অলৌকিক রাতের রহস্য
অতনু সরকার
আমার জীবন শরতের আকাশে ভাসমান এক খন্ড সাদা মেঘের মতো। কৈশোর বয়স থেকে জীবন নদের খেয়া বাইতে বাইতে কখন যে সমুদ্রে এসে পড়েছে তা বুঝতে পারিনি। আমি এক ভবঘুরে। আমার জীবন চলমান মেঘের মতো ভাসমান। প্রিয় কবি জীবনানন্দের মত আমিও বাংলা রূপে দিশাহারা। কিন্তু কবির মত আমি বাংলায় আবদ্ধ নই। যখন যেখানে মন চেয়েছে তখন সেখানে ছুটে গিয়েছি। অপরূপ বাংলাকে যেমন দেখেছি, সবুজ ঘেরা পাহাড় দেখেছি, আবার দেখেছি ফেনিল জলরাশি উচ্ছে পড়া সমুদ্র বক্ষ। যেখানকার সৌন্দর্য আমাকে মোহিত করেছে সেখানে রাত কাটিয়েছি। কারণ দিনের থেকে রাতের সৌন্দর্য আমাকে বেশি করে টানে। পাহাড় ঘেরা এই ধরমশালার একটা হোটেলে রয়েছে আমি। তারই জানালার ধারে বসে নীল আকাশের বুকে তারাদের দেখছিলাম। পাহাড়ের কোলে অজস্র বাড়ি। আকাশে যেমন তারারা জ্বলজ্বল করছে তেমনি নিচের দিকে তাকালে বাড়ি গুলিতে জ্বলা আলো গুলো দেখে মনে হয় হাজার হাজার তারারা নিচেও জ্বলজ্বল করছে। আমার জানালার অনুতি দূরে অরণ্য নেমেছে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে। আমার সঙ্গে এক পরিব্রাজক ছিলেন। তার সঙ্গে তীর্থ দর্শনই বেরিয়েছি। দুজনেই বৌদ্ধ কিন্তু ধর্মের ব্যাপারে কোন ছুত মার্গ নেই আমার। আমার কাছে ধর্ম হল সৌন্দর্য আর পবিত্রতার মিশ্রণ। যখন সত্য আর ন্যায়ের পথ দেখায় তখনই ধর্ম সার্থক হয়। আমার সঙ্গী পরিব্রাজক ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমার দেরি করে ঘুমানো অভ্যাস। তাই জানালা দিয়ে বাইরের প্রকৃতি দেখছিলাম। আমরা যে হোটেলটায় আছি, সেটা লোকালয় থেকে একটু দূরে নির্জন এলাকায়। এখানে একটি বৌদ্ধমট আছে। খুব কম লোকই এখানে মঠ দেখতে আসে। আমি নির্জনতা পছন্দ করি তাই এখানে এসে উঠেছি। সেদিন অমাবস্যার ঘুটঘুটে অন্ধকার। সুন্দরী নারীর ঘন কালো চুলের মতো অন্ধকার ঘিরে রয়েছে চারিধার। বেশ ঠান্ডা বাতাস বইছে শরীরে কাঁপন ধরে যাচ্ছে সেই ঠান্ডা বাতাসে। তবুও মায়াবী রাতটা দেখার অদম্য ইচ্ছায় জানালাটা বন্ধ করলাম না। জানালার পাশে একটা বড় ঝাউ গাছ। তার পাশ দিয়ে শুরু হয়েছে হালকা জঙ্গল। যা ক্রমে দূরে গভীর জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। এখানে জন্তু-জানোয়ারের ভয়ও রয়েছে। অনেকক্ষণ পর যখন জানালাটা বন্ধ করতে যাব ঠিক তখনই চোখে পড়ল সাদা কাপড় পরা একটি নারী ঝাউ গাছের নিচ দিয়ে উপরের দিকে উঠছে। একটু অবাক হলাম। কৌতুহল বসতো জানালা থেকে একটু আড়ালে গিয়ে দেখতে লাগলাম তাকে। এই হিমশীতল অমাবস্যার অন্ধকার রাতে একা এক নারী নির্জন অন্ধকার ভেদ করে কোথায় চলেছে? জানার এক অদম্য ইচ্ছা চেপে বসলো মনে। খোলা জানালার প্রায় পাশ দিয়ে সেই রমণী হেঁটে গেল। একটা হালকা উষ্ণ বাতাস মুহূর্তে ঘরে এসে প্রবেশ করলো। আমি ভয়ে জানালাটা বন্ধ করে দিলাম। পরিব্রাজক বন্ধু তখন অঘোরে ঘুমাচ্ছে। আমি ওর পাশে শুয়ে পড়লাম। নানা কথা মনে পড়ছিল শুয়ে শুয়ে। আসলে আমিও যে পরিব্রাজকের মতনই জীবন যাপন করি আজ এখানে তো কাল ওখানে প্রকৃতির সৌন্দর্যের টানে বারবার ছুটে গিয়েছে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। এতকিছুর মধ্যেও ওই নারী-মৃত্যুর কথা যেন কিছুতে ভুলতে পারছিনা। এত কাছ থেকে দেখলাম অথচ এই অন্ধকারে কিভাবে যে পথ খুঁজে হেঁটে চলেছে বুঝতে পারলাম না। অনেক কিছু ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনা।
সকালে হোটেলের বাইরে চিৎকার চেঁচামেচির মধ্যে দিয়ে ঘুম ভাঙলো। পাশে দেখি আমার সেই পরিব্রাজক বন্ধু নেই। ওর আবার খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠা অভ্যাস। ভাবলাম হয়তো প্রাত ভ্রমণে বেরিয়েছে। বেশ ঠান্ডা পড়েছে। জামা কাপড় পরতে কিছুটা দেরি হলো বটে। তখনো কৌতুহলী চিৎকার চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে হোটেলের নিচে। আমি ধীর পদব্রজে নিচে নেমে এলাম। দেখলাম সাত সকাল হলেও সেখানে বেশ লোকজনের ভিড়। উৎসুক জনতা ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা জায়গা। তার ভিতর থেকে একটু উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না। অনেক কষ্টে যখন উঁকি মারলাম তখন দেখলাম আমার সেই বন্ধুটি পড়ে রয়েছে মাটিতে। হঠাৎ মাথাটা গেল ঘুরে। কি ব্যাপার কি হল। যেন তার ভিড় ঠেলে পৌঁছে গেলাম সেই পরিব্রাজক বন্ধুর কাছে। চোখ দুটো খোলা বড় বড় শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে। ভয়ে কেউ এগিয়ে আসেনি। মুখ দিয়ে কোন কথা বার হচ্ছে না শুধু একটা ভয়ার্ত গোঙানির শব্দ। আমি কাছে যেতেই অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো আমার দিকে। আমি ওর নাম ধরে ডাকলাম কয়েকবার। একটু একটু সাড়া দেওয়ার চেষ্টা করছিল। এতটাই ভীত হয়ে পড়েছে এবং ভয়ে তার যে অবস্থা হয়েছে সেই ট্রমা থেকে তাকে বের করে আনতে হবে। ইশারা করে একজনকে জল আনতে বললাম। সঙ্গে সঙ্গে কয়েকদিন ছুটে গিয়ে দু তিন বোতল জল এনে দিল। সেই জলের বোতল থেকে জল নিয়ে পরিব্রাজক বন্ধুর মুখে ছিটিয়ে দিতে কিছুটা যেন সম্বিত ফিরে পেল সে। এরপর তার মুখে ঘাড়ে কিছুটা ঠান্ডা জল ছিটিয়ে দিলাম। সেই বরফ শীতল জল তার ইন্দ্রিয়গুলিকে মনে হয় দ্রুত সঞ্চালিত করতে সাহায্য করেছিল। অন্তত আমার তাই মনে হল। সে আমাকে কিছু একটা বলতে চাইছিল। কিন্তু তার অস্পষ্ট গোঙানির শব্দ ছাড়া আর কিছুই আমার বোধগম্য হলো না। আরো কিছুটা শীতল জল মুখে এবং ঘাড়ে ছিটিয়ে দিতে একটু স্বাভাবিক হলো। উপস্থিত লোকেদের সাহায্য নিয়ে ধরাধরি করে ওকে নিয়ে এলাম হোটেলের ঘরে। তারপর একটু একটু করে সে স্বাভাবিক হতে লাগলো। আমি জিজ্ঞাসা করলাম -কি ব্যাপার বন্ধু কি হয়েছে?
সে উত্তর দিল -খুব ভোরে আমি বেরিয়েছিলাম প্রাতভ্রমণে কিন্তু হঠাৎ পিছন থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরতে আসছিল সাদা কাপড় পরিহিতা এক মহিলা। ঘটনার সেই আপেক্ষিকতায় আমি কিছুটা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। ঠান্ডা সুশীতল হাত জোড় দুটো গায়ে পরতেই কেমন যেন অজ্ঞান হয়ে গেলাম। রাস্তার ধারে পড়েছিলাম। মনে হয় ওই লোকগুলো তুলে নিয়ে এসেছে হোটেলের সামনে। হঠাৎ যে কি হল ঠিক বুঝতে পারলাম না।
আমি বললাম -সাদা কাপড় উপর পরিহিত সেই ব্যক্তি নিশ্চয়ই কোন মহিলা ছিল। খুব রোগা তাইনা।
সে বলল -অনেকটা তাই তবে আমি খুব একটা ভালো করেই যে দেখেছি তা নয়। কিন্তু তুমি জানলে কি করে?
আমি বললাম -কাল রাতে তুমি যখন শুয়েছিলে আমি অনেকক্ষণ ঘরের ওই জানালা দিয়ে বাইরের অপরূপ দৃশ্য দেখছিলাম। গভীর রাতে হোটেলের পাশ দিয়ে হেটে যেতে দেখেছিলাম এক সাদা কাপড় পরিহিতা রমণীকে। অমাবস্যার ঘন অন্ধকার ভেদ করে হেঁটে চলেছেন একা।
আমার বন্ধু বললেন -সে কি তুমি দেখেছিলে তাকে। কিন্তু আমাকে তো কিছু বলনি।
আমি উত্তর দিলাম- বলবো কি করে? তুমি তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলে তাই শুধু শুধু তোমাকে ডাকার প্রয়োজন মনে করিনি।
আমার সেই পরিব্রাজক বন্ধু বললেন - এ হোটেলে থাকা আর নিরাপদ মনে হচ্ছে না বুঝলে ভাইয়া।
আমি বললাম-ব্যাপারটা যখন ঘটেছে তখন এর শেষ না দেখে তো যাওয়া যায় না।
বন্ধুটি বললে - চলো শেষ দেখেই ছাড়বো তুমি যখন আছো সঙ্গে তখন আর ভয় করিনে।
আমি ভাবছিলাম অন্য কথা। পরিব্রাজক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর উপর কি এমন রাগ থাকতে পারে যার জন্য হঠাৎ তাকেই আক্রমণ করে ফেলা। ভাবছিলাম মনে মনে। এইসব পাহাড়ি পর্বতে গ্রামগুলোতে নানান অলৌকিক কাহিনী লুকিয়ে আছে। সেরকম কোনো অলৌকিক কাহিনী এই গ্রামের মধ্যে আছে কিনা তা জানার জন্য একটু বেলা হতেই আমি বেরিয়ে পড়লাম। আমার একটু আগে আমার বন্ধু পরিব্রাজক বুদ্ধমঠে বেরিয়ে গেছে। সেই সুযোগে আমি বেরিয়ে পড়লাম পাহাড়ের গা ঘেষা এই গ্রামটায়। একেবারে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে একটা রাস্তা ধীরে ধীরে নেমে গেছে নিচে। তার চারিধার দিয়ে শুধু বাড়ি বাড়ি গুলো কেমন অদ্ভুতভাবে তৈরি না দেখে বিশ্বাস করতে পারবেন না। পাহাড়ের গায়ে এমন সুন্দর করে বাড়ি করা যায় তা না দেখলে বিশ্বাস হবে না। সেই বাড়িগুলির পাশে রয়েছে ছোট বড় নানা রকমের গাছ পাহাড়ি ফুল ফুটে রয়েছে তাতে। কখনো সোজা রাস্তা আবার কখনো এঁকেবেঁকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে বেশ কিছুটা নিচে নেমে এলাম। তার কারণ এখানেই কিছু জনবসতি আছে। হোটেলের পিছন দিকটা থেকে একটু একটু করে শুরু হয়েছে ঘন জঙ্গল। এতটাই ঘন যে সেখানে সূর্যের আলো প্রবেশ করতে পারেনা। আমি একটা ছোট্ট দোকানে সামনে এসে দাঁড়ালাম। এখানে কারো সঙ্গে কথা না বললে ব্যাপারটা বোঝা যাবে না। আর কথা বলতে গেলে একটু ভাব জমাতে হবে।। একটু বয়স্ক মানুষ যদি পাওয়া যায়, তাহলে বেশ ভালো হয়। দোকানের সামনে আসতে ওই দোকানদারকেই পেলাম। তোর বয়স মোটামুটি ৭০ এর কাছাকাছি হবে। আমি সেই দোকানের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। ভাবলাম কিছু একটা না কিনলে কথাটা শুরু করা যাবে না। দোকানটিতে নানা রকমের খাবার নিত্য প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস রয়েছে পাড়ার দোকানে যেমন থাকে আরকি। প্রচন্ড শীতল বাতাস বইছে, দোকানে তার সামনে একটা আগুনের ঝুড়ি নিয়ে আগুন পোহাচ্ছিল পাহাড়ি ভাষায় এর একটা নাম আছে আমার এখন ঠিক মনে পড়ছে না। তো যাই হোক আমি দোকান থেকে একটু খাবার কিনলাম, এবং সেই খাবার কেনার ফাঁকে একটা দুটো কথা আদান-প্রদান শুরু হল। এ কথা সে কথায় আমি বোঝাতে লাগলাম যে আমি এখানে এসেছি গ্রাম দেখার জন্য অনেক দূর থেকে। তাই এই গ্রাম সম্পর্কে দু একটা কথা জানতে চাই। বৃদ্ধ খুবই খুশি হলেন। কারণ পর্যটকরা হোটেল ছেড়ে এত নিচে কখনো আসে না। গ্রামের ভিতরে প্রবেশ করে না। গ্রামের মানুষের কথাও জানতে চায় না। ফলে কথায় কথায় বাড়তে লাগলো কথা। বৃদ্ধের নাম চিংগলেন। তার জন্ম এই গ্রামে অর্থাৎ এখানে ৭০ বছর ধরেই তিনি বাস করছেন। আমি হঠাৎই বললাম এখানে কি কোন অলৌকিক কিছু আছে। বৃদ্ধ একটু সতর্ক হয়ে বলল - “অলৌকিক পাহাড়ের কোলে কত অলৌকিক ঘটনা আছে আপনাদের জানা নেই। এই ৭০ বছরে কত অলৌকিক ঘটনাই তো দেখলাম”।
আমি কৌতুহলী হয়ে বললাম -তা একটু বলুন না শুনি।
চিংগেলন বলল - “এখানে ইয়েতির রহস্য যেমন আছে তেমন আছে ভয়ংকর সব মানুষের কথা। ইয়েতির নাম শুনেছেন”?
আমি বললাম - গল্পের বইতে দু-একবার শুনেছি ছোটবেলায়।
বৃদ্ধ বললেন - “এখানে গল্প নয় মশাই দূর পাহাড়ে শুনেছি বিরাট বিরাট পা ওয়ালা ইয়েতির বাস কখনো কখনো তারা এইসব লোকালয়েও চলে আসে সন্ধ্যের পর আমাদের আতঙ্কে দিন কাটে। একদিকে যেমন ইয়েতির হয় অন্যদিকে চিতা বাঘ আর বন্য জন্তুদের ভয় তার সঙ্গে আবার রহস্যময় এক নারী মূর্তি”।
রহস্যময় নারীমূর্তি কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে একটু নড়েচড়ে বসলাম। এইতো এবার ঠিক পথেই এগোচ্ছি। তার মানে আমি যে নারী মূর্তি দেখেছি গতকাল রাতে তা নিছক স্বপ্ন নয়। এখানকার মানুষের ধারণার সঙ্গে একেবারে সঠিক। আমি বললাম -নারী মূর্তি বিষয়টা কি?
বৃদ্ধ উত্তর দিলেন- “বেশ কয়েক বছর ধরে এটা উৎপত্তি হয়েছে। রাতের অন্ধকারে আমরা অনেকেই দেখেছি সেই নারী মূর্তি। দুর্ভেদ্য পাহাড়ি অন্ধকার কে ভেদ করে হঠাৎ দেখা যায় আর হঠাৎ মিলিয়ে যায়। সেই রাতে ওর সামনে যারা পড়ে তাদেরকে বাঁচতে দেয় না”।
আমি আরো কৌতুহলী হয়ে বললাম -ব্যাপারটা একটু খুলে বলুন তো মশাই।
বৃদ্ধ গল্প করার একজন মানুষ পেয়ে দিল খোলা হয়ে কথা বলতে লাগলেন আমার সঙ্গে।। তিনি বললেন - “আসলে এখানকার রাতগুলো এতটাই অন্ধকার। এতটাই নির্জন যে কেউ কারো খোঁজ রাখা খুবই কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়।আমরা ছোট বেলায় ইয়েতির গল্প শুনেছি। আপনারাও শুনে থাকবেন হয়তো। রাতে আমরা খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে যাই না। হঠাৎ করে বুঝলেন আমাদের এখানে এক নারী মূর্তির দেখা মিলল। তাকে নাকি হঠাৎ দেখা যায় আবার মিলিয়ে যায়। আমিও একবার দেখেছি মশাই। বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না।আমার ঘরের যা আলা দিয়ে স্পষ্ট হেঁটে যেতে দেখেছি। সেই রাতে ভয়ে ঘুমাতে পারিনি। জানেন সেদিন আমাদের মহল্লার এক জন মারা গেলো। সারা গায়ে আঁচড়, রক্ত মাখা শরীর। পড়েছিল রাস্তার ওপর। সকালে মহল্লার মানুষ দেখল। তারপর থেকে আমরা তারা দেবীর পুজো দিয়েছি এখানে”।
আমি বললাম - তারা দেবী কে? আমাদের তারা মা নাকি?
তিনি বলেন - না। আমাদের বৌদ্ধ দের তারাদেবী। তন্ত্রের দেবী। এখন অনেক দিন আর দেখা যায়নি।শুনলাম আজ ওপরে কি একটা। ঘটেছে।
আমি - আমার বন্ধুর সঙ্গে ঘটেছে।
বৃদ্ধ একটু অবাক হয়ে বললেন - আপনার বন্ধুর সঙ্গে? বেঁচে আছে সে?
আমি - হ্যাঁ ভালো ভাবেই বেঁচে আছে। সে একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী।
বৃদ্ধ - ও তাই বলুন।
আমি - কি ব্যাপার বলুন তো? সন্ন্যাসী বলে ছাড় পেয়ে গেলো নাকি?
বৃদ্ধ একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন - হবে হয়তো। বাঁচার তো কথা না।
আমি - কেনো বাঁচার কথা না কেন?
বৃদ্ধ - কেউ বাঁচে নি তো তাই বললাম।
আমি কিন্তু বেশ রহস্য পেলাম। বললাম - আপনি কি করে বুঝলেন কেউ বাঁচেনি?
বৃদ্ধ একটা ঢোক গিলে বলল - না মানে শুনি তাই। আমি কি মশাই তো জানি। বিকেল বিকেল দোকান বন্ধ করে ঘরে ঢুকে যাই। আর বের হই না।
মনের মধ্যে একটা কু ডেকে গেলো। আর দু একটা কথা বলে আমি অন্য একটা গলি ধরলাম। আসলে কিছু নতুন ঘটনা পেলে সেটার শেষ না দেখা পর্যন্ত ঠিক ভালো লাগে না।
ইচ্ছা এবার আরও একজনের সঙ্গে কথা বলা। ব্যাপারটা একটু খতিয়ে দেখতে হবে। বেশ কিছুটা এগোতেই আর একটা দোকান চোখে পড়ল। ঘরের ভিতরেই দোকান জানালা দিয়ে মালপত্র কেনাবেচা হয়। দোকানে একজন বৃদ্ধ মহিলা। আমি সেই মহিলার সঙ্গে কথা বলার জন্য দোকানে দাঁড়ালাম। প্রথমে পরিচয় দিলাম আমি একজন পর্যটক। গ্রামটা আমার ভালো লেগেছে তাই দেখতে এসেছি গ্রাম সম্পর্কে দু একটা কথা জানতে চাই।
গ্রাম সম্পর্কে জানতে চাই শুনে বৃদ্ধা হাসলেন কারণ আগে কোন পর্যটক তাদের এই মহল্লা সম্পর্কে জানতে আসেনি। এক গাল হেসে বললেন -কি হবে জেনে পাহাড়ের গ্রাম নানান সৌন্দর্যে ভরা সেগুলো দেখুন।
আমি বললাম-সৌন্দর্য তো দেখব কিন্তু তার পাশাপাশি এই মহল্লা সম্পর্কে একটু জানতে চাই এখানে নাকি কত রহস্য ঘুরে বেড়ায়? আপনি জানেন সেই সব কথা?
বৃদ্ধা বললেন- দেখো বাবা পাহাড়ের মহল্লার কোনায় কোনায় পাহাড়ের প্রতিটা বাঁকে নানান রহস্য লুকিয়ে আছে। আমাদের এই মহল্লা তার ব্যতিক্রম নয় ছোটবেলায় ইয়েতির গল্প শুনেছি। সেসব দেখার সৌভাগ্য হয়নি কখনো। মাঝে মাঝে পাহাড়ি চিতারা আসে। তবে তাদের ভয়ে সন্ধ্যেবেলার পরে বেরোনো খুব মুশকিল কখন যে কোথায় বসে থাকে বলা মুশকিল। যখন তারা জঙ্গলে খাদ্য পায় না তখন এই লোকালয়ে খাবারের সন্ধানে আসে তারপর কখন মানুষ খেকো হয়ে যায়। তবে হ্যাঁ সব চিকাই মানুষ খেকো হয় না।
আমি বললাম- আর কোন রহস্য?
বৃদ্ধা এবার আসল কথা এলেন অর্থাৎ আমি যেটা শুনতে চাইছি সেটা। বললেন -আর বোলো না বাবা এখানে নাকি রাতের বেলা মাঝেমধ্যে সাদা কাপড় পরা এক রহস্যময়ী মহিলাকে দেখা যায়। তার সামনে যাকে পায় তাকেই নাকি মেরে ফেলে। কিন্তু কেন মেরে ফেলে সে কথা বলতে পারবো না আমি কোনদিন দেখিনি। শুনেছি অনেকে দেখেছে। আমার পাশের বাড়ির এক ভদ্রলোক গতকালই নাকি গভীর রাতে তাকে দেখেছে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেত।
আমি বললাম- সে কি রাস্তা দিয়ে হেটে যেতে দেখলো কি করে?
বৃদ্ধা বললেন- দোকানে এসেছিল সকালে বলল, রাতে হঠাৎ একটা শব্দে ঘুম ভেঙে যায় তার। তারপর সে টয়লেট করতে গিয়ে ঘরের ভিতরের জানালা দেখেছিল সাদা কাপড় পরিহিত একজন হেঁটে চলেছে।
আমি বললাম- তারপর?
বৃদ্ধা বললেন - তারপর সে কোন রকমে ঘরে এসে শুয়ে পড়েছিল এই পর্যন্ত।
আমি বললাম - আচ্ছা এমন কি আগে কখনো কেউ দেখেছে। আপনারা যখন ছোট ছিলেন বা আপনাদের বয়সে কোনো ভূতের কথা এখানে শুনে ছিলেন।
বৃদ্ধা হেসে বললেন -ভূতের কথা আগে শুনিনি কিন্তু ইয়েতির কথা শুনেছি অনেকবার। সন্ধ্যের পরে কখনো ঘর থেকে বের হয়নি। তবে এই নারী মুক্তি আমাদের এখানে কয়েকজনকে মেরেছে। আর যে কজনকে মরতে হবে কি জানি। হঠাৎ কোথা থেকে যে এলো তাও তো জানিনা।
আমি - তাহলে খুব ভয়ংকর বলছেন তাই তো?
দীর্ঘায়ু এবার একটু গম্ভীর হয়ে বললেন -দেখো বাবা আমি তো দেখিনি লোকের মুখে শুনেছি তাই বলছি। আগের যুগে হলে হয়তো বলতাম বিয়েতির ভয় কিন্তু ইয়েতি তো আর এত ছোট হতে পারো না।
আমি আর দু একটা কথা বলি কয়েকটা লজেন্স কিনে হোটেলের দিকে ফিরলাম। আমার পরিব্রাজক বন্ধু তখন হোটেলের ব্যালকনিতে বসে দূরের পাহাড় দেখছিল। আমি তাকে গ্রামে ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা আর যা শুনেছি তা শেয়ার করলাম।
বন্ধুটি বললে - দেখো ভাইয়া এসব তথ্য জোগাড় করে কিছু হবে না যদি সত্যের সন্ধান করতে হয় তাহলে সরাসরি তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। বহুত সন্ন্যাসী আমি মরনে আমার কোন ভয় নেই। তবে তোমার জন্য একটু চিন্তা আছে বৈকি।
আমি উত্তর দিলাম -এইসব ভূত পিরিতের ভয়ে আমি করিনি কোনদিন আজও করি না। তাই ওই ভূত অথবা পেত্নী যেই হোক না কেন তার সামনে দাঁড়াতে আমার কোন অসুবিধা নেই। ভূত যদি হয়ে থাকে তো ভূতের সঙ্গে মোকাবিলা করার ক্ষমতা বা শক্তি আমার আছে।
বন্ধু বললে -দেখো সত্যিই যদি ভূত হয়ে থাকে তাহলে তন্ত্রসাধনা আমিও কিছু জানি তাই প্রথমে ভয় পেলেও এখন আমি মোটেই ভীত নই। আসলে প্রথমে ঘটনার প্রেক্ষাপটে আমি একটু হক চকিয়ে গিয়েছিলাম। এখন আমি বুঝতে পেরেছি আসলে ওটা ভয়ের কিছু নেই।
আমি বললাম -হয় যখন নেই তাহলে আজই একটা অভিযানে বেরোলে হয় না?
সে চটপট উত্তর দিল -অবশ্যই হয় নৈশ অভিযান বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের কাছে কোন নতুন কিছু নয়। আমার কাছে তো নয়ই।
সুতরাং দুজন মিলে ঠিক করে নিলাম কখন কিভাবে আমাদের এই ছবি যান ঠিক হবে। ঘটনা ক্রমে আজ অমাবস্যার রাত। এমন এক রাতের প্রতীক্ষা করতে হয় সকলকে এইসব ভূত-পেত্নী দেখার জন্য। আমাদের কাছে হঠাৎই যেন পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনার মতন দিনটা উপস্থিত হয়েই ছিল। তাই। অপেক্ষা করতে হলো না। আজ রাতেই। আমাদের অভিযান। ঠিক হলো তাড়াতাড়ি খেয়ে নেব আমরা তারপর রাত বারোটার পর হোটেল থেকে বেরোবো। কিন্তু এখানে নটা বাজলে হোটেলের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। হোটেলের ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বললাম বিষয়টা নিয়ে। রাত বারোটার পরে হোটেলের বাইরে যাব শুনে তিনি তো আকাশ থেকে পড়লেন। কয়েক মিনিট হাঁ করে তাকিয়ে থাকলে না আমাদের দিকে।
তারপর ম্যানেজার সাহেব বললেন -বারোটার পরে আমি তো দরজা খুলতে পারবো না। কোন বাজে ঘটনা ঘটলে মালিক আমাকে চাকরি থেকে তাড়িয়ে দেবে। ওর সঙ্গে বৃথা সময় ব্যয় করলাম না। ফিরে এলাম হোটেলের ঘরে। ঠিক করলাম সন্ধ্যে বেলাতেই আমরা বেরিয়ে যাব। বাইরে কিছু খেয়ে নেব। অপেক্ষা করব কোথাও। তারপর সেখান থেকেই অভিযান শুরু করব।
সারা বিকেল বৌদ্ধ মঠগুলোতে ঘুরে বেড়ালাম প্রার্থনা ও করলাম। না না ভুতের হাত থেকে বাঁচার জন্য না প্রার্থনা আমরা প্রতিদিনই করে থাকি। প্রার্থনা তো আমাদের কাছে নতুন নয়। আর পরিব্রাজক বন্ধুটির কাছে তো একদমই নতুন নয়। সন্ধ্যেবেলায় হোটেলে ফিরে এলাম আমাদের প্রয়োজনীয় যা কিছু নেওয়ার সঙ্গে নিলাম। বাজার থেকে কিনেছিলাম একটা টর্চ লাইট আর ধারালো একটা ছুরি।
সেগুলো একটা পিঠ ব্যাগে করে ভরে নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। ম্যানেজারকে বললাম খেয়ে দেয়ে ফিরে আসবো আজ আমরা বাইরের খাবার খাব।
বেরিয়ে তো পড়লাম কিন্তু এত রাত পর্যন্ত থাকবো কোথায়? প্রথমে যে বৌদ্ধ মরটির কথা বলেছিলাম সেই বৌদ্ধ মাঠে গেলাম সেখানে কিছুক্ষণ বসে তারপর আবার রাতের খাবার খেলাম ধরনশালা বাজার থেকে। এখানে রাত আটটা নটা পর্যন্ত জমজমাট থাকে। প্রচন্ড ঠান্ডা বাতাস বইছে। কানের পাশ দিয়ে হু হু করে বয়ে চলেছে ঠান্ডা বাতাস। শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। এখন এত ঠান্ডা আরো রাত নামবে কি হবে কি জানি। সঙ্গে যত জামা কাপড় ছিল সব পড়ে নিয়েছি। উপরে জ্যাকেট।
রাত বারোটা নাগাদ আমরা বেরিয়ে পড়লাম ছোট্ট বৌদ্ধ মঠের বারান্দা থেকে। কনকনে ঠান্ডা তার মধ্যে শীতল বাতাস। চারিদিকে কুয়াশায় আচ্ছন্ন। উপরে মনে হয় বরফ পড়ছে। এখানেও যা ঠান্ডা তাতে তুষারপাত হতে আর বাকি থাকবে না। আমরা দুজন টর্চের আলোয় ধীরে ধীরে বেরিয়ে পড়লাম হালকা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। একটু যেতে না যেতেই জঙ্গল বেশ গভীর যদিও এর ভেতর দিয়ে একটা পায়ে হাঁটা পথ রয়েছে। আমরা সেই পথ দিয়ে কিছুটা এগিয়ে বাঁদিকে আরেকটি পথ মহল্লার ভিতরে ঢুকে গিয়েছে আমরা সে দিকে যাব। এক রাতেই সেই রহস্যময়ীকে দেখা যাবে কিনা জানিনা। একটা ভয়ে রয়েছে সেটা হল চিতা বাঘের ভয়। জঙ্গলের কোথায় যে ঘাপটি মেরে বসে থাকে কেউ বলতে পারেনা। হঠাৎ করেই বেরিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে ঘাড়ে। ঘাড়কে রক্ষা করার জন্য মাফলার জড়িয়ে নিয়েছি মোটা করে। কারণ চিতাবাঘ প্রথমেই ঘাড়ে অ্যাটাক করে। যাইহোক পথ চলতে লাগলাম খুব সন্তর্পনে। চারিদিকে ঝিঝিঁ পোকার ডাক। পোকা ছাড়াও আরো কত রকম রাত জাগা পাখিদের ডাক, কীটপতঙ্গের শব্দ জঙ্গলকে রহস্যময় করে তুলেছে।। কিছুটা এগিয়ে যে রাস্তাটা বাঁদিকে চলে গেছে সেদিকে ঘুরে গেলাম। রাস্তায় একটা কুকুর পর্যন্ত নেই। এটাও একটা পায়ে হাটা পথ এইটা দিয়ে উঠেছে মহল্লার ঢালাই রাস্তায়।
রাত তখন দেড়টা বাজে। টর্চের আলোয় মহল্লার এ গলি সেগুলি ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। কোথাও আলো পর্যন্ত জ্বলছে না। অন্ধকার শুনশান নিস্তব্ধ গলি। হঠাৎ বন্ধুটি আমার হাত ধরে দাঁড়িয়ে পড়ল। ওর হাতে টর্চ ছিল টর্চের আলোটাও নিভিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে চোখ গেলো সামনের দিকে। দেখি আমাদের কিছুটা আগে হঠাৎই একটা সাদা কাপড়ের মত হেঁটে চলেছে। শুধু সাদা কাপড় টাই দেখা যাচ্ছে এগিয়ে চলেছে। আমরা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে সেই সাদা কাপড়ের পিছু নিলাম। ফিসফিস করে বললাম - টর্চটা জেলে দেখো একবার।
বন্ধু বললে - হয়তো মিলিয়ে যেতে পারে চলো কোথায় যায় দেখব।
আমি উত্তর দিলাম - বেশ চলো দেখা যাক সে কত দূর যায়।
অত্যন্ত সন্তর্পনে সেই সাদা কাপড়ের কিছু নিতে লাগলাম। দেখলাম এগিয়ে চলেছে কখন কখনও গলির বাঁকে বাঁকে সেও বেঁকে বেঁকে চলেছে। সে এক অদ্ভুত এডভেঞ্চার। এতই বিড়ি ভয়ংকর হবে তাহলে আমাদের উপস্থিতি টের পাচ্ছে না কেন? প্রশ্ন করলাম বন্ধুকে। বন্ধুটি ফিসফিস করে উত্তর দিল-দেখাই যাক না কি হয়। তবে যে কোন পরিস্থিতির জন্য তৈরি থেকো। বাড়ি ফিরতে পারবে কিনা বলতে পারিনা।
বন্ধুর কথা শুনে আমার খুব হাসতে ইচ্ছে করছিল কারন এইসব দিয়ে আমাকে ভয় পাওয়া নো যাবে না। বললাম - ভয় দেখাচ্ছো নাকি। আমি কিন্তু দৌড়িয়ে গিয়ে জড়িয়ে থাকতে পারি। এই কথা শুনে বন্ধুটি করে হেসে উঠলো। গভীর রাত্রির নিস্তব্ধতাকে ভেদ করি সেই হাসি পৌঁছল সাদা কাপড়ের কাছে। হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো সে তারপর ঘুরলো। বন্ধুর হাত থেকে টর্চ লাইট টা কিনে নিলাম। তার চির আলো সোজা গিয়ে পড়ল সাদা কাপড়ের উপর। আমাদের থেকে প্রায় ১০-১৫ হাত জ দূরে ছিল বোধ হয়। টর্চের আলু মুখে পড়তে আমরা তো হতবাক। একি এত সুন্দরী একজন মহিলা। এই রাতে একা কোথায় চলেছে। নারী মূর্তি হয়তো ভাবতেই পারিনি আমরা তার এত কাছাকাছি চলে এসে টরসের আলো ফেলবো। আসলে রাতে গ্রামে কেউ বেরোয় না তাই তার নিরাপদ এবং নিঃশব্দ পদচালনা করতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু কে এই রহস্যময়ী? টর্চের আলো জ্বালিয়ে রেখেই আমরা ধীরে ধীরে এগোচ্ছি। হঠাৎ সেই সুন্দরী নারীর মধ্যে এক চিৎকার করে উঠলো। আর সেই চিৎকার পাহাড়ের বাড়িগুলোতে ধাক্কা খেয়ে পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায় ধাক্কা খেয়ে বারবার প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো। প্রথমে আমাদের বুকটা কেঁপে উঠেছিল। হাত থেকে পড়ে গেছিল টর্চ। পরিব্রাজক বন্ধু সঙ্গে সঙ্গে টর্চটা কুড়িয়ে নিয়ে আবার আলো ফেললো তার দিকে। এবার আলো খেলতেই অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে গেল একজন সাধারণ নারী। কিন্তু অতীব সুন্দরী। আমরা আরো কাছে যেতে লাগলাম সেই নারী মুক্তি আবার চিৎকার করে ওঠে ভয় দেখাতে চাইলে আমাদের। তার দুহাতে দুটো ছুরি চকচক করছে। আমরাও দুজন দুটো ছুরি বের করলাম তারপর টর্চার আলোটা ফেললাম। আমাদের ছুরির উপর। জাতির সেও দেখতে পায় আমাদের দুজনের কাছেই ছড়িয়ে রয়েছে। আমরা যতই ঘুরছি এবার সেটা তো পিছাতে লাগলো। পরিব্রাজক গ্রন্থটি হিন্দিতে যা বলল তার সারকথা এই যে, তুমি যেই হও দাড়াও পারিও না। দৌড়াতে চাইলে আমরা কিন্তু দৌড়ে ধরে ফেলব মেরে ফেলবো তোমায়। পালিয়ে যেও না দাঁড়াও আমরা শুধু জানতে চাই তুমি কে। প্রথমে কিছুটা দৌড়ানোর চেষ্টা করেছিল। আমরাও টর্চের আলোর সামনে রেখে দৌড়াতে লাগলাম। আমরা কোনভাবেই তার কিছু ছাড়বো না তখন সে এগুলি সেগুলি কিছুটা ঘুরে বসে পড়ল রাস্তার মাঝখানে। হাঁপিয়ে গেছে আর দৌড়াতে পারছে না।
আমরা দৌড়ে গেলাম তার কাছে। সমস্ত রহস্য আমাদের কাছে জলের মতন পরিষ্কার হয়ে গেল। আসলে এই রহস্যময়ী নারী মুক্তি একজন পাহাড়ি গৃহবধূ। সম্ভবত এই মহিলাকেই আমি দেখেছিলাম বৃদ্ধ দোকানদারের বাড়িতে। এখন আমি ওই বৃদ্ধ দোকানদারের সঙ্গে কথা বলছিলাম তখন এই মহিলা কয়েকবার দোকানে এসেছিলেন ঘরের ভেতর থেকেই প্রয়োজন ছাড়াই। আমাকে কয়েকবার দেখার চেষ্টা করছিলেন। আমি বললাম -আপনি এই রাতে একা?
ভদ্র মহিলা কোন উত্তর দিলেন না। আমার বন্ধু বললে - কি ব্যাপার এই রাতে একা কোথায় চললেন কারোর বাড়িতে নাকি। এই অন্ধকারে আপনার ভয় করে না।
মুখ নিচু করে বসে আছে সে। হাতে ছোট দুটি ছুরি কিন্তু টর্চের আলোয় চকচক করছে। যেকোনো সময় হয়তো আমাদের দিকে ধেয়ে আসতে পারে। তাই আমরাও সতর্ক হয়ে রয়েছি আমাদের হাতে ও ছুরি রয়েছে তবে বেশ বড় এবং ধারালো নতুন চকচকে। আমি আবার বললাম - কালকে দোকানে আপনাকে দেখেছিলাম মনে হয়?
মহিলা এবার মুখ তুলল দুহাত থেকে গুজে নিল কোমরে। তারপর বলল -আপনি ঠিকই ধরেছেন। আসলে আমাকে দিয়ে এ কাজ করানো হয়।
রহস্যের গন্ধ পেয়ে বললাম- কি কাজ করানো হয় বলুন তো?
উনি বললেন আপনারা কাউকে বলবেন না দয়া করে।
আমার বন্ধুটি বললে- আপনি যদি না বলেন তাহলে আপনাকেই আমরা শেষ করে দেব।
ভদ্রমহিলা কাঁদতে কাঁদতে বললেন -আমার স্বামী ড্রাগের ব্যবসা করে। আমার স্বামী আমাকে দিয়ে ড্রাগ পাছার করতে কাজে লাগায়। রাতে অন্ধকারে সাদা কাপড় পড়ে পেত্নী সেজে লোককে ভয় দেখাই আমি। কিন্তু হঠাৎ যদি কেউ আমাকে চিনে ফেলে, পাড়ায় বদনাম রোটে যাবে, তাই সঙ্গে সঙ্গে তাকে মেরে ফেলি। আমি আমার সঙ্গে থাকা ড্রাগ পৌঁছে দি পাহাড়তলীর নিচের আরেকটি গ্রামে। ওখানে তিব্বত থেকে আসে লোক। তারা বৌদ্ধ সন্ন্যাসী সেজে আসেন। কিন্তু মোটেই তারা সন্ন্যাসী নন। আমার কাজ ওই বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের কাছে মাল পৌঁছে দিয়ে টাকা নিয়ে ঘরে ফেরা। সারাদিন ঘরে বসে আমার স্বামী বিভিন্ন লোকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। তারপর বিভিন্ন জায়গা থেকে সেই ড্রাগ একটা নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে দেয়। জঙ্গলের গভীরে আমার স্বামী অপেক্ষা করছে আমার জন্য। সেখানেই আসে নানা জায়গা থেকে অল্প অল্প করে মাল। তারপর সেই মাল একত্রিত করা হলে আমি নিয়ে যাই পাহাড়তলীর ছোট গ্রামটাতে। সেখানেও অপেক্ষা করে থাকে তিব্বত থেকে আসা লোকেরা। তারা এই মাল হাতে পেলে ন্যায্য দাম দিয়ে দেয়।
আমি বললাম - আপনি মহিলা একা যেতে আপনার ভয় করেনা। বা ধরুন কতগুলো পুরুষ মানুষ থাকে আপনার তো বিপদ হতে পারে।
মহিলাটি বললেন - যারা আসে তারা কেউ আমাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেনা কারণ খারাপ ব্যবহার করলে তাদের ব্যবসা নষ্ট হবে। তাছাড়া যেখানে পৌঁছে দিয়ে সেখানে আমাদের পরিচিত লোকেরাই থাকে। অপরিচিত কারো কাছে আমরা মাল দেই না। দয়া করে আমাকে ছেড়ে দিন আমি মালটা পৌঁছে দিয়ে আসি আর এ কথা কাউকে বলবেন না।
আমার বন্ধুটি বললেন যদি আপনাকেই মেরে ফেলি বা ঘরে নিয়ে যাই ? আমরা তো পুলিশের লোক।
ভদ্রমহিল বললেন - এখানে কে বা কারা আসে তাদের প্রত্যেকের খবরাখবর আমাদের কাছে থাকে। আজ হয়তো আমাকে যেতে দেবেন না বা আটকে রাখবেন কিন্তু কালকে কি আপনারা দিতে পারবেন বাড়িতে?
বুঝলাম ভাঙবে তবু মচকাবে না। সুন্দরের আড়ালে রয়েছে তেজ। আর তেজ না থাকলে এই রাতে প্রচন্ড শীত উপেক্ষা করে একা একজন মহিলার পক্ষে ভিনদেশী পুরুষের কাছে ড্রাগ পৌঁছে দেওয়া সহজ নয়। এই ক্ষমতা বা সাহস যার আছে সে তো সহজে ভেঙে যাওয়ার পাত্রী নয়।
আমার বন্ধুটি বললে- জান আপনি চলে যাবেন সাবধানে যাবেন আর চেষ্টা করুন এইসব ব্যবসা না করার।
মহিলা বললেন - কি করবো বলুন উপায় নেই তাই করতে হচ্ছে। দোকান টাও তো ভালো চলে না। যাইহোক আপনাদের কথা মাথায় রাখবো। চললাম এখন।
মুহূর্তে সাদা কাপড় জড়ানো সেই মহিলা চলতে শুরু করল। সাদা কাপড়ের তলায় রয়েছে মোটা জ্যাকেট মাথায় উলের টুপি আর তার ওপর এমনভাবে সাদা কাপড়টা জড়ানো যাতে যে কেউ দেখলেই ভয় পেয়ে যাবে।।
দূর দূর ভেবেছিলাম ভয়ঙ্কর কোন রহস্য হবে এমন একটা সাদামাটা রহস্য ভেদ করে মোটেই ভালো লাগছে না। হোটেলে যে ফিরবো তার উপায় নেই। কারণ এত রাতে হোটেল খোলা থাকবে না। ঘুড়ির কাটাই তখন সাড়ে তিনটে বাজে। আমরা এসে বসলাম আমাদের হোটেলের নিচে দরজার পাশে।
0 মন্তব্যসমূহ