নয়না
নয়না গ্রামের মেয়ে, কিন্তু ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় খুব মেধাবী। তার বাবা-মা চেয়েছিলেন মেয়েকে শিক্ষিত করে তুলতে, যাতে সে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে। নয়না উচ্চশিক্ষা অর্জন করে শিক্ষকতায় চাকরি পেলো। তার স্বপ্ন ছিল নিজের গ্রামের শিশুদের শিক্ষিত করে তোলা, তাদের উন্নতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
অন্যদিকে, অয়ন শহরের অভিজাত পরিবারের ছেলে। সে বড় শহরে চাকরি করলেও শিকড়ে থেকে গিয়েছিলো তার গ্রামের প্রতি ভালোবাসা। পরিবারের সবকিছু ছিল আধুনিকতার মোড়কে মোড়া, তাদের জীবনযাত্রা আর ভাবনাগুলো ছিল পুরোপুরি শহুরে। পারিবারিকভাবে দেখাশোনা করে বিয়ে হয় তাদের। নয়না একটা স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল শ্বশুরবাড়িতে।
কিন্তু বিয়ের পর নয়না এসে দেখলো তার এই নতুন জীবনের অনেক কিছুই তার চিন্তা-ভাবনার সাথে মেলেনা। তার সাজপোশাক, সহজ জীবনযাত্রা, সাদাসিধে কথা বলার ভঙ্গি—সবকিছুতেই শহরের লোকেরা তাকে একটু ভিন্ন চোখে দেখতে শুরু করলো। অয়নের পরিবারের লোকেরা তার সাথে ভালো ব্যবহার করলেও নয়না অনুভব করলো, তার স্বপ্নগুলো হয়তো এখানে পুরোপুরি খাপ খাবে না।
এতে নয়না খুবই মনমরা হয়ে পড়লো। একদিন অয়ন তার মন খারাপের কারণ জিজ্ঞেস করলে নয়না সব খুলে বলল। নয়নার কথা শুনে অয়ন উপলব্ধি করলো, তার জন্য এই পরিবেশটা খুব কঠিন। অয়ন তাকে আশ্বস্ত করল যে নয়না তার মতোই থাকবে। তার গ্রামের মাটির সাথে জুড়ে থাকা সাধাসিধে পরিচয়কে অয়ন নিজেও শ্রদ্ধা করতে শিখল।
বিয়ের কিছুদিন পরেই নয়না তার গ্রামের স্কুলে একটি শিক্ষামূলক প্রোগ্রাম চালু করার ইচ্ছা প্রকাশ করল, যা শহরের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্যও সহায়ক হবে। অয়ন তার এই উদ্যোগে পাশে দাঁড়ালো এবং নিজের পরিবারকেও এই কাজে সহযোগিতার জন্য অনুপ্রাণিত করল। সময়ের সাথে সাথে নয়নার উদ্যোগ ও কর্মক্ষমতাকে অয়নের পরিবারও শ্রদ্ধা করতে শুরু করল।
শহরের নতুন পরিবেশে থেকেও নয়না তার গ্রামের মাটি, তার শিক্ষাদানের প্রেরণাকে বাঁচিয়ে রাখলো, আর অয়নও শিখলো, প্রকৃত ভালোবাসা ও সম্মান তখনই পূর্ণতা পায় যখন মানুষ একজন আরেকজনের স্বপ্ন ও পরিচয়কে মেনে নিতে পারে।
বিয়ের প্রথম দিকে অয়নের ভালোই লাগছিল নয়নার সাদাসিধে, সহজ-সরল জীবনযাপন। তার মনে হয়েছিল, নয়নার মধ্যে এমন কিছু আছে যা শহরের চাকচিক্যে পাওয়া সম্ভব নয়। পরিবারের সবাইও নয়নাকে মেনে নিয়েছিল, কারণ তারা ভেবেছিল, সময়ের সাথে সাথে নয়নাও শহরের আচার-আচরণ, শপিং মল, পার্টির জীবনে মানিয়ে নেবে।
কিন্তু নয়না এসবের প্রতি আকৃষ্ট ছিল না। পার্টিতে গেলে সে চুপচাপ এক কোণে বসে থাকত, শহরের আধুনিক মেয়েদের মতো হয়ে উঠতে পারেনি সে। তার পোশাক, কথাবার্তা, এবং সহজ সরল জীবনযাত্রা দেখে অয়নের পরিবার ধীরে ধীরে বিরক্ত হতে শুরু করলো। তারা চাইছিল, নয়না যেন তাদের মতো আধুনিক হয়, যেন সে পার্টিতে সবার সাথে মিশে, আর শহুরে জীবনের আচার-আচরণ রপ্ত করে।
নয়না চেষ্টা করেছিল পরিবর্তন আনতে, কিন্তু তার ভেতরের সত্ত্বা সবসময় তাকে নিজের মতোই থাকতে বলত। সে ভাবত, সত্যিকারের ভালোবাসা তো মানুষকে তার নিজের মতো গ্রহণ করে। কিন্তু অয়নের পরিবার বারবার তাকে বুঝিয়ে দিত, সে যেন "আরও আধুনিক" হয়ে ওঠে। আর এসব চাপের কারণে অয়নের মধ্যেও একটা পরিবর্তন আসতে শুরু করল। সে ভাবতে লাগল, হয়তো নয়না কখনওই তার জীবনের সাথে মানিয়ে নিতে পারবে না।
একদিন অয়ন এক পার্টি থেকে ফিরল, যেখানে সবাই তার স্ত্রীর কথাবার্তা আর পোশাক নিয়ে নানা ধরনের মন্তব্য করছিল। অয়ন বিরক্ত হয়ে বাড়ি ফিরে নয়নাকে বলল, "তুমি কেন পারো না একটু বদলাতে? সবাই তোমাকে নিয়ে হাসে। তুমি আমার সম্মানহানি করছো।"
নয়না স্তম্ভিত হয়ে গেল। সে কখনও ভাবেনি, তার আপন সত্তা একদিন তার স্বামীর জন্য সম্মানহানির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। কষ্টে ভরা কণ্ঠে সে বলল, "আমি কি ভুল কিছু করেছি? আমি তো তোমার ভালোবাসা অর্জন করতেই চাইছিলাম, কিন্তু নিজের পরিচয় হারিয়ে নয়।"
অয়ন কিছু বলল না, কিন্তু তার মনে কষ্ট বাড়তে থাকলো। এভাবে দুজনের মধ্যে দিন দিন দূরত্ব বেড়ে গেল। পরিবারও অয়নকে নানা ভাবে বুঝিয়ে বলল, সে যেন নয়নাকে বদলানোর চেষ্টা চালিয়ে যায়।
নয়না এখন নিজেকে বন্দি মনে করতে লাগল, তার নিজস্বতা যেন হারিয়ে যাচ্ছে। একদিন সে সিদ্ধান্ত নিল, এই দূরত্বকে কমাতে হলে তাদের দুজনেরই আরও ভালো করে বুঝতে হবে যে সম্পর্কের জন্য শুধু মানিয়ে চলাই নয়, বরং একে অপরকে মেনে নেওয়া, গ্রহণ করাটাও প্রয়োজন। সে তাই অয়নের কাছে প্রস্তাব দিলো, "আসুন আমরা কিছুদিন আলাদা থাকি, যেন আমাদের নিজেদের কিছুটা সময় ও স্পেস পাই। হয়তো তবেই আমরা বুঝতে পারবো আমাদের সম্পর্কের প্রকৃত চাহিদা কি।"
নয়না যখন অয়নকে ছেড়ে গ্রামে ফিরে গেল, তার জীবন যেন নতুনভাবে শুরু হলো। গ্রামের সেই সাদামাটা মেয়েটা নিজেকে ভেঙে আবার গড়তে শুরু করল। একদিকে ভাঙা সম্পর্কের কষ্ট, অন্যদিকে নিজের আত্মবিশ্বাসকে ফিরিয়ে আনার সংকল্প—এই দুই শক্তির উপর ভর করে নয়না আবার পড়াশোনায় মন দিল। সে নিজের শিক্ষার আরও বিকাশ ঘটাল এবং ধীরে ধীরে সমাজে নিজের একটা পরিচয় গড়ে তুলল।
অন্যদিকে, অয়নও নতুন করে জীবন শুরু করেছিল। তার জীবনে আসা শহরের আধুনিক মেয়েটির সাথে সম্পর্কেও সে প্রথমে অনেক ভালোবাসা খুঁজে পেয়েছিল, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সে উপলব্ধি করল, সেই সম্পর্কের মধ্যে কোথাও যেন একটা শূন্যতা রয়েছে। হয়তো নয়নার সহজ-সরলতা আর ভালোবাসার পরশই সে মিস করছিল। কিন্তু তখন আর ফিরে যাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না।
নয়নার আত্মবিশ্বাস ও শক্তি তাকে একটা প্রতিষ্ঠিত পর্যায়ে নিয়ে গেল। সে সমাজে নারীর ক্ষমতায়ন এবং শিক্ষা নিয়ে কাজ করতে শুরু করল। তার কাজের প্রতি নিষ্ঠা ও একাগ্রতার জন্য খুব দ্রুত সে সকলের নজরে আসল। একদিন তাকে একটি বড় সেমিনারে প্রধান বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হলো, যেখানে সে নারীদের আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠার কথা বলবে।
সেমিনারের দিনটি ছিল নয়নার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সে মঞ্চে উঠল, আর তার সামনে বসে থাকা শত শত মানুষ তাকে গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। তার কথাগুলো ছিল হৃদয় থেকে আসা, প্রতিটি বাক্যে ছিল সংগ্রাম, প্রতিটি কথায় ছিল স্বপ্ন পূরণের অদম্য ইচ্ছা। কিন্তু তার অজান্তেই দর্শকদের মধ্যে বসেছিল অয়ন—তার প্রাক্তন স্বামী, যে তার এই পরিবর্তিত চেহারা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল।
অয়নের চোখের সামনে সেই সহজ-সরল নয়না যেন পরিণত হয়েছে এক দৃঢ়চেতা নারীতে। সে উপলব্ধি করল, নয়না এখন আর সেই গ্রামের সাদাসিধে মেয়ে নয়; বরং নিজের গুণ ও পরিশ্রমের মাধ্যমে সে সমাজে নিজের আলাদা পরিচয় গড়ে তুলেছে। নয়নার প্রতিটি কথা যেন তার ভেতরটা নাড়া দিয়ে যাচ্ছিল, মনে পড়ে যাচ্ছিল সেই সময়গুলো, যখন সে নয়নার মূল্যায়ন করতে পারেনি।
নয়না তার বক্তৃতা শেষ করল, এবং উপস্থিত সবাই তার কাজ ও কথাবার্তার জন্য প্রশংসা করল। কিন্তু নয়নার চোখ হঠাৎই পড়ল অয়নের দিকে। দুজনের চোখে চোখ পড়ল, মুহূর্তেই পুরনো স্মৃতির ঢেউ বইতে লাগল। দুজনই বোঝে, তাদের সম্পর্ক আর ফিরবে না। কিন্তু নয়না অয়নের দিকে তাকিয়ে একটা শান্ত মৃদু হাসি দিল—যেন বলতে চাইছে, "তোমার জন্য কষ্ট হলেও, এই যাত্রায় আমি নিজেকে খুঁজে পেয়েছি।"
অয়নও শান্তভাবে মাথা নোয়ালো, যেন নিজের ভুলগুলো মেনে নিচ্ছে। সে অনুভব করল, নয়না নিজের জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে আরও উজ্জ্বল হয়েছে। সেদিন, দুজনেই একে অপরকে বুঝতে পারল এবং মনের গভীরে এক শান্তি অনুভব করল—যেন সেই বিচ্ছেদের মধ্যেই তারা দুজনই নিজের নিজের পথে সঠিকভাবে এগিয়ে গেছে।
অয়ন যখন নয়নার সাথে সম্পর্ক ভেঙে নতুন সম্পর্কের মধ্যে জড়িয়েছিল, তখন সে ভেবেছিল, শহরের আধুনিক, চটপটে মেয়েটি তার জীবনে আনন্দ ফিরিয়ে আনবে। পরিবারের সবারও একই ধারণা ছিল—এই সম্পর্ক তাদের অভিজাত পরিবারের জন্য উপযুক্ত হবে, সামাজিক মর্যাদা এবং নাম থাকবে। কিন্তু সেই মেয়েটির উদ্দেশ্য ছিল অন্যরকম। সে অয়নের প্রতি আসল ভালোবাসা নয়, বরং তার অর্থ, সম্পত্তি, এবং সামাজিক অবস্থানের প্রতি আগ্রহী ছিল।
অয়ন প্রথমে এই বিষয়টি বুঝতে পারেনি, কারণ সে নতুন সম্পর্কে মানিয়ে নিতে এবং নিজেকে আরও আধুনিক প্রমাণ করার চেষ্টা করছিল। তবে ধীরে ধীরে তার চোখে ধাঁধা কেটে যেতে শুরু করল। সে দেখল, এই মেয়েটি তার জীবনের খুশির চেয়ে নিজের চাহিদাকে গুরুত্ব দেয়, আর সম্পর্কের প্রতি সেই আন্তরিকতা নেই যা নয়নার মধ্যে ছিল। একসময়, মেয়েটি পুরোপুরি অয়নকে ছেড়ে চলে গেল—যেমন ভাবে এসেছিল, তেমন করেই চলে গেল। সে যা চেয়েছিল তা পায়নি, আর যেহেতু সম্পদই তার আসল উদ্দেশ্য ছিল, অয়নের জীবনে তার কোনো স্থায়ী অবস্থান ছিল না।
এই অভিজ্ঞতা অয়নের জন্য এক বড় শিক্ষা হয়ে দাঁড়াল। সে উপলব্ধি করল, সম্পর্ক মানে শুধু বাহ্যিক আধুনিকতা নয়; বরং তার ভেতরের গভীরতা, সম্মান, এবং সততা আরও গুরুত্বপূর্ণ। সে স্মরণ করল নয়নার সেই সহজ, সাদাসিধে জীবনযাপন, যেখানে কোনো ভেজাল ছিল না, ছিল শুধু ভালোবাসা আর আন্তরিকতা।
অয়নের পরিবারও এবার উপলব্ধি করল, শুধু আধুনিকতার মোড়ক দিলেই সম্পর্ক টেকে না। শিক্ষিত এবং সৎ হওয়াটাও সমান প্রয়োজন, যেখানে মানুষের ভিতরের সৌন্দর্য প্রকৃত ভালোবাসা এনে দেয়। তারা বুঝল, নয়নার মতো মেয়ের মধ্যে যে শিক্ষা, শালীনতা, আর আত্মসম্মান ছিল, সেটাই সত্যিকারের মূল্যবান।
অয়ন এবং তার পরিবার এই ভুল বোঝাবুঝি থেকে শিক্ষা পেল। এবার তারা জানল, সত্যিকারের সম্পর্কের জন্য বাহ্যিক চাকচিক্য নয়, বরং আন্তরিকতা, শিক্ষা এবং মূল্যের উপর ভিত্তি করেই সম্পর্ককে টেকানো সম্ভব। আর এই শিক্ষা তাদের ভবিষ্যতের জন্য দায়িত্বশীল এবং মানবিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করল, যাতে জীবনের মূল ভিত্তি কখনোই হারিয়ে না যায়।
নয়না দীর্ঘদিন ধরে নিজেকে প্রমাণ করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছিল, আর তার সেই পরিশ্রমের ফলস্বরূপ এবার সে এমজি কোম্পানিতে চিফ ডিরেক্টর হিসেবে যোগদান করতে চলেছে। এটি ছিল তার জীবনের এক বড় সাফল্য, তার শিক্ষা, আত্মবিশ্বাস, এবং যোগ্যতার প্রমাণ। নয়নার জন্য এটি শুধু একটি পদ নয়, বরং তার দীর্ঘ যাত্রার প্রতিফলন, যা তাকে শূন্য থেকে শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছে।
সেদিন অফিসের সবাই তার জন্য অপেক্ষা করছিল, আর তার জন্য ফুলের তোড়া নিয়ে এক উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। সবাই জানত, নয়না কেমন অধ্যবসায় ও দৃঢ় মনোবলের অধিকারী, তাই সবাই তার অভ্যর্থনায় উদগ্রীব ছিল।
ঠিক তখনই কালো রঙের একটি মার্সিডিজ বেঞ্জ এসে থামল অফিসের সামনে। গাড়ি থেকে নেমে আসার পরপরই নয়নার চোখ পড়ল সেই মানুষটির দিকে, যাকে একসময় সে তার জীবনসঙ্গী হিসেবে ভেবেছিল—অয়ন। অয়নও সেই ভিড়ের মধ্যেই দাঁড়িয়ে ছিল, নয়নার নতুন এই পরিচয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল তার দিকে। নয়নার মনে তখন বহু পুরনো স্মৃতির ঢেউ খেলতে শুরু করল, কিন্তু সে জানত, এখন আর সেই স্মৃতির দিকে ফিরে তাকানোর সময় নেই।
অয়নের সাথে চোখাচোখি হওয়ার পর নয়নার কেমন যেন অস্বস্তি হতে লাগল। তার মনে হচ্ছিল, এ যেন তার জীবনের একটি বড় পরীক্ষা। তার কপালে ঘাম জমে উঠল, আর এক অদ্ভুত নার্ভাসনেস তাকে আচ্ছন্ন করল। তার পাশে দাঁড়ানো একজন তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে অফিসের ঘরে বসিয়ে দিলেন। সে শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল।
কিন্তু এই মুহূর্তটি তাকে উপলব্ধি করাল, সে কতটা এগিয়ে গেছে। নয়না ধীরে ধীরে নিজেকে স্থির করল এবং নিজের ভেতরের সেই শক্তিটুকু আবার খুঁজে পেল। সে জানত, এখন সে এক নতুন পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত, এবং এই পরিচয় তাকে তার প্রাক্তন জীবনের সীমানা ছাড়িয়ে অনেক দূরে নিয়ে এসেছে। এই নতুন পরিচয়ে সে শুধু নয়না, একজন সফল পেশাজীবী নারী, যাকে তার যোগ্যতা আর অধ্যবসায় শীর্ষে নিয়ে এসেছে।
নয়না নিজের ভাবনাগুলোকে সংযত করে অফিসের কাজে মন দিল। সে জানত, আজ থেকে তার পথ নতুন, এবং সে সেই পথেই সাফল্যের সাথে এগিয়ে যাবে, যাতে তার অতীত কখনও তার বর্তমান বা ভবিষ্যৎকে প্রভাবিত করতে না পারে।
নয়না কখনোই অয়নের সাথে সংসার বাধার স্বপ্ন দেখেনি। জীবনের কঠিন অভিজ্ঞতাগুলো তাকে শিখিয়েছিল, তার জীবনের লক্ষ্য শুধুই নিজের স্বপ্ন পূরণ আর অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানো। তাই সে বেছে নিল একাকী জীবন, কিন্তু এই একাকীত্বকে কোনোভাবে কষ্টের মতো অনুভব করেনি। বরং এই একাকীত্বই তাকে দিয়েছিল এক নতুন লক্ষ্য—পথশিশুদের জন্য একটি বিদ্যালয় গড়ে তোলার।
এই বিদ্যালয়টি শুধু শিক্ষার কেন্দ্র নয়, বরং ভালোবাসা ও সহানুভূতির ছায়া। নয়না তার সমস্ত ভালোবাসা আর যত্ন ঢেলে তৈরি করেছিল এই স্কুলটি। সে চেয়েছিল, তার মতো যেসব শিশুদের জীবনে সীমাহীন বাধা, অভাব, আর বঞ্চনা রয়েছে, তাদের জন্য সে একটি নতুন দিগন্ত খুলে দেবে। স্কুলে প্রতিটি শিশুকে সে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসত, তাদের জন্য খাবার, পোশাক, আর শিক্ষার ব্যবস্থা করত।
সময়ের সাথে সাথে নয়না তার জীবনের পূর্ণতা খুঁজে পেয়েছিল এই শিশুদের মধ্যে। তাদের হাসি, তাদের সাফল্যই ছিল নয়নার জীবনের আনন্দের উৎস। তিনি জানতেন, তার জীবনের সার্থকতা এভাবেই পরিপূর্ণ হবে, এবং তিনি গর্বের সাথে একাকী জীবন কাটিয়ে এই কাজের মধ্যেই নিজের শান্তি খুঁজে পাবেন।
0 মন্তব্যসমূহ