কখনো কখনো জীবন নিজের আপন খেয়ালে চলে। আবার কখনো কখনো একটা ছন্দে বাধা নিয়মে চলতে হয়। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই আমার জীবন সম্পূর্ণ বোহেমিয়ান। এখানে না আছে কোন ছন্দ না আছে কোন সুর না আছে কোন তাল। সম্পূর্ণ এক বিচ্ছিন্ন জীবন স্বাধীন একটা সত্তা। সেই আমি কবে যেন একটু একটু করে আমার স্বাধীন সত্তা গুলোকে নিয়ে বড় হয়ে গেছি। এখন তো আরো বেপরোয়া। একেবারেই নিজের মতো করে চলা একটা জীবন। ভেবেছিলাম জীবনটাকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে পারবো কিন্তু দেখলাম সুন্দরভাবে গড়ে তোলা জীবন আমার জন্য নয়। আমার জন্য এক বেপরোয়া বোহেমিয়ান জীবন অপেক্ষা করে আছে। মাঝে মাঝে ভাবি ভালই হয়েছে ছন্দে বাধা জীবন আমার জন্য কোনদিনই ছিল না। ছোটবেলা থেকেই আমি প্রকৃতির বুকে খুঁজে পেয়েছি নিজের ভালোলাগা গুলোকে। পাখির ডাক আমাকে মুগ্ধ করে। ভোরের সূর্যোদয় আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় এক অনাবিল আনন্দের জগতে। আপনাদের কাছে এসব হয়তো খুবই সাধারণ কিন্তু বিশ্বাস করুন এই ভবঘুরে মানুষটার কাছে প্রতিটা সূর্যোদয় যেন একটা নতুন জীবন বয়ে আনে। আসলে আমার ব্যক্তিগত দক্ষতা বলতে যা বোঝায় তার কিছুই নেই কিন্তু আমার যেটা আছে সেটা হল আত্মবিশ্বাস। আমি বিশ্বাস করি আমি পারবো তাই আমি পেরেছি। যখন প্রতিদিন সকালে উঠি তখন একটা নতুন সংকল্প নিয়ে ঘুম থেকে উঠি আর সেই সংকল্পকে বাস্তবায়নের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। এই মুহূর্তে আমি একজন ব্যবসাদার বলতে পারেন। একটা খেলাধুলার বিষয়ক কোম্পানি রয়েছে আমার। খেলাধুলার সমস্ত বিষয় যেমন সলিউশন দেওয়া হয় তেমনি খেলাধুলার যাবতীয় বিষয়কে এক ছাতার তলায় নিয়ে আসা হয়েছে এই কোম্পানির মাধ্যমে। ছোটবেলা থেকে খেলাধুলা একটু ভালবাসতাম তাই খেলাধুলাকে নিয়েই ভেবে গিয়েছি সারা জীবন। কোম্পানি মূলভাবনা অবশ্য ফুটবল কেন্দ্রিক। বলতে পারেন সেই চার বছর বয়সে বাড়ির লোককে না জানিয়ে পুকুরে সাঁতার শিখতে যাওয়া সেটা ওই ফুটবলকে আঁকড়ে ধরেই। বুকের মধ্যে ফুটবল জাপটে ধরে জলের মধ্যে ভেসে ভেসে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে আবার ফিরে আসতাম তারপর পরের জন। এইভাবে দুপুরে যখন বাবা-মা ঘুমিয়ে পড়তো তখন আমরা বাড়ির পিছন দিকের পুকুরে সাঁতার শিখেছিলাম। এখন ভাবলেও যেন শিহরত হয় হতে হয়। হয়তো এই সব কারণে ছোটবেলা থেকে ভয় ব্যাপারটা আর নেই কিন্তু ওই খেলাধুলার জগতে বেশ নিজেকে মানানসই বলে মনে হয়। যখন যেখানে ইচ্ছা হয় তখন সেখানে যেতে পারি কারণ সংস্থাটা আমার নিজের। বেশ কয়েকজন আছে সেখানে কর্মরত। সেখানে রয়েছে ফুটবল কোচ, ম্যানেজার থেকে শুরু করে মার্কেটিং জগতের লোক। তা সে যাই থাকুক আমার কোম্পানি নিয়ে আমার কোন কথা এখানে বলবার নেই। কারণ ওটা আলাদা। আর গল্পটা ব্যক্তিগত। তবে আজকে গল্পটা বলছি সে গল্পটা হয়তোবা আপনাদের বিশ্বাস নাও হতে পারে। পুরোটা পড়লে নিশ্চয়ই একটা ধারণা পরিষ্কার হয়ে যাবে। এমন ঘটনা বেশ অদ্ভুত লেগেছিল আমার কাছে। জীবনে অনেক ঘটনাই ঘটে কিছু কিছু ঘটনা বিবরণ লিখে যেমন দেওয়া যায় না মুখেও বলে শেষ করা যায় না। আবার কিছু কিছু ঘটনা আছে যে ঘটনার সত্য মিথ্যে বা কোন বিবরণ আপনার পক্ষে দেওয়া সম্ভব হবে না।
ছুটে চলেছে ট্রেন। জানলার ধারে বসে তাকিয়ে আছি বাইরের দিকে। সবুজ গাছপালা আর সবুজ মাঠগুলো ছুটে চলেছে উল্টোদিকে। যাব সিমলা। অবশ্যই ব্যক্তিগত কাজে। আর ব্যক্তিগত কাজে যখন যাব তখন দু একদিন বেশি করে সময় যে কাটাব এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তারপর আবার সময়টা দেখুন এখন দুর্গাপুজোর ছুটি চলছে। আহা শোনায় সোহাগা। ব্যক্তিগত কাজ আর ভ্রমণ একেবারে একসঙ্গে হয়ে গেল। তো যাই হোক ছুটে চলেছে ট্রেন কালকার দিকে, কালকা থেকে যাব শিমলা। যারা ভ্রমণ পিপাসু তাদের কাছে এ পথ একেবারেই জলভাত। আমার কাছে একদমই না কারণ পাহাড়ে উঠতে গেলেই আমার শরীরের কিছু থাকে না। প্রথমত বমি হওয়া একটা রোগ। তারপর যখন পৌঁছাই তখন একেবারেই মনে হয় বিধ্বস্ত একটা মানুষ। কিন্তু তারপরেও পাহাড়ে যাওয়ার লোভ সামলাতে পারি না। এবার পনের দিনের জন্য এসেছি এখানে। কাজের পাশাপাশি ছুটি কাটানো মূল লক্ষ্য। সিমলার একটা হোটেলে গিয়ে উঠলাম। আগে থেকে বুকিং করা ছিল তাই অসুবিধা কিছু হলো না। আগে তো বলাই হলো না কালনা থেকে একটা টয় ট্রেনে করে আমি সিমলা এসে পৌঁছেছি। যদি কখনো সম্ভব হয় কালকা থেকে টয় ট্রেনের সিমলা যাওয়ার তাহলে রাস্তার দু'ধারে প্রকৃতিকে সুন্দর ভাবে চেটেপুটে উপভোগ করতে পারবেন। যদি আমার মতন প্রকৃতি প্রেমী হন তাহলে তো কথাই নেই। যখন হোটেলে ঢুকলাম তখন সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত একটা মানুষ আমি। তখন আমাকে দেখে কেউ বলবে না যে আমার জীবন এতটাই ছন্দহীন বোহেমিয়ান। পাহাড়ি রাস্তার ধকল আমার একেবারেই সহ্য হয় না। কিন্তু পাহাড় দেখার লোভও তো সামলাতে পারি না। তাই বেছে নিয়েছি এই জায়গাটাকে। এখানে দুদিন কাজ মিটিয়ে চলে যাব মানালি। সেখানে রয়েছে একটা ছোট্ট হোম স্টে। দশ দিনের জন্য বুকিং করেছি সেটা। পাহাড়ের কোলে সম্পূর্ণ নিরিবিলি নির্জন একটা থাকার জায়গা। আমার পরিচিত এক বাঙালি এখানে এই হোম স্টে টা নিয়েছে। এখানে চারটি ঘর রয়েছে তারই একটা ঘর আমার জন্য বুকিং করা। সিমলার কাজ সারা হয়ে গেলে আমি চলে যাব মানালি।
সিমলাতে একটা স্পোর্টস একাডেমী খোলার জন্য এসেছি। মূলত ফুটবল একাডেমী খোলাই মূল লক্ষ্য তবে তার সঙ্গে যুক্ত হবে ব্যাডমিন্টন এবং টেবিল টেনিস। সেই ব্যাপারে কথা বলার জন্য এখানে এসেছি। এখানকার একটা কোম্পানির সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে তবে এই একাডেমী খোলার পরিকল্পনা রয়েছে। সমস্ত পরিকল্পনা জমা দেওয়া হয়েছে সুতরাং এবার আলোচনার বসার পালা। দেখা যাক আলোচনা সফল হয় কিনা। তবে আমার মন বলছে এখানে স্পোর্টস একাডেমি অবশ্যই তৈরি হবে। কারণ এদের ষোল আনা আগ্রহ রয়েছে এই স্পোর্টস একাডেমি গঠন করার। একটা স্কুলের মাঠ। স্কুলের জায়গা কিন্তু সঠিক পরিকল্পনার অভাবে তারা ঠিক করে উঠতে পারছে না। আমিও যোগাযোগ করতে করতে পরিচয় হয়েছিল এদের সঙ্গে। ফলে দুপক্ষের আলোচনাতে এগিয়েছে এই স্পোর্টস একাডেমি তৈরি করার কাজ। সেই জন্যই সিমলাতে এসেছি আমি।
যথারীতি শিমলার কাজ সেরে আমি পৌঁছে গেলাম মানালি। মানালি তে অনেকবার এসেছি। এবার এসেছি শুধুমাত্র রেস্ট নেবার জন্য। আসলে লম্বা সময় চলে গেছে কাজে ব্যস্ত থেকে। তাই এবার এটা লম্বা সময় কাটানোর জন্য এসেছি মানালিতে। এখানে যে হোম স্টেটা রয়েছে সেটা মানালি ম্যাল থেকে কিছুটা দূরে। একটা নির্জন সুন্দর জায়গা, এখন থেকে চারদিকের পাহাড় টা এত সুন্দর দেখায় বর্ণনা করা যায় না। এই বাড়িটার নামটাও ভারী সুন্দর, মধুমালা।
আমার একটা ঘর বুকিং করা ছিল। মধুমালার নিচে রয়েছে দুটি ঘর এবং উপরে রয়েছে দুটি ঘর। উপরের একটা ঘর আমার জন্য আগে থেকেই বুকিং করা ছিল। আমি সেখানে এসে উঠলাম। খাবার ব্যবস্থাও এখানেই হয়েছে। খাবার কথা আগে থেকে বলে রাখতে হয়। বলে রাখা ভালো এই হোটেলের মালিক একজন বাঙালি। মালিক বললে ভুল হবে মালকিন। ভদ্রমহিলা একাই চালান এই হোম স্টে টা। বছরের বেশিরভাগ সময়ে তিনি এখানে কাটান মাঝেমধ্যে কলকাতায় যান। আবার ফিরে আসেন এখানে। বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে রয়েছে এই মধুমালা। আশেপাশে ওই ভদ্রমহিলা সুন্দরভাবে নিজের হাতে বাগান যেমন তৈরি করেছেন তেমনি তৈরি করেছেন শাকসবজি বাগান। নিজের হাতেই তিনি নানা ধরনের সবজি চাষ করেন। কেউ খেতে চাইলে আগে থেকে বললে তিনি রান্নার ব্যবস্থাও করে দেন। আমি আগেই বলে রেখেছিলাম ফলে আমার খাবার ব্যবস্থা এখানেই হয়েছে। খাবার জন্য নিচে আসতে হয়। নিচের একটা আলাদা ঘর রয়েছে সেখানে খাবার ব্যবস্থা। আমি যখন মধুমালায় পৌঁছেছিলাম তখন সকাল দশটা এখন বাজে সাড়ে বারোটা। লাঞ্চ করার জন্য আমি নেমে এলাম নিচে। দেখলাম আরো কয়েকজন সেখানে অপেক্ষা করছেন লাঞ্চ করার জন্য। উনারা হয়তো আগে থেকেই এসে থাকবেন এখানে। দেখে তো বাঙালি মনে হল। তারপর যখন লাঞ্চ খেতে শুরু করল তাদের কথাবার্তা শুনে বোঝা গেল তারা বাঙালি। সেই দলে একজন ভদ্রলোক একজন বিবাহিত ভদ্রমহিলা এবং একজন অবিবাহিতা ছিলেন। তারা তিনজন একটা টেবিলে সঙ্গে একটা বাচ্চা। আর একটা টেবিলে সদ্য বিবাহিত এক জোড়া নব দম্পতি।
আমি কোনার দিকের একটা টেবিলে গিয়ে বসলাম। চারিদিকটা বেশ ভালো করে লক্ষ্য করছিলাম সাজানো-গোছানো একটা জায়গা। খেতে খেতে দেখছিলাম জানলা দিয়ে বাইরের সবুজ প্রকৃতিটাকে। মধুমালার যিনি মালিক তার নাম মধুমন্তি। হয়তো তিনি তার নামের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এই বাড়িটার নাম রেখেছেন মধুমালা।
মধুমন্তি দেবী জিজ্ঞাসা করলেন - কেমন লাগছে?
আমি একগাল হেসে উত্তর দিলাম - অসাধারণ লাগছে। সুন্দর করে তৈরি করেছেন জায়গাটা। কবে কিনলেন এটা?
মধুমন্তি দেবী বললেন - চার বছর হল। জায়গাটা আমি নিজে কিনেছি। কেনার আগে ৫ থেকে ৬ বার এসে দেখেছি। তারপর একটু একটু করে সাজিয়ে নিয়েছি মনের মতন করে।।
আমি বললাম - অসাধারণ হয়েছে। এত সুন্দর একটা পরিবেশে আমি যে থাকতে পারবো ভাবতেই পারিনি। নিরিবিলিতে এখানে বেশ কয়েকটা দিন বিশ্রাম করতে পারব। আর আপনার বাইরে যাওয়ার কোন পরিকল্পনা থাকলে জানাবেন নিশ্চয়ই আশেপাশের জায়গাগুলো ঘুরে দেখতে অসুবিধা নেই আমার।
মধুমন্তি দেবী বললেন - কালকে একটা সাইট সিন ট্যুর আছে। আপনি যদি যোগ দিতে চান যেতে পারেন।
আমি বললাম - বেশ যাব। কটায় বেরোতে হবে? টাইমটা একটু জানিয়ে দেবেন। আসলে আমার পরিকল্পনা ছিলনাএখানেই থাকব। কিন্তু আশে পাশে জায়গাটা ঘুরে দেখতে আপত্তি নেই।
বাংলায় কথা বলছি দেখে পাশের টেবিল থেকে ভদ্রলোক আমার দিকে একবার চাইলেন।
আমার সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে যাওয়াতে আমি বললাম -মশাই থাকা হয় কোথায়?
তিনি উত্তর দিলেন - বেহালা। আপনার?
আমি বললাম - হুগলি।
তিনি আবার বললেন - আজ এলেন বুঝি?
আমি বললাম - হ্যাঁ সকালে এসেছি।
তিনি বললেন - একা নাকি?
আমি একটা হেসে উত্তর দিলাম - হ্যাঁ।
ব্যাস এইটুকু তারপর আর কথা হল না। আমি আমার মতন খেয়ে চলে এলাম আমার ঘরে। দুপুরের দিকে বেরিয়েছিলাম জলের বোতল টা নেওয়ার জন্য। হঠাৎ দরজা খুলে মুখোমুখি দেখা সেই ভদ্রমহিলার সঙ্গে? যিনি আমার পাশের টেবিলে তার স্বামী এবং পুত্র এবং আরেকজনকে নিয়ে আহার করছিলেন। একেবারে মুখোমুখি দেখা। কথা বলতে লজ্জা লাগলেও জিজ্ঞাসা করলাম - এই ঘরে আছেন বুঝি?
ভদ্র মহিলা উত্তর দিলেন, বললেন - হ্যাঁ। আপনি তাহলে আমাদের উল্টোদিকে।
আমি মাথা নীড়ে নিচে চলে গেলাম। জল নিয়ে যখন উঠছি তখন সিঁড়িতে দেখা সেই অবিবাহিত মহিলাটির সঙ্গে। না না তার সঙ্গে কোন কথা হয়নি। তিনি আপন মনে নিচে নামছিলেন। আমি একবার শুধু তাকিয়ে দেখেছিলাম তাকে। সুন্দরী বলতে যা বোঝায় ঠিক তাই। যদিও কথা বলার কোন ইচ্ছা বা আসা কোনটাই আমার নেই। তবুও মনের মধ্যে একটা বিদ্যুৎ খেলে গেল। যাইহোক পরের দিন সকালে প্রস্তুত ছিলাম সাইট সিন করার জন্য। যে গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছিল সেখানে এই মধুমালায় যারা রয়েছে তারা সবাই যাবে। একজোলা নবদম্পতি এবং আমার সামনে থাকা একটি পরিবার ও আমি এবং সঙ্গে যাবে অবশ্যই মধুমন্তি। কারণ তিনি আমাদের গাইড হিসেবে কাজ করবেন এবং তিনি খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করবেন।
গাড়ি ছুটে চলেছে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। আসলে এই পাহাড়ী প্রকৃতির সৌন্দর্য যারা দেখেনি তাদের কাছে একটা আক্ষেপ অবশ্যই থেকে যাবে। সবাই আবার পাহাড়ে আসার সাহস দেখাতে পারে না, কারণ এখানকার রাস্তা অত্যন্ত বন্ধুর প্রকৃতির সঙ্গে ভয়ঙ্কর। তবে সাহস নিয়ে আসতে পারলে এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে সহজেই উপভোগ করা যায়। পাহাড়ের গা বেয়ে রাস্তাটা চলে গেছে সাপের মতন। রাস্তার দুই ধার দিয়ে সবুজ গাছ পালা। পাহাড়ের গায়ে ছোট্ট একটা উপত্যকা মতন আর সেখানেই ফুটে রয়েছে হাজারো বন্য পাহাড়ি ফুল। মধুমন্তি গাড়িটা দাঁড় করালো সেখানে। সুন্দর সেই প্রাকৃতিক শোভায় পরিপূর্ণ জায়গাটিতে সকলেই ফটো তুলতে ব্যস্ত। আমি একটা ছোট্ট টিলার উপরে গিয়ে বসলাম। বসে বসে দেখছিলাম তাদের ফটো তোলা। কেউ আবার ভিডিও করছে হয়তো ফেসবুকে রিল হিসেবে দেবে। যাইহোক সুযোগ যখন পেয়েছে তখন সদ্ব্যবহার তো করবেই। মধুমন্তি দেবী আমার কাছে এসে বললেন - দিন আপনার ফোনটা, দু একটা ফটো তুলে দিই। একা বসে আছেন।
ফোনটা তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম। ফটো তোলার নেশা আমারও কম নয়। মধুমন্তি দেবীর সৌজন্যে বেশ কয়েকটা ফটো তুললাম। তারপর ফোনে দেখলাম সুন্দর হয়েছে, জায়গাটা ফটোতে আরো সুন্দর লাগছে। এইভাবে সারাদিন ঘুরে বেড়ালাম তারপর যখন ফিরলাম তখন বিকেল পাঁচটা বাজে।
মধুমালা থেকে কিছুটা হেটে গেলে পড়বে বিপাশা বা বিয়াস নদী। মধুমালায় ফিরে সকলেই বিশ্রাম নিতে চলে গেল। আমি ঘরে ঢুকলাম না আমি হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম বিয়াস নদীর তীরে। বাংলায় অনেকে বিপাশা বলে থাকে। এই নদীর জল অত্যন্ত শীতল। চারিদিকে শীতল আবহাওয়া। নদীর শীতল জল জায়গাটিকে বেশ শীতল করে তুলেছে। নদীর ধারে অনেকের ভিড়। আমি একটা ছোট্ট টিলার উপরে গিয়ে বসলাম? সেই টিলার পাশ দিয়ে কুলু কুলু ছলোছলো রবে বয়ে চলেছে বিয়াশের শীতল জল। এক অদ্ভুত সুন্দর মায়াবী পরিবেশ। অনেকটা সময় কাটালাম এখানে। মনটা শান্ত হয়ে এল। সারাদিনের গাড়িতে ঘুরে বেড়ানোর ধখল অনেকটাই মুছে দিয়ে গেল এই সুশীতল জলের সুন্দর একটা পরিবেশ। পায়ের নিচ দিয়ে কি সুন্দর ভাবে বয়ে চলেছে সুশীতল নদীর জল। মাঝে মাঝে দু একটা মাছ দেখা যাচ্ছে সেখানে। স্বচ্ছ জলে মাছগুলো আপন মনে খেলা করছে।
একটু সন্ধ্যা হতেই আমি ফিরে এলাম আমার ঘরে। দরজা খুলতেই দেখলাম সেখানে পোস্টকার্ডের উপর লেখা একটা চিঠি। কিছুটা অবাক হয়ে চিঠিটা হাতে তুলে নিলাম। তারপর পড়তে শুরু করলাম। যখন পড়তে শুরু করলাম তখন এতটাই বিস্মিত হলাম যে আমার চিন্তারও অতীত ছিল।
চিঠির বয়ান ছিল মোটামুটি এইরকম।
“প্রিয় প্রাক্তন,
আশা করি তুমি ভালো আছো। আমি ভালো আছি কিনা সে খবর তুমি নেবে না আমি জানি। কিন্তু তুমি তো ভালো আছো তা তো বুঝতেই পারছি। ভালো না থাকলে একা একা পাহাড়ে বেড়াতে যাবেই বা কেন। জানি এখন আর আমি তোমার মনে নেই। না থাকারই কথা। কিন্তু মাঝে মাঝে তোমাকে খুব মনে পড়ে। আমি চলে গেছি না ফেরার দেশে। না ফেরার দেশে চলে এসেছি বলে তুমি কি আমায় মনে রাখবে না। যাক গে, মনে রাখো আর নাইবা রাখো তাতে কিবা এসে যায়। আমার খুব ইচ্ছে ছিল জানো তোমার সঙ্গে ওই পাহাড়টা দেখব। তুমি গল্প বলতে না পাহাড়ের। সেই গল্প শুনতে শুনতে পাহাড়ে বেড়ানোর খুব ইচ্ছা ছিল। এ জীবনে হলো না। তোমার ছায়া সঙ্গী হয়ে আমি আছি হয়তো সশরীরে নয় অশরীরে।
মনে রেখো তুমি যেখানে ই যাবে সেখানেই আমি আছি। তোমার ঘরে উল্টোদিকে একটা সুন্দরী মেয়ে রয়েছে ভুল করেও তার দিকে চেয়েও না যেন।
ইতি তোমার অপরাজিতা (অপু)”।
বিস্ময়ের শেষ নেই। তবে চিঠির এই বিষয়বস্তু পড়ে আমি এতটাই অবাক হয়েছিলাম যে দশ মিনিট আমি চুপ করে বসে ছিলাম।
তবে হ্যাঁ এই চিঠির লেখিকা সম্পর্কে জানতে হলে একটু অতীতে ফিরে যেতে হবে। আমি তখন যুবক বাইশ কি তেইশ বছর হবে। কর্মক্ষেত্রে নিজের প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছি। খেলতে পারি আর না পারি, মাঠে যেতাম প্রতিদিন। এর সঙ্গে সেই সময় থেকেই আমার একটা ধারণা ছিল খেলাধুলার জন্য কিছু করার। তো যাই হোক হঠাৎ পরিচয় হয় অপরাজিতার সঙ্গে। অপরাজিতা ছিল সুন্দরী যুবতী এবং প্রাণোচ্ছল তন্বী একজন মহিলা। তার সঙ্গে প্রথম পরিচয় এবং পরিণয় বলতে গেলে হয়তো আর একটা গল্প লিখে ফেলতে হবে। দুজনের বন্ধুত্ব ক্রমে পরিণত হয় পরিণয়ে। তখন চুটিয়ে কাজ করছি আর প্রেমের হাওয়ায় ভেসে চলেছি দুজনে। কিন্তু বাদ সাধল নিয়তি। আমি স্পোর্ট ম্যানেজমেন্টের জন্য এসেছিলাম ইউরোপে। সেই সময় ওর বাবা ওকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয়। আমি তখনও ছিলাম ইউরোপে। সংসার করতে পারল না ও। কেন জানিনা হঠাৎ কোথায় হারিয়ে গেল। সবাই বলে ও নাকি আত্মহত্যা করেছে কিন্তু কোথায় আত্মহত্যা করেছে আর কিভাবে আত্মহত্যা করেছে তা কেউ জানে না। বাড়ির লোকে বলে শ্বশুর বাড়ির লোকেরা মেরে ওকে গুম করে দিয়েছে। আমি ইউরোপ থেকে ফিরেছি আমার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। তারপর একটু একটু করে ভুলে গেছি ও। ভুলে গেলেও বিয়ে করা হয়ে উঠল না আর।
আজ প্রায় ১৫-১৬ বছর পরে হঠাৎ তার এই চিঠিটা আমার কাছে কেন এলো। কোথা থেকেই বা এলো? চিঠিতে কোন ঠিকানা নেই। শুধু মধুমালার ঠিকানা দেওয়া। উঠে দাঁড়ালাম। ঘরের জানলাটা খুলে দিয়ে বাইরের সবুজ প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবছিলাম অপরাজিতার কথা। ওর ডাকনাম অপু। অপুর কথা ভাবছিলাম তবে কি সে বেঁচে আছে। আছে কি এখানে কোথাও কাছাকাছি? আমাকে কি সে দেখেছে? কিন্তু চিঠিতে লিখেছে সে আর বেঁচে নেই অশরীরি। তাহলে কেমন করে এই চিঠি আসবে। ভাবছি আপন মনে। ভাবতে ভাবতে আমি নিচে নেমে এলাম। নিচে নেমে মধুমন্তি দেবীর কাছে গেলাম। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম - কোন পিয়ন কি এখানে এসেছিল চিঠি দিতে?
মধুমন্তি দেবী বললেন , তিনি এই চিঠির ব্যাপারে জানেন না। তিনিও কিছুটা অবাক হলেন। এর আগে এমন ঘটনা এখানে কোনদিন ঘটেনি। আমাকে বললে নিশ্চিন্তে থাকুন ভয়ের কোন ব্যাপার নেই। হয়তো কেউ বদমাইশি করতে পারে। চিঠিটা বাংলায় লেখা। ফলে স্থানীয় কেউ যে এটা করবে তা নয়।
যাই হোক আমি আবার ফিরে এলাম আমার ঘরে। দিনের বেলা যে ছবিগুলো তুলেছিলাম সেগুলো ফেসবুকে একটা একটা করে পোস্ট করতে লাগলাম। আর বারবার ভাবছিলাম সেই চিঠিটার কথা। অদ্ভুতভাবে হাতের লেখাটার মধ্যেও যেন একটা মিল রয়েছে। যদিও পনের ষোলো বছর আগের হাতের লেখা আমার খুব একটা মনে নেই। কিন্তু যতটুকু মনে আছে ততটুকু দেখে মনে হচ্ছে প্রায় হুবহু এক।
যতই এ কাজ সে কাজ করি না কেন মন বারবার ওই চিঠিটার দিকে যাচ্ছিল। মাঝে আরো কয়েকবার পড়লাম চিঠিটা। রাতে খেতে গেলাম। আসলে খাওয়ার সময়টা এক তাই সবাইকে একসঙ্গে খেতে আসতে হয়।। মধুমন্তি দেবী সকলকেই ডেকে নিয়ে আসেন খাবার জন্য। মধুমন্তি দেবীর সঙ্গে একজন স্থানীয় ভদ্রমহিলা আছেন যিনি তাকে সব ব্যাপারে সাহায্য করেন। রাতে সাদা ভাত আর পাহাড়ি মাছ খাব বলে জানিয়েছিলাম। আমি একটা ছোট্ট টেবিলে বসলাম। এই টেবিলটাতে দুজন বাসায় যায়। স্বাভাবিকভাবেই ছোট জায়গা, আমি আগে এসেছিলাম তাই কোনার দিকের এই টেবিলটাতে আমি বসলাম। বসে বসে ফেসবুক ঘাঁটছিলাম। ইতিমধ্যেই এক এক করে অন্যান্য পরিবারগুলি এসেছে। খাবার পরিবেশন শুরু হয়েছে। খেতে খেতে চোখ পড়ছিল সেই অবিবাহিতা মেয়েটির দিকে। চোখ পড়া স্বাভাবিক, কারণ তার সৌন্দর্য আমাকে বারবার মুগ্ধ করছিল। তার থেকেও বড় কথা এই প্রথম তাকে ভালো করে দেখলাম আর দেখে মনে হল অতীতে কোথাও যেন তাকে দেখেছি। কিন্তু কোথায় দেখেছি সে কথা মনে করতে পারিনা। আসলে আমি খুব সহজেই ভুলে যাই এটা আমার রোগ।
এক দিকে চিঠির কথা আরেকদিকে এই মেয়েটিকে দেখার পর যেন আরেকটা চিন্তা মাথায় ঢুকে গেল। কোথায় দেখেছি একে এত চেনা চেনা লাগছে কেন?
যাইহোক মন দিয়ে খাওয়া দাওয়া করলাম এবার একটা লম্বা ঘুম দিতে হবে।। তা না হলে সারাদিনের ক্লান্তি যেমন কাটবে না তেমনি এই মানসিক দুশ্চিন্তাও কাটবে না।
পরের দিন সকালে এই পরিবার বেরিয়ে যাবে অন্য কোথাও সাইট সিন করতে। সেখানে আমার যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই। আমি গিয়ে বসবো বিয়াশ নদীর ধারে। অথবা নদীর চারপাশ ঘুরে ঘুরে দেখব হাঁটবো আর বিশ্রাম নেব ঘরে। এইমতো পরিকল্পনা করে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আমি আমার ঘরে এসে শুয়ে পড়লাম। শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম অপুর কথা। সত্যি কথা বলতে ওকে আমি ভালোবেসে ছিলাম। কিন্তু এখন ভুলে গেছি। ভুলে যেতে হয়েছে কারণ যাকে পাওয়া যাবে না তার কথা ভেবে বা তার চিন্তা করে জীবনে সময় নষ্ট করার কোন মানেই হয় না। আমি স্পষ্ট বাস্তববাদী একজন। আজ হঠাৎ এত বছর পর অপুন এখানে কি করে এলো এই চিন্তাতে আমার ঘুম আসছিল না। তারপর সেই যুবতীকে দেখে আরেকটু সন্দেহ দানা বাধল। না অপুকে নিয়ে নয় কোথায় যেন দেখেছি সেইটা মনে করতে পারছি না কিছুতেই। ভাবছিলাম তাকে জিজ্ঞাসা করব কিন্তু তারপর ভাবলাম যদি কিছু মনে করে গায়ে পড়ে জিজ্ঞাসা করাতে? হয়তো কিছু ভাবতে পারে একে অবিবাহিতা তারপর সুন্দরী।। তাকে দেখে খুব স্নিগ্ধ এবং শান্ত বলে মনে হয়, খুব কম কথা বলছিল সে। সারাদিনে এক গাড়িতে করে ঘুরে বেড়ালেও তার সঙ্গে কোন কথা হয়নি। সে ঘুরতে এসেছে তার দিদি এবং জামাইবাবুর সঙ্গে।। জামাইবাবুর সঙ্গেও মাঝে মাঝে একটু কথা বলছিল হাসাহাসি করছিল আর বেশিরভাগ সময় ব্যস্ত ছিল বাচ্চাটাকে নিয়ে।
যাইহোক সাত পাঁচ নানা রকম ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুম এসেছিল মনে নেই। সকালে ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরি হয়ে গেছে। যখন ঘুম থেকে উঠলাম তখন আমার ঘড়িতে আটটা বাজে। কোথাও যাওয়ার তাড়া নেই। তাই তাড়াহুড়র ও কিছু নেই। ধীরে সুস্থে উঠে দরজাটা খুলে বাইরে বেরোতে যাব ঠিক সেই সময় চোখে পড়ল আর একটা পোস্ট কার্ড। কিছুটা অবাক হয়ে পোস্ট কার্ডটা হাতে তুলে নিলাম। দেখলাম সেখানে আরেকটা চিঠি। অবাক হলাম রাতের বেলা কোথা থেকে এলো চিঠিটা। চিঠিটা পড়তে লাগলাম।
“প্রিয় প্রাক্তন,
ভাবছো তো আমি আবার কোথা থেকে ফিরে এলাম। ভাবো। ভেবে কোন লাভ নেই। আমি আছি সারাক্ষণ তোমার সঙ্গে। আজ কোথাও গেলে না কেন? তুমি গেলে আমারও তো একটু ঘোরা হয়ে যেত। দেখো তোমার উল্টো দিকের ঘরে একটা সুন্দরী মেয়ে আছে তার প্রেমে পড়োনা আবার। না হলে কিন্তু আমি গলা টিপে দেবো।”
এইটুকু লেখা ছিল পোস্ট কার্ডটিতে। এবার আরো মুশকিলে পড়লাম। ভাবতে লাগলাম কেউ কি বদমাইশি করে এটা করছে না হলে এইভাবে হঠাৎ এতদিন পরে অপু ফিরে আসবে কোথা থেকে। তা না হলে আর একটা হতে পারে যে অপু মরেনি। সে এখানে কোথাও চলে এসেছিল হয়তোবা। আচ্ছা ওই যে দুজন দম্পতি ছিল তাদের মধ্যে কি অপু থাকবে কি? না সেখানে কেমন করে থাকবে? আমি তো দুজনকে দেখেছি। সদ্য বিয়ে করে আসা এক জোড়া দম্পতি। নতুন বৌটির সঙ্গে অপুর কোন মিল নেই। আমার উল্টো দিকের ঘরে যে দুজন মহিলা রয়েছে তারাও সম্পূর্ণ অপুর থেকে আলাদা। তাহলে কি কেউ কোথা থেকে এসে এই চিঠি দিয়ে যাচ্ছে? সেটা বোঝা ভারী দুষ্কর। হোটেলের রান্নাঘরে যে ভদ্রমহিলা থাকে তাকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম রাতে এখানে কেউ এসেছিল কিনা বা ভোর বেলায় এখানে কেউ এসেছিল কিনা। তিনি বললেন এখানে কেউ আসেনি। তার দিদিমনি সকাল পাঁচটার সময় বেরিয়ে গেছে। তারপর থেকে এখানে কেউ আসেনি। যাইহোক জল খাবার খেয়ে আমি বেরিয়ে পড়লাম বিয়াশ নদীর তীরে। একটা গাছের তলায় ছায়া পড়েছে সেখানে কতগুলো পাথরের টুকরো পড়ে রয়েছে। একটা বড় পাথরের টুকরোর উপর গিয়ে বসলাম। আমার সামনে থেকে তখন বয়ে চলেছে শীতল বিয়াশ নদী। শীতল হাওয়া বইছে এখানে। বেশ ঠান্ডা লাগছিল। রাতে কনকনে ঠান্ডা ছিল। এখনো কনকনে ঠান্ডা রয়েছে তার মধ্যে ঠান্ডা হাওয়া বইছে। কানের গোড়ায় যখন সেই ঠান্ডা হাওয়া লাগছে তখন মনে হচ্ছে কেউ ছুরি দিয়ে কানটা কেটে নিয়ে যাচ্ছে। সারাদিন এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে দুপুরবেলায় আবার খাওয়া দাওয়া করলাম। খাওয়া দাওয়ার পর আবার বেরিয়ে পড়লাম। নিজের মনে হেঁটে বেড়াচ্ছিলাম পাহাড়ের চারিদিকে। মন খুলে এই প্রকৃতির সৌন্দর্যকে উপভোগ করছিলাম কিন্তু কখনো কখনো খোঁচা দিয়ে যাচ্ছিল চিঠির কথাগুলো। অপুর কথা। অপু কি সত্যিই আছে এখানে।
দূর দূর অপু কোথা থেকে আসবে। চিঠিটা হয়তো অস্বীকার করা যায় না। ভূত প্রেত খুব একটা বিশ্বাস আমি করি না। তাহলে চিঠিটা কে লিখল? কোথা থেকেই বা এলো? সন্ধ্যেবেলা মধুমন্তিরা ফিরে এলো। আমি রাতে খাবার সময় চিঠিটা দেখালাম মধুমন্তি দেবীকে। সবাই ছিল সেখানে। নব দম্পতি চিঠিটার কথা জানতে পেরে কিছুটা যেন ভয় পেয়ে গেল। নতুন বৌ টি জিজ্ঞাসা করল মধুমন্তী দেবীকে। -দিদি এখানে ভূত-প্রেতের কোন ব্যাপার নেই তো।
মধুমন্তি দেবী কি বলবে ঠিক ভেবে উঠতে পারল না। কিন্তু দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বলল আজ এত বছর এখানে আছি। এমন কোন কথা বা ঘটনা আমার চোখে পড়েনি।। কিন্তু এই ঘটনার সম্পর্কে আমাকে একটু খোঁজ নিতে হবে ব্যাপারটা আমি খতিয়ে দেখব। বাইরে থেকে কেউ আসছে কিনা সেটা আমি রাতে দেখব আজ।
আমার ডান পাশের টেবিল থেকে জামাইবাবু ভদ্রলোক বলে উঠলেন-বিষয়টা বেশ মজার দেখছি একজন মৃত মহিলা চিঠি লিখছেন।
বলতে বলতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন - আপনি তো বেশ ভাগ্যবান মশাই। মৃত ব্যক্তির চিঠি পাচ্ছেন কি ভালোবাসা ভাবুন তো তাহলে।
আমি হেঁয়ালি করতে ছাড়লাম না-বললাম তাহলে ভেবে দেখুন মশাই মরে গিয়েও আমাকে ছাড়তে পারছে না তাহলে আমি আমায় কতটা ভালবাসি ভেবেছেন। মৃত্যুর ১৫ বছর পরে হঠাৎ পাহাড়ে এসে আমাকে চিঠি লেখার কথা মনে পড়ল তার বিষয়টা অদ্ভুত তাই না।
ভদ্রলোক বললেন শুধু অদ্ভুত নয় এটা সন্দেহজনকও বটে। আবার এমনও হতে পারে যে অশরীরী আত্মা এখানে ঘোরাফেরা করে।
এই কথা শুনে বাঁদিকে টেবিলের নতুন বৌ বলে উঠলেন -ভূতপ্রেত? মানে কি এখানে ভূতের তান্ডব আছে নাকি।
মধুমন্তি দেবী বললেন-আপনারা নিশ্চিন্তে থাকুন আমি এখানে কত রাত একা একা কাটিয়েছি, কোন চিন্তা নেই।
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আবার ফিরে এলাম ঘরে। ল্যাপটপটা খুলে আমার কাজ করছিলাম। কয়েকটা কাজ বাকি ছিল। অফিসের কার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে কাল তাদের কয়েকটা প্রজেক্ট তৈরি করতে বলতে হবে। তার একটা ফরমেট তৈরি করছিলাম এক মনে বসে। কিন্তু কোথাও মনে হচ্ছিল ঘরের মধ্যে কিছু একটা আছে হঠাৎ একটা শব্দ হলো পিছনে তাকিয়ে দেখি টেবিলের উপর রাখা কাপটা পড়ে গেছে। কাপটা একা একা পড়ল কি করে? ভাবছিলাম তারপর দেখলাম জানালাটা বন্ধ করতে ভুলে গেছি দমকা ঠান্ডা বাতাসে শুধু কাপটাই পড়েনি আশেপাশে দু একটা জিনিসও পড়ে গেছে টেবিল থেকে। দ্রুত উঠে জানালাটা বন্ধ করে দিলাম।
তখনই হঠাৎ আবার দরজার কাছে নজর পড়লো। নজর পড়তেই অবাক হয়ে দেখলাম আর একটা চিঠি সেখানে পড়ে রয়েছে। তুলে নিলাম। নিয়ে দেখলাম সেখানে লেখা আছে,
“তোমার আমার কথা লোককে কি না জানালেই নয়। কেন বারবার অন্যকে জানাচ্ছ। সবাইতো হাসাহাসি করছে তাই না। কাল ওরা বরফ দেখতে যাবে তুমি যাবে না”?
আমার বিস্ময়ের ঘোর কাটতে চাইছে না। আমার কেমন যেন অবাক লাগছে। ঠিক করলাম এই চিঠির কথা কাউকে জানাবো না। চিঠি লিখুক আর যাই করুক আমার তো কোনো ক্ষতি করছে না বিষয়টা চেপে গিয়ে দেখি কতদূর গড়ায়। এখনো ৭-৮ দিন থাকবো এখানে। দরকার হলে আরও দু-এক দিন বেশি থেকে যাব। এতে দেখব এই চিঠির উৎপত্তি কোথায়। দরজা খুলে আমি সরাসরি নিচে নেমে এলাম গেলাম মধুমন্তি দেবীর কাছে। জানতে চাইলাম আগামীকাল তাদের সফর কোথায় এবং কখন হবে। মধুমন্তি দেবীর কাছ থেকে সময়ে জেনে আমি চলে এলাম ঘরে। ঘরে ঢোকার আগে দেখলাম আমার উল্টো দিকের ঘরের দরজাটা খোলা। হয়তো তাদের মধ্যে কেউ বাইরে বেরিয়েছে। বাচ্চা ছেলেটার গলা পাচ্ছিলাম ঘর থেকে। যাইহোক ঘরে উঁকি দেওয়ার কোন চেষ্টা করিনি কারণ সেটা ভদ্রলোকের পর্যায়ে পড়ে না। আমি আমার ঘরে ঢুকে সশব্দে দরজাটা বন্ধ করে দিলাম।
ভোর পাঁচটার সময় মধুমন্তি দেবীর ডাকে ঘুম ভাঙলো। সাড়ে পাঁচটার সময় তাদের গাড়ি ছাড়বে। সবাই মোটামুটি প্রস্তুত হয়ে নিচে নেমে গেছে। আমাকে দেখতে না পেয়ে তিনি নিজেই উপরে উঠে এসেছেন। আমি তাড়াতাড়ি করে রেডি হয়ে নিলাম। ১০ মিনিটের মধ্যে নিচে নেমে এলাম। তারপর তাদের সঙ্গে রওনা দিলাম। মধুমন্তি দেবী গাড়িতে উঠে জিজ্ঞাসা করলেন আজ আর কোন চিঠি আসেনি তো?
আমি বললাম- না।
রাতের চিঠির বিষয়টা চেপে গেলাম। গাড়ি ছুটে চলেছে পাহাড়ের গা বেয়ে ঘুরে ঘুরে। জানালা দিয়ে বাইরের প্রকৃতিটা দেখছিলাম। আমি বসেছিলাম ড্রাইভারের সিটের পাশে। আমার ঠিক পিছনে চারজনের পরিবার তারপরে নতুন দম্পতি এবং শেষের দিকে একা ছিলেন মধুমন্তি দেবী। তিনি মাঝেমধ্যেই গাড়িটা দাঁড় করছিলেন। যখন যখন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জায়গা আসছিল তখন গাড়িটি দাঁড় করিয়ে তিনি দেখাচ্ছিলেন আমাদের। দুচোখ ভরে দেখছিলাম সেই সব দৃশ্য। সকাল আটটার মধ্যে আমরা পৌঁছে গেলাম বরফের রাজত্বে। চারিদিকে শুধু বরফ বরফ আর বরফ। এখানে বরফের স্কি করা যায়। বহু মানুষের ভিড়ে এখানে। ফিরে এলাম বিকেল বেলা। এখানে এসে খাওয়া-দাওয়া করার পর আমি একা বেরিয়েছিলাম একটু বাইরে। বিয়াস নদীর ধারে। যখন ফিরলাম তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে। শীতল বাতাস বইছে চারিদিকে। কনকনে ঠান্ডা বাতাস। শীতল বাতাস মনে হচ্ছে হাড় পর্যন্ত পৌঁছে গিয়ে কনকন করছে। এই সময় বাইরে থাকাটা ঠিক হবে না। কিন্তু শীতটা উপভোগ করতে বেশ ভালই লাগছিল। হঠাৎ নিজেকে বড় একা বলে মনে হচ্ছিল। যখন আমি ফিরছিলাম তখন মধুমালার গেটের সামনে দেখা ওই যুবতীর সঙ্গে। আমি তাকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিলাম। যুবতী হাসতে হাসতে বললেন, কোথায় যাওয়া হয়েছিল? একা একা বেশ ঘুরছেন তাই না।
আমি বললাম আমি বিয়াস নদীর ধারে গিয়েছিলাম প্রতিদিন বিকেলে সেখানে গিয়েই বসি। মনটা ভালো হয়ে যায় জানেন।
যুবতী বললেন -আপনারা স্বাধীন তাই একা একা যেতে পারেন আমাদের ইচ্ছা থাকলেও যেতে পারি না জানেন। একটু আগে আমরাও গিয়েছিলাম দিয়ে আশ নদীর ধারে আপনাকে যদিও সেখানে দেখতে পাইনি। আসলে অনেক লোকের ভিড়ে দেখাটাও সম্ভব নয়। কি সুন্দর লাগছিল জানেন ছোট ছোট পাথরের টুকরো গুলোর ভিতর দিয়ে ঠান্ডা জল কেমন সুন্দর করে বয়ে যাচ্ছিল তাই না।
আমি বললাম ঠিক তাই আপনি তো বেশ সুন্দর করে কথা বলতে পারেন আপনার নামটা জানতে পারি কি?
যুবতী বললেন আমার নাম চিত্রা।
আমি বললাম আপনার নামটা খুবই সুন্দর কিন্তু কোথাও যেন খুলেছি আপনাকে আর কোথাও যেন দেখেছি ঠিক মনে করতে পারছিনা আচ্ছা আপনার বাড়িটা কোথায় বলবেন?
চিত্রা বলল -আমার বাড়ি শ্রীরামপুর। আমাকে চেনা চেনা মনে হচ্ছে আপনার কিন্তু কেন বলুনতো?
আমি বললাম কোথাও দেখেছি হয়তো। কি করেন আপনি?
চিত্রা বলল আমি ব্যাংকে কাজ করি।
আমি বললাম এখানে থাকবেন কতদিন।
চিত্রা বলল আগামীকাল চলে যাবো এখান থেকে।
এরপর কোথায় যাবেন জানতে চাইলাম আমি।
চিত্রা বললেন - আমাদের পরের গন্তব্য ধরমশালা। আপনি এখানে থাকবেন কতদিন?
আমি বললাম-এখানে আমার দশ দিনের বুকিং। দীর্ঘ ইসলামের জন্য এখানে এসেছি তৃতীয় হিসেবে কি আর শান্তি আছে বলুন তো। এই দেখুন একটা চিঠি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমার মনের শান্তি গেছে দূর হয়ে।
চিত্রা একটু হাসলো তারপর বলল- চলুন এখানে বেশ ঠান্ডা লাগছে। তারপর আবার বলল -আপনার প্রেমিকা তো আপনাকে ভুলতে পারছে না।
আমি বললাম হবে হয়তো। এ জীবনে কত কিছুই তো দেখলাম। আসলে আমার এই বেওয়াড়া জীবনে বাস্তবতা ছাড়া কিছু বিশ্বাস করিনা। চিঠিটা কেমন যেন একটু গোলমেলে লাগছে আমার কাছে।যাইহোক যা হবার হবে এসব ভেবে লাভ নেই জায়গাটা খুব সুন্দর। তাই থাকার পরিকল্পনা নিয়েছে এখানে নিরিবিলি বেশ কটা দিন কাটাতে পারবে বলুন।
চিত্রা বলল - এই জায়গাটা আমারও খুব ভালো লেগেছে আসলে আমরা যারা কাজ করি একঘেয়েমি জীবন থেকে এরকম একটা নিরিবিলি জায়গা বেশ ভালো লাগে জানেন।
আমি বললাম ঠিক ধরেছেন সেই জন্যই কোন কিছু না ভেবে এখানে ১০ দিনের জন্য বুকিং করে নিয়েছি।
কথা বলতে বলতে আমরা উপরে উঠে এলাম। তারপর যে যার ঘরে ঢুকে গেলাম। ওমা ঘরে ঢুকেই দেখি আর একটি পোস্ট কার্ড।
হাতে তুলে নিলাম দেখি আবার কি অপেক্ষা করছে।
দেখলাম লেখা আছে- “ভালো লাগলো আগের চিঠির কথা কাউকে বলনি বলে। সব কথা সবাইকে বলতে নেই। আমি তোমাকে জ্বালাতন করছি বলে কিছু মনে করো না। আমি তো অশরীরি। তোমার ক্ষতি তো করছি না। তাহলে অন্যকে জানিয়ে কি লাভ। আমি অপুর ভূত। তবে ভয় নেই ক্ষতি করব না”।
চিঠিগুলো এক জায়গায় করে দেখলাম হাতের লেখা এক। চিঠির বিষয়বস্তু সবুজ কালিতে লেখা। সবুজখালি অপুর খুব প্রিয় ছিল। তবে এতটা গভীরে গিয়ে ভাবতে ভাবতে মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে। সবুজ কালী অপর প্রিয় অপু বরাবরই সবুজ কালী দিয়ে আমাকে চিঠি লিখতো তারপর হাতের লেখা এবং লেখার ভাষা প্রায় এক। ধুরু কেমন যেন সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। চিঠিগুলো টেবিলের উপর রেখে মোবাইলটা নিয়ে বসে পড়লাম। এবার ফেসবুকে ঢুকে থাকতে হবে।
রাতে খাওয়া দাওয়া করে শুয়ে পড়লাম। সকালে যখন ঘুম থেকে উঠলাম তখন দেখলাম ঘরের জানলা দিয়ে যথেষ্ট রৌদ্র এসে পড়েছে আমার খাটের উপর। দরজা খুলে দিলাম। যথারীতি আবার একটা চিঠি তবে এবার পোস্ট করে নয় সাদা কাগজে। দরজা খুলতেই দেখলাম সামনের ঘরের দরজাটা খোলা। তবে ঘরে থেকে কোন সাড়াশব্দ নেই। মনে পড়ল কাল চিত্রা বলেছিল তারা ধরমশালা যাবে। হয়তো তারা চলে গেছে তাই ঘরের দরজা খোলা। উকি মারা সাহস হলো না যদি থেকে থাকে তাহলে একটা অভদ্রতামি হয়ে যাবে। ভাস্করা কাগজটা নিয়ে খাটের উপরে বসলাম। দেখলাম লেখা আছে-
“প্রিয়,
তুমি আমাকে চিনতে পারোনি। চেনার কথাও নয়। আমি অপরাজিতা নই। আসলে তোমার সঙ্গে মজা করছিলাম। তাহলে এখন ভাববে আমি অপরাজিতার কথা বা আপনার সঙ্গে অপরাজিতার প্রেমের কথা জানলাম কি করে তাই তো? ভাববারই কথা। অপরাজিতা আমার প্রিয় বান্ধবী ছিল। তোমার সঙ্গে যখন সে প্রেম করত তখন সমস্ত কথা আমাকে খুলে বলত। ওর মুখে তোমার কথা শুনে আমিও মনে মনে তোমায় ভালোবেসে ফেলেছিলাম। না না সে কথা জানানোর কোন প্রয়োজন ছিল না তখন। কারণ অপরাজিতা তোমাকে খুবই ভালোবাসতো। তোমার সঙ্গে একবার দেখা হয়েছিল হয়তো তোমার মনে নেই। সেই জন্যই হয়তো চেনা চেনা লাগবে আমায়। অপরাজিতার হাতের লেখা এবং আমার হাতের লেখা প্রায় এক। অপরাজিতা যে চিঠি তোমায় দিত সেগুলো সবুজ কালিতে। আসলে ওগুলো আমি ওকে লিখে দিতাম। তাই সেই চিঠির হাতের লেখা আর এই চিঠির হাতের লেখা এক। তোমার সঙ্গে একটু বদমাইশি করলাম বলে রাগ কর না। এমনিতে আমি খুব শান্ত। খুব একটা কথা বলতে পছন্দ করি না। তোমার সঙ্গে একটু বদমাইশি করতে ইচ্ছা হল। ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। অপরাজিতা বেঁচে নেই। আসলে অপরাজিতা কে মেরে ফেলেছিল ওর শ্বশুর বাড়ির লোকেরাই। অপরাজিতা খোলা মনে উড়তে চাইতো খোলা আকাশের নিচে ঘুরতে চাইতো, কিন্তু শ্বশুর বাড়ির লোকজন হয়তো মেনে নেয়নি। অপরাজিতা নাম নিয়ে তোমার সঙ্গে এমন ব্যবহার করাটা আমার উচিত হয়নি? আমি ক্ষমা চাইছি তোমার কাছে। আজ রাতে ভাবলাম আপনার কাছে ক্ষমা চেয়ে না নিলে আমি নিজেই অপরাধী হয়ে যাব। তবে অনেকদিন পর তোমাকে দেখে ভালো লাগছিল। জান ইচ্ছা করছিল তোমার সঙ্গে ওই বিয়াশ নদীর ধারে বসে কিছুটা সময় কাটাই? বড় হয়েছি চাকরি করি ঠিকই কিন্তু কোথাও যেন একটা বাধা কাজ করে। ইচ্ছা করলেও তোমার সঙ্গে কথা বলতে পারছিলাম না? আশা করি এই অদ্ভুত আচরণের জন্য আমাকে ক্ষমা করে দেবে। তোমার সঙ্গে কথা বলে আমার ভালো লেগেছে। যদি মনে হয় আমার সঙ্গে কথা বলবে তাহলে ফোন নাম্বারটা নিচে দিয়ে রাখলাম। ফোনের অপেক্ষায় থাকবো।
নবগ্রহ পূজা করে চার বেদ
চন্দ্র একা পড়ে।
ছয় ঋতু দেখো নিজেরা
মারামারি করে।
সাত সমুদ্র অবাক চোখে দেখে
সামনে মহাশূন্য।
চার বেদ পড়ে চন্দ্র হলো ধন্য।
হেঁয়ালিতে খুঁজে নিও তুমি আমারে
না হলে অষ্ট বসু
পঞ্চবান মারে তোমারে।।”
চিঠিটা পড়লাম। তারপর নিচে নেমে এলাম। নিচে এসে দেখলাম নিচের ঘরটিও ফাঁকা। আজ এই মধুমালায় আমি একাই আছি। কিন্তু চিঠিতে হেঁয়ালি করে যে ফোন নাম্বার খুঁজে নিতে বলা হয়েছে তা উদ্ধার করতে পারব কিনা জানিনা। উদ্ধার না করতে পারলে বা ন পারলে ক্ষতি হবে না। কিন্তু মন চাইছিল ফোন নাম্বারটা উদ্ধার করি। জলখাবার খেয়ে উপরে এসে বারবার পড়ছিলাম।
“নবগ্রহ পূজা করে চার বেদ
চন্দ্র একা পড়ে।
ছয় ঋতু দেখো নিজেরা
মারামারি করে।
সাত সমুদ্র অবাক চোখে দেখে
সামনে মহাশূন্য।
চার বেদ পড়ে চন্দ্র হলো ধন্য।
হেঁয়ালিতে খুঁজে নিও তুমি আমারে
না হলে অষ্ট বসু
পঞ্চবান মারে তোমারে”।।
বেশ কয়েকবার পড়লাম তারপর বোঝার চেষ্টা করলাম। শেষে একটা ফোন নাম্বার উদ্ধার করতে পারলাম। নবগ্রহ অর্থাৎ নয়। চার বেদ মনে চার। চন্দ্র একা পড়ে তার মানে একে চন্দ্র এক। ছয় ঋতু মারামারি করে মানে ছয়। সাত সমুদ্র তাদের সামনে শূন্য মানে সাতের সামনে শুন্য। চার বেদ পড়ে মানে চার, চন্দ্র হলো ধন্য মানে একে চন্দ্র এক। অষ্ট বসু মানে আট পঞ্চ:বান মারে অর্থাৎ পাঁচে পঞ্চবান দাঁড়ালে গিয়ে পাঁচ। এই পর্যন্ত নাম্বারটা ঠিকঠাক করতে পারলাম কিনা জানিনা, মোটামুটি যখন উদ্ধার করা হলো তখন ফোনটা নিয়ে নাম্বারটা ডায়াল করলাম।
রিং হতে হতে ফোনটা ধরল। আমি বললাম - হ্যালো। অশরীর অপু বলছেন।
ফোনের অপর প্রান্তে নিস্তব্ধতা শুধু বলল - বলছি।
তবে চিত্রা অশরীরি নয়। ফোন নাম্বারটা উদ্ধার করতে পেরেছি দেখে খুশি হলাম।
আমি বললাম - তোমার বুদ্ধিমত্তা দেখে আমিও অবাক? এমন হেঁয়ালি করে লিখেছ আধঘন্টা পড়ার পর উদ্ধার করতে হয়েছে ম্যাডাম।
চিত্রা বলল -আমি ভেবেছিলাম তুমি উদ্ধার করতে পারবেন না। আর মনে মনে এটাও ঠিক করেছিলাম যদি উদ্ধার করতে পারেন তাহলে…. থাক।
আমি বললাম তাহলে থাক কেন বল।
চিত্রা - সব কথা সব জায়গায় সব সময় বলা যায় না।
বলে ফোনটা কেটে দিলো।
নম্বরটা সেভ করে রাখলাম। হয়তো পরে দরকার হতে পারে।
0 মন্তব্যসমূহ