বন্ধুত্ব







বন্ধুত্ব

অতনু সরকার।







 পাহাড়ের কোলে ছোট্ট একটা শহর। শহরটাকে দেখলে মনে হবে সাজানো গোছানো প্রাকৃতিক একটা দৃশ্যে ভরপুর মনোরম জায়গা। ঘুরতে ঘুরতে কে যে কখন কোথায় উপস্থিত হয় তা কেউ বলতে পারে না। আমি ভ্রমণপিপাসু মানুষ। চিরদিন নতুন নতুন শহর গ্রাম আর নতুন সভ্যতা দেখার লোভ সামলাতে পারিনা তাই ঘুরছি এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। চারিদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। চোখের আরাম হয় সবুজে। আসলে আমরা যে শহরে থাকি সেখানে ইট, কাঠ পাথর, কংক্রিটের একটা শহর। গাছপালা খুবই কম বলা যেতে পারে। সবুজ দেখা যায় কম। ফলে প্রকৃতির টানে যখন বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি তখন দুচোখ ভরে দেখেছি সবুজ প্রকৃতিকে। সিকিম থেকে হিমাচল প্রদেশ, সমুদ্র থেকে পাহাড়, পর্বত, নদী, ঝর্ণা আরো কত কিছু দেখেছি। দেখেছি মালভূমি, দেখেছি সমভূমি। আর এই শহরটা অবস্থিত পশ্চিমঘাট পর্বতমালা যেখানে শেষ হয়েছে ঠিক সেই দিকটা অর্থাৎ পর্বতের লেজের দিকটা বলা যেতে পারে। তবে এখানে পর্বতমালা যে বিরাট উঁচু তা নয়। এখানে পর্বতমালা অনেকটা দূর বিস্তৃত হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে চারিদিকে আর তারই মাঝে ছোট ছোট গ্রাম। কত নাম না জানা গাছ তাদের  বাহারি ফুল নিয়ে  দাঁড়িয়ে আছে। গতকাল রাতে হঠাৎ মেঘ জমে বেশ বৃষ্টি হলো। এখানে এসেছি ব্যক্তিগত কাজে। ইচ্ছামত থাকবো ঘুরবো আর কাজ মিটাবো। যদিও এখানে থাকার জন্য একটা ঘর পেয়ে গেলাম। খাওয়া দেওয়ার চিন্তা নেই। সুতরাং  কাজ করার বাকি সময়টা আমি পুরোটাই ফাঁকা। ওই ফাঁকা সময় টাতে বিশ্ব প্রকৃতির অপরূপ সৃষ্টি গুলোকে দেখতে এত ভালো লাগে না, বলে বোঝাতে পারবো না।  কেন জানিনা প্রকৃতির টানে বারবার ছুটে এসেছি প্রকৃতির বুকে। ভালোবাসি নানা রকমের গাছ পালা ফুল আর সুন্দর পরিবেশ। সারিসারি গাছ তার ভিতর দিয়ে সরু সরু রাস্তা চলে গেছে এদিক ওদিক। ছায়াময় সেই সরু পথগুলো দিয়ে হেঁটে যেতে কেমন যেন একটা মায়াবী পরিবেশের মতন লাগে।

যখন চক্রবালের সূর্য অস্তিমিত হয় তখন পাহাড়ের মাথায় লাল রঙের আবির খেলে যায়। ভাসমান মেঘগুলি লাল হয়ে ওঠে। কখনো কখনো সেই লালচে রং কেমন যেন দুধে আলতার মতো হয়ে যায়। তার চারপাশে সাদা মেঘগুলো ঘুরে বেড়ায় দেখে অপূর্ব লাগে। এখানে একটা হোস্টেলে আছি। ভাষার মাধ্যম একমাত্র ইংরাজি। ইংরেজি যে খুব ভালো জানি তা নয়। কিন্তু কাজ চালিয়ে দেবার মতন জানা আছে। তাই অসুবিধা হচ্ছে না। একটা গল্পের বই পড়ছিলাম। হঠাৎ দরজার সামনে একটা ছায়া মূর্তি এসে দাঁড়ালো। নানা ভূতের গল্প নয়। ভূতের কথাও বলছি না দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো একজন নারী। মুখ দেখে বয়স কিছুটা অনুমান করা যায় সম্ভবত ৩৫ বা ৪০ এর মধ্যে হবে। তার বয়স অনুমান করাতে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। তিনি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ডাকলেন আমায়। আমি কাছে যেতেই জিজ্ঞাসা তিনি জিজ্ঞাসা করলেন আমার নাম অর্পণ কিনা। 

আমি একটু বিস্মিত হয়ে বললাম হ্যাঁ আমার নাম অর্পণ কিন্তু আপনি কি করে জানলেন। 

ভদ্রমহিলা উত্তর দিলেন আমি জানিনা আমি চিনিও না আমার বাবা আপনাকে চিনি তিনিই আমাকে পাঠালেন। যদি কিছু মনে না করেন তাহলে একবার চলুন বাবা ডাকছে আপনাকে। আমি একটু অবাক হয়েই ভাবলাম এই অজানা অচেনা শহরে হঠাৎ আমাকে কে চিনবে দেখা যাক। কে তিনি তাই দরজাটা বন্ধ করে ওই ভদ্র মহিলার সঙ্গে হাটতে লাগলাম। 

কথা প্রসঙ্গে বলে রাখি, উনার সঙ্গে সমস্ত কথাই ইংরেজিতে হয়েছিল আমি যেহেতু ইংরেজিতে কাঁচা তাই বাংলাতে লেখার চেষ্টা করছি। বাংলা ছাড়া ইংরেজি আমার খুব একটা আসে না। প্রয়োজনে কাজ চালিয়ে নেওয়ার মতন একটু আধটু জানি এইটুকুই। 

দীর্ঘ বারান্দা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভদ্রমহিলা নিজেই তার পরিচয় দিলেন। বললেন - আমার নাম আনুথা মুথু বিশ্বাস।

বিশ্বাস টাইটেলটা শোনার পর সত্যিই একটু অবাক হলাম। তামিলনাড়ুতে আনুথা মুথু বিশ্বাস কি করে হলো। 

কৌতূহল চেপে রাখলাম কিন্তু বললাম আপনার কি জন্ম এখানে। 

তিনি  ইংরেজিতে বললেন -আমার বাবা বাঙালি মা তামিল। বিখ্যাত মুথু পরিবারে আমার জন্ম। আমার পড়াশোনা বেড়ে ওঠা সব এই স্কুল থেকে এবং এই কলেজ থেকে তারপর পড়াশোনা শেষ করে চাকরিও করছে এখানে। না না বাবা মায়ের দৌলাতে নয় নিজের যোগ্যতায়। আমি ডক্টরেট করেছি। তারপর চাকরির পরীক্ষায় পাস করে চাকরির জন্য বেছে নিয়েছিলাম এই জায়গাটা। কারণ এটা আমার ছোটবেলার একটা প্রিয় জায়গা। এই স্কুল আর এই কলেজ থেকেই আমি শেষ করেছি আমার পড়াশোনা। 

বলতে বলতে কিছুটা পথ এগিয়ে এসেছি। একটা দরজার সামনে দাঁড়ালাম। দরজার উপর লেখা আছে চেয়ারম্যানের ঘর। দরজায় শব্দ করে আনুথা দরজাটা খুললো -বলো বাবা এই যে উনি এসেছেন। 

আমি তো দেখে বিশ্বাস করতে পারছি না। আমার অতি পরিচিত সুকোমল বিশ্বাস। উনার কাছে আমি নানাভাবে ঋণী। কারণ উনার হাত ধরেই আমি পড়াশোনা আর খেলাধুলার জগতে অবাধ বিচারণ করতে পেরেছিলাম। বহু বছর আগে উনি চলে এসেছেন এখানে কিন্তু এইভাবে যে দেখা হবে তা মোটেই অনুমান করতে পারিনি আমি। চিনতে ভুল হয়নি আমার কারণ ওনার মুখের বাঁদিকে ছিল একটা বড় তিল। চুলগুলো একটু পাক ধরেছে। একটা দুটো কালো আছে এই বেশিরভাগটি সাদা। কিন্তু দেখে মনে হয় যথেষ্ট যুবক। আমি ওনার কাছে এগিয়ে গিয়ে প্রণাম করলাম। বললাম আপনি আমাকে কিভাবে চিনলেন আর এইখানে আপনাকে দেখব আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি না। 

সুকমল কাকু গম্ভীর ভাবে উত্তর দিলেন -ছোটবেলা থেকে দেখছি, চিনতে পারব না।

আমি মনে মনে বললাম চেনা টাই স্বাভাবিক কারণ অনেকগুলো বছর ওনার ছত্রছায়ায় কাটিয়েছি মাঠে এবং মাঠের বাইরে। পড়াশুনার ক্ষেত্রে বা খেলাধুলার ক্ষেত্রে উনি নানাভাবে আমাকে সাহায্য করেছেন বলা যেতে পারে উনি ছিলেন আমার একজন পথপ্রদর্শক।

সুকমল কাকু আমাকে বসতে বললেন সামনের চেয়ারে। তারপর আনুথা কে বললেন - এ আমার খুব পরিচিত। আমার ছাত্র বলতে পারো। খুব ভালো খেলাধুলা করতেও পড়াশোনায় ভালো ছিল। 

আনুথা সুকোমল কাকুর কথা শুনে আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো তারপর পাশের চেয়ারটা টেনে বসলো। 

সুকোমল কাপ এবার আমাকে বললেন -শুনেছিলাম বাংলা থেকে একজন আসবে কিন্তু তুমি আসবে এটা তো আমি কল্পনা করতে পারিনি যাই হোক ভালই হয়েছে তোমার ঘর ঠিকঠাক করে আমি সাজিয়ে দেব কোন সমস্যা হবে না। এখানে কোন সমস্যা হলে অবশ্যই তুমি আমাকে জানাবে।অনুথা এখানে আছে তাকেও জানাতে পারো।

আমি বললাম আপাতত কোন অসুবিধা হচ্ছে না কাকু। সবকিছুই ঠিকঠাক আছে। কিন্তু মাঝেমধ্যে বড় একা লাগে এই বিরাট বাড়িটাতে। যদিও লেখালেখি করে সময় কেটে যায়। 

সুকমল কাকু আমার দিকে চেয়ে বললেন- তুমি লেখালেখিও করো নাকি।

আমি মাথা নত করে বললাম - নিজের শখের বসে করি। ভালো লাগে তাই সময় কাটতে চায় না তাই লিখি তেমন কিছু না।

এই কথাগুলো বাংলায় বলছিলাম তাই আনুথা বুঝতে পারছিল না। সে জানতে চাইলো আমি কি বলছি। 

বাধ্য হয়ে তাকে ইংরেজিতে বোঝানোর চেষ্টা করলাম। 

সঙ্গে সঙ্গে এসে বলল, আমার একটা লেখা পড়ে শোনাতে। 

আমি তাকে বললাম বাংলা ভাষায় লেখা আপনি বুঝতে পারবেন না। সে কিন্তু বলল আপনি বলুন আমি চেষ্টা করছি বোঝায় না হলে আমাকে পাঠান একটা লেখা আমি গুগলের ট্রান্সলেট করে নেব। 

আনুথা আগ্রহ দেখে আমি তাকে আমার ওয়েবসাইটের লিংক শেয়ার করে দিলাম।

কিছুক্ষণ কথা বলার পর আমি ফিরে এলাম আমার ঘরে। পরেরদিন বিকেলে যখন স্কুল ছুটি হয়ে গেল তখন আনুথা করিডোর দিয়ে হেটে যাচ্ছিল। সামনাসামনি দেখা হতেই কথা বলতেই হল। 

আনুথা বললেন- আপনার লেখাগুলো দু-একটা আমি পড়েছি। গুগলে ট্রান্সলেট করে। খুব ভালো লাগলো। ইংরেজিতেও তো লিখতে পারেন।

আমি হাসতে হাসতে বললাম -আমি যদি ইংরেজিতে লিখি তাহলে ইংরেজি ভাষাটাই উঠে যাবে। 

 আনুথা হো হো করে হেসে উঠলো। প্রাণ খোলা উচ্ছল একটা হাসি। হাসতে হাসতে বললেন - একদিন আসুন না আমার ফ্ল্যাটে, গল্প করা যাবে। আপনার যেদিন ছুটি থাকবে বলবেন আমি গাড়ি পাঠিয়ে দেব। ফোন নাম্বারটা লিখে দিন, আচ্ছা থাক আপনার ফোন নাম্বারটা দিন।

আমার থেকে ফোন নাম্বার নিয়ে অত্যন্ত সহজ সরল ভঙ্গিমায় নিজের কাজে চলে গেল। আমিও আমার কাজে বেরিয়ে পড়লাম। 


রবিবার সকাল ৭ টা। বিকেলে খেলা আছে তাই সকালটা ছুটি। জানলার ধারে বসে বাইরের প্রকৃতিটা দেখছিলাম। মাঝেমধ্যে ফেসবুকে কে কি ছবি পোস্ট করেছে সেটাও দেখছিলাম। ঠিক সেই সময় ফোনটা বেজে উঠলো। অপর প্রান্তে আনুথা মুথু বিশ্বাস। 

ফোন করে বললেন - “গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। চলে আসুন। আজ সকালে প্র্যাকটিস নেই আমি জানি। ক্লাবের ফাউন্ডার কে জানিয়ে দিয়েছি। আজ এখানেই খাওয়া দাওয়া করবেন সুতরাং প্রস্তুত হয়ে চলে আসুন”। 

কথাটা শেষ করেই ফোনটা কেটে দিল। আমাকে কথা বলার সুযোগই দিল না। অগত্যা প্রস্তুত হয়ে নিলাম। তাড়াতাড়ি স্নান সেরে জামা কাপড় পড়ে সবে নিচে নেমেছি। দেখি অনেকক্ষণ আগেই গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে। 

১০ মিনিটের পথ। আমি যখন বিয়ে পৌছালাম তখন সুখ অমল কাকু বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। 

আমি তাকে বললাম - কাকু আপনি কোথায় চললেন?

তিনি উত্তর দিলেন - এটা আমার বাড়ি না। এখানে আমু মনে আনুথা একাই থাকে। আমি থাকি আরেকটু দূরে। আমি এসেছিলাম একটা  দরকারে। মিটেগেছে চলে যাচ্ছি। তুমি আসবে শুনেছি।  যাও সমস্যা নেই। 

সুকমল কাকু বেরিয়ে গেলেন। যে গাড়িতে আমি এসেছিলাম সেই গাড়িতেই উনি বাড়িতে যাবেন যাওয়ার আগে বলে গেলেন “আমার বাড়িতে যেতে হবে একদিন”।

আমি মাথা নিলি সম্মতি জানিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখি আনুথা দাঁড়িয়ে আছে দরজার কাছে। আমাকে আহ্বান জানালেন তারপর ভিতরে বসার ঘরে বসতে দিলেন। বসার সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে দিলেন সকালের জলখাবার। আমি যেহেতু বাঙালি তাই চাপাটি একটা সবজি তরকারি খেতে দিলেন। আনুথা বললেন আমার ডাক নাম আমু, আপনি আমাকে আমু বলবেন। তার পর শুরু হল গল্প। কথায় কথায় বাড়তে লাগলো বেলা। সে নানান কথা। আমার কথা। বাড়ির কথা। ছোটবেলার কথা। কোথায় ছোট বেলা কেটেছে, কিভাবে কেটেছে। নানা রকমের গল্প।

আমি বললাম আমার কথা। আমার জন্ম মালয়েশিয়া। সেখানে তিন বছর থাকার পর আমি চলে আসি ভারতে। এই মুহূর্তে থাকি উত্তর ২৪ পরগনা জেলায়। এখানেই আমার বেড়ে ওঠা এবং স্কুল কলেজ সব। শোনালাম আমার জীবনের আরো অনেক গল্প। কথায় কথায় উঠে এলো আমু অর্থাৎ আনুথার কথা।

আমি বললাম আমার কথা তো অনেক শুনলেন এবার আপনার কথা কিছু শুনি। 

আমি তো হেসে ফেললেন।

বললেন - আমার কথা কি শুনবেন।  কিছু বলার মত নেই।  ছোটবেলা থেকে যৌবন কেটেছে স্কুলের গণ্ডির মধ্যে। কারণ ওখানেই কলেজ পর্যন্ত পড়াশোনা করেছি। তারপর প্রেমে করলাম। চেন্নাই থেকে ডক্টরেট করলাম। চাকরি পেলাম। বাবা মা বিয়ে দিয়ে দিল। তিন বছরের মাথায় দিয়ে ভেঙে গেল। আসলে আমি চেয়েছিলাম বিয়ে টা টিকিয়ে রাখতে। বাবার আর মায়ের সম্মানের কথা ভেবে। কিন্তু পারলাম না। বর খুব বদ মেজাজি ছিল বাবা বুঝতে পারিনি কথাটা শ্বশুরবাড়ি র লোকেরা খুব একটা ভাল ছিল তা নয়। তিনটে বছর আমি মুখ বুজে সমস্ত যন্ত্রণা সহ্য করে গেছি। চাকরি করেছি। আর আমার সমস্ত টাকা নিয়েছে আমার বর। উড়িয়ে দিয়েছে জুয়া খেলে। শেষ পর্যন্ত ডিভোর্স হলো তারপর আমি এই ফ্ল্যাটটা কিনলাম। বাবা কিছু টাকা দিয়েছিল মা ও কিছু টাকা দিলে আর আমি কিছু দিব এই ফ্ল্যাটটা নিলাম। ভাবছেন একা থাকি এত বড় ফ্ল্যাট কেন। আসলে আমি একটু খোলামেলা পছন্দ করি বড় জায়গা বড় ঘর কারণ আমাদের বাড়ি আপনি গেলে দেখবেন ঘর গুলো সব বড় বড়। বাবা মা আর ভাই থাকে আমাদের পুরনো বাড়িতে। আমি মাঝেমধ্যেই যাই কিন্তু এখানে একাই থাকি ভালই লাগে আমার সঙ্গী হচ্ছে পড়ার বই। আসেন আমার সঙ্গে ওই পাশের ঘরটা আমি লাইব্রেরী করেছি। 

আমু আমাকে তার লাইব্রেরী দেখাতে নিয়ে গেল। ঘরের চারটে দেয়ালের মধ্যে তিনটে দেয়াল জুড়ে বইয়ের র‍্যাক করা আছে। নিচ থেকে উপর পর্যন্ত প্রচুর বই। সেখানে যেমন রয়েছে ইংরেজি বই প্রেমী রয়েছে তামিল ভাষার নানান বই। 

তার বইয়ের অজস্র ভান্ডার দেখতে দেখতে বললাম -জানেন আমু আমিও কিন্তু বই পড়তে ভীষণ ভালোবাসি। এক সময় আমি ছিলাম বইপোকা। যদিও এখন সময় পাই না তাই পড়ে ওঠা হয় না।

আমি বই পড়ি শোনা মাত্রই তিনি বললেন - আরে আপনি তো আমার দলের লোক।

আমি বললাম -আপনার কাছ থেকে মাঝেমধ্যে একটা দুটো বই নিয়ে যাব। অন্তত বই পড়ে অবসর কাটানো যাবে। 

আমু বললেন -বই তো পড়বেন কিন্তু লিখবেন কখন? 

আমি বললাম -সময় ঠিক বার করে নেব অসুবিধা নেই 


  • কার লেখা ভালো লাগে?

  •  আমার তেমন কোন স্পেশাল লেখক নেই। বাংলায় হলে বলতাম শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ইংরেজিতে যে কোন একটা বই হলেই হবে। 

  • আমার কাছে শেক্সপিয়ার রয়েছে পড়তে পারেন। 

  • দিলে পড়বো ম্যাকবেথ আছে নাকি। 

  • আমার কাছে শেক্সপিয়ার সমগ্র রয়েছে আমি দিতে পারি অনেকগুলো পেয়ে যাবেন।

গল্পে কথায় খেয়া খাওয়া দাওয়াই সারাটা দিন কেটে গেল। দুপুর বেলা দুটোর সময় ফিরে এলাম হোস্টেলে। রাত দশটা নাগাদ আবার ফোন এলো আমুর।

অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এলো - কি করছেন একা একা? 

আমি বললাম - লিখছিলাম। আপনি কি করছেন একা। 

আমু - আমি একটা তামিল উপন্যাস পড়ছি। খুব সুন্দর জানি উপন্যাসটা। আপনি তো বুঝতে পারবেন না, না হলে আপনাকে দিতাম। 

আমি - আমি যেটা বুঝতে পারি সেরকম একটা দিলেই হবে। 

আমু - আচ্ছা কালকে আমি যখন যাব তখন একটা ভালো বই নিয়ে যাব। একটা জাপানি উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ। দারুণ গল্প ভালো লাগবে। আমার মতন এক মেয়ের কথা গল্পটি লিখেছেন ওকা নাকামুরা।

আমি বললাম  - বেশতো। নিয়ে আসবেন পড়ে দেখব। 

আমু বললেন - আরেকদিন আসবেন কিন্তু আর শোনেন না আমাদের এখানে পাহাড়ের উপরে রয়েছে ছোট্ট একটা গ্রাম চলুন একদিন ঘুরে আসি। 

ঘোরার লোভ সামলাতে পারলাম না বললাম - কবে যাবেন বলুন? যেদিন বলবেন সেদিন যাব।

আমু বললেন - যেদিন বলব সেদিন যাবেন? পরে রবিবার অবশ্যই যাবো বিকেলে। আপনাকে ছুটি নিতে হবে। 

আমি বললাম - বেশ চেষ্টা করব।

তিনি বললেন - চেষ্টা নয় যেতে হবে। 


পরে রবিবার বেরিয়ে পড়লাম দুপুর দুটো নাগাদ। আমুর গাড়ি এসে দাঁড়াল আমার হোস্টেলের সামনে। প্রায় ঘন্টা দেড়েক পরে আমরা পৌঁছে গেলাম পাহাড়ের উপরে আর একটা শহরে। শীত রয়েছে সমতলের মতন নয়। চারিদিকে সুন্দর সাজানো গোছানো বাড়ি রয়েছে সুদৃশ্য একটা পার্ক। রয়েছে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট ঝর্ণা। পাহাড়ের উপর থেকে নিচের বাড়িগুলো খুব সুন্দর দেখা যায়। এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ বেশ মনোরম। সেই মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে দুজনে হাটতে লাগলাম একটা রাস্তা ধরে গাড়িটা রাখা হয়েছিল পার্কের সামনে গ্যারেজে। লম্বা বিস্তৃত পাক চারিদিকে সুন্দর করে সাজানো গোছানো গাছপালা। আর এই নির্জন রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গল্প করতে করতে কখন যে একটা লেখের ধারে পৌছালাম বুঝতে পারলাম না এখানে বসলাম একটা চেয়ারে অপূর্ব সুন্দর করে সাজানো লেকটা। 

আমু বললেন -কতদিন মন খুলে কারো সঙ্গে কথা বলিনি আজকে না মনটা খুব হালকা লাগছে। কিছু মনে করবেন না আপনাকে ডাকলাম বলে আসলে আমার না গল্প করতে খুব ভাল লাগে।

আমি বললাম - গল্প করতে তো সবারই ভালো লাগে।

মনে মনে ভাবলাম আমার মতন শিক্ষিত, মার্জিত, প্রাণবন্ত সুন্দরী নারী পাশে থাকলে সকলেরই গল্প করতে ভালো লাগবে।

আমু বললেন -আমরা কি বন্ধু হতে পারি না? 

আমি বললাম -অবশ্যই পারি। অর্থাৎ বহুদূরে একাকী নিরবিচ্ছিন্ন দ্বীপের মাঝে কাটানো একটা বদ্ধ জীবনের মধ্যে একজন বন্ধু পেতে অসুবিধা কোথায়। 

আমু বললেন - আপনি তো বেশ সুন্দর করে কথা বলেন। আচ্ছা আপনি বিয়ে করেননি কেন। 

আমি বললাম - সুযোগ আর সময় কোনটাই হয়নি। ছোটবেলায় মা মারা যায় আর বড় হয়ে মারা গেল বাবা। পিসির কাছে আছি। পিসি কয়েকবার বলেছিলে আমাকে কিন্তু হয়ে ওঠেনি জানেন।

আমু বললেন - কিন্তু একাকী জীবন কাটানো খুব কষ্টের জানেন আমিও তো আছি বুঝি। দুঃসহ একটা জীবনের মতন। আশেপাশে সবাই আছে কিন্তু তার মধ্যেও দেখবেন আপনি একা।

আমি -ঠিক বলেছেন কিন্তু কি করবো বলুন তো আসলেই আমাদের মতন কম রোজগার করা ছেলেদের এখনকার মেয়েরা ঠিক পছন্দ করেনা। তাছাড়া আমি দেখতেও ঠিক অতটা ভালো না যে সহজে গায়ে পড়ে কেউ বন্ধুত্ব করবে বা প্রেম নিবেদন করবে।

আমু হাসলো আমার কথা শুনে তারপর বলল-প্রেম আর ভালোবাসা যাই বলেন না কেন এসব গায়ের রং অথবা সুন্দর বা সুন্দরী দেখে করতে গেলেই বিপদ। অন্তত আমার অভিমত আপনার সঙ্গে নাও নিতে পারে। আমার মনে হয় একজন ভালো বন্ধু হওয়ার আগে দরকার। 

আমি বললাম আপনার সঙ্গে আমি একমত - কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় আমার কপালে জুটলো না কেউ। তাই নিজের জায়গা ছেড়ে চলে এসেছি এখানে। কিছুদিন থাকি দেখা যাক কি হয়। 

আমু -কলেজ জীবনে জানেন আমি একবার প্রেমে পড়েছিলাম। যদিও সেটা দুদিন টিকে ছিল। আবেগ রূপ দেখে ভুলে ছিলাম। পরে জানলাম ছেলেটা ভালো না। যখন জানলাম সেই মুহূর্তেই নিজেকে সরিয়ে নিলাম। তারপর আর সাহস হয়নি। পরে মা-বাব বিয়ে ঠিক করেছিল। তাও টিকলো না। 

আমি বললাম - আমাদের বাংলায় একটা প্রবাদ আছে জন্ম মৃত্যু এবং বিয়ে তিন বিধাতা নিয়ে। কখন কার কপালে কে জুটে যায় কে বা বলতে পারে।

আমু আমার চোখে চোখ রেখে বললেন -আপনি বিশ্বাস করেন এটা। 

আমি বললাম - বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর।

আমু লেকের দিকে তাকিয়ে বললেন -  দেখুন মন জলের মত স্বচ্ছ হওয়া দরকার। ভালোবাসা হওয়া দরকার আয়নার মতন। তাহলে সম্পর্ক টিকতে পারে জানেন তো আয়না ভেঙে গেলে ভাঙ্গা আয়না আর মুখ দেখা যায় না। 

আমি- ঠিক বলেছেন আসলে বিশ্বাস আর পারস্পরিক আস্থা থাকলে তবে সম্পর্ক দীর্ঘদিন টিকে থাকে। যে সম্পর্কের মধ্যে ঝগড়া আছে সেই সম্পর্ক টিকে থাকে বেশি দিন। 

আমু -আপনি এত কথা জানলেন কি করে? 

আমি হাসতে হাসতে বললাম -উপন্যাস পড়ে। তা না হলে আর জানবো কোথা থেকে প্রেমও তো করতে পারলাম না আর সংসার তো দূরের কথা। 

আমু -উপন্যাস জীবনের কথা বলে। গল্প সমাজের আয়না। আসুন ওই দিকটাই একটু হেঁটে আসি অনেকক্ষণ বসেছি আর ভালো লাগছে না। 

আবার হাঁটতে লাগলাম। আসলে হাঁটতে খুবই ভালো লাগছিল। এই মনোরম একটা পরিবেশ নীল আকাশ আর চারিদিকে রোদ্দুর। কিন্তু শীতল আবহাওয়া। দুপুরের সেই নরম রোদ্দুর গায়ে মেখে সুন্দরী নারীর পাশে হাঁটতে সকল যুবকেরই ইচ্ছা করবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমি সেই যুবক কাল বেরিয়ে এসেছি অনেকদিন আগে। আমার মনের কথা হয়তো পৌঁছেছিল আমুর কাছে। 

তিনি বললেন - এই বয়সে এসে আর প্রেম করতে ইচ্ছা করে না। বাবা মা চাইছে আবার একটা বিয়ে দেবে জানেন। কিন্তু আমার একেবারেই ইচ্ছা নেই। আবার মাঝে মাঝে ভাবি এই দীর্ঘ একাকিত্ব জীবন বহন করাও তো সম্ভব নয়। সুন্দর একজন মানুষ খোঁজা দরকার। আমি বাবা মাকে বলেছি আমি যদি খুঁজে পাই কাউকে তাহলে ভেবে দেখব।

আমি - আপনার সিদ্ধান্ত সঠিক। এই বয়সে এসে ভুলভাল সিদ্ধান্ত জীবনকে ডুবিয়ে দিতে পারে তাই না। 

আমু - ওই জন্যই ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আচ্ছা আসুন না ওই রেস্টুরেন্টে একটু বসি। 

কথাটা ফেলতে পারলাম না দুজনে গিয়ে বসলাম একটা রেস্টুরেন্ট প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে সুন্দরভাবে সাজানো একটা রেস্টুরেন্ট। চারিদিকে কাচের দেওয়াল। আমরা যে দিকটায় বসলাম খুব একটা ভিড় ছিল না। আমু বললেন -আমার পক্ষে না সবসময় সব জায়গায় যাওয়া হয়ে ওঠেনা। ভালো লাগেনা সময় ও পায়না তাই আজকে এই রেস্টুরেন্টটা দেখি আর আপনাকে কি খেতে ইচ্ছা করছে খুব। হঠাৎ করে যেন একটু খিদে পেয়ে গেল। 

এবার আমার হাসির পালা আমি হাসতে হাসতে বললাম -বেশতো খিদে যখন পেয়েছে চলুন না খাওয়া যাক। 

আমু -কি খাবেন বলুন? 

আমি অকপট স্বীকার করে বললাম -দক্ষিণের খাবার সম্পর্কে আমার কোন আইডিয়া নেই। নামও জানিনা ভাষা ও বুঝিনা। তাই আপনি যা খাবেন আমিও তাই খাব। আপত্তি নেই কিছুতে।

সন্ধি ঠিক আগে ফিরে এলাম যে যারা আস্তানায়। তিনটা যে ভালো কাটবে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু মনটাও যে কোথায় হারিয়ে গেল বুঝতে পারলাম না। নিজের মনটাকে নিয়ে নিজেই সন্দেহে পড়লাম। তবে কি আমি…. না না এসব ভেবে লাভ নেই।

সকাল বিকাল রাত তিন বেলায় কথা হয় আনুথা মুথু বিশ্বাসের সঙ্গে। ফুল না করলে মনে হয় যেন কিছু একটা অধরা রয়ে গেছে। বেশিরভাগ সময় আমু ফোন করে। কারণ ও যখন ফাঁকা থাকে তখনই ও ফোনটা করে। 

চুল ছিল সব ঠিকঠাক হঠাৎ আমাকে ফিরতে হবে কলকাতায়। পিসি একা থাকেন তিনি অসুস্থ। যিনি আমাকে মানুষ করেছেন তাই অসুস্থ এর সংবাদ শুনে আমি আর থাকতে পারলাম না। দ্রুত প্লেনের টিকিট কেটে নিলাম। আপাতত মাদুরাইতে যেতে হবে আমাকে। আমু নিজে তার গাড়ি নিয়ে আমাকে পৌঁছে দিলেন মাদুরাই। বিদায় বেলায় ছল ছল চোখে তিনি জানালেন - বন্ধু আবার ফিরে আসবেন তো। আপনার জন্য অপেক্ষা করবো। 

অপেক্ষা করব কথাটা শোনার পর বুকের মধ্যে একটা ধরাস করে শব্দ হলো। তাহলে আমার ধারনা কি সত্যি নাকি শুধু বন্ধুত্ব। যদি শুধু বন্ধুত্বই হবে তাতে ক্ষতি নেই তার চোখে জল দেখে বুঝেছিলাম তার বন্ধুত্বের মধ্যেও কোন খাদ নেই। মাদুরাই বিমানবন্দরে এসে বুঝলাম প্রেম প্রেম খেলার থেকে জীবনে একটা ভালো বন্ধু অনেক বেশি দরকার। 

হঠাৎ আমার চোখেও আবেগে এলো জল। রুমালটা বার করে চোখ - মুখটা মুছে আমুর চোখে চোখ রেখে বললাম - আসবো বন্ধু। আপনার জন্য আর আমাদের বন্ধুত্বের জন্য আসতেই হবে আমাকে। 

দুরন্ত এক আবেগে আমু জড়িয়ে ধরল আমায়।

এর থেকে ভালো বন্ধুত্ব আর কি হতে পারে। এমন বন্ধুত্বকে অবহেলা করা যায়?

















একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ