্মিকে। তিনজনে একটা নিরাপদ জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালো। প্রীতিশ সঙ্গে বড়দির পরিচয় করিয়ে দিল। উর্মি কি করবে ভাবছিল সেই সময় পারমিতা ওর হাত ধরে বলে-তোমায় দেখতে অনেক দূর থেকে এসেছি।
উর্মি বলল - আমি তো প্রথমে সাহস পাচ্ছিলাম না এখানে আসার।
পারমিতা - সে তো বুঝতেই পেরেছি।
পারমিতা হাসতে হাসতে বলে- যে যাই বলুক তোর পছন্দের তারিফ করতে হবে ভাই।
প্রীতিশ একটু লজ্জা পেল উর্মির মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠল।
তারপর পারমিতা উর্মির হাত ধরে বলল- তুমি সত্যি ওকে ভালোবাসো তো?
উর্মি উত্তর দিল - দিদি তা যদি বোঝানোর কোন যন্ত্র থাকত তাহলে বুঝিয়ে দিতাম।
পারমিতা - তোমার বাবা মা যদি তোমায় জোর করে বিয়ে দেয় অন্য কোথাও তখন তুমি কি করবে?
উর্মি - আমার প্রাণ থাকতে তো আর সম্ভব নয় কারণ ও তো আমাকে ভীষণ ভালোবাসি।
পারমিতা - আমার ভাই কোন চাকরি করে না শুধু লেখা আর চাষবাস করে যা হয় তাতেই তোমায় চালাতে হবে পারবে তো?
উর্মি - সবাই যদি পারে আমিও কেন পারব না। ভালোবাসা তো চাকরি আর অর্থের লোভী হয় না।
পারমিতা- ভীষণ খুশি হলাম। একসঙ্গে তোমাদের দেখতে পেলে এবার আরো খুশি হব।
প্রীতিশ বলে- উর্মি কিছু মনে করলি নাকি?
উর্মি - না না মনে করবো কেন। তবে হ্যাঁ বাবা সন্তোষকে অনেক বেশি করে প্রশ্রয় দিচ্ছে। এটা আমার সন্দেহ হচ্ছে।
পারমিতা - সন্তোষ কি চায়? প্রীতিশ তো ওকে…
প্রীতিশ - থাক দিদি। ও যে এ রকম করবে আমি ভাবতে পারিনি
উর্মি - বাবা-মা দুজনকেই ওকে প্রাধান্য দিচ্ছে আর ও তো আমার বিষয়ে একেবারে এক পায়ে রাজি।
পারমিতা - তুমি সাবধানে থেকো বোন। আমি আজ বাড়ি গিয়ে মাকে বুঝিয়ে বলব। যাতে দুজনকে একসাথে বাধা যায়।
উর্মি - তাই দেখো দিদি আজ আমি যাই।
উর্মি সোজা চলে গেল।
প্রীতিশ - চল বাড়ি যাই। তুই মাকে বলিস।
পারমিতা হাঁটতে হাঁটতে বলল - মেয়েটা ভারী সুন্দর দেখতে রে। আর কত সুন্দর চেহারা। আমি এক্ষুনি বলবো মাকে।
0 মন্তব্যসমূহ