সূর্যোদয়

 সূর্যোদয় 

অতনু সরকার







নিঃসঙ্গতা কতটা ভয়ানক তা একমাত্র যে নিঃসঙ্গ সেই জানে। জীবনের খেয়া বাইতে বাইতে কখন যে ৪৪ টা বসন্ত পার করে বসেছে অর্পণ হয়তো সে খেয়াল তার হয়নি। আজ বিজয়া দশমী। বাংলার সব থেকে বড় উৎসবের শেষ দিন। সেই দিন হলেও আনন্দ শুভেচ্ছা বিনিময় কত কিছুই হয়। অর্পনের ছোটবেলায় এই দিনে বড়দের প্রণাম করে আশীর্বাদ নিতে না আর মিষ্টিমুখ করতেন। বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতন একটা জন বিরল জায়গা স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছে অর্পণ। জীবনের অর্ধেক টা কাটিয়ে ফেলেছে সে। আরো বাকি অর্ধেক জীবন তাকে এইভাবে কাটাতে হবে। চারিদিকে পাহাড়। চোখ তাকালে চারিদিকে শুধু সবুজ সবুজ আর সবুজে ঘেরা একটা পাহাড়ি উপত্যকা। উপত্যকাটা ছোট নয় অনেকটা বিস্তারিত একটা জায়গা। সেখানে একটা স্কুলে অংকের শিক্ষক অর্পণ বাবু। নিজের নামের পেছনে বাবু শব্দটা মোটেই পছন্দ করেন না অর্পণ। কিন্তু অনেকেই তাকে ডাকেন অর্পণ বাবু বলে। যদিও স্কুলের বাউন্ডারির ভেতরে তাকে সরকার নামেই চেনে সবাই। সরকার স্যার বললে এক কথায় সকলেই চেনে তাকে আজ পাঁচটা বছর সে এখানে রয়েছে। স্কুলের সময়টুকু ছাড়া জীবনের বাকিটা সময় নিঃসঙ্গতাই কেটে যায় তার। স্কুল ছুটি দশদিন। এই দশদিন তাকে একা কাটাতে হবে হোস্টেলের ছেলে মেয়েরা ফিরে গেছে বাড়িতে। একা আরও একা হয়ে বড় মাঠের একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায় বসে পড়ে সে। তার মন খুঁজে ফিরতে চেষ্টা করে ছোটবেলার ফেলে আসা গ্রাম বাংলার দূর্গা পূজার দিনগুলো। ঢাকে কাঠি পড়ার দিন থেকে বিজয় দশমীর শেষ পর্যন্ত কত যে মজা হত। মহালয়ার ভোর থেকেই শুরু হয়ে যেত একটা অন্যরকম আবেগ। রেডিওতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহালয়ার সোনার মধ্যে দিয়ে দুর্গাপুজোর সূত্রপাত হয়ে যেত। তারপর একদিন একদিন করে বিজয় দশমী। আজ বিজয় দশমী নিশ্চয়ই বাঙালির ঘরের মা-বোনেরা সিঁদুর খেলায় মেতেছে। অর্পণ কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায় বসে দুরে পাহাড় টার দিকে তাকিয়ে থাকে পাহাড়ের পিছন দিক থেকে ঘন নীল আকাশ কি অপূর্ব একটা প্রাকৃতিক সভা সৃষ্টি করেছে। রৌদ্র স্নাত একটা দিন। তাই বাধ্য হয়ে গাছের ছায়ায় একটা বড় পাথরের বেঞ্চের উপর বসে সে। গাছের কাছে কত রকমের পাখি তাদের আপন মনে রেখে চলেছে। পাখিগুলোকে বড্ড আপন বলে মনে হয় তার। এই কত বছরে প্রবাসী জীবনে ইচ্ছে করে বাড়ি ফেরা হয়নি তার। বাড়ির লোক শুধু পয়সা চাই। টাকা চাই যখন দরকার হয় তখন ফোন করে শুধু টাকার খোঁজ করে। মানুষটার খোঁজ কেউ পারেনা সেই রাগে ই অভিমানে বাড়িফেরা হলো না তার। ছেলেমেয়েরাও এখন হয়তো অনেকটাই বড় হয়ে গেছে। ছোটবেলা থেকে অর্প ণ প্রচন্ড অভিমান একবার কারো সঙ্গে বনিবানা না হলে আর কখনো তার সঙ্গে কথা বলা তো বিয়ের কথা সেই পথ পর্যন্ত মাড়িয়ে যেত না। জীবনের সেই একঘেয়েমি সবারটা হয়তো আজও গেল না। তাই এই পাঁচ বছর বাড়িতে টাকা পাঠিয়েছে নিয়মিত। মাঝে মাঝে ছেলেমেয়েরা আসতে বলে দূরে থাকলে যা হয়। সম্পর্কটা পুরোটাই আগলা হয়ে গেছে। বাড়ির কথা আর ভাবি না এই প্রকৃতি গাছপালা খুব আপন বলে মনে হয় তার। মাঝে মাঝে মনে হয় ফুটে গেলে দূরে কোথাও ঘুরে আসবে দূরে অনেকটা দূরে। একা না ওর আর ভালো লাগেনা। আগে একা একা ঘুরেছি অনেকটা জায়গা। কিন্তু এখন আর ভালো লাগেনা জীবনের রং ফিকে হয়ে এসেছে এই বয়সে। ৪৪ টা পর্যন্ত কোন ব্যাপারই না। মাথার চুলে একটা দুটো পাক ধরেছে। মাঝে মাঝে সেগুলোকে দেখলে বড়ই আনমনা হয়ে পড়ে। অর্পণ সরকার স্কুলের অংকের শিক্ষক। লাক্ষা দ্বীপের কাভারাত্তি একটা স্কুলে কর্মরত রয়েছে। এখান কার বেসরকারি একটা স্কুল। এখান থেকে সমুদ্র সৈকত সামান্য একটু দূরে। সন্ধ্যেবেলা টা সমুদ্র সৈকতের নির্মল বাতাসে বসিয়ে দিয়ে অনেকটা সময়ে কাটায় সে।

জীবনের এই সময়টা খুব দুর্বিসহ কারণ এখন বন্ধু-বান্ধবদের হুড়োহুড়ি নেই, প্রেমের রঙিন প্রজাপতি নেই। আছে শুধু সংসারের বোঝা বয়ে নিয়ে যাওয়া একটা দায়িত্ব। কিন্তু অর্পণ সেই দায়িত্ব থেকেও নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে বেশ কয়েক বছর হল। নিরবিচ্ছিন্ন নির্জন দ্বীপে নিজেকে নিজেই নির্বাসন দিয়েছে সে। ছুটির দিনগুলো সমুদ্রের সৈকত ধরে হাঁটতে থাকে। এখন আমি সৌন্দর্যের মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দিতে চাই সে। কিন্তু যখন ঘরে ফিরে আসে তখন হাজার একাকীত্ব চারিদিক থেকে আক্রান্ত করে তাকে। হাতের মোবাইলটা নিঃসঙ্গতা অনেকটা দূর করে। ফেসবুক অথবা ইনস্টাগ্রামে অনেকটা সময় কেটে যায় তার।

সোশ্যাল মিডিয়াতে কতখানি বা ভালো লাগবে। তবুও নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে চেষ্টা করে সে। মাঝেমধ্যে বিকেল হলে ফুটবল খেলার মাঠে গিয়ে বসে থাকে স্কুলের ছেলেরা ফুটবল খেলে একটা গাছের তলায় বসে সে দেখতে থাকে তাদের কিশোর বয়সের উদ্বাদনা। তখন মাঝে মাঝে উদাস হয়ে ফিরে যায় নিজের কিশোর জগতে। দলবেঁধে বন্ধুদের সঙ্গে আমবাগানের পুকুরটা সাঁতার কাটা ঝমঝম করে বৃষ্টি এলে বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবল খেলা অথবা সন্ধ্যেবেলায় গঙ্গার ধারে দু একটা দিন হই হই করে কাটানো এসব এখন অতীত। এই ছেলেগুলোকে দেখে অতীতটাকে ফিরে পেতে ইচ্ছা করে মনে মনে। কিন্তু চরম বাস্তব হলেও সেখানে আর করা যাবে না। বাড়ির সঙ্গে এক প্রকার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন তার। কিউ আর খোঁজ নেয় না মাঝেমধ্যে ছেলে মেয়েরা ফোন করে এইটুকুই। ওদের মা নিজের মতো করে মানুষ করছে করুক। অর্পণ প্রতিমাসে সময়মতো টাকা পাঠিয়ে দেয়। না পাঠালেও পারতো কিন্তু দায়িত্ববোধ কর্তব্য থেকে সে পিছুপা হয় না। মাঝে মাঝে ছেলে মেয়েদের দেখতে ইচ্ছা হয় কিন্তু ওর স্ত্রী ছেলেমেয়েদেরকে ওর থেকে দূরে রেখেছে কিন্তু কেন সে নিজেও জানে না। অভিমান ভুল বোঝাবুঝি স্বামী স্ত্রীর মধ্যে থাকতেই পারে। কিন্তু তা ছেলে মেয়েদের মধ্যে দিয়ে প্রয়োগ করতে গেলে তার ফল খুব একটা ভালো হয় না সেই সব ভালো মন্দ এখন তার জীবনে অতীত। 

অর্পণ একটা সমুদ্র তীরবর্তী নারকোল বাগানের পাশ দিয়ে হাঁটতে থাকে। কয়েকশো কিলোমিটার দূরে বিস্তৃত নারকোলের বাগান এবং সমুদ্র সৈকত। পুরো দুধটাই সমুদ্রের মধ্যে সুতরাং দ্বীপের চারপাশে সমুদ্র ঘিরে রেখেছে। এখানে জলের রং সময়ে সময়ে পাল্টায়। আকাশের রঙের সঙ্গে সঙ্গে জলের রঙেও পরিবর্তন দেখা দেয়। সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত অসাধারণ একটা সৌন্দর্য নিয়ে উপস্থিত হবে সকলের মনে। আসলে প্রকৃতিতেই দৃশ্য যারা দেখেছে তারাই জানে কতটা নৈঃসর্গময় সৌন্দর্য। যারা দেখেনি তাদের ভাষায় বলে খুব একটা বোঝানো যাবে না। আজ ছুটির দিন। সকাল বেলায় অনেকটা পথ হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছে বাজারে। এখান থেকে বাজার করে নিয়ে ফিরবে সে। তারপর আবার হাঁটা পথ। নিজেই রান্না করে খায় নিজের মত। অনেকদিন আগেই তেল মশলার খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে সে। নিজের মত কম মসলাদার রান্না করি কোনো রকমে পেট ভরায় মাঝে মাঝে তো বাঁচার আসাটাই হারিয়ে যায় মন থেকে। 

একদিন তার ছোট্ট বাড়িটার ব্যালকনিতে বসে সমুদ্রের হাওয়া গায়ে মাখছিল সে। এখানে আবহাওয়া মনোরম। বিকেল হলেই প্রচন্ড হাওয়া দেয়। দিনের বেলাটা একটু গরম থাকে কিন্তু রাতের বেলা ধীরে ধীরে তাপমাত্রা কমতে থাকে। সামনে টেবিলটাতে রয়েছে একটা ট্যাবলেট। যেখানে সংগৃহীত হয়েছে অনেকগুলি ই-বুক। ই- বুকের দুনিয়ায় এখন মোটা মোটা বই হারিয়ে যেতে বসেছে। আসলে ই-বুক থাকলে সময়টাও কেটে যায়। যারা বই পড়তে ভালোবাসে তাদের জন্য ই-বুক যথেষ্টই উপকারী। সামনের রাস্তাটা দিয়ে হুশাস করে গাড়ি চলে যাচ্ছে। আরেকটু রাত হলেই নির্ঝুমতায় ঢেকে যাবে সমগ্র দ্বীপপুঞ্জ। এই ভাবেই একটা দুটো করে নিঃসঙ্গ দিনগুলি কেটে যেতে থাকে। হঠাৎ তার মাথায় আসে একটু বেড়াতে যাবে। বহুদিন কোথাও যাওয়া হয়নি। নির্জন নিঃসঙ্গ এই দ্বীপের থেকে একটু বেরিয়ে পড়বে জনাকীর্ণ ঘনবসতি কোন একটা অঞ্চলে। সেখানেও আবার মানুষের গাদাগাদি ঠাসাঠাসি এতদিন এই নিঃসঙ্গতার পরে একগাদা মানুষের ভিড় খুব একটা ভালো লাগবে না। তাই সে ঠিক করল এখান থেকে সে যাবে কন্যাকুমারী। ভারতের একেবারে শেষ দক্ষিনবিন্দু। যেখানে রয়েছে স্বামী বিবেকানন্দ রক। তারপর সেখান থেকে রামেশ্বরম। এবং কাছাকাছি আরো যদি কিছু থাকে তখন ঠিক করে নেবে কোথায় যাবে। এখন স্কুল ছুটি। বেশ কিছু দিন ছুটি থাকবে এখানে। তাই সেই রাতেই সমস্ত টিকিট কেটে ফেলেছে। প্লেনি এখান থেকে তাকে যেতে হবে মুম্বাই। মুম্বাই থেকে চেন্নাই অথবা মাদুরাই। মাদুরাইতেই সুবিধা হবে বেশি। মাদুরাইতে নেমে সেখানে মীনাক্ষী মন্দির দেখা,  তারপর সেখানে আরো অনেক কিছু ছোট বড় মন্দির রয়েছে সেগুলোকে দেখে সেখান থেকে সে চলে যাবে কন্যাকুমারী। কন্যাকুমারী থেকে রামেশ্বরম। এখান থেকে সে আসবে চেন্নাই। চেন্নাইতে দু একদিন থেকে সেখান থেকে মুম্বাই। মুম্বাইয়ের কিছু জায়গা ঘুরে তারপর সে ফিরে আসবে আবার তার নির্জন বসতিতে। 

রাত্রে খোঁজ নিয়ে জেনেছিল পরের দিন বিকেল চারটেয় রয়েছে ফ্লাইট। রাতেই বুকিং করে  সে। কাভারাত্তি বিমানবন্দর তার থাকার জায়গা থেকে ত্রিশ মিনিটের পথ। সকালে উঠে সমস্ত লাগেজ গুছিয়ে নেয়। খাতায় লিখে একটা একটা করে মিলিয়ে দেখে নেয় সব ঠিক আছে কিনা। 

আসলে এরকম ঝাড়া হাত-পা মানুষের কাছে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়াটা খুব একটা কঠিন ব্যাপার নয়। টিকিট ও তাড়াতাড়ি পেয়ে গেল, তাই সোজা চলে এলো মুম্বাই। মুম্বাই থেকে মাদুরাই একই দিনে আসা যায়। ফ্লাইটের হেরফের মাত্র এক ঘন্টার। কাভারাত্তি থেকে মুম্বাই তে নেমে এক ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে। তারপর সেখান থেকে চলে এসেছে মাদুরাই। প্লেনে বসে মাদুরাই তে একটা হোটেল ঠিক করে রেখেছে। মাদুরাই তে নেমে সোজা হোটেলে গিয়ে উঠলো। এখন রাত এগারোটা বাজে। হোটেলে ওঠার পর ভালো করে স্নান করে খেয়ে দেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ল। খুব ভরে ওঠে সে যাবে মীনাক্ষী মন্দিরে। 

দক্ষিণ ভারতীয় স্থাপত্য রীতিতে তৈরি এই বিরাট মীনাক্ষী মন্দির সত্যি অপূর্ব একটা কারু কার্যের শৈলী নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এখানে না এলে সত্যি সত্যি জীবনের একটা অপূর্ণতা থেকে যেত তার। মনে মনে ঠিক করে ফেলে ফেরার পথে তিরুপতি মন্দিরও দেখে যাবে। কিছুটা প্ল্যান পরিবর্তন করে নেয় সে। মীনাক্ষী মন্দির দেখার পর সেখানে পূজা নিবেদন করে সে চলে যায় আশেপাশের আরো কয়েকটি মন্দিরে। মীনাক্ষী মন্দিরের পরিবেশ বেশ ভালো লাগলো তার। এত জনবহুল শহর অনেকদিন দেখা হয়নি তার। হয়তো সেই কারণে শহরটি অন্যরকম ভাবে ভালো লেগেছে তার। 

অর্পণ সারাদিন শহর ঘুরে সন্ধ্যার সময় হোটেলে ফিরে আসে। তারপর আবার দীর্ঘ বিশ্রাম। আগামীকাল তাকে যেতে হবে কন্যাকুমারীর উদ্দেশ্যে। মাদুরাই থেকে ট্রেন পথে সহজে যাওয়া যায়। তৎকালীন ভিত্তিতে একটি টিকিট সে বুকিং করে নিল। তারপর সময়মতো চেপে পড়ল মাদুরাই কন্যাকুমারী ট্রেনে।

এখানে সমুদ্র সৈকত। সমুদ্র সৈকতকে নতুন করে পাওয়ার মতন কিছু নেই কারণ কাভারাত্তি দ্বীপপুঞ্জটি চারিদিক থেকে সমুদ্রে ঘেরা। তবে কেন এসেছে কন্যাকুমারী এসেছে নতুন কে জানার জন্য ভারতের এই দিকটা ঘোরা হয়নি তার। তাই অর্পণ বেছে নিয়েছে এই দক্ষিণ ভারতকে। একটা সময় উত্তর ভারতের বেশ কয়েকটা জায়গা ঘুরে নিয়েছে সে। তাই দক্ষিণ ভারত দেখার জন্য চলে এসেছে এখানে। সময় মত ট্রেন এসে থামল কন্যাকুমারী। এখানে সৈকত সংলগ্ন একটা হোটেলে উঠেছে সে। আরব সাগর আর ভারত মহাসাগরকে যুক্ত করেছে মান্নার উপসাগর। একদিকে সু বিস্তৃত নীল জলরাশি নিয়ে বিরাজমান ভারত মহাসাগর আরেক দিকে আরব সাগর। আরব সাগর সম্পর্কে অজানা কিছু তার নেই। কিন্তু ভারত মহাসাগরের জল যেন আরো বেশি নীল। যদিও এটা মান্নার উপসাগরের মধ্যে পড়ে।  বলা যেতে পারে মান্নার উপসাগর ভারত মহাসাগরের একটা ক্ষুদ্র অংশ যা শ্রীলংকা এবং ভারতকে বিচ্ছিন্ন করেছে। সমস্ত দ্রষ্টব্য স্থানগুলো একটু একটা একটা করে দেখতে থাকে সে। একদিন খুব ভোরে উঠে বিবেকানন্দ রকে যায়। চারিদিকে যাওয়ার জল বেষ্টিত ক্ষুদ্র একটা দ্বীপ বিবেকানন্দ রক। অর্পনের মনে অদ্ভুত  একটা অন্তর্জাগরণ তৈরি হয়েছে। একটা ছোট্ট শিলার উপর বসে ধ্যানমগ্ন হয়ে পড়ে সে। বলা যেতে পারে ধ্যান করতে হঠাৎ মন চাইলো তার। তাই ওইভাবে ধ্যানমগ্ন হয়ে নিজেকে নিবিষ্ট রাখে কিছুক্ষণ। বেশ কিছুটা সময় এইভাবে বয়ে যায় তারপর যখন চোখ খুলে তখন দেখে তার সামনে আরেকটি ছোট্ট শিলার উপর বসে রয়েছে একজন ভদ্রমহিলা। পরনে হালকা সবুজ রঙের একটা শাড়ি। সকালের স্নান সেরে হয়তো এসেছেন তাই চুলের মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসছে অসাধারণ স্নিগ্ধ একটা সুবাস। খোলা চুলগুলো এলিয়ে পড়েছে তার সমস্ত পিঠ জুড়ে। শাড়িটা তাকে বেশ মানিয়েছে। এই দিকটা জনবহুল অতটা নয়। কিছুটা দূরে দূরে একজন বা দুজন হয়তো বসে রয়েছে। কেউবা পরিবার নিয়ে উপভোগ করছে সমুদ্রের ঢেউ গুলি। কিন্তু এই ভদ্র মহিলা অর্পণের  মতন একা। বহুদূর বিস্তৃত সমুদ্রের জলের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা চিন্তায় মগ্ন। হঠাৎ তার মোবাইল ফোনে একটি কল এলো। অর্পণ দেখল বাংলায় কথা বলছে। পাঁচ বছর পর বাঙালি কাউকে সামনে দেখল সে। মনে মনে বাংলায় কথা বলার লোভ সংবরণ করতে পারল না। কিন্তু ভাবল যদি হঠাৎ এই ভাবে কথা বললে অন্যভাবে নেয় তাহলে ব্যাপারটা বিশ্রী হবে। তবুও পাঁচ বছর পরে বাংলা বলার লোভ যেহেতু সামলাতে পারল না তাই তার ফোনটি যখন তিনি রেখে দিলেন তখন অর্পণ বলল -এই যে ম্যাডাম কবে এসেছে এখানে? 

সেই ভদ্র মহিলা উত্তর দিলেন আগামীকাল এখানে এসেছি। আপনি কবে এলেন?

অর্পণ এক গাল হেসে বলল -  কবে এসেছি ঠিক মনে করতে পারি না। তবে পাঁচ বছর হয়ে গেল বাংলা ছাড়া। আপনাকে বাংলায় কথা বলতে দেখে বাংলা বলার লোভ সামলাতে পারলাম না। কথা বলছি বলে কিছু মনে করবেন না।

তিনি হেসে বললেন  - পাঁচ বছর আগে এসেছেন? এখানে কি কোন কাজ করা হয় নাকি? 

অর্পণ বলল -  এখানে ঠিক থাকি না। থাকি এইরকমই আর একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপে। লাক্ষাদ্বীপপুঞ্জের নাম শুনেছেন? 

তিনি বললেন - হ্যাঁ শুনবো না কেন? শুনেছি তো। 

অর্পণ -  ওই লাক্ষা দ্বীপে কাভারাত্তি বলে একটা জায়গা আছে। ওখানে আমি থাকি। পাঁচ বছর ধরে ওখানে আছি। আপনার মত আমিও এই বিবেকানন্দ রক দেখার জন্য এসেছি। 

তিনি বললেন -বাংলায় কোথায় থাকা হয়? 

অর্পণ - থাকা এখন আর হয়  না। থাকা হতো হুগলিতে।

তিনি এক আকাশ বিস্ময় ভরা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন -আমিও তো হুগলিতে থাকি। 

অর্পণ - আপনি হুগলিতে থাকেন? বেশ তো। একই জেলার লোক কিন্তু আপনার সঙ্গে আর কাউকে তো দেখছি না? 

তিনি পাল্টা দিলেন অর্পণ কে -আপনিও তো একা। আপনার সঙ্গে তো কাউকে দেখছি না। আসলে পুরুষরা একা ঘুরলে সমস্যা নেই। সমস্যা মহিলাদের ক্ষেত্রে। জানেন মহিলারা একা ঘুরলেই হাজার প্রশ্ন উকি দেয়। 

অর্পণ বিগতিক দেখে বলল -আসলে পুরুষদের একা যেতে দেখেছি। মহিলারা খুব একটা একা এতদূর ভ্রমণ করতে আসেন না। তার মানে এই নয় যে তারা আসতে পারবে না। আসলে আপনি যে একা এটা আমি বুঝতে পারিনি। 

তিনি বললেন -অনেকেই বুঝতে পারে না। আসলে সত্যিই আমি একাই এসেছি। আমি দক্ষিণ ভারত একা একাই ঘুরবো। তারপর যেদিন ইচ্ছা হবে ফিরে যাব বাংলায়। 

কথাটা একটু খটকা লাগলো অর্পণের কাছে। যেদিন ইচ্ছা হবে মানে। তারমানে কোন পিছুটান খুব একটা নেই। তাই নিজের ইচ্ছা মতো ঘুরতে পারবেন এবং সেই সংকল্প নিয়েই হয়তো এসেছেন। 

অর্পণ বলল-  এখান থেকে আপনার পরবর্তী গন্তব্য কোথায়? 

তিনি বললেন - ঠিক করিনি এখনো। দেখি যেদিকে মন চায় যাব। 

অর্পণ - আপনি তো ঠিক আমার মতন যেদিকে মন চায় যাব বলে এসেছি। 

তিনি বললেন - এখানে আছেন কোন হোটেলে?

অর্পণ - “হোটেল কন্যাকুমারী”তে।

তিনি হেসে বললেন - সে কি আমি ও তো ঐ হোটেলে আছি।

অর্পণ -  যদি কিছু মনে না করেন তাহলে একটা কথা বলতে পারি কি? 

তিনি বললেন। -একটা কেন যত ইচ্ছা কথা বলতে পারেন। মনে করার তো কিছু নেই। আসলে আমিও ভাবি নি যে এখানে এসে বাংলায় কথা বলতে পারব। তামিল জানিনা তাই ভাঙ্গা ইংরেজিতে কাজ চালাতে হচ্ছে। অসুবিধা হচ্ছে একটু। 

অর্পণ - তামিল আমিও জানিনা, তাই আমাকেও ইংরেজিতে কাজ চালাতে হচ্ছে। একা একা ঘোরার থেকে অন্তত ঘোড়ার মত একটা সঙ্গী পেলে বেশ মজা করে ঘুরা যায়। 

তিনি একগাল হেসে বললেন -কথাটা আপনি ঠিকই বলেছেন কিন্তু কি জানেন এই মধ্য বয়সে এসে ভয় লাগে, কারণ মানুষ চেনা খুব দুষ্কর।। 

অর্পণ -এ বিষয়ে আমি আপনার সঙ্গে এক মত। কিন্তু আমি যদি বলি নারী চেনা খুব কষ্টকর এবং দুষ্কর তাহলে খুব একটা ভুল বলা হবে না আশা করি। 

কথাটা বলে সে হাসতে থাকে। 

ভদ্রমহিলা জবাব দেয় - সত্যি নারীর মন খুবই বিচিত্র। বিচিত্র বলেই এই দীর্ঘ পথ আমি একা চলে এসেছি কোন ভয় না করে। আর এখানে এসে হঠাৎ আপনার সঙ্গেও দেখা হয়ে গেল। একজন বাঙালি তাই কথা বলতে সত্যি সুন্দর লাগছে। আচ্ছা জানতে পারি কি আপনি কি করেন মানে আপনার পেশাটা কি? 

অর্পণ - আমি একজন অঙ্কের শিক্ষক। লাক্ষাদ্বীপপুঞ্জের সব থেকে বড় ইস্কুলের আমি অংকের শিক্ষক। প্রাইভেট ইংরেজি মাধ্যম স্কুল। এখানে আছি প্রায় পাঁচ বছর হলো। স্কুলের বাইরে  একাকীত্ব একটা জীবন। 

ভদ্রমহিলা বললেন -এই পাঁচ বছরে বাড়িতে ফেরা হয়নি? 

অর্পণ বলল - না বাড়িতে ফেরা হলো না জানেন। মান অভিমান রাগ ছোটবেলা থেকে আমার খুব বেশি ছিল। সেই মান অভিমান এর জন্য বাড়ি ফেরা হলো না। 

ভদ্রমহিলা বললেন -কার উপর এত অভিমান? 

অর্পণ বলল - নির্দিষ্ট করে কারো নাম বলতে চাই না কিন্তু সমগ্র পরিবারের উপর আমার এই অভিমান। জানেন সংসারটা কেমন যেন একটা বিষের মতন হয়ে গিয়েছিল আমার কাছে। 

কথা বলতে বলতে অর্পণ  সমুদ্রের পাড়ের দিকে তাকায়। যেখানে জলের ঢেউ গুলো আছড়ে পড়ছে প্রায় তাদের পায়ের কাছে। তারপর আবার বলে - এই পাঁচ বছরের নিঃসঙ্গ জীবনে ভালো আছি জানেন। হয়তো আমি একা হয়তো সারা জীবন একাই থাকবো কিন্তু তবুও বলবো ভালো আছি। 

ভদ্র মহিলা বললেন -একা থাকার যন্ত্রণা আমিও বুঝি। কারণ আমিও প্রায় পাঁচ ছয়  বছরের বেশি সময় একাই আছি। ছেলে বাইরে পড়াশোনা করে স্বামী মারা গেছে বহুদিন আগে। এতদিন অনেক কষ্ট করে সংসার চালিয়েছি প্রাইভেট স্কুলে চাকরি করি তবে আপনার মত বড় স্কুল নয়। 

অর্পণ -আপনিও স্কুল টিচার তাহলে। বাহ কি অদ্ভুত একটা মিল এই দেখুন মিল বললাম বলে আবার কিছু মনে করবেন না আসলে এই ঘুরতে এসে এরকম একটা ঘোরার সঙ্গী পেলে খারাপ লাগে না। আসলে কটা তো দিন। তারপর ফিরে যাব যে যার কাজে হয়তো এই সংক্ষিপ্ত কিছু স্মৃতি মনের মাঝে থেকে যাবে সারা জীবন।। 

তিনি বললেন -ঠিকই বলেছেন ভালোই হলো ঘোরার জন্য একজন মানুষকে পাওয়া গেল। আসলে বন্ধু পাওয়া বা বন্ধুত্ব করা খুব কঠিন ব্যাপার জানেন। দেখবেন সংক্ষিপ্ত এই বন্ধুত্বের পরিচয় যেন বিষাক্ত হয়ে না যায়। 

অর্পণ বলল -দেখুন যদি ভরসা রাখতে পারেন তবেই আমার সঙ্গে ঘোরার জন্য আসতে পারেন। আপনি থাকবেন আপনার মত আমি আমার মত শুধু এই ঘোরার পথটুকু না হয় হাঁটলাম পাশাপাশি সেখানেও যদি ভরসা না থাকে তাহলে দুজন দুজনের মতো চলাই ভালো। কারন আমরা তো কেউ কারোর জন্য এখানে আসিনি। আমরা এসেছি নিজের জন্য তাই না। 

তিনি বললেন -একদমই ঠিক। এসেছি নিজের জন্য। আর এখানে এসে যদি বন্ধু পাওনা হয় তাতেই বা খারাপ কি? 

কথা বলতে বলতে এই দিকটা বেশ রোদ্দুর এসে গেছে। আস্তে আস্তে লোকজনের সংখ্যাও বাড়ছে। অনেক ভোরে তারা এসেছিল তাই জায়গাটা ফাঁকা ছিল। 

অর্পণ  -আসুন না ওই দিকটা একটু হেঁটে আসি। 

তিনি বললেন - বেশ চলুন। 

অর্পণ - যদি কিছু মনে না করেন তাহলে আপনার নামটা কি জানতে পারি? 

তিনি বললেন -এই দেখেছেন কথায় কথায় কেউ কারো নামটাই জানা হলো না। আমার নাম শালুক। 

অর্পণ বলল -শালুক ফুল। খুব জনপ্রিয় একটা ফুল জানেন। আমার খুব প্রিয় ফুলটা। 

শালুক - জানি জলাশয় হয় তাই খুব বেশি একটা লোক ওকে পছন্দ করেনা। আমার মতন। আমাকেও যেমন কেউ পছন্দ করেনা।

অর্পণ -আমার নাম অর্পণ।  

শালুক - আসুন অর্পণ বাবু ওই দিক থেকে যাই এদিকটা বেশ রোদ্দুর। 

অর্পণ -চলুন ওই দিকটা। সমুদ্রের ধারে হাঁটতে আমার কোন আপত্তি নেই। প্রতিটা দিন আমি সমুদ্রের ধারে গিয়ে নতুন করে জীবনে বাঁচার রসদ খুঁজে পাই। আসুন দেখবেন আপনিও নতুন বাঁচার রসদ খুঁজে পাবেন। 

শালুক -চলুন দেখি আপনার মত আমিও বাঁচার রসদ খুঁজে পাই কিনা। 


দুজন হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে কথা বলতে বলতে অনেকটা পথ অনেকটা সময় তার অতিক্রম করে ফেলে। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে কিছু খেয়ে নেয় তারা। তারপর আশেপাশের সুন্দর সুন্দর জায়গাগুলো উপভোগ করতে থাকে। 

সারাটা দিন সেখানে কেটে যায়। মনে হয় দুজনের বন্ধুত্ব কত পুরনো দিনের। যদি সম মনোভাবাপন্ন দুটো মন আর সুন্দর  ব্যবহার থাকে তাহলে বন্ধুত্ব হতে খুব একটা সময় লাগে না। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সন্ধ্যায় অর্পণ এবং শালুক ফিরে আসে নিজের নিজের ঘরে। অর্পণ আমন্ত্রণ জানায় শালুক কে ডিনারের জন্য। শালুক সে আমন্ত্রণ গ্রহণ করে।


পরের দিন তাদের গন্তব্যস্থল হয় রামেশ্বরম। এবার তারা পাড়ি দেয় আর একটা গন্তব্যস্থলে। রামেশ্বরমে কাছাকাছি একটা সুন্দর হোটেল তারা খুঁজে নেয়। পাশাপাশি দুটো ঘর। একদিন অর্পণ সারাদিনের খরচ বহন করে তো পরের দিন শালুক বহন করে খরচ। সুন্দর একটা জায়গা তবে ব্যয় বহুল বটে। কিন্তু এখানে দু-তিন দিন তারা কাটিয়ে দেয়। অদ্ভুত একটা উদ্মদনা কাজ করে দুজনের মধ্যে। মনে হয় যৌবনের উদ্দীপনা ফিরে এসেছে আবার। দুটি একাকীত্ব মন যখন নতুন বন্ধুত্বের পথ খুঁজে পায় তখন সেই উন্মাদনা ধীরে ধী রে যৌবনের উদ্যম কেও ছাপিয়ে যায়। এই কয়েকদিনের মধ্যেই তারা একে অপরের ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছে। মাঝখানে দেওয়ালটা শুধু রয়েছে। এমনি করে সারাটা দিন গল্পে মজায়, ঝগড়ায় কেটে যায় তাদের। সঙ্গে প্রাকৃতিক দৃশ্য উপরি পাওনা।


এক সন্ধ্যেবেলা তারা সমুদ্রের তীর হাঁটতে থাকে। অর্পণ বলে - শালুক আসুন না লাক্ষাদ্বীপে। কটা দিন থেকে যান। আপনার জন্য একটা ঘরের ব্যবস্থা আমি করে দেব। দেখবেন সেই জায়গাটাও কত সুন্দর। লাক্ষাদ্বীপটা প্রবাল দিয়ে গঠিত। খুব সুন্দর লাগবে জানেন।

শালুক উত্তর দেয় - কিন্তু আমি যে সেইভাবে প্রস্তুতি নিয়ে আসেনি। তাছাড়া খরচটা অনেক। 

অর্পণ -যদি বিশ্বাস করেন তাহলে খরচ নিয়ে ভাবতে হবে না আর আপনার যাওয়া এবং ফিরে আসার খরচ আমি দিয়ে দেব। যদি আপনি আসেন কটা দিন কাটান আপনারও ভালো লাগবে আমারও ভালো লাগবে।

সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে শালুক উত্তর দেয় -অজানা অচেনা পথে পা তো বাড়িয়েছি। সুতরাং যেতে আমার আপত্তি নেই অগাধ সময় আমার চলুন একবার ঘুরে আসি। 

রামেশ্বরম থেকে তারা চলে আসে চেন্নাই। চেন্নাই থেকে সরাসরি কাভারাত্তি। 

এখানে যে বাড়িটায় অর্পণ ভাড়া থাকে তারই পাশের একটা ঘর শালুকের জন্য বরাদ্দ করে দেয়। 

অর্পণ বলে - এই ঘরটা আপনার জন্য। 

শালুক - বাহ খুব সুন্দর সাজানো গোছানো ঘরটা তো। আপনি নিজেই রান্না করেন বুঝি। রান্নাঘরটা কোন দিকে। 

অর্পণ - আজ আর রান্না করবো না। আসুন  কাছেই একটা হোটেল রয়েছে সেখান থেকে আজকের মত কিছু খেয়ে নি।


সন্ধ্যায় তারা গিয়ে বসে একটা সৈকতের ধারে। এমনি করে বেশ কয়েকটা দিন কেটে যায়। শ্যালুক ধীরে ধীরে এই জায়গাটাকে ভালোবেসে ফেলে। ভালোবেসে ফেলে হয়তো অর্পণ কেও।

ভালোবাসার কথাটা অর্পণ আকারে ইঙ্গিতে জানিয়েছিল শালুক কে। 

একদিন বিকেল বেলা সূর্যাস্ত দেখার জন্য অর্পণ শালুককে নিয়ে গেছে সানসেট পয়েন্টে। এখানে বহু মানুষ আসেন সূর্যাস্ত দেখার জন্য। এতদিন সূর্যোদয় দেখে অভ্যস্ত ছিল শালুক। আজ সূর্যাস্ত দেখলো। সমুদ্রের বহুদূরে মনে হচ্ছে যেন সূর্যটা ডুবে যাচ্ছে সমুদ্রের গহন গভীরে। আকাশ জুড়ে লাল রং ছড়িয়ে দিয়েছে সিঁদুরের মতন। সেই লাল রং জলের মধ্যে পড়ে এক অদ্ভুত মায়াবী দৃশ্য সৃষ্টি করেছে। এ দৃশ্য মনের মধ্যেই শুধু শিহরণ তোলে না এই জায়গায় আসার সমস্ত গ্লানিকে দূর করে দেয়। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নেমে আসে। একে অপরের হাত ধরে সানসেট পয়েন্ট সমুদ্র তীর ধরে হাঁটতে থাকে তারা। হাঁটতে হাঁটতে অর্পণ বলে - শালুক একটা কথা বলবো তোমায়? 

শালুক অর্পণের হাতটা শক্ত করে ধরে। তারপর বলে - বলো না কি বলবে? 

কখন যেন আপনি থেকে তুমি তে চলে এসেছে তারা।

অর্পণ বলে - আমার এই  একাকীত্ব জীবনের সঙ্গী হবে তুমি। 

শালুক উত্তর দেয় -আমার একটা পরিবার আছে। তোমারও একটা পরিবার আছে। হয়তো আমার বাঁধন কম তোমার বাধন বেশি, যদি সবকিছু মেনে নিয়ে এই বন্ধুত্ব সারা জীবন চালিয়ে যেতে চাও আমার কোন আপত্তি নেই।

অর্পণ -এই জীবনের নিঃসঙ্গতা আর অনেক কিছু না পাওয়া যন্ত্রণা থেকে গেছে মনে। সেই সব যন্ত্রণাকে দূর করতে আসুন না একসঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে পথ হাঁটি।

শালুক -অজানা অচেনা সাগরে ডুব দিয়েছি আর একবার না হয় ডুব দিলাম। ক্ষতি কি? 

হাঁটতে হাঁটতে তারা কখন যেন বাড়ি পৌঁছে যায়। আসার পথে তারা একটি হোটেল থেকে খেয়ে নিয়েছিল।  তাই এখন রাতের খাবার চিন্তা নেই আর। 

দ্বীপপুঞ্জের মাথায় নারকেল গাছের ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো পড়েছে চারিধারে। অর্ধেক চাঁদ রাতের অন্ধকার কে অনেকটাই ম্লান করে দিয়েছে। অন্ধকার ঘর। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে  অর্পণ। সেই অন্ধকার জানালা দিয়ে বাইরের আলো আঁধারি জগৎটা কেমন যেন মায়াবী মনে হয় তার। ঘুম আসছিল না । পাশের ঘরে হয়তো শালুক ঘুমিয়ে পড়েছে। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল ঠিক মনে নেই। অন্ধকারে ঘড়ি বা মোবাইল দেখার প্রয়োজন মনে হয়নি তার। হঠাৎ পিছন দিক থেকে দরজার ওপর একটা শব্দ হলো। যার যার অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে শালুক।

 শালুক বলল - আসতে পারি?

অর্পণ অবাক হয়ে বলল - এত রাতে আমার ঘরে? কি হয়েছে? কোন দরকার?

শালুক -ঘুম আসছে না তাই বাইরে বেরিয়ে দেখলাম তোমার ঘরের দরজাটা খোলা।  ভাবলাম একটু গল্প করা যাক। 

অর্পণ বলল আমিও মনে মনে ভাবছিলাম এই সুন্দর মায়াবী অন্ধকার রাতে যদি তোমার সঙ্গে বসে একটু কথা বলা যেত। 

শালুক বলে - আমি কি এখানে দাঁড়িয়ে থাকবো? 

অর্পণ এগিয়ে যায় শালুকের দিকে। তারপর তার হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে আসে জানালার পাশে। মায়াবী সেই রাত যেন আরো মায়াময় হয়ে ওঠে দুজনের কাছে। ধীরে ধীরে দুজনে কাছাকাছি চলে আসে, চলে আসে মনের থেকে শরীরে। রাতের মায়াবী আচ্ছন্নতায় এক আদিম খেলায় মেতে ওঠে তারা। তারপর ভোরের আলো ফোটে দুজনের জীবনে। একটা নতুন সূর্যোদয় হয় আবার।




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ